Ajker Patrika

আল-জাজিরার প্রতিবেদন

কাশ্মীর স্বাধীনতা আন্দোলনের শীর্ষ নেতা কি ভারতের চর— হলফনামা নিয়ে তোলপাড়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১৫: ৫৮
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন ইয়াসিন মালিক। ছবি: সংগৃহীত
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন ইয়াসিন মালিক। ছবি: সংগৃহীত

তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা হিসেবে পরিচিত ইয়াসিন মালিক। তিনি বর্তমানে নয়াদিল্লির তিহার জেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন। একসময় সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতীক ছিলেন, পরে অহিংস প্রতিরোধের পথ বেছে নেন। তবে, গত আগস্টের শেষে দিল্লি হাইকোর্টে ৫৯ বছর বয়সী মালিক এক চাঞ্চল্যকর হলফনামা দাখিল করেছেন। এই হলফনামা ভারতের রাজনীতিতে তোলপাড় তুলেছে। তাঁর দাবি, তিনি বছরের পর বছর ধরে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ‘গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ’ হিসেবে কাজ করেছেন।

৮৪ পৃষ্ঠার হলফনামায় মালিক দাবি করেছেন, ১৯৯০-এর দশক থেকে, যখন কাশ্মীরি যুবকদের সশস্ত্র বিদ্রোহ তুঙ্গে, তখন থেকেই তিনি সংঘাত নিরসনের জন্য ভারত সরকারের শীর্ষ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে—তিনি কি শুরু থেকেই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার গোপন সহযোগী ছিলেন?

মালিক জানান, তিনি একাধিক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান, এমনকি কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সদস্যদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, কাশ্মীর শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে ভারত সরকার অনুমোদিত ব্যাক-চ্যানেল কূটনীতির অংশ হিসেবে এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বহুবার তাঁর শ্রীনগরের বাসভবনে এসেছিলেন।

সবচেয়ে চমকপ্রদ দাবিগুলোর মধ্যে একটি হলো: ২০০৬ সালে পাকিস্তানের জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ সাঈদের সঙ্গে তাঁর বৈঠকটি তাঁর নিজস্ব উদ্যোগ ছিল না, বরং সাঈদকে অস্ত্র ছাড়তে রাজি করানোর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) আয়োজন ছিল।

শ্রীনগরের মাইসুমার বাসিন্দা ইয়াসিন মালিক ১৯৮৭ সালের বিতর্কিত স্থানীয় নির্বাচনের পরই ক্ষুব্ধ হয়ে পাকিস্তানে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে যান। ফিরে এসে তিনি জম্মু ও কাশ্মীর লিবারেশন ফোর্সের (জেকেএলএফ) কমান্ড গ্রহণ করেন এবং ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বেশ কয়েকটি প্রাণঘাতী হামলার নেতৃত্ব দেন।

তবে, কাশ্মীরকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৯০ সালে গ্রেপ্তারের পর তাঁকে তিহার জেলে রাখা হয় এবং পরে দিল্লির উপকণ্ঠে একটি গেস্ট হাউসে স্থানান্তর করা হয়। ইয়াসিন মালিক দাবি করেন, সেখানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্র শেখরসহ ভারতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রায় প্রতিদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন এবং সশস্ত্র বিদ্রোহ থেকে সরে আসার জন্য অনুরোধ করতেন।

মালিক দাবি করেন, ১৯৯৪ সালে তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় একটি নিশ্চিত বোঝাপড়ার ভিত্তিতে। সেই বোঝাপড়ার অংশ হিসেবে তিনি প্রকাশ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহ ত্যাগ করে মহাত্মা গান্ধীর প্রচারিত অহিংস উপায়ে কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার ঘোষণা দেন। প্রায় ২৫ বছর ধরে তিনি অহিংস বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়েছেন। যদিও সশস্ত্র লড়াই তাঁকে কাশ্মীরি জনগণের কাছে এক আপসহীন নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

২০১৯ সালে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সন্দেহভাজন বিদ্রোহীদের আত্মঘাতী হামলার পর ইয়াসিন মালিকের জীবনে নাটকীয় মোড় আসে। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, তাঁর দল জেকেএলএফ নিষিদ্ধ হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে বহু পুরোনো মামলাগুলো (যেমন ১৯৮৯ সালে রুবাইয়া সাঈদ অপহরণ, ১৯৯০ সালে ভারতীয় বিমানবাহিনীর চার সদস্যকে হত্যা এবং পাকিস্তানের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ) পুনরায় চালু করা হয়।

বর্তমানে জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে মৃত্যুদণ্ডে উন্নীত করার জন্য আদালতে আবেদন করেছে। এর জবাবেই মালিক হলফনামা দাখিল করে দাবি করেছেন, সরকার ২৫ বছর ধরে তাঁর প্রতি এই বোঝাপড়ার সম্মান দেখিয়েছিল যে অহিংস পথে থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনা হবে না। তাঁর মতে, এনআইএ এখন তাঁকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে ফাঁসানোর জন্য অভিযোগগুলোকে বিকৃত করছে।

মালিকের হলফনামা থেকে আরও জানা যায়, তিনি ২০১৬ সালে বিদ্রোহী নেতা বুরহান ওয়ানি হত্যার পর কাশ্মীর উপত্যকায় সৃষ্ট জনপ্রিয় বিদ্রোহ দমনে ভারত সরকারকে সহায়তা করেছিলেন। তিনি দাবি করেন, সরকারের সম্মতিতেই তিনি সে সময়কার প্রবীণ স্বাধীনতাপন্থী নেতা সৈয়দ আলি শাহ গিলানির সঙ্গে দেখা করে বিক্ষোভ কর্মসূচি সাময়িকভাবে স্থগিত করার অনুরোধ করেন, যার ফলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়।

তিনি ২০০০ সালে ভারতীয় শিল্পপতি ধীরুভাই আম্বানির সঙ্গে গোপন ব্যাক-চ্যানেল আলোচনায় জড়িত থাকার বিষয়টিও প্রকাশ করেন। আম্বানি ওই সময় কাশ্মীর সংঘাতের কারণে তাঁর গুজরাটের তেল শোধনাগার প্রকল্পের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। এ ছাড়া, ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির আমলে তিনি একটি ভারতীয় পাসপোর্ট পেয়েছিলেন এবং বিদেশে ভ্রমণের বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতেন বলেও দাবি করেন।

জম্মু ও কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ইয়াসিন মালিকের এই নতুন তথ্যের আলোকে তাঁকে ‘সহানুভূতিশীল দৃষ্টিতে’ দেখার জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কাছে চিঠি লিখেছেন। মুফতি তাঁর এক নিবন্ধে আফজাল গুরুর ফাঁসির ঘটনার সঙ্গে মালিকের মামলার তুলনা করে বলেন, ভারত রাষ্ট্র সাময়িক লক্ষ্য অর্জনের জন্য মানুষকে ব্যবহার করে এবং পরে তাদের আর প্রয়োজন না থাকলে বর্জন বা শাস্তি দেয়।

তবে, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আজাই সাহনি মনে করেন, মালিকের এই তথ্য ফাঁস তাঁর সততা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। সাহনি বলেন, ‘তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা ও সন্ত্রাসের মামলা আছে। তিনি হয়তো সরকারের কারও কাছাকাছি ছিলেন। সে কারণেই তাঁকে মুক্ত থাকতে দেওয়া হয়েছিল। আপনি রাষ্ট্র দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছেন বলেই যে আপনি একজন সৎ ব্যক্তি, তা কিন্তু নয়। বরং উল্টোটা—যদি আপনার সততা থাকত, তবে রাষ্ট্র আপনাকে ব্যবহার করতে পারত না।’

অন্যদিকে, সাংবাদিক ও লেখক বিক্রম জিত সিং, যিনি ১৯৯০-এর দশকে কাশ্মীর সংঘাত কভার করেছেন, তিনি মালিকের দাবিগুলোকে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ বলে মনে করেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এমন পরিস্থিতিতে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সেতুবন্ধ তৈরির জন্য এই ধরনের উপাদান ব্যবহার করে থাকে, এটি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতের যে গ্রামে রয়েছে নবীদের কবর

বিয়ের আগের রাতে গলায় ফাঁস দিলেন বর, দশমিনায় উৎসবের বাড়িতে শোকের ছায়া

দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের শর্তেই কেবল ট্রাম্পের গাজা প্রস্তাব মানতে প্রস্তুত রাশিয়া: পুতিন

মাথা ঠান্ডা করে আরামে ঘুমান, নিজেদের সমস্যায় মন দিন—পশ্চিমা নেতাদের পুতিন

ফ্লোটিলার সর্বশেষ জাহাজটির বর্তমান অবস্থান, স্টারলিংকের ইন্টারনেট এখনো সচল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত