Ajker Patrika

মুম্বাইয়ে ‘অবাঞ্ছিত’ মুসলিমদের জন্য গড়ে উঠছে হালাল টাউনশিপ, হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষুব্ধ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মুম্বাইয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি বিলাসবহুল আবাসন প্রকল্প ঘিরে ভারতে নতুন করে শুরু হয়েছে সাম্প্রদায়িক বিতর্ক। ছবি: সংগৃহীত
মুম্বাইয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি বিলাসবহুল আবাসন প্রকল্প ঘিরে ভারতে নতুন করে শুরু হয়েছে সাম্প্রদায়িক বিতর্ক। ছবি: সংগৃহীত

মুম্বাইয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি বিলাসবহুল আবাসন প্রকল্প ঘিরে ভারতে নতুন করে শুরু হয়েছে সাম্প্রদায়িক বিতর্ক। চলতি মাসের শুরুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যমে ভাইরাল হয় ‘সুকুন এম্পায়ার হালাল টাউনশিপ’ নামের ওই আবাসন প্রকল্পের বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, পেন্টহাউস, ইনফিনিটি পুলসহ নানা বিলাসবহুল সুবিধা রয়েছে ওই আবাসন প্রকল্পে।

ওই বিজ্ঞাপনে হিজাব পরিহিত এক নারী ‘অথেনটিক কমিউনিটি লিভিং’, ‘হালাল পরিবেশ’, ‘শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ’, ‘একই মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রতিবেশী’—ইত্যাদি সংলাপ ব্যবহার করে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর বর্ণনার সঙ্গে ভিজ্যুয়ালে দেখানো হয় টুপি পরা এক ব্যক্তি কোরআন পড়ছেন, ‘প্রার্থনার জায়গা’র কথা যখন উল্লেখ করা হয় তখন গম্বুজযুক্ত একটি স্থাপনার ভিজ্যুয়াল দেখানো হয়—মূলত সেটিকে মসজিদ বোঝানো হয়েছে। ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পরপরই হিন্দুদের একাংশ ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন।

বিশেষ করে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের প্রবল ক্ষোভের কারণ হয়েছে এই বিজ্ঞাপন। তাদের ভাষ্য—এই প্রকল্পের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ উসকে দেওয়া হচ্ছে। সুকুন এম্পায়ার প্রকল্পটিকে ভারতের সংহতি বিনষ্টের একটি ‘গোপন ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করছে তারা। তারা বলছে, ভারতের আইন ও রীতির বাইরে এই প্রকল্পের মাধ্যমে আলাদা করে ‘শরিয়াহ ভিত্তিক সমান্তরাল ব্যবস্থা’ তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে।

ব্যাপারটা এখানেই থামেনি। এই ইস্যুতে মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকারের কাছে রিপোর্ট চেয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। দুই সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সিঙ্গাপুরের সংবাদমাধ্যম দ্য স্ট্রেইটস টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপারসন প্রিয়াংক কনুনগো ইন্দো-এশিয়ান নিউজ সার্ভিসকে বলেছেন, ‘এই প্রকল্প “দেশের মধ্যে দেশ” তত্ত্বের বাস্তবায়ন। আর এই বিজ্ঞাপন ইঙ্গিত দেয় যে মুসলিমরা অসহিষ্ণু। আজ তারা আলাদা টাউনশিপ চাচ্ছে, কাল মুসলিম চিকিৎসক চাইবে, এরপর মুসলিম পুলিশ চাইবে।’

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারতের শহরাঞ্চলে মুসলিমদের প্রতি বৈষম্যকে নতুন করে সামনে এনেছে এই প্রকল্প। আর এই বৈষম্যের কারণেই শহরগুলোতে গেটো ধরনের কমিউনিটির চাহিদা বেড়েছে। শুধু নিরাপদ আবাসন নয়, ধর্ম চর্চার স্বাধীনতার জন্যও এই ধরনের প্রকল্পগুলোর চাহিদা বেড়েছে।

সুকুন এম্পায়ার প্রকল্পটি এমন সময়ে সামনে এসেছে, যখন ভারতে মুসলিমদের প্রকাশ্যে ধর্মীয় আচার পালন ক্রমশ বাধার মুখে পড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, পার্ক বা অন্যান্য জায়গায় নামাজ পড়াকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন না অনেক হিন্দু। এমন ঘটনায় পুলিশি পদক্ষেপও দেখা গেছে।

২০১৪ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর দেশটি ধর্মীয়ভাবে আরও বিভক্ত হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।

কিন্তু এরপরও এই ‘হালাল টাউনশিপ’গুলোকে সমর্থন করেন না অনেক মুসলিমও। তাঁদের আশঙ্কা, এতে ইসলামি রক্ষণশীলদের প্রভাব বাড়বে, ধর্মের কঠোর রূপ চাপানো হবে এবং ভারতের বহুসংস্কৃতির বৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ভারতের সংবিধান ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য নিষিদ্ধ করলেও, বাস্তবে দেশে আবাসনের ক্ষেত্রে বৈষম্য ব্যাপকভাবে দেখা যায়। শুধু ধর্ম নয়, বরং বর্ণ, বৈবাহিক অবস্থা, লিঙ্গ পরিচয়, এমনকি খাদ্যাভ্যাসের ভিত্তিতেও মানুষকে আবাসিক কমপ্লেক্সে অবাঞ্ছিত করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, সব শাকাহারী (নিরামিষাশী) কমপ্লেক্সে আমিষাশীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।

২০২১ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে, দিল্লি ও মুম্বাইতে সাধারণ আবাসিক এলাকায় মুসলিমরা নিজেদের অবাঞ্ছিত মনে করছেন। সেখানে বাসা ভাড়া নিতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন। তিন বছর ধরে মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করে এমন পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে হাউজিং ডিসক্রিমিনেশন প্রজেক্টের এই গবেষণা প্রতিবেদনে।

গবেষণা প্রতিবেদনের সহ-লেখক ড. এম. মোহসিন আলম ভাট এবং আসাফ আলি লোন বলেন, ‘অনেক মুসলিম যাঁরা মুসলিম সংখ্যালঘু এলাকায় বাসা ভাড়া নেন, তাঁরা মূলত আগে অন্য জায়গায় বাড়িওয়ালাদের প্রত্যাখ্যানের শিকার হয়েছেন এবং পরবর্তীতে আরও প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আশঙ্কায় ওই সংখ্যালঘু এলাকায় গিয়ে বসবাস শুরু করেছেন।’

দিল্লি ও মুম্বাইয়ে ৩৪০ জনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়েছে। রিয়েল এস্টেট এজেন্ট, বাড়িওয়ালা ও মুসলিম ভাড়াটিয়াদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গবেষকেরা। গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, প্রধানত খাদ্যাভ্যাস এবং ইসলামোফোবিয়ার (ইসলামভীতি) কারণে মুসলিমদের বাড়ি ভাড়া দিতে চান না হিন্দুরা। বিশেষ করে হিন্দুপ্রধান এলাকাগুলোতে মাসের পর মাস চেষ্টা করেও বাড়ি ভাড়া পাননি মুসলিমরা—এমন উদাহরণও অনেক।

লোন বলেন, ‘ভারতের শহরগুলোতে বাস্তবেই মুসলিমদের (ধর্মীয়) বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে।’

সারা ভারতে বছরের পর বছর ধরে ধর্ম ও সামাজিক মর্যাদার ভিত্তিতে নানা পাড়া গড়ে উঠেছে। মধ্য ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মুসলিমদের জন্য গেটেড কমিউনিটি বা গেটো (এক সময় ইউরোপে গড়ে ওঠা ইহুদিদের আলাদা বসতির মতো) এখন অনেক শহরে সাধারণ ঘটনা। গবেষক লোরাঁ গায়ার ও ক্রিস্টোফ জাফ্রেলো বলেন, এটি মূলত ভারতজুড়ে ‘সংগঠিত সহিংসতার ফল।’ উচ্চ-মধ্যবিত্তদের মধ্যেও বিভাজন দেখা যায়। মুম্বাইয়ে কিছু অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স অঘোষিতভাবে নির্দিষ্ট ধর্ম, বর্ণ ও ভাষার মানুষের জন্য সংরক্ষিত থাকে, যেমন—জৈন, ক্যাথলিক খ্রিষ্টান, বোহরা মুসলিম (ইসমাইলি শিয়া সম্প্রদায়) এবং গুজরাটি হিন্দু। দিল্লিতে জাতীয় রাজধানী অঞ্চলেও অন্তত দুটি গেটো শুধু মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত বলে ধারণা করা হয়।

মুসলিম পেশাজীবী নারী মারিয়া সালিম দ্য স্ট্রেইটস টাইমসকে জানিয়েছেন, ২০২০ সালে দিল্লিতে অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজতে খুঁজতেই তাঁর পাঁচ মাস চলে গেছে! ব্রোকারদের অনেকেই তাঁকে জানাতেন, বাড়িওয়ালা মুসলিমদের ভাড়া দিচ্ছেন না। একজন তো বলেই বসেন যে মুসলিমেরা ভালো নয়।

আসাফ আলি লোন স্ট্রেইটস টাইমসকে বলেন, মুসলিমদের মধ্যে সুকুন এম্পায়ার-এর মতো আবাসিক প্রকল্পের চাহিদা মূলত এই বৈষম্যেরই ফল। তিনি বলেন, ‘যদি মুসলিমদের আলাদা কলোনিতে থাকতে বাধ্য করা হয়, তাহলে তাঁরা আর কোথায় যাবেন?’

সুকুন এম্পায়ার-এর নির্মাতারা স্ট্রেইটস টাইমসের প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি। তবে উচ্চবিত্ত ভারতীয় মুসলিমদের লক্ষ্য করে এমন প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। ২০১৮ সালে কেরালার কোচিতে ভারতে প্রথমবারের মতো অ্যাসেট জেনেসিস নামে ‘শরিয়াহ মেনে চলা ও হালাল সনদপ্রাপ্ত’ আবাসিক প্রকল্প নির্মাণের কথা ওঠে। তখনও একই ধরনের প্রতিবাদের কারণে প্রকল্পটি বাতিল হয়।

কিছু ক্ষেত্রে হিন্দুপ্রধান কমপ্লেক্সে বসবাসরত উচ্চ-মধ্যবিত্ত মুসলিমরা প্রকাশ্যে ধর্মীয় আচার পালন করতে বাধার সম্মুখীন হন। ২০২৩ সালে, নয়ডা ও গ্রেটার নয়ডায় দুটি হাইরাইজ কনডোমিনিয়ামে মুসলিমরা তাঁদের হিন্দু প্রতিবেশীদের বাধার কারণে রমজান মাসে জামাতে নামাজের আয়োজন বাতিল করতে বাধ্য হন। যদিও, এই কমপ্লেক্সগুলোতে হিন্দু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়। অনেক জায়গায় অবৈধভাবে মন্দিরও বানানো হয়েছে।

২০২৪ সালে, উত্তর প্রদেশ রাজ্যের মুজফফরনগরের রাজনীতিবিদ রাও নাদিম একটি হিন্দু এলাকায় ব্যাংক নিলামে একটি বাড়ি কিনেন। সেটিকে তিনি মসজিদে রূপান্তর করবেন এই অভিযোগ তুলে ব্যাপক প্রতিবাদ করেন স্থানীয় হিন্দুরা। শেষ পর্যন্ত, বাধ্য হয়ে তাঁকে বাড়িটি একটি হিন্দু পরিবারের কাছে বিক্রি করতে হয়।

হাউজিং ডিসক্রিমিনেশন প্রজেক্টের সাক্ষাৎকারে মুসলিমরা জানান, মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় বসবাসের সবচেয়ে বড় কারণ হলো নিরাপত্তা এবং নিরাপত্তার অনুভূতি। তবে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সময় এ ধরনের এলাকাগুলোই সহজ লক্ষ্য হয়ে ওঠে।

রাও নাদিমও স্ট্রেইটস টাইমসকে জানান, তিনি শুধু মুসলিমদের জন্য কনডোমিনিয়ামের ধারণারও বিরোধী। কারণ এটি জাতীয় ঐক্যে বিভেদের ঝুঁকি তৈরি করে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত