Ajker Patrika

ইস্তাম্বুলে রাশিয়া-ইউক্রেন সরাসরি আলোচনা আজ, ফলাফল কী হতে পারে

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৫ মে ২০২৫, ১৪: ১৭
ফ্রান্সের এলিসি প্রাসাদে ২০১৯ সালের এক বৈঠকে ভ্লাদিমির পুতিন ও ভলোদিমির জেলেনস্কি। ছবি: এএফপি
ফ্রান্সের এলিসি প্রাসাদে ২০১৯ সালের এক বৈঠকে ভ্লাদিমির পুতিন ও ভলোদিমির জেলেনস্কি। ছবি: এএফপি

প্রায় তিন বছর পর সরাসরি আলোচনায় বসতে যাচ্ছে লড়াইরত দুই প্রতিবেশী রাশিয়া ও ইউক্রেন। আজ বৃহস্পতিবার তুরস্কের ঐতিহাসিক শহর ইস্তাম্বুলে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। সবার নজর এখন ইস্তাম্বুলের দিকে। কারণ, এই বৈঠকই রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারে।

গতকাল বুধবার গভীর রাতে রুশ প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ক্রেমলিন ঘোষণা দিয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই আলোচনায় উপস্থিত থাকবেন না। অন্যদিকে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি উপস্থিত থাকবেন কি না, তা নিশ্চিত নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগে আলোচনায় যোগ দেওয়ার ইঙ্গিত দিলেও তিনিও উপস্থিত থাকবেন না বলে মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

গত রোববার পুতিন তুরস্কে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সরাসরি আলোচনার প্রস্তাব দেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যরা যেখানে এত দিন প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনার চেষ্টা চালিয়েছিল, সেখানে পুতিন সরাসরি বৈঠকের কথা বলেন। তিনি ২০২২ সালে তুরস্কে হওয়া সরাসরি আলোচনার কথা উল্লেখ করে তা আবার শুরু করার পক্ষে যুক্তি দেন।

পুতিন বলেন, ‘২০২২ সালে আলোচনা রাশিয়া ভেঙে দেয়নি। কিয়েভই সেটা করেছিল। তবু আমরা কিয়েভকে কোনো পূর্বশর্ত ছাড়াই সরাসরি আলোচনা আবার শুরু করার প্রস্তাব দিচ্ছি।’ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণ শুরু করে। এর অল্প সময় পরই তুরস্কের ইস্তাম্বুলে রাশিয়া ও ইউক্রেন আলোচনা করেছিল।

ভলোদিমির জেলেনস্কির মতে, রাশিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে দনবাস অঞ্চলের দখল ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানানোয় সেই আলোচনা ভেঙে যায়। দনবাস অঞ্চল ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত, যার কিছু অংশ রাশিয়া দখল করে নিয়েছে।

জেলেনস্কি আরও বলেন, রাশিয়া চেয়েছিল ইউক্রেন দীর্ঘ পাল্লার অস্ত্র সমর্পণ করুক, নিরপেক্ষতা ঘোষণার জন্য সংবিধানে পরিবর্তন আনুক এবং তাদের সশস্ত্র বাহিনীর আকার উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে ফেলুক। জেলেনস্কি সে সময় বলেছিলেন, ‘কোনো আলোচনাই হয়নি, এটি ছিল এক খুনির চরমপত্র।’

জেলেনস্কি আগে বলেছিলেন, যেকোনো শান্তি চুক্তির জন্য রাশিয়াকে দখল করা ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে হবে। তবে গত বছরের ডিসেম্বরে তিনি বলেন, ন্যাটো যদি বর্তমানে কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইউক্রেনের অংশের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেয় তবে যুদ্ধের ‘উত্তেজনাপূর্ণ পর্যায়’ শেষ হতে পারে। তিনি আরও বলেন, রাশিয়া যে ভূমি দখল করেছে তা কূটনৈতিকভাবে আলোচনা করা যেতে পারে।

লন্ডনভিত্তিক থিংক ট্যাংক চ্যাথাম হাউসের সিনিয়র কনসালটিং ফেলো কিয়ের জাইলস আল-জাজিরাকে বলেছেন, ‘ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য আমেরিকা যে চাপ সৃষ্টি করেছে, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। মনে হচ্ছে এই পরিবর্তনের সাম্প্রতিক উপাদানগুলো, বিশেষ করে ইউক্রেনের প্রতি ইউরোপীয় সংহতি, রাশিয়াকে সরাসরি আলোচনায় অংশ নিতে বাধ্য করেছে।’

ইউক্রেনের চার প্রধান ইউরোপীয় মিত্র পুতিনকে নিঃশর্ত ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বা নতুন নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হবে বলে চরমপত্র দেওয়ার একদিন পর আলোচনায় পুতিনের আগ্রহ দেখা দেয়। এই ৪ ইউরোপীয় দেশ হলো—ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং পোল্যান্ড। তারা কিয়েভ সফরের পর এই চরমপত্র দেয়।

এই চার দেশ পুতিনকে ১২ মে পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেয়। ১১ মে পুতিন যুদ্ধবিরতি মানার প্রতিশ্রুতি না দিয়ে বলেন, ‘আমরা ইউক্রেনের সঙ্গে কার্যকর আলোচনার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর উদ্দেশ্য হলো—সংঘাতের মূল কারণ দূর করা, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে একটি দীর্ঘমেয়াদি, স্থায়ী শান্তি স্থাপন করা।’

আলোচনা আজ বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টা নাগাদ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। আলোচনাটি ইস্তাম্বুলের দোলমাবাগ প্রাসাদে রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনুষ্ঠিত হবে। ইস্তাম্বুল শহর এশিয়া ও ইউরোপের সীমানা জুড়ে অবস্থিত। বসফোরাস প্রণালির ওপর অবস্থিত এই প্রাসাদটি ১৯ শতকের মাঝামাঝি থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল।

চার ইউরোপীয় নেতা—ব্রিটেনের কিয়ের স্টারমার, ফ্রান্সের ইমানুয়েল মাখোঁ, জার্মানির ফ্রিডরিখ ম্যার্ৎজ এবং পোল্যান্ডের দোনাল্দ তুস্ক—বলেছেন, তাঁরা পুতিনকে তাদের চরমপত্র সম্পর্কে ফোন কলের মাধ্যমে ট্রাম্পকে জানিয়েছেন এবং ইঙ্গিত দেন, ট্রাম্পও এর পক্ষে। কিন্তু পুতিন যখন কিয়েভ ও মস্কোর মধ্যে সরাসরি আলোচনার আহ্বান জানান, তখন ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে এক বিবৃতিতে ইউক্রেনকে ‘অবিলম্বে’ রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করতে বলেন।

ট্রাম্প ২০২৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি দ্রুত ইউক্রেন যুদ্ধ অবসান ঘটাবেন। ট্রাম্প প্রশাসন ফেব্রুয়ারি থেকেই সেই প্রচেষ্টা শুরু করে। সে সময় সৌদি আরবে রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মার্কিন কর্মকর্তাদের পৃথক বেশ কয়েক দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে কোনো চুক্তি সে সময় হয়নি।

এ ছাড়া, গত এপ্রিলে ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়ার অবস্থান থেকে একধাপ পিছিয়ে আসার ইঙ্গিত দেয়। ট্রাম্প প্রশাসন বলেছিল, তারা চায় ইউরোপ ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় নেতৃত্ব দিক। দেশটি জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য অগ্রাধিকার রয়েছে, যার মধ্যে সীমান্ত নিরাপত্তা অন্যতম। তবে সাম্প্রতিক সপ্তাহে ট্রাম্প এবং তাঁর দল আলোচনায় অর্থপূর্ণ অগ্রগতির অভাবে ক্রমবর্ধমান হতাশা প্রকাশ করেছেন এবং শান্তি মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা থেকে সরে আসার হুমকি দিয়েছেন।

আজ ইস্তাম্বুলে যে আলোচনা হবে, তাতে ইউক্রেনের যোগদানের ওপর জোর দেওয়ার ব্যাখ্যায় ট্রাম্প যুক্তি দিয়েছিলেন, ‘অন্তত তারা নির্ধারণ করতে পারবে যে একটি চুক্তি সম্ভব কিনা এবং যদি সম্ভব না হয় তবে ইউরোপীয় নেতারা এবং যুক্তরাষ্ট্র জানতে পারবে পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়িয়েছে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে পারবে!’

এদিকে, পুতিনের আহ্বানের পর জেলেনস্কি সোমবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লেখেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প (রুশ প্রেসিডেন্ট) পুতিনের সঙ্গে সরাসরি যে আলোচনার ধারণা দিয়েছেন, তা সমর্থন করেছি। আমি প্রকাশ্যে সাক্ষাতের জন্য আমার প্রস্তুতি তুলে ধরেছি। আমি তুরস্কে থাকব। আমি আশা করি, রাশিয়ানরা সাক্ষাৎ এড়িয়ে যাবে না।’

গত মঙ্গলবারও জেলেনস্কি ঘোষণা করেন, তিনি বৃহস্পতিবার আঙ্কারায় থাকবেন। এ সময় তিনি সেখানে তিনি তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের সঙ্গে দেখা করবেন। তবে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা পরবর্তীতে ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।

ট্রাম্প বলেছেন, তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং ইউক্রেন ও রাশিয়া বিষয়ক বিশেষ দূত কিথ কেলগকে ইস্তাম্বুলের আলোচনায় যোগ দিতে পাঠাবেন। বুধবার রাতে রাশিয়া আলোচনার জন্য তাদের দলের ঘোষণা দিয়েছে। এতে পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী ভ্লাদিমির মেদিনস্কি নেতৃত্ব দেবেন। তাঁর সঙ্গে থাকবেন উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী আলেকজান্ডার ফোমিন এবং প্রধান গোয়েন্দা অধিদপ্তরের পরিচালক ইগর কোস্তিউকভ।

জেলেনস্কি আগে বলেছিলেন, পুতিন উপস্থিত থাকলেই কেবল তিনি সরাসরি আলোচনায় থাকবেন। জেলেনস্কি মঙ্গলবার এক্স পোস্টে বলেন, ‘রাশিয়ায় সবকিছুর সিদ্ধান্ত পুতিন নেন, তাই তিনিই যুদ্ধের সমাধান করবেন। এটা তাঁর যুদ্ধ। সুতরাং, আলোচনা তারই সঙ্গে হওয়া উচিত।’ পুতিন যেহেতু এখন উপস্থিত থাকার জন্য প্রস্তুত নন, তাই জেলেনস্কি নিজে ব্যক্তিগতভাবে আলোচনায় অংশ নেবেন কিনা বা তিনি তাঁর দলের ওপর ছেড়ে দেবেন কিনা তা স্পষ্ট নয়।

তবে, জেলেনস্কি অনেক দিক থেকে পুতিনের চেয়ে এগিয়ে গেছেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে এবং তাঁকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে। কিয়ের জাইলস বলেছেন, ‘জেলেনস্কি রাশিয়ার সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন যাতে তারা দেখাতে পারে যে, তাদের সত্যিকারের আগ্রহ আছে; রাশিয়া এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে নাকি করবে না, সেটা তাদের ওপর নির্ভর করছে।’

এদিকে, তুরস্কের বৈঠকে ঠিক কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে, তা অনুমান করা কঠিন। জাইলস বলেছেন, ‘বৈঠকে কোনো অর্থপূর্ণ আলোচনা হবে কি না তা ভবিষ্যদ্বাণী করা হঠকারিতা হবে। কারণ, দুই পক্ষের গ্রহণযোগ্য ফল এখনো অনেক দূরে। রাশিয়া ইউক্রেনকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে নিষ্ক্রিয় করতে চায়, আর ইউক্রেন টিকে থাকতে চায়।’

বর্তমানে, ইউক্রেন ৩০ দিনের নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে। অন্যদিকে, রাশিয়া জোর দিয়ে বলেছে—তারা এই ধরনের যুদ্ধবিরতিতে যোগ দেওয়ার আগে তাদের বেশ কয়েকটি দাবি মানতে হবে। মস্কো বলেছে, তারা যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থার ব্যাপারে নিশ্চয়তা চায় এবং ইউক্রেন যেন এই সুযোগে পুনরায় অস্ত্র সংগ্রহ ও আরও সৈন্য সমাবেশ না করে। এর পরিবর্তে, পুতিন সম্প্রতি সংক্ষিপ্ত, একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছেন। তবে ইউক্রেন বলছে, রাশিয়া আসলে কখনো মেনে চলেনি।

পুতিন রোববার বলেন, ‘আমরা এটা উড়িয়ে দিচ্ছি না যে এই আলোচনা চলাকালে, কিছু নতুন যুদ্ধবিরতি, একটি নতুন যুদ্ধবিরতি এবং একটি বাস্তব যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে একমত হওয়া সম্ভব হবে, যা কেবল রাশিয়াই নয়, ইউক্রেনীয় পক্ষও মেনে চলবে। (এটি) হবে প্রথম পদক্ষেপ। আমি আবারও বলছি, এটি দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল শান্তির দিকে এবং সশস্ত্র সংঘাত চালিয়ে যাওয়ার কোনো পূর্বাভাস নয়।’

জাইলস বলেছেন, যদি আলোচনা হয়, ‘তবে তা-ই একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন পর্যন্ত শান্তি আলোচনা বলে যা উল্লেখ করা হয়েছে, তার কোনোটিই আসলে সেরকম ছিল না।’ তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে হওয়া দুটি সমান্তরাল আলোচনার কথা উল্লেখ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত