Ajker Patrika

দক্ষিণ কোরিয়ায় আন্দোলনে অগ্রভাবে ছিলেন নারীরা, তাঁরাই এখন রাজনীতিতে অদৃশ্য

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ০১ জুন ২০২৫, ১৯: ১১
ইউনবিরোধী আন্দোলনে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। ছবি: আন্দোলনকারী লি জিনহা
ইউনবিরোধী আন্দোলনে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। ছবি: আন্দোলনকারী লি জিনহা

৩ ডিসেম্বর রাত। ভিডিও গেম খেলছিলেন আন বিয়ংহুই। হঠাৎ খবর পেলেন দেশে সামরিক আইন জারি করেছেন প্রেসিডেন্ট। প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। কিন্তু ইন্টারনেটে ঢুকতেই দেখেন হাজার হাজার পোস্ট। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলের হঠাৎ ঘোষণা, সংসদ ভবনের জানালায় সৈন্যদের লাথি ও সংসদ সদস্যদের দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করার সেই বিখ্যাত দৃশ্য—সবই ততক্ষণে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল।

প্রেসিডেন্টের এমন ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রাস্তায় নেমে আসেন লাখ লাখ মানুষ, যার একটি বড় অংশ দক্ষিণ কোরিয়ার তরুণীরা। আন বিয়ংহুইও যোগ দেন ওই বিক্ষোভে। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার দেগু শহরের বাসিন্দা। কয়েক মাইল হেঁটে পাড়ি দিয়ে রাজধানী সিউলে গিয়ে আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। কেবল ইউনের সামরিক আইন জারির ঘোষণাকে কেন্দ্র করেই ক্ষুব্ধ নন এই নারীরা, বরং এমন এক প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে তাঁরা এককাট্টা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, যিনি বারবার বলার চেষ্টা করেছেন যে দক্ষিণ কোরিয়ায় কোনো লিঙ্গবৈষম্য নেই। তবে বাস্তবতা কি আসলেই ইউনের বক্তব্যকে সমর্থন করে?

দেশটির নারীদের ভাষ্যমতে ও সাম্প্রতিক জরিপ অনুসারে, প্রকৃত চিত্র বরং উল্টো। নারীদের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও সহিংসতার ঘটনা বেশ নিয়মিতই। নাটকীয় চার মাস পর যখন ইউন অভিশংসিত হন, তখন আনন্দে ফেটে পড়েন আন্দোলনে অংশ নেওয়া এই নারীরা। কিন্তু ৩ জুন, আসন্ন নির্বাচন ঘিরে যখন দেশে প্রস্তুতি চলছে, তখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যেন আবার অদৃশ্য হয়ে পড়েন নারীরা।

নারীদের অভিযোগ, প্রধান দুই প্রার্থীই নারীর সমতার প্রশ্নে নীরব। নারীদের অধিকারের বিষয়ে ২০২২ সালের নির্বাচনে অভিশংসিত ইউনের অবস্থানও একই রকম ছিল। তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘অতিরিক্ত নারীবাদী’ এই সমাজে তিনি পুরুষের পক্ষ নেবেন।

এবারের নির্বাচনে প্রধান দুই প্রার্থীর বাইরে তৃতীয় আরেক প্রার্থীও মনোযোগ কাড়ছেন। নারীবিরোধী স্পষ্ট অবস্থানের কারণে তিনি তরুণদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় বলে জানিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো।

নতুন এই প্রার্থীর এমন জনপ্রিয়তা দক্ষিণ কোরীয় তরুণীদের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে নতুন এক লড়াই হিসেবে। ২৪ বছর বয়সী বিয়ংহুই বলেন, ‘আমরা তো ভেবেছিলাম, ইউন-বিরোধী সমাবেশে গিয়ে আমরা পৃথিবীকে একটু হলেও বদলাতে পেরেছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, কিছুই বদলায়নি, নারীর কণ্ঠরোধের চেষ্টাই অব্যাহত।’

ইউনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন যে নারীরা

বিয়ংহুই যখন সিউলের জনস্রোতে পৌঁছান, চারপাশের দৃশ্য তাঁকে স্তব্ধ করে দেয়। হাড়কাঁপানো শীত উপেক্ষা করে হাজারো নারী রাস্তায় নামেন—হুডি জ্যাকেট গায়ে চেপে হাতে লাইটস্টিক আর ব্যানার নিয়ে জোর গলায় স্লোগান দেন তাঁরা। তাঁদের কণ্ঠে ছিল একটাই দাবি—প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলের পদত্যাগ।

বিয়ংহুই বলেন, ‘আমার চারপাশে নানা বয়সের নারীরা ছিলেন। কিন্তু বয়স যা-ই হোক, সবার মধ্যে যেন তারুণ্য ভর করেছিল। আমরা গার্লস জেনারেশনের “ইনটু দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড” গাইছিলাম।’ ২০০৭ সালের এই গান একসময়কার আরেক প্রেসিডেন্ট-বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক ছিল, সেই ঐতিহ্য টেনেই এবার তা হয়ে উঠেছিল ইউন-বিরোধী ক্ষোভের কণ্ঠস্বর।

নারীদের অংশগ্রহণের নির্ভরযোগ্য সরকারি পরিসংখ্যান না থাকলেও স্থানীয় সংবাদমাধ্যম চোসুন ডেইলির এক অনুসন্ধানে জানা যায়, আন্দোলনকারীদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ছিলেন ২০-৩০ বছর বয়সী নারী। বিবিসি কোরিয়ানের আরেক বিশ্লেষণ বলছে, ডিসেম্বরে একটি বিক্ষোভে সবচেয়ে বড় গোষ্ঠী ছিলেন ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী নারী—প্রায় ২ লাখ, যা মোট জমায়েতের ১৮ শতাংশ। অন্যদিকে ওই আন্দোলনে একই বয়সের পুরুষের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ শতাংশ।

এই বিক্ষোভ ছিল এক দীর্ঘদিনের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ—একটি সমাজে যেখানে নারীরা বছরের পর বছর ধরে বৈষম্য, হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়েছে, তারই ফল ছিল ওই বিক্ষোভ। ধনী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়াতেই লিঙ্গভিত্তিক মজুরিবৈষম্য সর্বোচ্চ—৩১ শতাংশ। এর পাশাপাশি দেশটিতে ক্রমশ জন্মহার কমে যাওয়ার জন্যও দায়ী করা হচ্ছে নারীদের। রাষ্ট্র ও সমাজ একযোগে তাঁদের ঘাড়ে চাপিয়েছে বিয়ের বাধ্যবাধকতা এবং সন্তান ধারণের দায়িত্ব। পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার জন্য রাজনীতিকদের পক্ষ থেকেও অব্যাহত চাপ রয়েছে।

২৩ বছর বয়সী কিম সায়েয়ন বলেন, ‘আমার জমে থাকা সব হতাশা যেন সেদিন ফেটে বেরিয়ে এসেছিল। অনেকে এসেছিলেন শুধু তাঁদের ক্ষোভ জানাতেই।’ ২৬ বছর বয়সী লি জিনহা নিয়ম করে প্রতিবাদে যেতেন। তিনি বলেন, ‘ভীষণ ঠান্ডা, বিশাল ভিড়, পায়ে ব্যথা, কাজের চাপ—সব সত্ত্বেও আমি যেতাম। কারণ মনে হতো, এটা আমার দায়িত্ব।’

ইওহা উইমেন্স ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গো মিন-হির মতে, ইউন সুক-ইওলের ‘নারীবিরোধী’ ভাবমূর্তি নতুন কিছু নয়। সুক-ইওল স্পষ্ট করে বলেছিলেন—তরুণীদের জন্য তাঁর কোনো বিশেষ নীতি নেই। অন্যদিকে ইউনের সমর্থনে রাস্তায় নেমেছিলেন বহু তরুণ। তাঁদের কাছে ইউন ছিলেন এক ‘রক্ষাকর্তা’, যিনি ২০২২ সালের নির্বাচনে তাঁদের হতাশা আর ক্ষোভের রাজনৈতিক রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এই তরুণদের ভাষ্য—তাঁরা ‘বিপরীত বৈষম্যের শিকার’। তাঁরা নারীবাদীদের ‘পুরুষবিদ্বেষী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে নারীবিদ্বেষ ছড়াচ্ছিল। আর প্রেসিডেন্ট ইউনের আমলে অনলাইনে নারীদের বিরুদ্ধে এই ধরনের বিদ্বেষ একধরনের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছিল। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘নারীর অধিকারে অতিরিক্ত মনোযোগী’ জেন্ডার ইকুইটি মন্ত্রণালয় বিলুপ্ত করা হবে। তাঁর দাবি ছিল, দক্ষিণ কোরিয়ায় কাঠামোগত লিঙ্গবৈষম্য বলে কিছু নেই—যদিও বাস্তবতা বলছে, লিঙ্গসমতা সূচকে দেশটির অবস্থান উন্নত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিচে।

২০২১ সালের এক জরিপে দেখা যায়, ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী দক্ষিণ কোরীয় পুরুষদের ৭৯ শতাংশই মনে করে, তারা তাদের লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে ‘গভীর বৈষম্যের শিকার’। কোরিয়ান উইমেনস অ্যান্ড পলিটিকস সেন্টারের পরিচালক কিম ইউন-জু বলেন, ইউনের দল সচেতনভাবেই লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনকে রাজনৈতিক কৌশল বানিয়েছিল। ইউনের শাসনকালে ‘নারী’ শব্দটি ছাঁটাই করা হয়েছে বহু সরকারি ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের নাম থেকে। তরুণীদের চোখে এটি ছিল অর্জিত অধিকার কেড়ে নেওয়ার শামিল। আর এ কারণেই ইউনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল নারীদের।

বিয়ংহুই বলেন, দেগুতে তাঁর দেখা বিক্ষোভগুলোতে নারীর উপস্থিতিই ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি অভিযোগ করেন, আন্দোলনের সময় পুরুষেরা নারীদের গালি দিয়ে যেতেন। তিনি বলেন, তরুণদের আচরণ কেমন ছিল? তাঁরা গাড়ি চালিয়ে এসে গালি দিতেন, গা ঘেঁষে হুমকি দিয়ে যেতেন। বিক্ষোভটা যদি তরুণদের দ্বারা পরিচালিত হতো, তবে কি এমন হতো?’—প্রশ্ন করেন বিয়ংহুই।

ভোটের মাঠে নারীদের কণ্ঠ অনুপস্থিত

ইউনের পতনের পর তাঁর দল পিপল পাওয়ার পার্টি চরম বিশৃঙ্খলায় পড়ে। এবারের নির্বাচনে ১৮ বছরের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো কোনো নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নেই। গত নির্বাচনে অন্তত ১৪ জন প্রার্থীর মধ্যে দুজন ছিলেন নারী।

প্রধান বিরোধী ডেমোক্রেটিক পার্টির (ডিপি) লি জে-মিয়ং এগিয়ে থাকলেও নারীদের প্রতি তাঁর অবস্থান খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। সায়েন নামের এক তরুণী বলেন, ‘তাঁদের নীতিতে শুরুতে নারী ইস্যু খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। পরে এসে কিছু কিছু পরিবর্তন এনেছেন তাঁরা। কাঠামোগত বৈষম্য দূর করতে বাস্তবসম্মত কোনো পরিকল্পনা দেওয়া হোক, সেটাই আমাদের চাওয়া।’

নির্বাচনী প্রচারের শুরুতে লি বলেছিলেন, নারী-পুরুষ কেন ভাগ করছেন? সবাই তো কোরীয়। পরে সমালোচনার মুখে দল স্বীকার করে—নারীরা কাঠামোগত বৈষম্যের শিকার। এরপর তারা প্রতিশ্রুতি দেয়—সমতার জন্য বাজেট বাড়াবে।

২০২২ সালে লি ছিলেন নারীদের পক্ষে সরব; দলের অভ্যন্তরে যৌন হয়রানির ঘটনায় কঠোর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে নারী নেতৃত্বের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এবারে অনেকটাই চুপ তিনি। অধ্যাপক ইওহা উইমেন্স ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গো মিন-হি বলেন, লি এবার ভোট হারাতে চান না, তাই তিনি সবাইকে খুশি রাখতে চাচ্ছেন। নারীবাদ এখন ভোটে জেতার কৌশল নয়।

এই অবস্থায় তরুণীরা বঞ্চিতবোধ করছেন। সায়েন বলেন, ‘আমরা এত বড় আন্দোলন করলাম, অথচ আমাদের কণ্ঠ প্রতিফলিত হচ্ছে না।’

ভবিষ্যতের শঙ্কা ও প্রতিরোধ

ইউনের সাবেক শ্রমমন্ত্রী কিম মুন-সু জন্মহার বাড়াতে আর্থিক প্রণোদনার ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু তরুণ নারীদের বক্তব্য—সমস্যা শুধু অর্থ নয়, বরং কর্মজীবন ও পরিবার সামলানোর কাঠামোগত অসাম্যই মূল বাধা, এখনো পুরো সমাজ নারীর বিরুদ্ধে।

এই কারণেই বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এসেছে নারী ও পরিবারবিষয়ক মন্ত্রণালয়—যেটি ইউন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। এখন বিরোধী প্রার্থী লি জে-মিয়ং বলছেন, তিনি এই মন্ত্রণালয় আরও শক্তিশালী করবেন। আর কিম বলছেন, এটা বাদ দিয়ে ‘ভবিষ্যৎ যুব ও পরিবার মন্ত্রণালয়’ গঠন করবেন। এই মন্ত্রণালয়ের বাজেটও খুবই ছোট—সরকারের পুরো বাজেটের মাত্র ০ দশমিক ২ শতাংশ। এর মধ্যে লিঙ্গ সমতার পেছনে খরচ হয় মাত্র ৭ শতাংশ।

অধ্যাপক গো মিন-হি বলেন, মন্ত্রণালয়টি ছোট হলেও এটা একটা বড় বার্তা দেয়। কিন্তু এটি একেবারে তুলে দেওয়ার অর্থ—লিঙ্গসমতা রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বহীন।

আরেক প্রার্থী লি জুন-সক—ইউনের সাবেক দলের নেতা—এই মন্ত্রণালয়ের বিরোধিতা করছেন। এখন তিনি নিজের রিফর্ম পার্টি খুলেছেন। যদিও নির্বাচনে এগিয়ে নেই তাঁর দল, তবে তরুণদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়ছে।

প্রার্থীদের মধ্যে একমাত্র যিনি খোলাখুলি লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে কথা বলছেন, তিনি ৬১ বছর বয়সী কওন ইয়ং-গুক। তবে তাঁর জনপ্রিয়তা কম।

বিবিসির প্রতিবেদন অবলম্বনে

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত