Ajker Patrika

নেপালে জেন-জি আন্দোলনের ওপর ব্যর্থ মাও বিপ্লবের ভূতের আছর

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
অগ্নিসংযোগের পর নেপালের সাবেক মাওবাদী প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ডের বাসভবনের চিত্র। ছবি: সাবিন নিংলেখু
অগ্নিসংযোগের পর নেপালের সাবেক মাওবাদী প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ডের বাসভবনের চিত্র। ছবি: সাবিন নিংলেখু

দীর্ঘ এক দশকের ‘জনযুদ্ধ’ শেষে ২০০৬ সালে কাঠমান্ডুর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল মাওবাদীরা। রাজধানীতে প্রবেশের পর এক মাও নেতাকে সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এখন আপনার স্বপ্নের শহর কেমন হবে?’ তিনি উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘ব্যাংককের মতো শপিং মল, পশ্চিমাদের মতো চকচকে সড়ক’। মাওবাদী নেতার সেই কল্পিত শহর বাস্তবায়নে দরকার ছিল সরকারি অর্থনৈতিক প্রকল্পের পাশাপাশি বেসরকারি পুঁজির ব্যাপক বিনিয়োগ।

একজন বিপ্লবীর মুখে এমন কথা ছিল বিদ্রূপাত্মক, কিন্তু স্বপ্নের এই রূপরেখা ছিল একটি কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের উন্মোচন। ২০১৫ সালের ভূমিকম্প-পরবর্তী কাঠমান্ডুতে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে থাকে। বহুতল ভবন, বিলাসবহুল হোটেল, আধুনিক ক্যাফে, অত্যাধুনিক প্রাইভেট হাসপাতাল শহরের চেহারা পাল্টে দেয়। নতুনভাবে গড়ে ওঠা হিলটন হোটেল যেন এর প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ২০২৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সেই স্বপ্ন ভেঙে দেয় জেন-জি আন্দোলন। আগুনে ধ্বংস করে দেওয়া হয় হিলটন হোটেলসহ বহু স্থাপনা।

কীভাবে শুরু হলো এই আন্দোলন

কিছু তরুণ-তরুণীর একটি ভাইবার গ্রুপ থেকে এই আন্দোলনের সূত্রপাত। প্রথমে কবিতা ও সৃজনশীল প্রতিবাদের মাধ্যমেই এই আন্দোলনের পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু ৪ সেপ্টেম্বর সরকার ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউবসহ সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা দিলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ভাইবার গ্রুপের ১৫-২০ জন সদস্য বেড়ে ৩০০ ছাড়িয়ে যায়।

৮ সেপ্টেম্বর হাজারো মানুষ কাঠমান্ডুর মৈতিঘর মণ্ডলা থেকে সংসদ ভবনের উদ্দেশে মিছিল শুরু করে। কিন্তু শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে ‘অদৃশ্য শক্তি’র অনুপ্রবেশ ঘটে; যাদের মধ্যে কেউ কেউ হতে পারে অসন্তুষ্ট রাজনৈতিক কর্মী, জীবিকার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নির্ভরশীল তরুণ, কিংবা ডানপন্থী রাজতন্ত্রী ও হিন্দুত্ববাদী।

দিন শেষে ৭২ জন নিহত হয়, শত শত আহত। পরদিন কারফিউ অমান্য করে মানুষ আবার রাস্তায় নামে। স্লোগান ওঠে, ‘অলি চোর, দেশ ছাড়’। মুহূর্তেই আগুন জ্বলে ওঠে সংসদ ভবন, সুপ্রিম কোর্ট, আইনসভা ভবন, এমপিদের বাড়িঘরে। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যান। ভাইরাল হয়, কংগ্রেস নেতা শের বাহাদুর দেউবা ও তাঁর স্ত্রী পররাষ্ট্রমন্ত্রী অর্জু দেউবাকে টেনে বের করার ভিডিও।

রাজধানী কাঠমান্ডুর একটি ভবনে জেন-জিদের রেখে যাওয়া ছাপ। ছবি: সাবিন নিংলেখু
রাজধানী কাঠমান্ডুর একটি ভবনে জেন-জিদের রেখে যাওয়া ছাপ। ছবি: সাবিন নিংলেখু

দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির প্রতীক হিলটন হোটেল

২০২৫ সালের জুনে সাংবাদিক দিল ভূষণ পাঠকের বিরুদ্ধে সাইবার অপরাধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। তিনি ইউটিউবে টাফ টক নামের একটি শো প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে ভূষণ দাবি করেন, দেউবা পরিবারের ছেলে জয়বীর দেউবা অস্বাভাবিক কম দামে (১৭৭ মিলিয়ন ডলারে) হিলটন হোটেলের শেয়ার কিনেছেন। এ ছাড়া দুবাই, অস্ট্রেলিয়া, কানাডায়ও তাঁর ব্যবসা রয়েছে।

এই কেলেঙ্কারি তুলে ধরে ভূষণ দেখিয়েছিলেন, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা এক হয়ে জনগণকে কীভাবে জিম্মি করছে। এর পাশাপাশি তাদের সন্তানেরা এই ক্ষমতা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে, যা ক্রনি ক্যাপিটালিজম বা বা স্বজনতোষী পুঁজিবাদের ব্যবস্থাকে চিরস্থায়ী করবে।

এরপরেই ভূষণের বিরুদ্ধে জারি করা হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। এটি কেবল দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক আঁতাতকেই নয়, বরং ক্ষমতাশালীদের হুমকির মুখে পড়লেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে কীভাবে পদদলিত করা হয়, সেই প্রবণতাকেও নগ্নভাবে প্রকাশ করেছে। ফলে এই আন্দোলনের স্লোগান হয়ে ওঠে #NepoBaby ও #Corruption। আর হিলটন হোটেল ছিল এই দুয়েরই ফল এবং নিখুঁত লক্ষ্যবস্তু।

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, নেপালের অনেক মানুষের মতো সাংবাদিক ভূষণেরও কোনো ধারণা ছিল না যে মাত্র তিন মাস পর জেন-জি আন্দোলন হবে। তাঁরা ভাবতেই পারেননি, হিলটন হোটেল ও অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদের মাধ্যমে করা এমন অনেক স্থাপনা এবং দেউবা পরিবারের মতো অন্যান্য ‘ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারের’ ভাগ্যে কী ঘটবে।

বিপ্লব-পরবর্তী ভৌতিক অবস্থা

বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে ‘পুরোনো শাসনব্যবস্থা’র প্রতিনিধিত্বকারী আটটি প্রধান রাজনৈতিক দল নেপালি জনগণের দাবি করা সংস্কারের পক্ষে কোনো মত দেয়নি। উল্টো তারা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কারকির নিয়োগকে অসাংবিধানিক বলে একটি যৌথ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। এ থেকে বোঝা যায়, পুরোনো দলগুলো এখনো সময়ের পরিবর্তন ও বিপ্লব-পরবর্তী অবস্থা বুঝতে ব্যর্থ কিংবা তারা পরিবর্তন মেনে নেয়নি।

কাঠমান্ডুর আগুন দেন জেন-জি বিক্ষোভকারীরা। ছবি: মনজিৎ লামা
কাঠমান্ডুর আগুন দেন জেন-জি বিক্ষোভকারীরা। ছবি: মনজিৎ লামা

যুব কমিউনিস্ট ও কংগ্রেসের তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। কারণ, এত দিন ধরে তারা যে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার ওপর নির্ভর করে এসেছে, তা হঠাৎ ভেঙে পড়েছে। নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির (ইউনিফায়েড মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বা ইউএমএল ও সিপিএন) একজন বিশিষ্ট নেতা মহেশ বসনেট সম্প্রতি একটি ভিডিও শেয়ার করেছেন। ওই ভিডিওতে তিনি জেন-জিদের আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া তাঁর বাড়ি দেখাচ্ছিলেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা একদল অনুচরের মধ্যে একজনকে বলিউডের বিখ্যাত একটি সংলাপ বলতে শোনা যায়। তিনি বলছিলেন, ‘চুন চুন কে মারেঙ্গে’ অর্থাৎ একটা একটা করে বেছে বেছে মারব। তিনি মূলত জেন-জিদের উদ্দেশে এই কথা বলেন। এরই মধ্যে পুরোনো রাজনৈতিক দলের কর্মীদের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়ে জেন-জি আন্দোলনের একজন সদস্য আত্মহত্যা করেছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে।

এদিকে আদিবাসী, মধেশি, দলিত ও ভূমিহীন তরুণেরা আলাদাভাবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে, যা আন্দোলনের মূলধারার জেন-জেড নেতৃত্বের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করছে।

৯ সেপ্টেম্বরের অগ্নিকাণ্ডে নেপালের সাবেক মাওবাদী প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ডের বাড়িও পুড়ে যায়। মজার বিষয়, ‘প্রচণ্ডপথ’-এর রচয়িতা, যিনি একসময় রাজতন্ত্র ভেঙে সমাজতান্ত্রিক নেপালের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, সেই প্রচণ্ডই জেন-জিদের বিপ্লবের আগুনে পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য হলেন। তাঁর বাড়ির দেয়ালেও লেখা হলো, ‘বিপ্লব সংক্রামক’। কারণ, ২০০৬ সালের পর এই বিপ্লবী মাওবাদীরাও ক্ষমতার লোভে পুঁজিবাদী রাজনীতিতে ডুবে গিয়েছিল।

কিন্তু প্রচণ্ডের বাসভবনের ধ্বংসাবশেষ সেই মাও বিপ্লবের ব্যর্থ ভুতুড়ে প্রতিচ্ছবি, যাকে একসময় পরিবর্তনের অগ্রদূত বলে মনে করা হয়েছিল। আর এই ব্যর্থতার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী।

১৯২০ থেকে ত্রিশের দশকে মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী শাসনামলে কারাগারে থাকার সময় ইতালির দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামসি লিখেছিলেন, ‘সংকটটি মূলত এই কারণে যে, পুরোনোটা মরে গেছে এবং নতুনটির এখনো জন্ম হয়নি; এই অন্তর্বর্তী সময়ে নানা ধরনের রোগগ্রস্ত লক্ষণ দেখা দেয়।’ নেপাল এখন সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে নতুন ইতিহাস রচনার পথে তাদের ওপর আছর করতে পারে ব্যর্থ মাও বিপ্লবের ভূত। জেন-জিদের এই আন্দোলনের পর নেপালের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো—এই সময়কে সুস্থ রাখা।

দ্য ওয়ার থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

লেখক: সাবিন নিংলেখু, আরবান পলিটিকস ও সামাজিক আন্দোলন গবেষক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বাগদান সারলেন এনসিপির হান্নান মাসউদ, কনে বাগছাসের নেত্রী

উচ্চদক্ষ কর্মীদের ভিসা ফি ৩০ হাজার থেকে ১ লাখ ডলার করলেন ট্রাম্প

বাংলাদেশের আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা আনতে যে ৮ পরামর্শ দিল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর

আবাসিক হোটেলে তিন বন্ধু, মিলল একজনের লাশ

যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ও স্থায়ী বসবাসের সুযোগ: গোল্ড ও প্লাটিনাম কার্ড ভিসার ঘোষণা ট্রাম্পের

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত