Ajker Patrika

বাড়ছে করোনা রোগীর চাপ, সংকট আইসিইউয়ের

বিশেষ প্রতিবেদক
আপডেট : ২৩ মার্চ ২০২১, ১৪: ০১
বাড়ছে করোনা রোগীর চাপ, সংকট আইসিইউয়ের

রিয়াজ দেওয়ান (২৮)। রাজধানীর হাতিরপুলে একটি মেসে থেকে প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করছেন। গত বছরের জুলাইয়ের দিকে ওই মেসে থাকা চার বন্ধু করোনায় আক্রান্ত হলেও সেসময় পরীক্ষায় তার করোনা নেগেটিভ আসে। তবে সম্প্রতি দ্বিতীয়বার করোনা পরীক্ষায় তার করোনা শনাক্ত হয়। এরই মধ্যে তিনি টিকা নিতে নিবন্ধন করেছেন, যদিও এখনো নেওয়া হয়নি।

আক্রান্তের পর থেকে শরীর খুব দুর্বল হয়ে যায় রিয়াজের। এক পর্যায়ে অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন হওয়ায় গত ১৪ মার্চ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের (আইসিইউ) বেড পেতে বেশ বেগ পেতে হয় তার স্বজনদের। কেননা, আইসিইউ সেসময় ফাঁকা ছিল না। তবে বর্তমানে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ায় কেবিনে নেয়া হয়েছে রিয়াজকে। সেখানেই এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি।

গত তিনদিন ঢাকা মেডিকেল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ ও সোহরাওয়ার্দীসহ কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, গত এক মাসের ব্যবধানে হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীর চাপ বেড়েছে কয়েকগুণ। বর্তমানে করোনা ওয়ার্ডে তিল ধারণের ঠাই নেই। হাসপাতালসূত্রে জানা গেছে, আইসোলেশন ইউনিট করোনা রোগীতে ভরে গেছে, খালি নেই আইসিইউগুলোও। চলমান পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে এই সংকট প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। বর্তমানে আক্রান্তদের প্রায় ৫০ শতাংশ রোগীই তরুণ। দ্রুত তাদের অবস্থা খারাপের দিকে যাওয়ায় অল্প সময়েই আইসিইউতে নিতে হচ্ছে। যা খুবই ভয়ংকর বার্তা বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।

চলতি মাসের শুরুর দিকে দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দুই হাজারের নিচে নামলেও গত বুধবার (১৭ মার্চ) প্রথম তা দুই হাজার ছাড়িয়ে যায়। এরপর অব্যাহত রয়েছে ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ। সবশেষ সোমবার (২২ মার্চ) সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ করোনা রোগী শনাক্ত ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এদিন ২ হাজার ৮০৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়, মৃত্যু হয় ৩০ জনের।

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আইসিইউ না থাকলেও খালি নেই আইসোলশন বেড। মাঝে কিছুটা রোগীর চাপ কমলেও চলতি মাসের শুরু থেকে তা আবারও বাড়তে থাকে। তবে মহামারী শুরুর পর কখনোই আইসোলশন বেড ফাঁকা ছিল না বলে জানান কর্তব্যরত চিকিৎসক। এ হাসপাতালে আগের চেয়ে পরীক্ষার সংখ্যা বেড়েছে বলেও জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

অন্যদিকে নগরীর প্রধান চিকিৎসাকেন্দ্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোভিড রোগীর পাশাপাশি কোভিডমুক্ত রোগীর চাপ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এতে করে সেবা দিতে গিয়ে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। বিশেষ করে ক্রিটিক্যাল রোগীদের সংখ্যা আগের তুলনায় কয়েকগুণ বাড়ায় আইসিইউ সংকট হয়েছে এই হাসপাতালে।

হাসপাতালসূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে এখনো ৪০ শতাংশ বেড খালি রয়েছে। তবে যে হারে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত তা কমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একই সাথে সংকটাবস্থা তৈরি হয়েছে আইসিইউ নিয়ে। যা আরও তীব্র করেছে সম্প্রতি হাসপাতালটির একটি আইসিইউকেন্দ্র পুড়ে যাওয়ায়। বর্তমানে ১৫টি দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে ঢামেক কর্তৃপক্ষ। এমতাবস্থায় নতুন করে ১০টি আইসিইউ যুক্ত করছে হাসপাতালটি। যা চলতি সপ্তাহেই চালু হতে পারে বলে জানা গেছে।

দুই মাস আগেও অন্যান্য রোগের পাশাপাশি করোনাক্রান্ত রোগীর চাপ অনেকটা কমে গিয়েছিল রাজধানীর প্রধান এই হাসপাতালে। কিন্তু চলতি মাসের শুরু থেকে তা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বর্তমানে ৯শ’র বেশি করোনা রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে ঢামেকে, যার অধিকাংশই তরুণ। অল্পতেই অবস্থা খারাপ হওয়ায় আইসিইউতে নিতে হচ্ছে তাদের। কিন্তু সে তুলনায় এই মুহূর্তে আইসিইউ বেড খালি নেই।

জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা শাহানা বানু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সারাদেশের ন্যায় রাজধানীর পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোতে আগের চেয়ে টেস্ট বাড়ানো হয়েছে, ফলে অন্যান্য হাসপাতালগুলোর চেয়ে ঢাকা মেডিকেলে আগের চেয়ে করোনা রোগীর চাপ বেড়েছে। মাঝে তো আমরা ধরেই নিয়েছিলাম দেশে করোনা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা বলছে ভিন্নকথা। সম্প্রতি ব্রিটেন ও দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রকোপ দেখা দেয়ায় আমাদের দেশেও তা ছড়িয়েছে। ফলে প্রতিদিনই হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েই চলেছে। এ হাসপাতালে করোনা ওয়ার্ডের পাশাপাশি আইসিইউ পর্যন্ত খালি নেই। যে অবস্থা চলছে, তাতে আইসিইউ সংকট দেখা দিবে যেকোনো সময়।’

তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে অন্যান্য রোগগুলো বিস্তার লাভ করছে। ফলে নন কোভিড ওয়ার্ডগুলোতেও রোগীদের উপচে ভিড় লেগেই থাকছে। দেশব্যাপী ভ্যাক্সিন কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও করোনা নিত্য নতুন রূপ নেয়ায় তা তেমন একটা কাজে আসছে না। আর সবচেয়ে বড় কারণ স্বাস্থ্যবিধির প্রতি উদাসীনতা। আমরা টিকা নিয়েই মনে করছি করোনা চলে গেছে। আসলে তা ভুল। কোন ভ্যাক্সিনই এখন পর্যন্ত শতভাগ কার্যকরি নয়। তারপরও দ্বিতীয় ডোজ এখনো বাকি। তাই আমরা যদি বেপরোয়া চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তবে খুব ভয়াবহ কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।’

টিকা নয়, করোনা প্রতিরোধে শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মানার বিকল্প নেই জানিয়ে ভাইরোলজি বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, ‘করোনার আসলে একক কোন রূপ নেই। ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিয়ে বংশ বিস্তার করে। ফলে ভ্যাক্সিন চললেও সহজে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে এই মহামারীর মতো আরও অনেক শক্তিশালী ভাইরাস আসবে, তাই নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। গবেষণার মাধ্যমে ভাইরোলজিস্ট তৈরি করতে হবে।

এ ব্যাপারে সরকারের রোগ তত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের অসতর্কতার কারণেই দিন দিন জটিলতা তৈরি হচ্ছে। পৃথিবীর কোন দেশেই আইসিইউ পর্যাপ্ত নেই। এখানে যে যায়, তার ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই এর থেকে যদি আমরা বাঁচতে চাই তাহলে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।’ চলমান পরিস্থিতি মোকাবেলা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়, এর আগেও আমরা দেখেছি। তাই সবার জায়গা থেকে সরকারি নির্দেশনা মেনে এগিয়ে আসতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।

এদিকে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা জাতীয়ভাবে দেখতে পাচ্ছি যে, কোভিড সংক্রমণ বাড়ছে। প্রতিদিনই দেশের অন্যান্য হাসপাতালের ন্যায় ঢাকা মেডিকেলেও চাপ বাড়ছে রোগীর। বিশেষ করে গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে যেসব কেবিন ফাঁকা ছিলও, সেগুলোও এখন ভরে গেছে। যদিও আমাদের সক্ষমতা রয়েছে। ঢামেকে এখনো ৪০ শতাংশ বেড ফাঁকা রয়েছে। আমাদের কাছে আগের তুলনায় বেশি ফোন আসছে, মানুষ সহযোগিতা চাচ্ছে। এখনো যত বেড ফাঁকা রয়েছে, আশা করা যায় আমরা যথেষ্ট সেবা দিতে পারবো।’

তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন আমাদের এখানে আইসিইউতে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটেছে। তারপরও প্রয়োজনমতও সব করেছি। বর্তমানে ১৫টি আইসিইউ বেড সম্পূর্ণ চালু আছে। তবে কোনটি ফাঁকা নেই। রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ায় কিছুটা হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই চলতি সপ্তাহেই নতুন করে ১০টি আইসিইউ বেড যুক্ত করা হচ্ছে। এতে করে আইসিইউয়ের সংখ্যা ২৫টিতে দাঁড়াবে।’

পুরনো আইসিইউ কবে নাগাদ চালু হতে পারে জানতে চাইলে ঢামেক পরিচালক বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি রমজানের আগেই করার। নীতি নির্ধারক পর্যায়ে কয়েকবার আলোচনা হয়েছে। এরই মধ্যে যন্ত্রপাতি লাগানো হচ্ছে। তবে মূল যন্ত্রাংশগুলো বিদেশ থেকে কিংবা দেশে পেলেও হাতে পেতে কিছু সময় লাগবে, তাই বিলম্বও হতে পারে।’

 

 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিক্ষোভ থেকে সহিংসতায় উত্তাল ভাঙ্গা, মসজিদে আশ্রয় নিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নতুন বেতনকাঠামো ৬ মাসের আগেই চূড়ান্ত করার আশ্বাস

১২ জেলায় বন্যার শঙ্কা, বৃষ্টি থাকবে কত দিন—জানাল আবহাওয়া অফিস

পদ্মা সেতু এলাকায় বসছে সোলার প্যানেল, ২৩ কোটি টাকার কাজ পেল ওমেরা

পাকিস্তানের জাতীয় সংগীতের সময় বাজল উৎসবের গান

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত