Ajker Patrika

মাংসে, বেগুনে বা মোরগের ডাকে সৃষ্টিকর্তার নাম, এর ব্যাখ্যা কী

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
আপডেট : ১৪ মে ২০২৪, ১৭: ১১
মাংসে, বেগুনে বা মোরগের ডাকে সৃষ্টিকর্তার নাম, এর ব্যাখ্যা কী

বেগুন কাটতেই ভেসে উঠলো ‘আল্লাহ’র নাম—এমন শিরোনামে গত রমজানে বেসরকারি সংবাদভিত্তিক টিভি চ্যানেল এটিএন নিউজ একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি গত ২৫ মার্চ চ্যানেলটির ফেসবুক পেজ এটিএন নিউজ ডিজিটালে প্রতিবেদনটি পোস্ট করা হয়।

দাবি অনুযায়ী, ঘটনাটি ঝিনাইদহের মহেশপুর পৌরসভার ঘটনা। বেগুনটি কিনে আনা হয়েছিল ইফতারের আয়োজনে বেগুনি বানানোর উদ্দেশ্যে। বেগুনটি ফালি করে কাটতেই দেখা মেলে আরবি হরফে লেখা ‘আল্লাহ’। ভিডিওটি রোববার (১২ মে) রাত ৮টা পর্যন্ত দেখা হয়েছে ১১ লাখ বার। কমেন্ট পড়েছে ২৮ হাজারের বেশি। এসব কমেন্টে অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী এমন ঘটনায় স্রষ্টার প্রশংসা করেছেন।

ঝিনাইদহের মহেশপুরে বেগুনে আল্লাহর নাম দেখা যাওয়ার দাবিতে সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন। ছবি: এটিএন নিউজআবার শনিবার (১১ মে) ‘মোরগের কণ্ঠে “আল্লাহ আল্লাহ” ডাক’ শিরোনামে ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতীয় দৈনিক কালবেলা। এবারের ঘটনা নারায়ণগঞ্জে। আনিসুজ্জামান আনিস নামে এক ব্যক্তি খাওয়ার জন্য কিনেছিলেন এ মোরগ। রান্নার জন্য স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে মোরগটি জবাইয়ের প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। ঠিক তখনই মোরগের কণ্ঠে আকস্মিক শোনা যায় ‘আল্লাহ, আল্লাহ’ ডাক। ভিডিওটি রোববার রাত ৮টা পর্যন্ত দেখা হয়েছে ৮৭ হাজার বার। 

কেবল এ দুটি ঘটনাই নয়, বিভিন্ন সময়েই দেশের সংবাদমাধ্যমে এমন ঘটনা উঠে এসেছে। একসময় কোরবানি ঈদের মৌসুমে এমন অনেক ঘটনা শোনা যেত যে, কোরবানির পশুর মাংসের গায়ে দেখা মিলেছে আল্লাহর নাম।

ইন্টারনেটে খুঁজে দেখা যায়, এসব ঘটনা কেবল বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর নানা প্রান্তে বিভিন্ন সময় ঘটেছে। ২০০৪ সালে বিবিসিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই সময় প্রায় এক যুগ পুরোনো টোস্ট করা চিজ স্যান্ডউইচ নিলামে ২৮ হাজার মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়েছিল। ওই স্যান্ডউইচে নাকি ফুটে উঠেছিল মাতা মেরির মুখ!

এক যুগ পুরোনো এই টোস্টেড চিজ স্যান্ডউইচ ২৮ হাজার মার্কিন ডলারে নিলামে বিক্রি হয়েছিল। ছবি: বিবিসি নিউজ আবার ২০০২ সালে প্রায় ২০ হাজার খ্রিষ্টান ভারতের বেঙ্গালুরুতে ছুটে গিয়েছিলেন একটি রুটি দর্শনে। কারণ, এ রুটিতে দেখা গিয়েছিল যিশু খ্রিষ্টের মুখাবয়ব! কিছু দর্শনার্থী তো রুটিটির কাছে প্রার্থনাও করেছিলেন। 

এমন দাবিগুলো কেবল ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম মেট্রোর ২০১২ সালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ওই সময় তিন বছরের পুরোনো একটি ফ্রোজেন চিকেন নাগেট নিলামে ৫ হাজার পাউন্ডে বিক্রি হয়েছিল। কারণ, ওই নাগেটে দেখা গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের মুখাবয়ব!

এসব ঘটনার ব্যাখ্যা কী? 
এই প্রশ্নের উত্তর মেলে বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েবসাইট লাইভ সায়েন্সে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। ওয়েবসাইটটি জানায়, এসব প্রশ্নের উত্তর আছে ‘প্যারেডোলিয়া’ নামের একটি বিশেষ মানসিক অবস্থার মধ্যে।

প্যারেডোলিয়া কী
ইংরেজি ‘প্যারেডোলিয়া (Pareidolia)’ শব্দটির উৎপত্তি দুটি গ্রিক শব্দ থেকে। শব্দটি গ্রিক para (ইংরেজি অর্থ: পাশে বা বাইরে) এবং Eidos (ইংরেজি অর্থ: ছবি, চেহারা) শব্দের সমন্বয়ে তৈরি।

ব্যাপক অর্থে প্যারেডোলিয়া হলো মস্তিষ্কের ভ্রান্তি, যেখানে একজন ব্যক্তি এলোমেলো চিত্র বা প্যাটার্নকে সংগঠিত একক অবয়ব হিসেবে দেখেন। অর্থাৎ মানুষ কোনো জড় বস্তুর পৃষ্ঠে কোনো মুখাবয়ব দেখতে পান— এটিই প্যারেডোলিয়া। স্যান্ডউইচের মধ্যে মাতা মেরির ছবি বা চাঁদে মানুষ দেখা প্যারেডোলিয়ার উদাহরণ। 

যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের স্নায়ুবিজ্ঞানী সোফি স্কট প্যারেডোলিয়া সম্পর্কে বিবিসিকে বলেন, এটি মানুষের আকাঙ্ক্ষা থেকেই তৈরি হয়। অর্থাৎ মানুষ যা দেখতে চায় (সচেতনে বা অবচেতনে), জড়বস্তুর পৃষ্ঠেও তা–ই দেখে। যেমন, যে ব্যক্তি টোস্টে যিশুর মুখাবয়ব দেখছেন, তিনি টোস্টটিকে কেবল টোস্ট হিসেবে না দেখে, নিজের চাওয়া বা কল্পনার সঙ্গে মিলিয়ে যিশুর মুখাবয়ব খুঁজে নিয়েছেন।

২০০২ সালে প্রায় ২০ হাজার খ্রিষ্টান ভারতের বেঙ্গালুরুতে ভ্রমণ করেছিলেন একটি রুটি দর্শনে। ছবি: বিবিসি নিউজসোফি স্কট আরও বলেন, মানুষের মস্তিষ্ক এলোমেলো নানা জিনিসের মধ্যে নির্দিষ্ট প্যাটার্ন খুঁজতে যে পছন্দ করে, সেটির একটি দারুণ উদাহরণ প্যারেডোলিয়া। বিশেষ করে যদি একজন ব্যক্তি অলৌকিকতায় বিশ্বাসী হন, তিনি সবকিছুর মধ্যেই বিশেষ কিছু বা অলৌকিক কিছু দেখতে চান, যা প্রকৃতপক্ষে সেখানে অনুপস্থিত।

‘দ্য সেলফ ইলিউশন: হাউ দ্য সোশ্যাল ব্রেইন ক্রিয়েটস আইডেনটিটি’ বইয়ের লেখক ব্রুস হুড বিবিসিকে বলেন, একবার যখন কেউ টোস্টে মাতা মেরি বা চিকেন নাগেটে জর্জ ওয়াশিংটনকে আবিষ্কার করে ফেলেন, তখন আর তাঁর দৃষ্টি থেকে সেই চিত্র সরানো কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। মানে কেউ না দেখলেও টোস্ট বা নাগেটের গায়ে বারবার তিনি ওই অবয়বই দেখবেন।

হুড আরও বলেন, কেউ কেউ এই ঘটনাগুলোকে অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ঘটনার প্রমাণ বলে বিশ্বাস করতে পারেন। আর এ কারণেই এটি কখনো কখনো হয়ে ওঠে লাভজনক বাণিজ্য!

সোজা কথায়, প্যারেডোলিয়া হলো এমন ঘটনা, যখন মানুষ এলোমেলো বিশৃঙ্খল প্যাটার্ন, চিত্র, রেখা বা অমৃণ পৃষ্ঠের মধ্যে অর্থপূর্ণ ও নির্দিষ্ট কিছু আবিষ্কার করে ফেলে। বাংলাদেশে বেগুন বা মাংসের গায়ে আল্লাহর নাম খুঁজে পাওয়াও এই প্যারেডোলিয়ারই অংশ। 

লাইভ সায়েন্স বলছে, কেবল চিত্র বা মুখাবয়ব নয়, প্যারেডোলিয়া শ্রবণের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। একে ‘অডিও প্যারেডোলিয়া’ বলা হয়। এ ক্ষেত্রে একজন মানুষ কোনো সুগঠিত বাক্য, গান বা এলোমেলো শব্দের মধ্যে এমন কিছু শোনে, যা আদতে সেখানে ছিল না। এটা হতে পারে বাক্যের ভুল ব্যাখ্যার কারণে অথবা বিশৃঙ্খলার মধ্যে শোনার কারণে। 

অডিও প্যারেডোলিয়ার ক্ষেত্রে মানব মস্তিষ্ক বুঝতে না পারা শব্দের জন্য স্বীকৃত কোনো প্যাটার্নের অনুসন্ধান করে, নিকটতম মিল খুঁজতে থাকে এবং এসবের ভিত্তিতে বার্তা তৈরি করে। এর ফলে ওই ব্যক্তি এক সময় অদ্ভুত ও উদ্ভট সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। মোরগের ডাকের মধ্যে ‘আল্লাহ’ খুঁজে পাওয়াকে এই অডিও প্যারেডোলিয়া দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

কাদের ক্ষেত্রে এমন বেশি ঘটে?

দ্বিমাসিক পিয়ার–রিভিউড বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা অ্যাপ্লায়েড কগনিটিভ সাইকোলজিতে ২০১২ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ধার্মিক বা অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী মানুষের প্যারেডোলিয়ার অভিজ্ঞতা বেশি হয়। স্নায়বিকভাবে দুর্বল মানুষেরও এমন হয়। এর কারণ হিসেবে মনে করা হয়, এ ধরনের মানুষ বিপদের আশঙ্কায় সতর্ক থাকে বেশি। এ ছাড়া প্যারেডোলিয়ার অভিজ্ঞতা পুরুষদের তুলনায় নারীদের সাধারণত বেশি হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আজকের পত্রিকার নামে ছড়িয়ে পড়া এই ফটোকার্ডটি ভুয়া

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৯: ২১
আজকের পত্রিকার নামে ছড়িয়ে পড়া এই ফটোকার্ডটি ভুয়া

সম্প্রতি আজকের পত্রিকার নাম ও ফটোকার্ড ব্যবহার করে ‘হরেকৃষ্ণ হরিবোল, দাঁড়িপাল্লা টেনে তোলঃ পরওয়ার’ শিরোনামে একটি ভুয়া ফটোকার্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি একটি সম্পূর্ণ ভুয়া ফটোকার্ড।

আজকের পত্রিকা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করছে, এই ধরনের কোনো খবর আজকের পত্রিকাতে কখনোই প্রকাশিত হয়নি। ফটোকার্ডটিতে আজকের পত্রিকার লোগো ব্যবহার করা হলেও এর ভেতরের খবর ও শিরোনাম সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।

আজকের পত্রিকা সর্বদা সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

বর্তমান সময়ে এ ধরনের ভুয়া ফটোকার্ড ও খবর নিয়ে পাঠকদের সচেতনতা জরুরি। যেকোনো সন্দেহজনক খবর যাচাই করার জন্য অনুরোধ রইল।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ফ্যাক্টচেক /মধ্যরাতে মাঝরাস্তায় বাঘকে মদ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে মাতাল—ভাইরাল ভিডিওটি ফেক

ফ্যাক্টচেক  ডেস্ক
আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০২৫, ১৪: ২৫
মধ্যরাতে মাঝরাস্তায় বাঘকে মদ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে মাতাল—ভাইরাল ভিডিওটি ফেক

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্প্রতি ভাইরাল একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, রাতে রাস্তার মাঝখানে এক মধ্যবয়সী ব্যক্তি এক হাতে একটি স্বচ্ছ বোতল, অপর হাতে বাঘের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এমনকি বাঘটির মুখে বোতল গুঁজে দিতেও দেখা যায় তাঁকে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে এই ভিডিও শেয়ার করে দাবি করছেন, একটি সিসিটিভি ফুটেজ। ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ঘটনাটি ভারতের মধ্যপ্রদেশের পেঞ্চ এলাকার। ওই ব্যক্তি দেশীয় মদ পান করে মাতাল হয়ে রাস্তায় বেরিয়েছিলেন। তিনি এতটা মাতাল ছিলেন যে বাঘকেও মদ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। বাঘ অবশ্য তাঁর হাতে মদ্যপানে রাজি হয়নি! পরে ওই বাঘটিকে উদ্ধার করে বন বিভাগ। বাঘটি ওই ব্যক্তির কোনো ক্ষতি করেনি।

বাঘকে বোতল থেকে মদ খাওয়ার দাবি করা ভিডিওর ক্যাপশন, যেখান থেকেই গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ছবি: সংগৃহীত
বাঘকে বোতল থেকে মদ খাওয়ার দাবি করা ভিডিওর ক্যাপশন, যেখান থেকেই গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ছবি: সংগৃহীত

ভিডিওটি দেখে অনেকেই বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন—কেউ বিশ্বাস করেছেন, এটি বাস্তব কোনো ঘটনা; কেউ আবার মনে করছেন, এটি নিছকই কৃত্রিম ভিডিও। কিন্তু সত্যিটা কী? দ্য কুইন্টের সাংবাদিক অভিষেক আনন্দ ও ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা বুম বিষয়টি অনুসন্ধান করে প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করেছে।

বুম ভিডিওটি নিয়ে বিভিন্ন কিওয়ার্ড দিয়ে এ-সম্পর্কিত প্রতিবেদন অনুসন্ধান করেছে, কিন্তু কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে এমন ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। এরপর তারা সরাসরি মধ্যপ্রদেশের সেওনি জেলার পুলিশ কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করে। দ্য কুইন্ট ও বুমকে সেওনি জেলার পুলিশ সুপারের দপ্তর থেকে স্পষ্ট জানানো হয়—তাদের জানামতে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।

পেঞ্চ টাইগার রিজার্ভের উপপরিচালক রাজনীশ সিংহের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি যাচাই করা হয়। তিনি বলেন, ভিডিওটির সঙ্গে পেঞ্চ এলাকার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি আরও ব্যাখ্যা দেন, বনের বাঘের সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠভাবে মানুষের যোগাযোগ সম্ভব নয়, যদি না বাঘটিকে বন্দী করে দীর্ঘদিন ধরে পোষ মানানো হয়। তাঁর ভাষায়, ‘বনের বাঘ কখনো এমন আচরণ করে না, এটা বাস্তবে সম্ভব নয়।’

ভিডিওর সন্দেহজনক দিক বা ভিজ্যুয়াল অসংগতি

বুম ভিডিওটির একটি উচ্চমানের সংস্করণ সংগ্রহ করে তাতে কিছু অস্বাভাবিক দিক লক্ষ করে। দেখা যায়, ভিডিওটির পটভূমির দৃশ্যে কিছু অস্পষ্ট বস্তু নড়াচড়া করছে, যা বাস্তব ভিডিওর মতো স্বাভাবিক নয়।

বাঘের মাথায় হাত রাখা ব্যক্তির আঙুলগুলো বিকৃতভাবে বাঁকানো, যেন সফটওয়্যারে তৈরি কৃত্রিম ছায়া। এমনকি হাতে থাকা বোতলের মুখ কখনো দেখা যায়, আবার মিলিয়ে যায়—এই ভিজ্যুয়াল অসংগতিগুলো ইঙ্গিত দেয়, এটি ধারণকৃত কোনো ফুটেজ নয়। সব মিলিয়ে ভিডিওটির একাধিক ফ্রেমে গ্রাফিক বিকৃতি স্পষ্ট।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর বিশ্লেষণ

এরপর ভিডিওটি পরীক্ষা করা হয় ডিপফেক-ও-মিটার নামের একটি উন্নত টুলে। এটি তৈরি করেছে ইউনিভার্সিটি অব বাফেলোর মিডিয়া ফরেনসিকস ল্যাব। এই টুল ভিডিওটির বিভিন্ন অংশ বিশ্লেষণ করে দেখায়, এতে ‘উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক নির্মাণের চিহ্ন’ রয়েছে।

এআই টুল দিয়ে ভিডিওটির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি হওয়ার প্রমাণ পরীক্ষার ফলাফল। ছবি: সংগৃহীত
এআই টুল দিয়ে ভিডিওটির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি হওয়ার প্রমাণ পরীক্ষার ফলাফল। ছবি: সংগৃহীত

এরপর বুম তাদের অংশীদার ডিপফেক অ্যানালাইসিস ইউনিটের সাহায্য নেয়। তারা ভিডিওটি পরীক্ষা করে ‘Is It AI’ এবং ‘AI Or Not’—নামক দুটি আলাদা টুলে। উভয় টুলের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভিডিওটি এআই দিয়ে নির্মিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৬৯ শতাংশ।

এই ফলাফল অনুযায়ী বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভিডিওর মানুষের সঙ্গে প্রাণীর মিথস্ক্রিয়া এবং আলো-ছায়ার ত্রুটি স্পষ্ট করে দিচ্ছে এটি আসল নয়, বরং জেনারেটিভ এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বানানো একটি দৃশ্য।

ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর বহু ব্যবহারকারী এটিকে সত্যি বলে বিশ্বাস করেছেন। কিছু পোস্টে দাবি করা হয়েছে, ভিডিওর ওই ব্যক্তির নাম রাজু পাতিল। ৫২ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি একজন দিনমজুর। তিনি নেশাগ্রস্ত অবস্থায় রাস্তায় বাঘটিকে আদর করছিলেন এবং আশ্চর্যজনকভাবে অক্ষত অবস্থায় রয়ে গেছেন।

একাধিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শনাক্তকরণ টুলের ফলাফল এবং প্রশাসনিক যাচাই মিলিয়ে নিশ্চিতভাবে বলা যায়—ভিডিওটি বাস্তব নয়, বরং এআই প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি একটি কৃত্রিম দৃশ্য। পেঞ্চ টাইগার রিজার্ভের উপপরিচালক রাজনীশ সিংহও সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এই ভিডিওর কোনো অংশই পেঞ্চের নয়। এটি সম্পূর্ণ ভুয়া।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পাকিস্তানি জেনারেলকে ‘ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলযুক্ত বাংলাদেশের পতাকা উপহারে’র দাবি নিয়ে যা বলল সিএ ফ্যাক্ট চেক

ফ্যাক্টচেক  ডেস্ক
ছবি : সিএ ফ্যাক্ট চেকিং
ছবি : সিএ ফ্যাক্ট চেকিং

বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পাকিস্তানের যৌথবাহিনীর চেয়ারম্যানকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল যুক্ত বাংলাদেশের মানচিত্রসংবলিত পতাকা উপহার দিয়েছেন বলে ভারতের সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের দাবি সম্পূর্ণ অসত্য ও কল্পনাপ্রসূত বলে জানিয়েছে সিএ (প্রধান উপদেষ্টা) ফ্যাক্ট চেক।

ভারতের সংবাদমাধ্যমটি গতকাল এক প্রতিবেদনে দাবি করে, পাকিস্তানের যৌথবাহিনীর চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জাকে এমন একটি পতাকা উপহার দিয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস, যেখানে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বাংলাদেশের মানচিত্রের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।

সিএ ফ্যাক্ট চেক জানায়, প্রকৃতপক্ষে অধ্যাপক ইউনূস উপহার দিয়েছেন ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ নামে একটি চিত্রসংকলন—যেখানে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের আঁকা রঙিন গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র সংকলিত হয়েছে।

‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন প্রকাশিত একটি সচিত্র দলিল, যেখানে ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগে অর্জিত বিপ্লবের ইতিহাস ফুটে উঠেছে।

গ্রাফিতি সংকলনের প্রচ্ছদে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ আবু সাইদের পিছনে রক্তরাঙ্গা বাংলাদেশের মানচিত্র প্রদর্শিত হয়েছে।

প্রচ্ছদে দৃশ্যমান মানচিত্রটি গ্রাফিতি হিসেবে অঙ্কিত হওয়ায় বাংলাদেশের মূল মানচিত্রের পরিমাপের কিছুটা হেরফের হয়েছে বলে কারো কাছে মনে হতে পারে। কিন্তু ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের কোনো অংশ গ্রাফিতি মানচিত্রটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে দাবি করাটা সম্পূর্ণ অসত্য এবং কল্পনাপ্রসূত। বাংলাদেশের মানচিত্রের সাথে উল্লেখিত গ্রাফিতিতে দৃশ্যমান মানচিত্রের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, অঙ্কিত মানচিত্রটিতে বাংলাদেশের প্রকৃত মানচিত্র প্রায় হুবহুভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা এর আগেও একই গ্রাফিতি সংকলন ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ জাতিসংঘের মহাসচিব, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোসহ বিশ্ব নেতাদের উপহার দিয়েছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ফ্যাক্টচেক /অরকার আক্রমণে তরুণী প্রশিক্ষকের মৃত্যু, ভাইরাল ভিডিওটি সম্পর্কে যা জানা গেল

ফ্যাক্টচেক  ডেস্ক
আপডেট : ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ১৬: ৫০
ভাইরাল ভিডিওটির দৃশ্য। ছবি: স্ক্রিনশট
ভাইরাল ভিডিওটির দৃশ্য। ছবি: স্ক্রিনশট

একটি মেরিন পার্কে এক নারী প্রশিক্ষককে চুবিয়ে হত্যা করেছে অরকা বা কিলার তিমি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। মর্মান্তিক ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওতে দাবি করা হয়, প্যাসিফিক ব্লু মেরিন পার্কে ‘জেসিকা র‍্যাডক্লিফ’ নামে একজন প্রশিক্ষককে একটি অরকা আক্রমণ করে হত্যা করেছে।

ভিডিওটি টিকটক, ফেসবুক এবং এক্সে ভাইরাল হয়েছে। তবে, একাধিক ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা নিশ্চিত করেছে যে, এই ভিডিওটি সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।

ভিডিওতে যা দেখানো হয়েছে

ভাইরাল হওয়া ক্লিপটিতে দেখা যায়, একজন তরুণী একটি অরকার পিঠে দাঁড়িয়ে নাচছেন। দর্শকেরা তখন উল্লাস করছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর হঠাৎ অরকাটি ওই তরুণীকে আক্রমণ করে পানির নিচে টেনে নিয়ে যায়। ভিডিওটি শেয়ার করা অনেক ব্যবহারকারী দাবি করেছেন, পানির নিচে নিয়ে যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওই তরুণীর মৃত্যু হয়।

ঘটনা বা প্রশিক্ষকের কোনো প্রমাণ নেই

ভিডিওটি ব্যাপকভাবে শেয়ার হওয়া সত্ত্বেও, জেসিকা র‍্যাডক্লিফ নামে একজন প্রশিক্ষক অরকার আক্রমণে মারা গেছেন—এই দাবির পক্ষে কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কর্তৃপক্ষ, মেরিন পার্ক এবং প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমগুলো জেসিকা র‍্যাডক্লিফের অস্তিত্ব বা এমন কোনো ঘটনার রেকর্ড খুঁজে পায়নি। দ্য স্টার পত্রিকার মতে, ভিডিওটি কাল্পনিক; এমনকি ভিডিওতে থাকা কণ্ঠস্বরগুলোও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তৈরি বলে মনে করা হচ্ছে।

অন্যান্য প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এমন দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সাধারণত যে ধরনের আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়, এই ঘটনায় তার কোনোটিই পাওয়া যায়নি। ফরেনসিক বিশ্লেষণ অনুসারে, ভিডিওর মধ্যে পানির অস্বাভাবিক গতিবিধি এবং অদ্ভুত বিরতিও নিশ্চিত করে যে এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। এমনকি ভিডিওতে যে পার্কের নাম বলা হয়েছে, সেটিও ভুয়া।

এক্স-এ ছড়িয়ে পড়া ভিডিও। ছবি: স্ক্রিনশট
এক্স-এ ছড়িয়ে পড়া ভিডিও। ছবি: স্ক্রিনশট

সম্পূর্ণভাবে এআই-নির্মিত

ফোর্বস ম্যাগাজিন ক্লিপটিকে ‘একটি প্রতারণা’ বলে চিহ্নিত করেছে। তারা উল্লেখ করেছে, এমন একটি মর্মান্তিক ঘটনা যদি সত্যিই ঘটতো, তাহলে তা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হতো। ভিডিওর দৃশ্য এবং শব্দ সম্ভবত চাঞ্চল্যকর প্রভাব তৈরির জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা টুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। দ্য ইকোনমিক টাইমস উল্লেখ করেছে, এই গল্পের চরিত্র এবং নাম কোনো যাচাইযোগ্য রেকর্ডের সঙ্গে মেলে না। ফলে বলা যেতে পারে যে, পুরো গল্পটি বানোয়াট।

সত্যিকারের দুর্ঘটনার সঙ্গে মিল

এই ধরনের প্রতারণামূলক ভিডিওগুলোতে কিছুটা সত্যের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করা হয়। ভিডিওটি ২০১০ সালে সি ওয়ার্ল্ডে ডন ব্রাঞ্চেউ এবং ২০০৯ সালে অ্যালেক্সিস মার্টিনেজ-এর বাস্তব জীবনের মৃত্যুর ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয়। উভয় প্রশিক্ষকই অরকার আক্রমণে মারা যান। কিন্তু এই ঘটনাগুলো জেসিকা র‍্যাডক্লিফের গল্পের মতো নয়, কারণ সেগুলো নথিভুক্ত এবং কর্তৃপক্ষের তরফে নিশ্চিত করা হয়েছে।

কেন এই ধরনের প্রতারণা ভাইরাল হয়

বিশেষজ্ঞরা বলেন, একটি ভিডিওর আবেগপূর্ণ তীব্রতা এবং বাস্তবসম্মত উৎপাদন কৌশল এটি ভাইরাল হতে সাহায্য করে। এই ধরনের ক্লিপগুলো বুদ্ধিমান সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বন্দী করে রাখার নৈতিকতা নিয়ে মানুষের গভীর উদ্বেগগুলোকে কাজে লাগায়। একই সঙ্গে, এগুলো চাঞ্চল্যকর বিষয়বস্তু ব্যবহার করে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ফ্যাক্টচেকিং হলেও ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়।

কথিত জেসিকা র‍্যাডক্লিফকে নিয়ে অরকার আক্রমণের ভিডিওটি একটি সম্পূর্ণ বানোয়াট। এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। এই নামে কোনো প্রশিক্ষকের অস্তিত্বেরও কোনো প্রমাণ নেই।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত