Ajker Patrika

ভারতীয় পণ্য বয়কটে পুষ্টিহীনতায় বাংলাদেশিরা! ভারতীয় মিডিয়ায় বিভ্রান্তিকর প্রচার 

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
আপডেট : ১৮ মে ২০২৪, ২০: ১২
ভারতীয় পণ্য বয়কটে পুষ্টিহীনতায় বাংলাদেশিরা! ভারতীয় মিডিয়ায় বিভ্রান্তিকর প্রচার 

চলতি বছরের শুরুতেই বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে ভারতের হস্তক্ষেপের অভিযোগ এনে দেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দিয়ে শুরু হয় ‘ইন্ডিয়া আউট’ বা ভারতীয় পণ্য বয়কটের ক্যাম্পেইন। সোশ্যাল মিডিয়া ছেড়ে এই ক্যাম্পেইন জায়গা করে নিয়েছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও। সম্প্রতি এই ক্যাম্পেইন ঘিরেই ‘হিন্দুস্তানকে বয়কটের ফল, ৭৩% বাংলাদেশি পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে না’—এমন শিরোনামে একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতের টিভি নেটওয়ার্কের মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যম আজতক। 

সংবাদমাধ্যমটির ইউটিউব চ্যানেলে ১ মে (বুধবার) প্রতিবেদনটি পোস্ট করা হয়। প্রতিবেদনটি আজ শনিবার (১৮ মে) বিকেল ৪টা পর্যন্ত দেখা হয়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার বার। কমেন্ট হয়েছে দেড় হাজারের কাছাকাছি। এসব কমেন্টে ভারতের নাগরিকেরা বাংলাদেশিদের নিয়ে একই সঙ্গে ধর্মীয় ও বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করেছেন। 

পলাশ দে নামে একজন লিখেছেন, ‘বয়কটের সফলতা কামনা করি, বাংলাদেশিদের এমনটি হওয়া উচিত। ওদের দুরবস্থার কারণ ওঁরা নিজেই। ভারতের তরফে ওদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করলে বেশি ভালো হতো।’ কুনাল বসাক নামে আরেকজন লিখেছেন, ‘এই আপদগুলো পৃথিবীর বোঝা, এরা মরলেও ভারতের কিছু যায় আসে না।’ 

প্রকাশ সাহা লিখেছেন, ‘দেশটার নাম বাংলাদেশ! যে দেশের ৯০ ভাগ লোকের নাম বাংলাভাষায় নয়, তাদের দেশের নাম বাংলাদেশ। এদের দেশের শিক্ষিত মহল এটা নিয়ে কিছু ভেবেছেন কথনও? দেশটার নাম মানুষের নামের সঙ্গে সংগতি রেখে করা উচিত নয় কি?’ (মন্তব্যগুলোর বানান ও ভাষা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে)। কমেন্টবক্সে বাংলাদেশি নাগরিকেরাও এই প্রতিবেদনের বিরোধিতা করে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। ভিডিও প্রতিবেদনটি নিয়ে আলোচনা, বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে এক্স (সাবেক টুইটার), ফেসবুকেও। 

যেমন, ‘বয়কট ইন্ডিয়ান প্রোডাক্টস’ নামের প্রায় এক লাখ সদস্যের ফেসবুক গ্রুপে ১১ মে (শনিবার) আজতকের প্রতিবেদনটির থাম্বনেইল পোস্ট করে ক্যাপশনে লেখা হয়, ‘বয়কটের ফলে যে ভারতের পুচ্ছে আগুন ধরে যাচ্ছে, সেটা ওদের মিডিয়ার খবরই প্রমাণ করে। ভারত বয়কটের ফলে নাকি ৭৩% বাংলাদেশি পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে না। তার মানে হলো—ভারতের মিডিয়া পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিয়েছে যে বাংলাদেশের ৭৩% মানুষ ইতিমধ্যে ভারতীয় পণ্য বয়কট করেছে। তাই সবাই ভারত বয়কট কর্মসূচি চালিয়ে যান। বিজয় আমাদেরই হবে ইনশা আল্লাহ।’ 

আবার এক্সে ‘Sanghi (Modi ka parivaar)’ নামের অ্যাকাউন্ট থেকে থাম্বনেইলটি টুইট করে লেখা হয়, ‘এমনি কি কই কাঙ্গালদেশ (Emni ki koi kangaldesh).’ 

কী আছে আজতকের প্রতিবেদনে? 

৫ মিনিট ১৫ সেকেন্ডের ভিডিওটি প্রতিবেদনটির শুরুতেই উপস্থাপিকা দাবি করেন, সম্প্রতি ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দেয় বাংলাদেশ। আর এবার সামনে উঠে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য। ৭৩ শতাংশ বাংলাদেশি পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছেন না। পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন বাংলাদেশের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ। কৃষি এবং পুষ্টি খাতে অর্থায়ন শীর্ষক একটি আলোচনা সভায় উঠে এসেছে এই উদ্বেগজনক ছবি। এও বলা হয় বাংলাদেশের ২২ শতাংশ মানুষ মাঝারি থেকে শুরু করে চরম খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি। প্রতিবেদনটিতে আরও দাবি করা হয়, এই বয়কট আন্দোলনের পেছনে পরোক্ষ মদদ রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের কয়েকটি কট্টরপন্থী দলের।

ভারতের পণ্য বয়কট ক্যাম্পেইনের ফলে আসলেই কী পুষ্টিহীনতার সম্মুখীন হচ্ছেন বাংলাদেশিরা?

আজতকের প্রতিবেদনে বিভ্রান্ত ফেসবুক ব্যবহারকারীরাআজতক বাংলার পুরো প্রতিবেদনটি শুনে ভারতের পণ্য বয়কটের সঙ্গে বাংলদেশিদের পুষ্টিহীনতায় ভোগার তথ্যটির কোনো যোগসূত্র পাওয়া যায়নি। তবে উপস্থাপিকা বাংলাদেশিদের পুষ্টিহীনতায় ভোগার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে একটি সমীক্ষার (কাদের সমীক্ষা উল্লেখ করেননি) বরাত দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের ৩৬ শতাংশ মানুষ খর্বাকার, ৭৩ শতাংশ মানুষ খাবার পান না। তাই এখনই সতর্ক না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে...। 

উপস্থাপিকা এরপর খাদ্যের অনিশ্চয়তার ভয়াবহতা তুলে ধরতে ২০১২ সালের বাংলাদেশিদের রক্ত স্বল্পতায় ভোগার চিত্র সামনে আনেন। তিনি দাবি করেন, ওই বছর রক্ত স্বল্পতায় ভুগতেন বাংলাদেশের ৩৫ শতাংশ মানুষ। ২০১৯ সালে এসে এটি এক শতাংশ বেড়ে যায়। এসব তথ্য উপস্থাপনের পরেই উপস্থাপিকা বলেন, বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন চলছে প্রায় সাড়ে তিন মাস। 

আজতকের প্রতিবেদনে উল্লিখিত এসব তথ্যের ভিত্তি সম্পর্কে যাচাইয়ে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানে দেশীয় সংবাদমাধ্যম ঢাকা পোস্টে গত ৩০ এপ্রিল ‘৭৩ শতাংশ মানুষ পুষ্টিকর খাবার পায় না’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। 

এ থেকে জানা যায়, গত ২৯ এপ্রিল বরিশালের একটি হোটেলে পুষ্টি খাতে অর্থায়ন শীর্ষক সংলাপে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. নাসিরুজ্জামান বলেন, জরিপ অনুযায়ী দেশের ৩৬ শতাংশ মানুষ খর্বাকার। ৭৩ শতাংশ মানুষ পুষ্টিকর খাবার পায় না। 

যাচাইয়ে দেখা যায়, আজতক বাংলার ভিডিওটি প্রতিবেদনটি মূলত এই সংলাপের আলোচনার ভিত্তিতেই তৈরি। তবে এ সংলাপে আলোচিত তথ্যগুলোর ভিত্তি অন্তত দুই বছরের পুরোনো। ২০২২ সালে ‘বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি’ শিরোনামে একটি যৌথ প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন সংস্থা (ইফাদ), ইউনিসেফ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এতে বলা হয়, ২০২০ সালে বাংলাদেশে পুষ্টিকর খাবার কিনতে অক্ষম মানুষের হার ছিল ৭৩.৫ শতাংশ। একই বছর ভারতে এমন মানুষের হার ছিল ৭০.৫ শতাংশ। 

অর্থাৎ আজতকের প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় চলমান ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইনটি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ২০১২, ২০১৯ ও ২০২০ সালের কিছু তথ্য সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। যার সঙ্গে ভারতীয় পণ্য বয়কট ক্যাম্পেইনের কোনো যোগসূত্রই নেই।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

নতুন মেট্রো নয়, রুট বাড়ানোর চিন্তা

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত