Ajker Patrika

বিভক্তিই তাহলে ভবিতব্য!

অরুণ কর্মকার
বিভক্তিই তাহলে ভবিতব্য!

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কয়েক দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গিয়েছিলেন জুলাই-আগস্টের বিপ্লবী ছাত্র-তরুণদের আঁকা গ্রাফিতি দেখতে। সেখানকার দেয়ালে দেয়ালে অসংখ্য গ্রাফিতি আঁকা রয়েছে, যেগুলোতে ওই আন্দোলনের মৌলিক দর্শন ও মূল লক্ষ্য সম্পর্কে ছাত্র-জনতার মনের কথা ব্যক্ত হয়েছে। জনপ্রিয় এই গ্রাফিতিগুলো নিয়ে ‘দি আর্ট অব ট্রায়াম্প’ শিরোনামে একটি আর্টবুকও ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। গ্রাফিতিগুলোর মধ্যে সামাজিকমাধ্যমে একটি গ্রাফিতি একটু বেশিই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাতে বলা হয়েছে ‘আমি তুমি আমরা সবাই।’ অর্থাৎ সবাই মিলে, সবাইকে নিয়ে, এক লক্ষ্যে এগিয়ে চলা। সমাজে এবং রাষ্ট্রে সকলের অন্তর্ভুক্তি।

জুলাই-আগস্টের অভূতপূর্ব ছাত্র-গণ-অভুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে যে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, তার পেছনে রয়েছে আন্দোলনের এই দর্শন। এই দর্শনই সবাইকে রাজপথে এক সারিতে মিলিয়ে দিয়েছিল।

লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে হলেও আন্দোলনকে সফল করার প্রেরণা জুগিয়েছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রায় আড়াই মাস পর, এখন আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে, জুলাই-আগস্টের ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থান অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার যে অপূর্ব সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল, তা বোধ হয় অধরাই থেকে যাবে। এই মনে হওয়াটা শুধু আমার একার নয়। আলোচনা করে দেখেছি, একই রকম ধারণা অনেকের এবং অসংখ্য মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছে, যাঁরা কোনো না কোনোভাবে জুলাই-আগস্টের ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছেন এবং যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে সমর্থন জুগিয়েছেন।

কী কারণে এই ধারণার সৃষ্টি হলো তা ব্যাখ্যা করা দরকার। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের ঘোষিত ও প্রতিপালিত ৮টি জাতীয় দিবসের মর্যাদা অবনমিত করেছে এবং ওই দিবসগুলোতে সরকারি ছুটি বাতিল ঘোষণা করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ওই দিবসগুলো শেখ হাসিনার পবিবারকেন্দ্রিক অথবা আওয়ামী লীগের নিজস্ব। তাই এগুলো জাতীয় দিবসের মর্যাদা পেতে পারে না। ওই ৮টি দিবসের মধ্যে ৭ মার্চ এবং ১৫ আগস্টও রয়েছে। এই ‍দুটি দিবসের বিষয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন।

৭ মার্চ কী কারণে ঐতিহাসিক, এ কথা সবাই জানেন। দীর্ঘ ২৩-২৪ বছর পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির ধারাবাহিক স্বাধীনতাসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে যখন মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া সব বিকল্পের সম্ভাবনা তিরোহিত, সেই পরিস্থিতিতে একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে যে ভাষণ দেন তা কি তিনি শেখ হাসিনার পিতা হিসেবে দিয়েছিলেন! কিংবা সেই ভাষণ কি দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে? বাঙালির দীর্ঘ স্বাধীনতাসংগ্রামের ধারায় পর্যায়ক্রমে মুজিব তাঁর পারিবারিক এবং দলীয় পরিচয়ের গণ্ডি অতিক্রম করে কি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেননি? তাহলে ৭ মার্চ কীভাবে শেখ হাসিনার পারিবারিক কিংবা আওয়ামী লীগের দলীয় বিষয় হয়?

একাত্তরে যে কিশোর-তরুণ, শ্রমজীবী-কৃষক, যে সেনা কর্মকর্তা, সৈনিক-সিপাই, আমলা এবং শ্রেণি-পেশানির্বিশেষে এ দেশের আপামর মানুষ ৭ মার্চের ভাষণ শুনে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা কি শেখ হাসিনার বাবার ভাষণ শুনে গিয়েছিলেন? নাকি আওয়ামী লীগের সভাপতির ভাষণ শুনে? সবাই জানেন, এর কোনোটাই নয়। বাংলাদেশের অগণিত মানুষ ৭ মার্চকে শেখ হাসিনার পারিবারিক কিংবা আওয়ামী লীগের দলীয় বিষয়ের ঊর্ধ্বে স্থান দেন এবং সেটা দেন তাঁদের অন্তরের বিশ্বাস থেকে। তাঁরা কোনো দিন কোনোভাবেই ৭ মার্চ সম্পর্কে অন্তর্বর্তী সরকারের বয়ান গ্রহণ করবেন না, যেমন গ্রহণ করেননি ওই দিবসগুলো সম্পর্কে আওয়ামী লীগের তথা শেখ হাসিনার বয়ানও। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের ওই বয়ান জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের দৃঢ় সমর্থক একটি জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করার পরিবর্তে চিরকালের মতো বিভক্ত করে দিল। এই বিভক্তি কখনোই ঘুচবে বলে মনে হয় না।

একইভাবে ১৫ আগস্ট কী করে শেখ হাসিনার পারিবারিক কিংবা আওয়ামী লীগের দলীয় বিষয় হতে পারে? সেদিন কি দেশের রাষ্ট্রপতিকে খুন করা হয়নি? সেদিন কি দেশের রাষ্ট্রপতির পরিবারবর্গকে খুন করা হয়নি? খুন করা হয়েছে আওয়ামী লীগের সভাপতিকে? খুন করা হয়েছে শেখ হাসিনার বাপ-মা, ভাই, আত্মীয়-স্বজনদের? এই বয়ানও গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না। যেমন হয়নি এ সম্পর্কে শেখ হাসিনার অতিনাটকীয় স্পর্শকাতরতাও। অর্থাৎ এ বিষয়েও অন্তর্ভুক্তি হলো না। হলো বিভক্তি। অথচ অন্তর্ভুক্তি হতে পারত। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়েই অন্তর্ভুক্তি হতে পারত। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃস্থানীয়রা যেমন একাধিকবার বলেছেন, তাঁদের পথচলা একাত্তরকে অস্বীকার করে কিংবা নাকচ করে দিয়ে নয়। এটাই হতে পারত ‘মাইনাস আওয়ামী লীগ’ সামাজিক-রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরণের কার্যকর কৌশল।

এ কথা ঠিক যে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনামল, একাত্তর, পঁচাত্তর, অর্থাৎ ৭ মার্চ, ১৫ আগস্ট, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রভৃতি নিয়ে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার দৃষ্টিকটু এবং অপ্রয়োজনীয় রকম বাড়াবাড়ি করেছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকেই এগুলো করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সামাজিক সংগঠন-সমিতি সর্বত্র তারা দলীয়করণ করেছে ওই বয়ানের আড়ালে। এর মাধ্যমে তারা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের উপেক্ষা এবং অকার্যকর করতে চেয়েছে। তাদের অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তা আমলেই আনেনি। তাদের বয়ানের বাইরেও যে সমাজে আরও বয়ান আছে এবং সেগুলো বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন, সে কথা তারা বোধ হয় ভুলেই গিয়েছিল। সেটা ছিল তাদের আত্মঅহমিকা। এই ভূমিকার মাধ্যমে তারা রাষ্ট্রে এবং বিস্তৃত জনসমাজে একটা স্পষ্ট বিভক্তি সৃষ্টি করেছে।

আমরা এ কথাও সবাই জানি এবং মানি যে সেই বিভক্তিই আওয়ামী লীগকে, শেখ হাসিনার সরকারকে দেশের বিস্তৃত জনসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। অথচ তারা তাদের বয়ানের সাফল্য নিয়েই মনে মনে খুশি এবং মশগুল ছিল। তারা বুঝতেই পারেনি যে ধীরে ধীরে নীরবে-নিভৃতে তাদের পায়ের তলার মাটি সরে গেছে। ফলে জুলাই-আগস্টের ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত হয়েছে। এই অভ্যুত্থানে দেশের ব্যাপক জনসমাজ অংশ নিয়েছে, সমর্থন জুগিয়েছে। আজ আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে এই জনসমাজের মধ্যে এমন অসংখ্য মানুষ রয়েছেন যাঁরা ৭ মার্চ কিংবা ১৫ আগস্ট অথবা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি এবং সেখানে স্থাপিত জাদুঘর পুড়িয়ে দেওয়া সম্পর্কে অন্তর্বর্তী সরকারের বয়ানের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন না। অথচ তাঁরা জুলাই-আগস্টের ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থক। সুতরাং তাঁদেরকে বিভক্ত করে দেওয়া উচিত নয়।

এ কথা মনে রেখে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পদক্ষেপ নিতে পারলে ভালো হয় যে ভবিষ্যতে যদি কখনো আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান ঘটে, তাহলে এই বিভক্তিই তাদের সবচেয়ে বড় সুযোগ করে দেবে। এই বিভক্তিই তাদের সবচেয়ে বেশি সহায়তা করবে, কাজে লাগবে।

আর আওয়ামী লীগের সৃষ্ট সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিমুখী বিভক্তি ঘুচিয়ে সামাজিক-রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার যে অমিত সম্ভাবনা জুলাই-আগস্টের ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি করেছিল, তা কাজে লাগাতে না পারলে অতীতের মতো বিভক্তিই হবে আমাদের ভবিতব্য।

লেখক: জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

যুদ্ধের পর এ যেন এক নতুন ইরান, জনগণের মতো বদলে গেছে সরকারও

তেহরান ওপর থেকে সুন্দর, একদিন যেতে চাই: ইরানে বোমা ফেলা ইসরায়েলি পাইলট

ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের কথা ভাবছেন ট্রাম্প

সাইপ্রাসে বিপুল জমি কিনছে ইসরায়েলিরা, দেশ বেদখলের শঙ্কা রাজনীতিবিদদের

হোয়াটসঅ্যাপের ব্যবহার নিষিদ্ধ করল বিমান বাংলাদেশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত