Ajker Patrika

উচ্চাভিলাষী রাজস্বের ঝুঁকি থাকছে এবারের বাজেটে

ফারুক মেহেদী, ঢাকা
আপডেট : ০৭ জুন ২০২২, ১৩: ৩৩
উচ্চাভিলাষী রাজস্বের ঝুঁকি থাকছে এবারের বাজেটে

হাতে টাকা-পয়সা কম। তারপরও নতুন অর্থ বছরে সরকার অনেক বেশি খরচের পরিকল্পনা করছে। এ জন্য বড় অঙ্কের ধারের পাশাপাশি কর আদায়ের মাধ্যমে বাড়তি টাকা জোগাড়ের কথা ভাবা হচ্ছে। সুদ দিলে হয়তো ব্যাংক আর উন্নয়ন সহযোগীদের থেকে ধার পাওয়া যাবে। কর আদায় করে কাঙ্ক্ষিত টাকার সংস্থান করার বিষয়টিতে ঝুঁকি রয়েছে।

আসছে বাজেটে বড় অঙ্কের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ঠিক করা হলেও এ টাকা আদায়ের জন্য যে প্রস্তুতি, পরিকল্পনা বা কৌশল নেওয়ার কথা, তার কোনো রোডম্যাপ বা পথনকশা আসছে বাজেটে নেই বলে জানা গেছে। ফলে সরকারের উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যপূরণ নিয়ে এরই মধ্যে আশঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে।

দেশের ব্যবসায়ী ও রাজস্ব খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, যারা কর দিচ্ছেন, প্রতিবছর তাঁদেরই ধরছে এনবিআর। দেশে যে ছোট বড় অন্তত চার কোটি ব্যবসায়ী আছেন, তাঁদের করের আওতায় আনতে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপের কথা শোনা যাচ্ছে না। ফলে রাজস্ব আয়ের স্বপ্ন অধরাই থাকছে।

বাজেট ঘোষণার আর মাত্র দুদিন বাকি। এরই মধ্যে বাজেটের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ হয়ে গেছে। অর্থমন্ত্রী নিজেও বাজেটে কী কী পদক্ষেপ নেবেন তার সারমর্ম গণমাধ্যমে বলেছেন। তাতে জানা যায়, এবারের বাজেট আকারে চলতি বাজেটের থেকে প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ বড়। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এতে ব্যয় যেমন বেশি ধরা হচ্ছে, তেমনি আয়ের অঙ্কও বড়। রাজস্ব লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরেরই আয় করার কথা ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি অর্থ বছরের চেয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা বেশি। যদিও বর্তমান অর্থ বছরের রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে প্রথম ১০ মাসে ঘাটতি অন্তত ১ লাখ কোটি টাকা। এ অবস্থায় আগের লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে যোগ হচ্ছে আরও ৪০ হাজার কোটি টাকা।

এ বিষয়ে বাজেটের সঙ্গে জড়িত অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশ না করে তাঁরা জানান, এবারের বাজেটও গতানুগতিক ধারাই বজায় থাকছে। টাকার অঙ্ক বাড়ছে। তবে নিজস্ব উৎস থেকে যে টাকা আয় করার লক্ষ্য প্রস্তাব করা হবে, তা আদায়ে সংস্কারমূলক তেমন পদক্ষেপ থাকছে না বাজেটে।

এনবিআর সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা যে হারে বাড়ে, নতুন করদাতা সে হারে বাড়ে না। টিআইএনধারী করদাতা বাড়লেও প্রকৃত করদাতার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে না। বর্তমানে প্রায় ৭০ লাখ টিআইএনধারী করদাতার বিপরীতে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন মাত্র ২৫ লাখ করদাতা। ফলে টিআইএনধারী করদাতাদের রিটার্ন দেওয়ায় বাধ্য করায় যেমন ঢিলেমি আছে, তেমনি প্রতি বছর যারা কর দেন, তাদেরই টার্গেট করা হয়।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা মনে করি দেশে ছোট বড় অন্তত চার কোটি ব্যবসায়ী আছেন। ঘুরে ফিরে কর ভ্যাট দেন মাত্র ৪০ লাখ। বাকিরা দিচ্ছে না কেন? তাঁদের ধরা হচ্ছে না কেন? এখানে এনবিআর কী করছে? আমরা বারবার বলছি, যারা নিয়মিত কর দেয়, তাদের ওপর ছুরি না চালিয়ে, যারা কর দেয় না, তাদের ধরেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি ৪৬০টি উপজেলায় কর ও ভ্যাট অফিস করেন। গ্রামীণ অর্থনীতি যেভাবে বড় হচ্ছে, রাজধানীর অলিগলিতে যেভাবে ব্যবসার প্রসার ঘটেছে, সেভাবে কতজন কর দেয়? আমি তো মনে করি প্রতিটি ওয়ার্ডে কর অফিস করা উচিত। সদ্য পাশ করা শিক্ষিত বেকারদের চাকরি দিয়ে কর আদায়ে নামিয়ে দেন। রাস্তায় যে ব্যবসা করে, দিনে ৫-১০ হাজার টাকা ব্যবসা তারও আছে। তাকেও করের আওতায় আনেন।’

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, অর্থের সংস্থান করতে সরকারের ঘাটতির পরিমাণ যেন ৫ শতাংশের বেশি না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। মোট কথা রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। তবে তা করতে গিয়ে যেন গণহারে করের হার, ভ্যাট ও শুল্কের হার না বাড়ে। কারণ এমনিতেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। নতুন করে কর বাড়ালে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে যাবে। বেশি মনোযোগ দিতে হবে কর ও ভ্যাট আদায়ের দিকে। কারণ ব্যবসায়ীরা ঠিকমতো ভ্যাট দেয় না। ভ্যাট আদায় নিয়ে কিছু কর্মকর্তার অবহেলা ও দুর্নীতিও আছে। তিনি বলেন, ‘আমি সারা দেশে ৭ লাখ ইএফডি মেশিন বসানোর উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এত বছর পরও তা ঠিকমতো বাস্তবায়ন হয়নি।’

কর প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর তেমন পদক্ষেপ বাজেটে না থাকলেও জানা যায়, কিছু কিছু নতুন খাত থেকে বেশি করের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে ধনীদের থেকে একটু বেশি কর আদায় করা হবে। যাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১ কোটি বা তার চেয়েও বেশি টাকা আছে, তাদের ওপর আরও উচ্চ মাত্রায় আবগারি শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করছে সরকার। নতুন অর্থবছরে ডেবিট বা ক্রেডিট আকারে ১ থেকে ৫ কোটি টাকার স্থিতি আছে, এ রকম অ্যাকাউন্টের মালিকদের কাছ থেকে ব্যাংক বছরের যেকোনো সময় ১৮ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক কেটে নেবে। এ ছাড়া আসছে অর্থবছরে শুধু টিআইএন নয়; রিটার্নের সঙ্গে আগের অর্থবছরের রিটার্ন দাখিলের প্রত্যয়নপত্র জমা দেওয়া, বিলাসী পণ্যে বেশি শুল্ক বসানো, কিছু নতুন নতুন খাতে বাড়তি ভ্যাট আদায়ের কথা ভাবা হচ্ছে। বিদেশে পাচার করা কালোটাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে বিশেষ সুবিধার ঘোষণাও আসছে বাজেটে থাকতে পারে। যদিও থেকে কাঙ্ক্ষিত কর পাওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে।তবে বেশি সংখ্যক সক্ষম করদাতাকে করের জালে আনতে যেসব উদ্ভাবনী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তার পরিষ্কার দিক নির্দেশনা আসছে বাজেটে নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত