Ajker Patrika

অবন্তিকা ও মিম: মৃত ও জীবন্মৃত

তাপস মজুমদার
অবন্তিকা ও মিম: মৃত ও জীবন্মৃত

বিচারহীনতার সংস্কৃতি, জঘন্য অপরাধকে উৎসাহিত করার সংস্কৃতি—কে বা কারা তৈরি করে? একটির পর একটি ঘটনা ঘটে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। কজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? ব্যবস্থা নিলেও কর্তৃপক্ষ কি নিয়েছে? নাকি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নেওয়া হয়েছে?

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কাজী ফারজানা মিমের সাক্ষাৎকার দেখে মনে হলো কী বীভৎস সামাজিক চিত্র! কী মর্মান্তিক দুর্ভাগ্যবরণ তাঁর! তাঁর বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব ধ্বংস করে দিয়েছেন এক শিক্ষক। মেয়েটিকে ইনকোর্স পরীক্ষায় ৪০-এর মধ্যে দুটো শূন্য দেওয়া হয়েছে। এই প্রভাষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানও ক্ষুব্ধ হন মেয়েটির ওপর। তিনিও ইনকোর্স পরীক্ষায় এক শর মধ্যে তিন নম্বর দিয়েছেন। মিম যথার্থই বলেছেন—একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বনিম্ন যে যোগ্যতা নিয়ে একজন ছাত্র বা ছাত্রী ভর্তি হয়, সেই যোগ্যতায় তিনি কোনোভাবেই পরীক্ষায় শূন্য বা তিন পেতে পারেন না। শুধু তা-ই নয়, তাঁর চরিত্র নিয়ে শিক্ষকেরা কথা বলেছেন। সাংবাদিকদের প্রভাবিত করে এ বিষয়ে খবর ছাপা পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে। তাঁকে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন নারী বানাতে চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁকে ডিপার্টমেন্টে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে একা করে ফেলা হয়েছে। প্রতিবাদ করার জন্য অনার্সে তাঁকে ফেল করতে হলো। তাঁর পরিবারের কাছ থেকেও তিনি দূরে সরে গেছেন। তাঁর বন্ধুরা তাঁর সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলেন। অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে। তদন্তে ঘটনা প্রমাণিত হয়েছে। তারপর তিনি রিট করেছেন। হাইকোর্টে সেই রিটও খারিজ হয়ে গেছে। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এটাই কি আমার দেশ?

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অবন্তিকা আত্মহত্যা করেছেন। তাঁকে উৎপাত করার জন্য তিনি বাধ্য হয়েছেন এই মর্মান্তিক সিদ্ধান্ত নিতে। চোখের জল, দীর্ঘশ্বাস আর হতাশা নিয়ে তিনি নিজেকে আর বাঁচিয়ে রাখতে চাননি। যাওয়ার আগে তিনি সুইসাইড নোট লিখে গেছেন। তাঁর সহপাঠী আম্মান এবং সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে দায়ী করে গেছেন। তাঁরা দুজনই এখন কারান্তরে।

এ দেশের কমপক্ষে ২৬ শতাংশ মানুষ মানসিকভাবে পীড়িত (সেপিয়েন ল্যাবস-যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান)। অভিযোগ পেলে অভিযোগকারীর নিরাপত্তা প্রদানসহ তাঁর মানসিক সুস্থতার জন্য যেখানে অতিরিক্ত যত্নশীল হওয়া দরকার, ভুক্তভোগীকে কাউন্সেলিং করানো দরকার, সেখানে তা না করে উল্টো তাঁকে মানসিকভাবে পীড়ন করা হয়। এটাকে কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলা চলে না টর্চার সেল? দেশের প্রতিটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ঘটনা ঘটছে। মনে করার কোনো কারণ নেই যে অভিযোগ আসছে না বলে এসব ঘটনা ঘটছে না। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, অভিযোগ আসে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ। উত্থাপিত অভিযোগের একটা অংশ আবার ধামাচাপা পড়ে যায় নানান চাপে। পুরোনো অনেক ঘটনার হিসাব এখানে নাইবা আনলাম।

এসব ব্যাপারে ইউজিসির উদাসীনতাও লক্ষণীয়। সম্প্রতি বিচার না-পাওয়া একজন অভিভাবকের পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে ইউজিসি জানিয়েছে, যেহেতু আদালতে মামলা বিচারাধীন, সুতরাং তাদের কিছু করার নেই। অথচ উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী (২০০৯) অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিযুক্তকে সাময়িক বরখাস্ত করতে হবে।

মনে রাখতে হবে—একজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন, সেটাই যথেষ্ট। এরপর সব দায়দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের। ভুক্তভোগী যেন সম্পূর্ণ নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। মেয়েরা সাহসের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছেন। এটা অনেক বড় এবং ভালো দিক। আমরা বিশ্বাস করতে পারি, এ রকম ঘটনা গোপন থাকবে না; বরং সামনে আসবে। সেখান থেকেই বের হবে এর সমাধান-সূত্র।

এমন অবস্থায় আমাদের প্রাণান্ত দাবি—অবন্তিকার পরিবারকে নিরাপত্তাদানসহ কাউন্সেলিং করানোর ব্যবস্থা করা হোক। এ ব্যাপারে দায়ী শিক্ষক, ছাত্র এবং কর্তৃপক্ষ যাদের অবহেলা রয়েছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা হোক (প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য)। আদালতে যৌন হয়রানি-সংক্রান্ত বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক (একটি বিচার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপর্যুপরি তারিখ ফেলে বিচারকাজ ত্বরান্বিত করা যায় কি না, এটা ভেবে দেখা দরকার)। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র সবার মাইন্ডসেট পরিবর্তন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। পরিবার তথা সমাজ থেকে সব রকম বৈষম্য দূর করার উদ্যোগ নেওয়া হোক। যথাযথ প্যারেন্টিংয়ের মাধ্যমে পরের প্রজন্মকে তৈরি করার বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। উত্তম মানসিক স্বাস্থ্যের চর্চা ও সুরক্ষার দিকে নজর দেওয়া হোক। যেকোনো প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রশাসক বা নির্বাহী নিয়োগ করা হোক। যোগ্যতার প্রধান মাপকাঠি হবে সততা, দক্ষতা ও ভালো কাজ করার সাহস।

তবে এই মুহূর্তে মিমকে বাঁচান। সঙ্গে শত শত মিমকে চিহ্নিত করুন এবং বাঁচান। অত্যন্ত বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে অবন্তিকা এবং মিম দুজনই একই স্ট্যাটাসে আছেন। পার্থক্য শুধু এই, একজন মৃত এবং অপরজন জীবন্মৃত। আমরাই পারি দ্বিতীয়জনকে জীবন ফিরিয়ে দিতে।

তাপস মজুমদার, সাংস্কৃতিক সংগঠক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত