Ajker Patrika

ডলির খামারে পাল্টে গেছে একটি গ্রাম

শাইখ সিরাজ
ডলির খামারে পাল্টে গেছে একটি গ্রাম

গত শতাব্দীর সেই আশির দশকে যখন ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ তৈরি করতে ঘুরে বেড়াচ্ছি দেশের আনাচকানাচে, তখন থেকে দেখেছি আমাদের দেশেও কৃষির গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশে রয়েছে নারীর অবদান। সে সময় একবার ভেবেছিলাম নারী ঠিক কতটুকু কৃষিতে জড়িত, তা বোঝা যেত একটা পরিসংখ্যান বের করা গেলে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার একটা পরিসংখ্যান তখন পেয়েছিলাম।

‘বিশ্বজুড়ে কৃষিতে নারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিশ্রমিকের ৭০ শতাংশ, খাদ্য উৎপাদনকারীর ৮০ শতাংশ, খাদ্যসামগ্রীর প্রাথমিক প্রক্রিয়াকরণে ১০ শতাংশ নারী। গ্রামীণ কৃষি বিপণনের ৬০-৯০ শতাংশ নারীর দখলে। এভাবে কৃষি উৎপাদনে যুক্ত কর্মী সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই নারী।’ (খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ১৯৮৫)।

এখন সারা দেশেই সফল কৃষকের তালিকায় রয়েছে অসংখ্য নারীর অবস্থান। যাঁরা এখন শুধু নিজের বা সংসারের জন্যই কাজ করেন না, তাঁরা পথ দেখান বহু নারীকে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন বহু মানুষের। এমনই একজন উদ্যমী নারী নরসিংদীর পলাশ উপজেলার পলাশের চর গ্রামের আনোয়ারা খানম ডলি। শখ থেকে শুরু করে হয়ে উঠেছেন বড় এক উদ্যোক্তা।

মাস দুয়েক আগে আনোয়ারা খানম ডলির উদ্যোগটি দেখে আসার সুযোগ হয় আমার। গ্রামের মাঝে তিনতলা এক বাড়ি। তিনতলা বাড়িটি গ্রামের এক সমৃদ্ধির উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই বাড়িটি আগে ছিল ছোট টিনশেডের একটি ঘর। সেই ঘরে শখে আনা দুটি কোয়েল পাখি থেকে সূচনা হয় এক সমৃদ্ধির গল্প।

সেই সমৃদ্ধি ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্রামে। আনোয়ারা খানম ডলি বলছিলেন খামার গড়ে তোলার শুরুর গল্প, ‘২০০২ সালে আমার ছেলে শখ করে দুটি কোয়েল এনেছিল। কয়েক দিন পরেই কোয়েলের একটি শুরু করল ডিম দেওয়া।তখনই ভাবলাম কোয়েল পাখির একটা খামার করলে কেমন হয়।’ সেখান থেকেই শুরু। উদ্যোক্তা তাঁর ব্যতিক্রমী চিন্তা আর উদ্যোগে দিনে দিনে গড়ে তুলেছেন বিশাল কোয়েল খামার। 
বাড়ির নিচতলায় ইনকিউবেশন ইউনিট। উদ্যোক্তার ভাষায় এখানেই ‘বীজ ডিম’ থেকে কোয়েলের বাচ্চা উৎপাদন করা হয়। বাড়ির তিনতলায় চলছে কোয়েল পাখির ব্রুডিং।

যত দূর জেনেছি প্রথম জাপানি গবেষকেরাই কোয়েলকে গৃহপালিত পাখি হিসেবে পোষ মানানোর উপায় উদ্ভাবন করেন। পরে জাপানসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কোয়েল হয়ে ওঠে লাভজনক একটি পোলট্রি উপাদান। কোয়েল লালনপালনের খরচ তুলনামূলক অনেক কম।

সহজেই পোষ মানানো যায় বলে বাড়ির যেকোনো কোণে বা আঙিনায় কিংবা বাড়ির ছাদে পালন সম্ভব। বাংলাদেশের আবহাওয়াও কোয়েল পালনের জন্য বেশ উপযোগী। উদ্যোক্তা ডলির মতে, এদের রোগবালাইও কম। দীর্ঘদিন ধরে কোয়েল লালনপালন করায় চিকিৎসাপদ্ধতিও অনেকটা নিজেরা আয়ত্ত করে নিয়েছেন। কোয়েল ঘিরে একটি বহুমুখী বাণিজ্যকাঠামো দাঁড় করিয়েছেন উদ্যোক্তা ডলি। প্রথম ধাপে হয় ডিম উৎপাদন। ডিম খাদ্য উপকরণ হিসেবে বাজারে বিক্রি হয়। আবার ডিম ব্যবহার হয় হ্যাচিংয়ের মাধ্যমে বাচ্চা উৎপাদনে। দ্বিতীয় ধাপে কোয়েলের বাচ্চা উৎপাদন।

উৎপাদিত বাচ্চা চলে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের খামারে। পাশাপাশি নিজের খামারের জন্য বাচ্চা এখানেই উৎপাদন হয়। তৃতীয় ধাপে পরিণত কোয়েল বাজারে বিক্রি করেন। বিক্রি করেন হিমায়িত কোয়েল পাখির মাংসও। সুনামগঞ্জ, সিলেট, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, ময়মনসিংহ কিংবা বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এখান থেকেই কোয়েলের বাচ্চা পাঠানো হয়। দিন দিন বাড়ছে চাহিদা। বাড়ছে তাঁর খামারের আকার।

কোয়েল এ পরিবারটির অর্থনৈতিক মূল ভিত তৈরি করেছে। পাশাপাশি গ্রামের অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে তাঁদের খামারে। আবার ডলিকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন গ্রামের অনেক নারী। গ্রামের বেশ কয়েকটি কোয়েল খামার ঘুরে দেখলাম। কথা বললাম দু-একজন নারী উদ্যোক্তার সঙ্গেও। ঘরে বসে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারায় তাঁরা খুব উৎফুল্ল।

কেউ গৃহিণী, কেউ বা লেখাপড়ার পাশাপাশি কোয়েল লালনপালন করছেন। তাঁরা বলছেন, কোয়েল লালনপালনের মাধ্যমে সংসারের হাল ধরতে পেরেছেন, লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারছেন। চাকরি না খুঁজে নিজে স্বাবলম্বী হতে পারছেন। ঠিক যেমন অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন আনোয়ারা খানম ডলিকে দিয়েছে অন্য রকম এক শক্তি; যা তাঁর স্বপ্নের পরিধিকে করেছে বিস্তৃত। ছেলেকে নিয়ে তিনি যেতে চান আরও বহুদূর।

গবেষকেরা বলেন, কোয়েলের একটি ক্ষুদ্র ডিমে যে পরিমাণ প্রোটিন আছে, একটি বড় আকারের মুরগির ডিমেও প্রায় সেই পরিমাণ প্রোটিন রয়েছে। অথচ, দামের দিক থেকে একটি মুরগির ডিমের বিনিময়ে চারটি কোয়েলের ডিম পাওয়া যায়। আবার কোয়েলের মাংসও পুষ্টিকর। এ কারণে, আমাদের মতো দেশে পুষ্টির চাহিদা পূরণে কোয়েল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। কৃষি এবং গবাদিপ্রাণী ও পাখি পালনের মাধ্যমে বাংলাদেশের নারীদের বিশাল অংশ যুক্ত রয়েছেন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে।

ডলিকে দেখে মনে পড়ল নুরুন্নাহারের কথা। ঈশ্বরদীর নুরুন্নাহারের জীবনসংগ্রামের হাতিয়ার ছিল কৃষি। আজ সফল কৃষকের উদাহরণ হিসেবে ভূষিত হয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা এআইপি সম্মাননায়। মাগুরার সাবিনা ইয়াসমিন, ফরিদপুরের সাহিদা আক্তার, কক্সবাজারের নয়ন সেলিনাসহ অসংখ্য নারী কৃষিতে গড়ে তুলেছেন সাফল্যের নজির।

কৃষি একটি স্বাধীন পেশা। এ পেশায় নতুন করে ভালো করার দিন এসে গেছে। কেননা তথ্য, প্রযুক্তি ও উপকরণ এখন একেবারেই হাতের কাছে। এ জন্য যে অবস্থানেই থাকেন না কেন আপনি চাইলেই আপনার আগ্রহের ফসল সম্পর্কে জেনে-বুঝে বিনিয়োগে নামতে পারেন।

ভেতরে-ভেতরে বহু মানুষও আপন স্বপ্ন ও সৃজনশীলতা দিয়ে সাজাচ্ছেন তাঁর কৃষি খামার। নিশ্চিত করছেন সাফল্য। দেশের এমন অসংখ্য সফল ও নিবেদিতপ্রাণ নারীর একজন আনোয়ারা খানম ডলি। তিনি ভিন্ন পেশা এবং গৃহস্থের কাজ সামলিয়েও যে তৎপরতা দেখিয়েছেন, তা অনুসরণ করতে পারেন যেকোনো নারী। আর তাতেই দেশ এগিয়ে যাবে, সুদৃঢ় হবে দেশের কৃষিজ অর্থনীতি।

আনোয়ারা খানম ডলির মতো তৃণমূলের নারী জাগরণের মধ্য দিয়েই এক অনন্য বিপ্লব এসেছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। কোয়েলের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার বাড়াতে নীতি পরিকল্পনা নিয়ে এই উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়ানো যেমন জরুরি। প্রয়োজন নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি। আমরা বিশ্বাস করি, সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রামীণ অর্থনীতির এই খাতগুলো উন্নয়নে সুদৃষ্টি রাখবে।

লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

নতুন মেট্রো নয়, রুট বাড়ানোর চিন্তা

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত