Ajker Patrika

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর: অর্থছাড় বন্ধ তবু দরপত্রের হিড়িক

রাহুল শর্মা, ঢাকা
আপডেট : ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৮: ১৬
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর: অর্থছাড় বন্ধ তবু দরপত্রের হিড়িক

অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকি এড়াতে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই কৃচ্ছ্রসাধনের পথে হাঁটছে সরকার। এর অংশ হিসেবে পরিচালন বাজেটের আওতায় ভবন ও স্থাপনা খাতে অর্থ ব্যয় বন্ধ রাখা হয়েছে। অর্থ ছাড় বন্ধের পরও থেমে নেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভবন নির্মাণের দরপত্র আহ্বান। কাজের বিল পরিশোধে জটিলতায় পড়তে হবে জেনেও একের পর এক দরপত্র আহ্বান করে চলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি)।

ইইডি সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে গত নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। অর্থ ব্যয় বন্ধের নির্দেশনার পরও এত দরপত্র আহ্বান করাটা বিধিসম্মত নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, ঠিকাদারের কাছ থেকে ‘অনৈতিক সুবিধা’ নিতেই দরপত্র আহ্বানের এসব ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।

ইইডি সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, নতুন ভবন নির্মাণ, বিদ্যমান ভবনগুলোর সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ও সংস্কার এবং আসবাব সরবরাহের কাজ করে থাকে। এ ছাড়া মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, আইসিটি ল্যাব স্থাপন, ইন্টারনেট সংযোগ, আইসিটি-সুবিধা সরবরাহের কাজও তারা করে থাকে। নভেম্বর পর্যন্ত আহ্বান করা পাঁচ শতাধিক দরপত্রের প্রায় সবগুলোই নতুন ভবন নির্মাণ ও সম্প্রসারণের।

ইইডির প্রধান প্রকৌশলী মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বলেন, ‘দরপত্র আহ্বান করা যাবে না, এমন কোনো বিধিনিষেধ নেই। একটি দরপত্রের প্রক্রিয়া করতে সাত-আট মাস সময় লাগে। আমরা কাজগুলো এগিয়ে রাখছি। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যখন টাকা ছাড় হবে, তখন যেন সময়ক্ষেপণ না হয়। আর আমরা অনুমোদনও সব ক্ষেত্রে দিচ্ছি না।’

ইইডির প্রধান প্রকৌশলী দরপত্র আহ্বানে বিধিনিষেধ না থাকার দাবি করলেও অর্থ ব্যয় বন্ধ থাকলে দরপত্র আহ্বান করা যায় না বলে জানিয়েছেন সাবেক শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, অর্থ ব্যয় বন্ধ-সংক্রান্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের পর এর আওতাধীন কোনো দরপত্র আহ্বান করা যায় না। তবে তা প্রজ্ঞাপনের আগে দরপত্র হলে ঠিক আছে।

উল্লেখ্য, কৃচ্ছ্রসাধনের অংশ হিসেবে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের কিছু খাতে ব্যয় বন্ধের নির্দেশনা দিয়ে গত ২ জুলাই একটি পরিপত্র জারি করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট অনুবিভাগ। উপসচিব মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান স্বাক্ষরিত ওই পরিপত্রের ‘ক’-এর ৩ দফায় বলা হয়, আবাসিক ভবন, অনাবাসিক ভবন এবং অন্যান্য ভবন ও স্থাপনা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় বন্ধ থাকবে। কিন্তু সেই পরিপত্র জারির পরও ভবন নির্মাণ ও সম্প্রসারণে দরপত্র আহ্বান করে চলেছে ইইডি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইইডির একাধিক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জানান, অর্থ ব্যয় বন্ধ থাকার পরও দরপত্র আহ্বান বিধিসম্মত নয়, এটা সবাই জানে। ইইডির সভায় বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার আপত্তিও তোলা হয়েছিল। কিন্তু ইইডির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এসব আপত্তি আমলে নেয়নি। মূলত ‘অনৈতিক সুবিধার’ বিনিময়ে বিশেষ গোষ্ঠীকে কাজ পাইয়ে দিতে তড়িঘড়ি করে নিয়মবহির্ভূতভাবে দরপত্র আহ্বান করা হচ্ছে। বলা যায়, ইইডিতে দরপত্র আহ্বানের হিড়িক পড়েছে। কেননা যত বেশি দরপত্র, তত বেশি কমিশন। এটা ইইডিতে ওপেন সিক্রেট।

ইইডির এক ঊর্ধ্বতন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ইইডিকে কেন্দ্র করে অসাধু ঠিকাদারদের এক বিশেষ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তাঁরা দরপত্র পেয়ে কাজ বিক্রি করে দেন। এতে কাজের মান নষ্ট হচ্ছে এবং সময়মতো কাজ শেষ হচ্ছে না।

অর্থ ছাড় বন্ধ থাকার পরও দরপত্র আহ্বান করায় ভবিষ্যতে জটিলতা তৈরি হবে বলে জানিয়েছেন ইইডির তালিকাভুক্ত একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। তাঁরা জানান, অর্থ ব্যয় বন্ধ থাকার নির্দেশনা থাকায় কাজ করলেও ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। এতে একদিকে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ হবে না, অন্যদিকে কাজের মানও খারাপ হবে। সব মিলিয়ে কাজ শেষে বেকায়দায় পড়বেন ঠিকাদারেরা।

জানতে চাইলে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ঢাকা মেট্রো) ঠিকাদার সমিতির সভাপতি মো. মিজানুর রহমান বলেন, অর্থ ছাড় বন্ধ থাকার পরও দরপত্র আহ্বান করলে ঠিকাদারেরা কাজ করে সময়মতো বিল পাবেন না। এতে জটিলতা তৈরি হবে, ঠিকাদারেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

এদিকে ইইডির দরপত্র নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিক্রির বিষয়টি উঠে এসেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ২১তম বৈঠকেও। গত ৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের তৎকালীন সিনিয়র সচিব মো. কামাল হোসেন বলেন, মাঠপর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে মূল ঠিকাদার অন্য ঠিকাদারকে আন অফিশিয়ালি কাজ বিক্রি করে দিচ্ছেন।

মো. কামাল হোসেনের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে সংসদ সদস্য মো. আবদুস সোবহান মিয়া বলেন, নির্দিষ্ট কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ক অর্ডারগুলো পায় এবং তারা থার্ড পার্টি এমনকি ফোর্থ পার্টির কাছে কাজগুলো বিক্রি করে দেয়, ফলে কাজের মান খারাপ হচ্ছে।

অর্থ ব্যয় বন্ধের নির্দেশনা থাকার পরও দরপত্র আহ্বান করার বিষয়টি স্বীকার করেছেন প্রধান কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী (ডেস্ক-১) মো. ফাহিম ইকবাল। তিনি বলেন, পরিচালন বাজেটের অধীনে যে নির্মাণকাজ আছে, তার অর্থ ব্যয় বন্ধ রাখার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিয়েছে। অর্থ ব্যয় বন্ধ মানে টাকা ছাড় বন্ধ। তারপরও এবার কিছু কিছু কাজে দরপত্র আহ্বান করা হচ্ছে। তবে তা পুরোদমে নয়। গত বছর দরপত্র আহ্বান বন্ধ রাখার নির্দেশনা ছিল।

অর্থ ব্যয় বন্ধ রাখার নির্দেশটি এখনো বলবৎ রয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বাজেট-১) আবু দাইয়ান মোহাম্মদ আহসানউল্লাহ। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিলে নির্দেশটি আরেকটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে রহিত করা হবে।

সার্বিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও অর্থ) এ কে এম আফতাব হোসেন প্রামাণিক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। এ বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

বন্ধুকে ছাত্রলীগ সাজিয়ে পুলিশে দিয়ে তাঁর প্রেমিকাকে ধর্ষণ করলেন ছাত্রদল নেতা

মানিকগঞ্জে রাতের আঁধারে স্থানান্তর করা বিদ্যালয় ভবন পরিদর্শনে কর্মকর্তারা

পরিপাকতন্ত্রের ওষুধের পেছনেই মানুষের ব্যয় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত