Ajker Patrika

এই জাতির কী যেন একটা হয়েছে

অজয় দাশগুপ্ত
আপডেট : ০১ এপ্রিল ২০২৪, ০৮: ০৩
এই জাতির কী যেন একটা হয়েছে

আমাদের জাতির কী যেন একটা হয়েছে; বিশেষ করে সামাজিক মিডিয়া খোলার পর জাতি যেন সব বিষয়ে মতামত রাখার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। এটা মন্দ কিছু না। কিন্তু আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, মত দেওয়ার জন্য মত দেওয়া বা বলার জন্য বলার কোনো মানে নেই। বলতে হলে বলার মতো করে বলতে হয়। আর সে জন্য লাগে পড়াশোনা। একসময় মানুষ যে বই পড়ত, বেশি বেশি পড়ে কম বলত, সে সময়টাই ছিল আমাদের উৎকৃষ্ট সময়।

কিছুদিন আগে অধ্যাপক চিন্ময় গুহ এসেছিলেন ঢাকায়। ওপার বাংলার ইমেরিটাস অধ্যাপক। তাঁর কথা শুনে মনে হলো কথার ভেতর যে ওজন আর ঐশ্বর্য তা কত ব্যাপক বিস্তৃত হতে পারে। আমাদের দেশের হাতে গোনা কয়েকজন ব্যতীত বাকি ইমেরিটাস, নন-ইমেরিটাসদের কথা না বলাই ভালো। চিন্ময় গুহ সাংঘাতিক কিছু সত্য বলেছেন। যার ভেতর একটি—এত বেশি তথ্য আসলেই মানুষের কাজে লাগে কি না। তাঁর মতে, এত তথ্য মগজের জন্য অস্বাস্থ্যকর। মানুষের সব অঙ্গের একটা ধারণক্ষমতা আছে। মাত্রাতিরিক্ত কোনো কিছুই তার জন্য সুখকর নয়। সত্যি তাই।

আজকাল বাংলাদেশ ও দেশের বাইরের বাঙালি জনগোষ্ঠী দুই লাইনের খবর আর গুগলের কল্যাণে সবজান্তা। সোশ্যাল মিডিয়া হচ্ছে এর সালাদ বা শেষ পাতের দই কিংবা ক্ষীর। যার যেমন ইচ্ছে তেমন করে তথ্য পরিবেশন আর ভ্রান্তি ছড়ায় বলে সত্য-মিথ্যা মিলেমিশে একাকার। বলছিলাম বাস্তবতার কথা। এই যে আজকাল ‘ভাইরাল ভাইরাল’ করে দেশ মাথায় তোলা, তার আসল পরিণতি কী? দেখবেন, ঘোর প্রগতিশীল নামে পরিচিত মানুষজনও পথভ্রষ্ট। আমি এক ভদ্রলোককে চিনি সেই মান্ধাতা আমল থেকে। চট্টগ্রামের মানুষ।

এখনো শুদ্ধ কথা বলতে পারেন না। কিন্তু অবিরল বকে চলেছেন। প্রথমটায় মনে হতো কথা বলতেন। তারপর মনে হলো বকছেন। এখন মনে হয় পাগলের প্রলাপ। কী তাঁদের টার্গেট? কারা তাঁদের টার্গেট? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, আর কলকাতা। মুশকিল, এই আমি কলকাতা গিয়ে বা দূরে থেকে কখনো তাঁদের ভেতর এই প্রবণতা দেখিনি। এটা মানি, মাঝে মাঝে তাঁদের কেউ কেউ বাংলাদেশ বা বাঙালি বিষয়ে বাজে কথা বলেছেন। বলেনও। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে কারও সময় নেই আমাদের নিয়ে মাথা ঘামানোর।

বড় বড় দেশের সঙ্গে তাদের প্রতিবেশী ছোট ছোট দেশগুলোর সম্পর্ক সব সময়ই নাজুক। আর একটা চূড়ান্ত সত্য হলো আমেরিকাকে নিয়ে কথা বলে, চেনে, চিনতে বাধ্য হয় মেক্সিকো বা গুয়াতেমালা। উল্টোদিকে আপনি একজন আমেরিকানও পাবেন না, যিনি গুয়াতেমালার রাজধানীর নাম বলতে পারেন।

বাংলাদেশ কিন্তু নাম না-বলা বা না-জানার অবস্থানে নেই; বরং এই যাঁরা এমন আবোলতাবোল বকে দুশমন তৈরি করছেন, তাঁদের মূল উদ্দেশ্যই হলো নিজেকে বড় করে জাতি ও দেশকে ছোট করা। একবার ভাবুন তো, এই যে লাগাতার রবীন্দ্রবিরোধিতা, এর কারণ কী? এই ভদ্রলোক প্রায়ই স্বীকার করেন রবীন্দ্রসংগীতের তুলনা হয় না। বলে থাকেন, তাঁর কবিতা অসাধারণ। কিন্তু সেটা নিজের জন্য।

আমজনতার কানে বিরোধিতার নামে নিন্দা আর ঘৃণা ছড়ানোর কারণ কী তবে? কারণ, সেই পাকিস্তানি আমলের মতো আবার সাম্প্রদায়িকতার বাতাবরণ তৈরি করা। কলকাতা, শেক্‌সপিয়ারসহ নানা বিষয়ে উদ্ভট কথাবার্তার জন্য তিনি যতটা দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী যাঁরা তাকে অতিথি বানিয়ে এসব বলতে দেন। মৌলিক অধিকার বা মানবাধিকার অথবা স্বাধীনতা মানে কি এই যে, ‘আমি জানি না তা-ও বলব’? আমার মনে হয়েছে এ কথাটি বলা উচিত, জ্ঞানী মানুষের চিহ্ন বা প্রমাণ একটাই—তাঁরা জানেন যে তাঁরা কী জানেন না আর কতটুকু জানেন। চোখ-মুখ খিঁচিয়ে কাউকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে খাবলে খাবলে একটু লবণ, একটু গুড়, কয়েক ফোঁটা পানিতে জানার স্যালাইন হতে পারে, ওষুধ হয় না।

বলছিলাম জাতির যেন কী হয়েছে। কোনো এক চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য আসবেন। ভালো কথা। সে নিয়ে সে কী আনন্দ-উল্লাস! সেই উল্লাসের নৃত্য ভাইরাল করে দিয়েছে অনেকে। ব্যস, এবার শুরু গালাগালি। কিন্তু কেন? কারও কি অধিকার নেই তাদের নবাগত উপাচার্যকে নেচে-গেয়ে বরণ করার? যদি সেটা অন্যায্য বা অন্যায় মনে হয়ে থাকে, তার বিচারক আপনি হবেন কোন সুখে? তাদের সেই প্রতিষ্ঠানের লোকজন বুঝবে কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ। না, সেটুকু বোঝার মতো হুঁশ নেই আর। একটা কিছু পেলেই হলো। পঙ্গপালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ার এই প্রবণতা খেলাকেও ছাড় দিচ্ছে না।

লিটন দাসের ভক্ত আমি। এই ছেলেটি শুরু থেকে কোটার খেলোয়াড় শুনতে শুনতে আজ এ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। লিটন যখন জেতায়, তখন মনে হয় সবাই মিলে জিতিয়েছে আর হেরে গেলে বা খারাপ খেললে সব দোষ লিটনের। এখন তার খারাপ সময় চলছে। রান আসছে না। আউট হয়ে যাচ্ছে বারবার। আরে ভাই, এই হাল তো সবার হয়। ইমরান খান, শচীন টেন্ডুলকার থেকে সৌরভ—কে বাদ?

তাঁদের দেশের জনগণ তো এভাবে আক্রমণ করেনি; বরং তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহস আর শক্তি জুগিয়ে গিয়েছিল যাতে তাঁরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। কথাগুলো বললাম এই কারণে, সামাজিক মিডিয়া ও টিভিকে এ বিষয়ে একহাত নিয়েছেন নিক পোথাস। নিক বাংলাদেশের সহকারী কোচ। সাউথ আফ্রিকান এই ক্রিকেটার বলেছেন, ‘টিভি ও সামাজিক মিডিয়ার অপপ্রচারের চাপে লিটন দাস স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারছে না। এগুলো বন্ধ হলে সে তার ছন্দে ফিরতে পারে।’ হয়তো তাই। হয়তো না। কিন্তু কথা একটাই, এতটা আগ্রাসী হতে হবে কেন? কেন মানুষ এমন হয়ে উঠল? লিটনের বেলায় এর কারণ যদি সাম্প্রদায়িকতা হয়, সাকিব আল হাসানের বেলায় কী বলব?

কোনো কিছুই দেখি সমালোচনার বাইরে থাকছে না। কদিন আগে দোলপূর্ণিমা রাশ উৎসব গেছে। সে কারণে কোথায় যুবক-যুবতীরা রং মেখে নাচল তা নিয়েও হইচই। তারা এ বয়সে নাচবে না তো কি ঘোমটা টেনে বসে থাকবে? আর তাদের নাচ আপনি না দেখলেই তো হয়।

একবার নয়, বারবার দেখবেন, তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করবেন, তারপর বিরুদ্ধে লেখা বা বলা শুরু করবেন, এ কেমন স্ববিরোধিতা?
মূলত রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে যে কাউকে নিয়ে যা-তা বলা, ট্রল করা এখন এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এর ভেতর আমাদের চিন্তা ও মননের দেউলিয়াত্ব এখন প্রকাশ্য।

এটা বাদ-প্রতিবাদ বা সুস্থতা চাড়িয়ে এমন একপর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে, যেখানে আমরা সবাই ধীরে ধীরে অজান্তে একেকজন হিরো আলমে পরিণত হতে চলেছি। কোনো সামাজিক প্রতিরোধ নেই, হবেও না। তাহলে উপায়? মনে হয় একটাই—আস্তে আস্তে তলোয়ারের যেমন ধার কমে যায়, এসবেও মরচে পড়ে ভোঁতা হয়ে যাবে। কনফুসিয়াস মনে করতেন শুদ্ধ বাতাস প্রবাহিত হলে যেকোনো দুর্বিনীত ঘাসও নুয়ে পড়তে বাধ্য হয়। সে সুবাতাস কবে বইবে?

লেখক: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত