Ajker Patrika

করোনাকালে মানসিক সমস্যায় ৪১% কিশোর-কিশোরী

আজাদুল আদনান, ঢাকা
আপডেট : ২০ মে ২০২২, ১১: ৫২
করোনাকালে মানসিক সমস্যায়  ৪১% কিশোর-কিশোরী

অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহির। করোনা মহামারির প্রভাবে গত বছরের এপ্রিলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে ঘরবন্দী জীবন শুরু হয় তার। দেড় বছর পর সরাসরি পাঠদান যখন চালু হয়, তখন মাহিরের মানসিক অবস্থা আগের মতো নেই। দীর্ঘ সময় ঘরবন্দী থাকা মাহির এরই মধ্যে মাদকে জড়িয়ে পড়ে।

করোনায় অনলাইনে ক্লাস চললেও আর্থিক সংকটের কারণে ঠিকমতো ক্লাস করতে পারেনি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী এশা। অভাবের তাড়নায় তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় পরিবার। কিন্তু তিন মাসও সেই বিয়ে টেকেনি। এখন বাবার বাড়িতে অনেকটা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় দিন কাটছে এই কিশোরীর।

শুধু মাহির বা এশা নয়, তাদের মতো লাখ লাখ কিশোর-কিশোরীর মানসিক স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে করোনাকালে ঘরবন্দী জীবন। গবেষণা বলছে, গত দুই বছরে করোনা মহামারির ফলে দেশের ৪১ শতাংশ কিশোর-কিশোরী মানসিক সমস্যার শিকার হয়েছে, যা করোনাপূর্ব দুই বছরের তিন গুণ।

করোনা মহামারি দেশের কিশোরী-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যে কতটা প্রভাব ফেলেছে, তা জানতে গত বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ৮ বিভাগের ৮টি জেলার ২ হাজার ৩০ জন কিশোর-কিশোরীর ওপর এ গবেষণা চালায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার অধীনে চালানো ওই গবেষণায় যেসব কিশোর-কিশোরী অংশ নিয়েছে, তাদের বয়স ১৪ থেকে ১৯ বছর।

গবেষণায় তাদের ৪১ শতাংশের মধ্যেই মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তার তথ্য উঠে এসেছে। এর পেছনে করোনায় ঘরবন্দী জীবন ও করোনাকালে সৃষ্ট খাদ্যসংকটকেই দায়ী করেছেন গবেষকেরা।

গবেষণায় দেখা যায়, করোনা মহামারিতে মানসিক সমস্যার শিকার কিশোর-কিশোরীদের ৩৯ শতাংশ ছেলে এবং ৬১ শতাংশ মেয়ে। এর মধ্যে ১৮ শতাংশ মানসিক দুশ্চিন্তায়, ১৬ শতাংশ মানসিক চাপে এবং ১৪ শতাংশ নানা উদ্বেগে ভুগছে। ২২ ভাগ কিশোর-কিশোরী পরিবারের খাদ্য নিয়ে নানা সংকটের কথা চিন্তা করে। এ ছাড়া ৫ শতাংশ একেবারে নিম্নমানের জীবন যাপন করেছে।

গবেষক দলের কো-ইনভেস্টিগেটর ছিলেন বিএসএমএমইউয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. মারুফ হক খান। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘এখন থেকে যদি আমরা মনোযোগ না দিই, তাহলে এটি আমাদের জন্য অনেক বেশি বোঝা হবে। নারীরা এ সময়ের বেশির ভাগ ঘরেই ছিল, সেটিও অনেক বেশি প্রভাব পড়ে।’

চিকিৎসকেরা বলছেন, করোনার ধাক্কা যতটা ছেলে-মেয়েদের মধ্যে পড়েছে, তার চেয়ে বেশি অভিভাবকদের মধ্যে। আর এর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলা করতে হচ্ছে তাদের। দীর্ঘদিন ঘরবন্দী থাকায় বেড়েছে ইন্টারনেটের ব্যবহার। ফলে নৈতিক অবক্ষয়, মাদকাসক্ত এবং নানা সহিংস ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে কম বয়সী ছেলে-মেয়েরা।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক রোবেদ আমিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, করোনা মহামারি কম বয়সীদের মধ্যে যে মানসিক প্রভাব ফেলেছে, সেটির বৈজ্ঞানিক কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত নেই। তবে মাঠপর্যায়ে সমীক্ষা চালিয়ে তাঁরা যে গবেষণা করেছেন, সেখানে অনেক বেশি উচ্চ হার দেখা যাচ্ছে।

করোনায় সংক্রমণ বাড়লে স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। এতে পুরোপুরি ঘরবন্দী হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা, যার সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে। অনলাইনে ক্লাস চালু হলেও তা ছিল সাময়িক সময়ের জন্য। কিন্তু ঘরবন্দী শিশুদের বাইরে বের করতে না পারায় প্রায় সময় তারা মোবাইল-কম্পিউটার নিয়ে ব্যস্ত ছিল। মা-বাবারাও সন্তানকে শান্ত রাখতে মোবাইল ফোন হাতে তুলে দেন। ইন্টারনেট পাওয়ায় সারা দুনিয়াকে কাছে পায় সে। এতে করে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তৈরি কনটেন্টেও ঢুঁ মারে তারা। অনেকে এতে আসক্তও হয়ে পড়ে। এর ফলে যৌনতা, মাদক ও নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে তারা।

এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক, বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, করোনাকালে কিশোর-কিশোরীদের শুধু যে নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে, তা কিন্তু নয়, এই সময়ে অনেক পরিবারের অর্থনৈতিক দুরবস্থাও তাদের মনে প্রভাব ফেলেছে। এই হতাশা থেকেও অনেকে নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। এ জন্য সবার আগে বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। খেলার মাঠ যেহেতু কম, তাই বাসাবাড়িতে জিমের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত