Ajker Patrika

ইউক্রেন যেন একাত্তরের বাংলাদেশ

জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা
আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৩: ০৫
ইউক্রেন যেন একাত্তরের বাংলাদেশ

নীলিমার একটা ছোট্ট মেসেজ। তাতে আমাদের মনে হলো, শান্তি পাচ্ছি। অনেক পথ পেরিয়ে নিকুঞ্জকে নিয়ে নীলিমা এখন পোল্যান্ড সীমান্তে। ব্যক্তিগত ভাইবারে ও আর যোগাযোগ করছে না। আমরা যাঁরা ১৯৮৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে একসঙ্গে পড়তে গিয়েছিলাম, তাদের ৪২ জনের একটি ভাইবার গ্রুপ আছে। সেই গ্রুপেই নীলিমা লিখেছে, ‘আমরা পোল্যান্ড সীমান্তে।’

এই কদিনে নীলিমার ভয়াবহ যাত্রা চোখের সামনে সেলুলয়েডের মতো ভেসে উঠল। আর মনে পড়ল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন তথ্যচিত্রে দেখেছি উদ্বাস্তু মানুষের সারি। ভয়ার্ত চোখে দ্রুত হেঁটে সীমান্তের দিকে যাচ্ছে মানুষ। হাঁটছে দ্রুত, যেন তাতে সীমান্তের ওপারে পৌঁছে যেতে পারবে দ্রুত। চোখে ভাসছে বেতের টুকরির মধ্যে বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে চলেছে ছেলে, দুই বছরের সন্তানের হাত ধরে চলেছে মা। কষ্ট করে হাঁটছে সন্তানসম্ভবা নারী। যে যা পেরেছে, নিয়ে এসেছে সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত কে কখন কোথায় গিয়ে পৌঁছাল,

সেটাও একে অন্যের কাছে থাকে অজানা।

নীলিমাও সে রকম নিরাপত্তাহীন একটা পথ পাড়ি দিয়েছে। খারকভ থেকে ট্রেনে করে যখন ও কিয়েভের উদ্দেশে রওনা হয়েছে, তখনো রুশ বাহিনীর কার্যকলাপ সম্পর্কে ধারণা ছিল না ওর। এত দ্রুত খারকভের কাছাকাছি চলে আসবে রুশ বাহিনী, সেটা ওরা কল্পনা করতে পারেনি। ছেলেকে নিয়ে ট্রেনে করে পথ পাড়ি দেওয়ার সময়ই শোনা যেতে লাগল গুলির শব্দ। এই ভয়াবহতার সময় ওর স্বামী আজমল ছিল খারকভে। আজমল চেয়েছিল খারকভে থেকে যেতে। কিন্তু একসময় বুঝতে পেরেছে, থেকে যাওয়া ঠিক হবে না। তখন নিজের গাড়িতে করে পরদিন রওনা হয়েছে ল্‌ভভের পথে।

আর নীলিমা ও নিকুঞ্জ? কিয়েভ থেকে যত দ্রুত সম্ভব ল্‌ভভের টিকিট কেটে রওনা হয়েছে সে পথে। মনে আজমলের জন্য শঙ্কা। ঠিকভাবে পৌঁছাতে পারবে তো ও? বিদ্যুৎ না থাকলেই ফোনের চার্জ চলে যাচ্ছে। তখন আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। ল্‌ভভে এসে শুনেছে, কিয়েভ দখল করে নিয়েছে রুশ সেনারা। তবে সেটা ছিল গুজব। আসলে ইউক্রেনীয় বাহিনী কিয়েভের রাস্তায় রাস্তায় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।

তবে ট্যাংক থেকে ছোড়া গোলা এসে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল কোনো কোনো ভবন। রাস্তায় থাকা নিরাপদ নয়। সবাইকে বাংকারে চলে যেতে বলা হয়েছিল। ছেলেকে নিয়ে বাংকারে ভয়ংকর একটা রাত পার করেছে নীলিমা। লিখেছিল, ‘বাংকারে খুব শীত।’

সে সময় আজমল ছিল অনেক দূরে। সান্ধ্য আইন ছিল বলে সোজা পথে গাড়ি চালিয়ে আসা যাচ্ছিল না। বিকল্প পথ দিয়ে এগোতে হচ্ছিল। পথে পথে পানি আর খাবার হাতে দাঁড়িয়ে ছিল স্বেচ্ছাসেবীরা। কিন্তু কোনো হোটেল কিংবা হোস্টেলে জায়গা খালি ছিল না। আগেই উদ্বাস্তুদের দিয়ে ভরে গেছে সেগুলো। এরা সবাই রাত কাটিয়ে রওনা দেবে পোল্যান্ড সীমান্তের দিকে।

গত শনিবার যখন বারবার নীলিমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলাম, তখন ওর কোনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছিল না। শোনা যাচ্ছিল, পোল্যান্ডে ঢোকার জন্য ইউক্রেনীয়দের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বিদেশিদের ধীরে ধীরে ঢোকানো হবে। ফলে বিদেশিদের অনেকেই সারা দিন সীমান্ত এলাকায় কাটিয়ে পোল্যান্ডে ঢুকতে না পেরে আবার ফিরে এসেছে দূরের শহরে, নিরাপদ আশ্রয়ে। পরদিন আবার গেছে সীমান্তের কাছে।

গত শনিবার প্রথম নীলিমার সঙ্গে ভাইবারে কথা বলল বন্ধু মঞ্জু। তখনো নীলিমা সীমান্ত থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে। কত পথ পাড়ি দিতে হয়েছে, সেটা ও জানে না। প্রথমে ফোন ধরেছিল নিকুঞ্জ। ও শুধু বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছিল, ‘আঙ্কেল, আঙ্কেল!’ মঞ্জু লিখেছে, ওর করুণ আর্তিতে চোখের পানি ধরে রাখা যাচ্ছিল না।

আজ দুপুরে অস্ট্রেলিয়া থেকে বন্ধু মহিদুর আজমলের সঙ্গে কথা বলতে পারল। আজমল অবশেষে গাড়ি করে ল্‌ভভে পৌঁছাতে পেরেছে। ও-ই জানাল, নীলিমারা ২০-২৫ কিলোমিটার পথ হেঁটে যাচ্ছে। তাহলেই পৌঁছে যাবে সীমান্তে।

সে সময় থেমে থেমে যুদ্ধ চলছে। রকেটের আওয়াজ আর বোম্বিংয়ে পুরো এলাকা হয়ে আছে মৃত্যুপুরী।

আমি লিখেছিলাম, এই ভয়াবহ সময়ে নীলিমাকে প্রশ্ন করতে সংকোচ হচ্ছে। জবাবে নীলিমা আমাকে লিখেছে, ‘জাহীদ, সংকোচের কিছু নেই। তোমরা বন্ধুরা অবশ্যই খোঁজ করবে। আর সেটা আমার জন্য বিশাল সাপোর্ট এই উদ্ভট সময়ে। ভয়াবহ কষ্ট ২৭ কিলোমিটার বাচ্চা ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ।’

এ কথা পড়ে আবার চোখে ভেসে উঠল একাত্তরের উদ্বাস্তুদের চেহারা। নীলিমাও সন্তানসহ হেঁটে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে। এরপর নীলিমা লিখল এক ভয়াবহ কথা: মনে হচ্ছে, গুলিতে মরে যাওয়া আর এখানে কষ্টে মরে যাওয়ার মধ্যে কতটাই-বা তফাত!’

এর কিছুক্ষণ পর একটা আনন্দ সংবাদ, ‘আমরা এইমাত্র ইউক্রেন সীমান্ত পার হলাম। পোল্যান্ডের ইমিগ্রেশনে অপেক্ষা করছি।’ লিখেছে নীলিমা। না জানি আর কত নীলিমা এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে বা যাচ্ছে।

এরপর আর কিছু জানা হয়নি। আজমল যদি ঠিকমতো গিয়ে নীলিমাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারে, তাহলে একটি পরিবারের ভয়াবহ যাত্রার একটা সফল পরিসমাপ্তি হবে। দেখা যাক। একটি যুদ্ধ এ রকম কত সহস্র গল্পের জন্ম দেয়, তার কতটুকুই বা আমরা জানতে পারি? আর কতটুকুই বা পুতিন বা বাইডেন সাহেব ও সঙ্গীরা বোঝেন!

অন্যদিকে কিয়েভ থেকে শুধু দুবার কথা হয়েছে টিপু ভাইয়ের সঙ্গে।

-কেমন আছেন?

-ভালো নেই।

-এখন কি প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছে?

-হ্যাঁ। চলবে শেষনিশ্বাস পর্যন্ত।

এ কথার পর আর কিছুই বলার থাকে না। শুধু হু হু করে ওঠে বুক।

 

 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত