Ajker Patrika

বিদেশেও যাবে খেজুরের গুড়

জিয়াউল হক, যশোর
আপডেট : ০৪ নভেম্বর ২০২১, ১৬: ২৫
বিদেশেও যাবে খেজুরের গুড়

খেজুরের গুড়ের কথা উঠলে সবার আগে যে অঞ্চলের নাম আসে সেটি হলো যশোর। ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’–এমনই প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে এ অঞ্চলের রসের খ্যাতি নিয়ে।

কিন্তু গত কয়েক দশক ধরেই ইটভাটা, সড়ক ও ঘরবাড়ি নির্মাণসহ নানা কারণে কাটা পড়ে কমে গেছে খেজুরগাছ। ফলে কমেছে রস সংগ্রহও। অথচ উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ইংরেজরা খেজুরের রস থেকে চিনি উৎপাদন করে রীতিমতো ব্যবসা শুরু করে দিয়েছিলেন এই বৃহত্তর যশোর অঞ্চলে এসে।

বৃহৎ আকারে ও ঘরোয়াভাবে যশোর অঞ্চলে খেজুর গুড় কেন্দ্রিক অন্তত ৫০০ চিনি কারখানা গড়ে উঠেছিল সে সময়। কিন্তু কালের আবর্তে এখন আর সেই গুড়ের চিনি উৎপাদন নেই। শীতে দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে রসও। তবে কদর কমেনি খেজুরের গুড় ও পাটালির।

এই গুড়ের চাহিদা মেটাতে গত বছরের শীতের মৌসুমে যশোরে সাড়ে তিন হাজার মেট্রিক টন গুড় ও পাটালি উৎপাদন হয় রসের জন্য বিখ্যাত এই জেলায়। এবার সেই গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ হাজার মেট্রিক টন। যা সরকারিভাবে সমন্বয় করে বিদেশে রপ্তানিরও উদ্যোগ নিয়েছে জেলা কৃষি বিভাগ।

চলতি মৌসুমে হেমন্তে শীতের আমেজ শুরু হওয়ায় রসের জন্য খেজুর গাছ পরিষ্কার করে প্রস্তুত করছেন গাছিরা। কিন্তু তাঁদের দাবি, এক সঙ্গে অনেকগুলো উঁচু গাছ বেয়ে রস সংগ্রহ করা অনেক কষ্টকর। এ জন্য কৃষি বিভাগ যদি উন্নত দেশ থেকে গাছে ওঠার যন্ত্র এনে সহায়তা করত তাহলে এই জেলায় রসের সংগ্রহ আরও বাড়ত। পাশাপাশি সরকারিভাবে খেজুরের গুড় বিদেশে রপ্তানিরও ব্যবস্থার দাবি তাঁদের।

যশোর সদরের রুদ্রপুর গ্রামের গাছি সমীর বিশ্বাস বলেন, ‘খেজুর গুড়ির চাহিদা আগের চেয়ে বাইড়ে গেছে। এ জন্যি আগেভাগেই গাছে ছা দিচ্ছি। যদি রস বেশি পাই, তালি লাভও বেশি হবেনে। এর ওপর দিয়েই তো সংসার চলে। বইসে থাকব ক্যান?’

তিনি বলেন, ‘এখন আর আগির মতো গাছ বাতি পারি না। বয়স অইচে। যদি সরকার একটা মেশিন-টেশিন দিত, তালি গাছ বাতি কষ্ট হইতো না।’

শীতের আমেজ আসতে না আসতেই খেজুর গুড়ের রাজধানী খ্যাত যশোরের খাজুরায় চলছে পুরোদমে রস আহরণের প্রস্তুতি। ইতিমধ্যেই গাছ ছা দিতে (পরিষ্কার করে প্রস্তুত করা) শুরু করেছেন গাছিরা।

খাজুরার জয়নাল হোসেন বলেন, ‘দুই-তিন দশক আগেও খাজুরা অঞ্চলে প্রচুর খেজুরের গাছ ছিল। তখন এক ভাঁড় (হাঁড়ি) রস বিক্রি হতো ৭০-৮০ টাকা। গুড়ের কেজি ছিল ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। তখন ঘরে ঘরে উৎসব হতো। গুড় খেতে না পেরে, নষ্ট হয়ে যেত। পরিচিতদের ফ্রিতেও গুড় দিয়েছি কত? আর এখন! পরিস্থিতি পুরোটাই পাল্টে গেছে। অনেকেই অতি মুনাফার লোভে গুড়ে ভেজাল দেওয়া শুরু করেছেন। আর খেজুরের রস হয়ে উঠেছে দুষ্প্রাপ্য।’

একই এলাকার ইয়াকুব আলী জানান, ‘যত দিন যাচ্ছে তত খেজুর গাছ কমছে। কেউ বিপদে পড়ে টাকার জন্য বিক্রি করছেন, কেউ গাছে উঠতে না পেরে কিংবা গাছি না পাওয়ায় বিক্রি করে দিচ্ছেন। আবার ইটভাটা মালিকেরা গাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। কোনো কোনো জায়গায় আবার বাড়িঘর ও রাস্তার জন্য কাটা পড়ছে খেজুর গাছ। বিশ বছর আগে যে গাছ ছিল, এখন তার অর্ধেকও নেই।’

খেজুর গাছ পরিষ্কার করার সময় কথা হয় গাছি লিয়াকত আলীর সঙ্গে। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘একে তো গাছ কুইমে গেছে। তার ওপর গাছে ওঠার লোক নেই। কিন্তু গুড়ের চাহিদা অনেক বাইড়ে গেছে। তাই আগে ভাগেই গাছে ছা দিচ্ছি। ইট্টু ঠান্ডা পড়তি শুরু করলিই রস পাবানি। আমাগের এখেনে প্রায় দেড়, দুই শ গাছি আছেন। তাঁরা সবাইই ছা দিয়া শুরু কইরেছেন।’

মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘গতবার কারা আইল। উরা কচ্ছিল ইন্টারনেটে নাকি গুড় বিক্রি হয়। সিবার বেশ কিছু গুড়ও কিনিল। আর কইয়ে গিলো, আগে ভাগে ছা দিতি। যাতি বেশি রস পাই। কিন্তু গাছে উঠতি গিলি ম্যালা কষ্ট হয়। তয় সময় নিয়ে করলি কষ্ট ইট্টু কম হয়।’

গাছি ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমাগের জন্যি যদি গাছ বাওয়া মেশিন দিত, তালি আমাগের সুবিধা হইতো। কষ্ট কম হইতো। রসও বেশি পাওয়া যাইত।’

যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘যশোর জেলায় প্রায় ৫ লাখ খেজুরগাছ রয়েছে। গত মৌসুমে এখান থেকে সাড়ে তিন হাজার মেট্রিক টন খেজুরের গুড় উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫০০ টন গুড় ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে আমরা চেষ্টা করছি বিদেশি ক্রেতা খোঁজা এবং সমন্বয় করার। কেননা, বিদেশে প্রচুর পরিমাণে খেজুর গুড়ের চাহিদা রয়েছে। আর সে লক্ষ্যে এবার যশোরে ৫ হাজার মেট্রিক টন খেজুর গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।’

কৃষি কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ হোসেন আরও বলেন, ‘গাছে ওঠার জন্য উন্নত প্রযুক্তি সংগ্রহের লক্ষ্যে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দেশে যোগাযোগ করা হচ্ছে। প্রক্রিয়াটি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত