Ajker Patrika

কাঙাল হরিনাথের প্রেস

সম্পাদকীয়
কাঙাল হরিনাথের প্রেস

রাজনৈতিকভাবে গরম আবহাওয়ার মধ্যে একটি মন ঠান্ডা করা সংবাদ পাওয়া গেল। কাঙাল হরিনাথের মথুর নাথ (এম এন) প্রেসটি সংরক্ষণের জন্য জাতীয় জাদুঘর ও কাঙাল হরিনাথের বংশধরদের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে জাতীয় জাদুঘরের নবনির্মিত বোর্ড সভাকক্ষে। ২০ লাখ টাকা এবং কাঙালের দুই বংশধরকে জাদুঘরে চাকরি দেওয়ার বিনিময়ে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন কাঙাল হরিনাথের চতুর্থ বংশধরের স্ত্রী গীতা মজুমদার। ছোট্ট এ সংবাদটি আমাদের অতীত ঐতিহ্য সংরক্ষণের এক অনন্য বার্তা হয়ে রইবে।

গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ বলা হয় কাঙাল হরিনাথকে। মূলত কাঙাল হরিনাথ শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের পক্ষে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। লেখাপড়া খুব বেশি করতে পারেননি আর্থিক কারণে, কিন্তু ১৮৫৫ সালেই ২০ বছর বয়সে তিনি বন্ধুদের সহায়তায় নিজ গ্রামে ভার্নাকুলার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজে সেখানে অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পরের বছর তাঁর সহযোগিতায় কৃষ্ণনাথ মজুমদার কুমারখালীতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন।

সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন সংবাদ প্রভাকর নামের পত্রিকায়। সেখানে তিনি অত্যাচারিত কৃষক সম্প্রদায়ের পক্ষে কলম ধরেন। ১৮৬৩ সালে তিনি নিজেই ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন। পরে তা পাক্ষিক এবং আরও পরে তা সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে এক পয়সা মূল্যে বিক্রি করা হতো। পত্রিকাটি প্রথমে প্রকাশিত হতো কলকাতার গিরিশ বিদ্যারত্ন প্রেস থেকে। পরে ১৮৬৪ সালে কুমারখালীতে স্থাপিত হয় মথুর নাথ যন্ত্র। অক্ষয়কুমার মৈত্রের বাবা হরিনাথের বন্ধু মথুর নাথ প্রেসটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তিনি তা কাঙাল হরিনাথকে দান করেন। ১৯৭৩ সাল থেকে এই যন্ত্রেই ছাপা হতে থাকে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’।

এই পত্রিকায় সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধের পাশাপাশি নীলকরদের অত্যাচারের খবর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ছাপানো হতো। এটা ব্রিটিশ সরকার এবং প্রজাপীড়ন করা জমিদারেরা পছন্দ করত না। তারা কাঙাল হরিনাথকে নানাভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে থাকে। কিন্তু তাতে দমে যাননি তিনি। রাজশাহীর রানী স্বর্ণকুমারী দেবীর আর্থিক সহায়তায় পত্রিকাটি প্রকাশিত হতে থাকে। দীর্ঘ ১৮ বছর চলার পর আর্থিক কারণে এবং মুদ্রণবিষয়ক আইনের কারণে ১৮৮৮ সালে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।

ফকির লালন শাহর শিষ্য ছিলেন কাঙাল হরিনাথ। ১৮৮০ সালে তিনি ‘কাঙাল ফিকির চাঁদের দল’ নামে একটি বাউল দলও গঠন করেছিলেন। সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রে কাঙাল হরিনাথের লেখা ‘হরি দিন যে গেল সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে’ গানটি ব্যবহার করেছেন।

ফকির লালন শাহ এবং কাঙাল হরিনাথ—দুজনের জন্মই কুষ্টিয়ায়। কাঙাল জন্মেছিলেন কুমারখালীতে, লালন কুমারখালীর অন্তর্গত গড়াই নদীর অপর পারে ভাঁড়ারা গ্রামে। দুজনই ছিলেন দরিদ্র। সেই দরিদ্রতার মধ্যেই তাঁরা মহৎ জীবনের সাধনা করেছেন। পার্থিব লোভ-লালসা তাঁদের মধ্যে ছিল না। কুমারখালীর কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘরে দর্শনার্থীরা নিশ্চয়ই মুদ্রণযন্ত্রটির সঙ্গে আমাদের ইতিহাসও খুঁজবেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত