Ajker Patrika

কোনটায় আক্রান্ত হতে চান?

রহমান মৃধা
কোনটায় আক্রান্ত হতে চান?

জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে আমরা কিন্তু অস্ত্র নয়, বই হাতে নিই। আবার এমনও সময় জীবনে আসে বা আসতে পারে, যখন আমরা বই ফেলে অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হই। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের তাগিদে বই ছেড়ে অস্ত্র ধরেছিলাম, পরে দেশ স্বাধীন হলে অস্ত্র ছেড়ে বই ধরেছি। পৃথিবীতে অনেক দেশ রয়েছে, যারা এখনো এই কাজ করে চলেছে। অনেকের ধারণা, হাতে বই উঠলে অস্ত্র মাটিতে নামাতে বাধ্য সবাই, সেটা পৃথিবীর যেখানেই হোক না কেন। এটা এই যুগে সঠিক নয়। কারণ এই যুগে বাধ্যবাধকতা বলে কিছু নেই, নৈতিকতা বলেও কিছু নেই। তবে ক্ষমতা ধরে রাখতে যা কিছু করা, সেটা করতে অনেকে জীবন নিতে এবং দিতে প্রস্তুত।

একটি রাষ্ট্রের পরিকাঠামোয় অনেক কার্যক্রম থাকে, তবে দুটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক কাজে রাষ্ট্র বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সে দুটি মৌলিক কাজ হলো রাষ্ট্রে বেকারত্ব দূরীকরণ এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। যে দেশগুলো এর দুটিতেই ব্যর্থ, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও আমরা এ দুটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে পারিনি, খাতা-কলমে গুরুত্ব দিলেও তেমন ফল দেখাতে পারিনি। পুরো দেশটি এখন দুর্নীতিগ্রস্ত। শিক্ষায় দুর্নীতি, খাবারে ভেজাল, রাজনীতিতে প্রতিহিংসাপরায়ণ মানসিকতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার।

সুস্থ ও ন্যায়বিচারের সঙ্গে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ পেতে অস্ত্র হাতে নিতে হতে পারে! বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা বা স্বাধীন করার জন্য নেতৃত্ব দেওয়া আর দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান করা এক নয়। এই কঠিন ও জটিল কাজে নেতৃত্ব দেওয়া ও বিজয়ী হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এ ধরনের সমস্যা যেসব দেশে ছিল বা আছে, অতীত ও বর্তমান দেখলে লক্ষণীয় যে, বড়সড় গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এর সমাধান হয়েছে। আমরা কি আদৌ প্রস্তুত তেমন একটি বিপ্লবের জন্য, যাকে বলে গণ-অভ্যুত্থান? এখন প্রশ্ন, কিসের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান? গণতন্ত্রের, নাকি স্বৈরতন্ত্রের? এক বাক্যে সবাই বলবে—স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এখানেই যত ন্যাটা!

আমরা সবাই গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে মূলত স্বৈরশাসন কায়েম করে চলেছি। আমার এই যুক্তি বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই তো? তাহলে একটা ঘটনা তুলে ধরি। যেমন—সুইডেনের বর্তমান দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতারা সরাসরি ইসলামের বিরুদ্ধে নানা ধরনের মন্তব্যসহ পবিত্র কোরআন প্রকাশ্যে পোড়াচ্ছে—গণতন্ত্র ও বাক্‌স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে। একটা জাতি বা ধর্মের বিশ্বাসকে দিবালোকে পোড়ানো হচ্ছে, অথচ দেশটি কিছুই করছে না। কিন্তু যদি একটি দেশের পতাকা পোড়ানো হয় বা কোনো ব্যক্তিকে তার বর্ণের ভিন্নতার কারণে কটূক্তি করা হয়, তবে সেটা বড় ধরনের অপরাধের সারিতে ফেলে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। একইভাবে হঠাৎ যদি একটি দেশের সঙ্গে যুদ্ধ লাগে, তবে একে অপরকে খুন করা মানে বীর খেতাব অর্জন করা। কিন্তু যদি চোখের সামনে নিজের বোন বা মাকে কেউ ধর্ষণ করে এবং নিজ হাতে যদি তার প্রতিশোধ কেউ নেয়, তবে সেটা হবে বড় অপরাধ এবং তার জন্য বাকি জীবন জেলহাজত এমনকি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। এখন আমার প্রশ্ন, এ ধরনের ঘটনা কোন তন্ত্র বা কোন শাসনের মধ্যে পড়ে? পুরো পৃথিবীকে এখন যদি ‘আন্ডার অল ক্রিটিসিজম’ বলি, তাহলে কি ভুল হবে?

ধরুন মহামারি চলছে। ক্যানসার ও কলেরা—কোনটায় আক্রান্ত হতে চান? এমন একটি সংকটের মধ্যে আমরা এখন যে আমাদের পছন্দের কিছু নেই। জাতি হিসেবে আমরা দুটোতেই আক্রান্ত। এমতাবস্থায় কী করণীয়, ভেবেছেন কি? জনগণ ভোট দেবে। কিন্তু কাকে দেবে? যে আছে সে হয়তো ক্যানসার, কিন্তু যে আসবে সে তো কলেরা!

গণ-অভ্যুত্থান করার আগে ভাবুন এবং নতুন সমস্যা না বাড়িয়ে বরং সমস্যাগুলো আগে শনাক্ত করা শিখুন, তারপর একে একে সেগুলোর সমাধান করুন। দেখবেন পরিবর্তন আসবে। যে পরিবর্তন আমাদের শেখাবে মানুষ এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক হতে, ভণ্ড হতে নয়।

লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত