Ajker Patrika

নিম্ন আদালতে মামলা: দলীয় বিবেচনা ছাড়া পিপি চায় পুলিশ

আমানুর রহমান রনি, ঢাকা
নিম্ন আদালতে মামলা: দলীয় বিবেচনা ছাড়া পিপি চায় পুলিশ

বিচারিক আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারি আইন কর্মকর্তাদের গাফিলতি ও অদক্ষতার অভিযোগ করেছেন বেশ কয়েকজন পুলিশ সুপার (এসপি)। নিজেদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে পুলিশ সদর দপ্তরে দেওয়া আলাদা চিঠিতে কয়েকটি জেলার এসপি এমন অভিযোগ করেন। তাঁরা বলেন, সরকারি আইন কর্মকর্তারা রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনায় আন্তরিক থাকেন না। অন্য আদালতে ব্যক্তিগত মামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে আসামিদের পক্ষে অন্য আদালতে মামলা পরিচালনা করেন। তাতে আসামিরা সুবিধা পান, বাদী ক্ষতিগ্রস্ত হন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রংপুর, শেরপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, নওগাঁ ও মৌলভীবাজারের এসপি গত বছরের অক্টোবরে সরকারি কৌঁসুলিদের গাফিলতি, অদক্ষতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ, সুপারিশসহ পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি দেন।

ওই এসপিদের মতে, সরকারি আইন কর্মকর্তাদের গাফিলতি ও অদক্ষতার জন্য ভাতা কম হওয়া এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া দায়ী। এই অবস্থায় তাঁরা দলীয় বিবেচনা বাদ রেখে দক্ষ ও সৎ আইনজীবীদের নিয়োগ দেওয়ার এবং তাঁদের ভাতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে অভিজ্ঞ ও দক্ষ আইনজীবীদের নিয়োগের বিষয়ে আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। এগুলো আমরাই আলোচনায় নিয়ে এসেছি। ধীরে ধীরে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পিপিদের ভাতা বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করার বিষয়টি আলোচনাধীন। জেলাভিত্তিক এটি করা হবে। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত করব।’

জানা যায়, দেশের নিম্ন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন দুই ধরনের আইনজীবী। যাঁরা ফৌজদারি আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে মামলা পরিচালনা করেন, তাঁদের বলা হয় পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি), আর যাঁরা দেওয়ানি আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের মামলা পরিচালনা করেন, তাঁদের বলা হয় গভর্নমেন্ট প্লিডার (জিপি)। আরও কয়েকজন বিশেষ, অতিরিক্ত ও সহকারী আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁদের বলা হয় বিশেষ পিপি, অতিরিক্ত জিপি, অতিরিক্ত পিপি, এজিপি, এপিপি ও এলজিপি।

রংপুরের এসপির পক্ষে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, পিপি-এপিপি নিয়োগের ক্ষেত্রে সততা, যোগ্যতা, দক্ষতার তুলনায় দলীয় বিবেচনা বেশি অগ্রাধিকার পায়। এ জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা বস্তুনিষ্ঠভাবে মামলা পরিচালনা করেন না। নির্ধারিত আদালত ছাড়াও অন্যান্য আদালতে আসামি বা বিবাদীদের হয়ে মামলা পরিচালনা করেন। এতে তাঁর নির্ধারিত আদালতে মামলা পরিচালনার সময় অনুপস্থিত থাকেন এবং মনোযোগের ঘাটতি হয়। ফলে আসামিরা খালাস পান। চিঠিতে দলীয় বিবেচনার চেয়ে দক্ষ ও সৎ আইনজীবীদের এই পদে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া নিম্ন আদালতে আগের মতো পুলিশ নিজেই যাতে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনা করতে পারে, সে সুযোগ চাওয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রংপুরের এসপি মো. ফেরদৌস আলী চৌধুরী বলেন, এটা পরামর্শ। তিনি আরও বলেন, ভুক্তভোগীদের সঠিক বিচার নিশ্চিত করা এবং দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কৌঁসুলি, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সবাই একযোগে কাজ করছেন।

শেরপুরের এসপি চিঠিতে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে পিপি, বিশেষ পিপি, জিপি এবং এপিপিদের যথেষ্ট আন্তরিকতার অভাব এবং অনভিজ্ঞতা পরিলক্ষিত হয়। ধার্য তারিখে সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা হলেও বিনা কারণে তাঁদের সাক্ষ্য না নিয়ে মাঝেমধ্যে ফেরত দেওয়া হয়। কিছু সাক্ষীকে দায়সারাভাবে আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এতে আসামিপক্ষ সুবিধা পায়। এ ছাড়া কোনো মামলার রায় সরকারের বিপক্ষে গেলে তাঁরা আপিল দায়ের করেন না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পিপিরা আসামিপক্ষের হয়ে বাদীপক্ষকে আপসে উৎসাহিত করেন।

চিঠিতে বলা হয়েছে, সরকারি কৌঁসুলিদের সম্মানী ভাতা অপ্রতুল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেরপুরের এসপি মোনালিসা বেগম তাৎক্ষণিকভাবে মনে করতে না পারায় কিছু বলতে রাজি হননি।

আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে জিপি, পিপি ও বিশেষ পিপিদের মাসিক রিটেইনার ফি বিভাগীয় শহরের ক্ষেত্রে ১৫ হাজার টাকা এবং জেলা শহরের ক্ষেত্রে ১২ হাজার টাকা। এ ছাড়া জিপিদের মামলাপ্রতি মাসিক ভ্যালুয়েশন ফি ৫ হাজার টাকা। মামলার শুনানির জন্য পিপিদের দৈনিক ফি ৬০০ টাকা, অর্ধদিবসের জন্য ৩০০ টাকা। অতিরিক্ত জিপি ও অতিরিক্ত পিপিদের মাসিক রিটেইনার ফি ১২ হাজার টাকা। এজিপি, এপিপি ও এলজিপিদের মাসিক রিটেইনার ফি বিভাগীয় শহরের ক্ষেত্রে ৬ হাজার টাকা।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নাও মনে করেন, সরকারি কৌঁসুলিদের নির্দলীয় হওয়া উচিত। তাঁদের যে ভাতা দেওয়া হয়, তা-ও নগণ্য। তাই সৎ ও অভিজ্ঞ আইনজীবীরা এখানে আসতে চান না। তিনি বলেন, ‘একসময় ঢাকার আদালতে লিজেন্ডারি আইনজীবীরা পিপি হতেন। তাঁদের কেউ কোনো অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার সাহস পেত না। কিন্তু দিনে দিনে সেই জায়গাটা আমরা নষ্ট করেছি। এখন মেধাবীরা আর এই পদে আসতে চান না। এ জন্য সরকারের উচিত ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর নীতিমালা করে পিপিদের ভাতা বাড়ানো। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত