Ajker Patrika

অকস্মাৎ গুলির শব্দ

জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা
অকস্মাৎ গুলির শব্দ

২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের আন্দোলনের ওপর পুলিশ গুলি চালাতে পারে, এ রকম কথা কেউই ভাবতে পারেনি। লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস, গ্রেপ্তার ইত্যাদি পর্যন্ত ছিল ভাবনার সীমানা। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া মানুষের শরীর লক্ষ্য করে গুলি চালানোর ভাবনা কার মাথায় এসেছিল, সেই রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। তবে অবাঙালি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোরাইশী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ মাহমুদ এবং চিফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদের ওপর দায় চাপানো হয়।

বাঙালি ডিআইজি ওবায়দুল্লাহর কথা চেপে যাওয়া হয়। আর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা তো ছিলেন বাঙালি। সুতরাং তাঁদের ওপরও গুলিবর্ষণের দায় বর্তায়।

তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন ছিল মেডিকেল কলেজ লাগোয়া। দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দেয়ালের একটি অংশ ছিল ফাঁকা। সেই ফাঁকা অংশ দিয়ে দলে দলে ছাত্ররা যাচ্ছিল মেডিকেল হোস্টেলের দিকে। এখন যেখানে মেডিকেল কলেজের আউটডোর আর ডিসপেনসারি, সেখানেই ছিল মেডিকেল হোস্টেলের ব্যারাকগুলো।

পূর্ববঙ্গ বিধানসভার অধিবেশন ছিল বেলা তিনটায়। মেডিকেল হোস্টেলের সামনে দিয়ে পরিষদ সদস্যদের কেউ কেউ যাবেন, সেটা ভেবেছিলেন ছাত্ররা।

মানিকগঞ্জের এমএলএ আওলাদ হোসেনের সঙ্গে রাজা মিয়াকেও কিছু তরুণ ছাত্র মেডিকেল হোস্টেলে নিয়ে এসেছিলেন। পরিষদে রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলাকে গ্রহণ না করলে ইস্তফা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করা হয় আওলাদ হোসেনের কাছ থেকে।

পুলিশের লাঠিপেটা আর টিয়ার গ্যাসের বিপরীতে ছাত্ররা ছুড়ে মারছিলেন ইটপাটকেল। সে সময় স্লোগান উঠল, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও জনসমাগম হতে থাকল। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় মাঠ, মেডিকেল কলেজ গেটের সামনে এবং আশপাশের এলাকা ভরে গিয়েছিল আন্দোলনরত মানুষে। সেদিন নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, পাবনা, যশোর ও দিনাজপুরে পরিপূর্ণ হরতাল হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাসে সেই আন্দোলনকারীদের নামও অক্ষয় হয়ে থাকবে।

পুলিশ গুলি চালিয়েছিল তিনটার পর। উপস্থিত ছাত্র-জনতা ভেবেছিল, এটা বুঝি টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপের শব্দ। কিন্তু এটা যে শেল নয়, গুলি; সেটা বোঝা গেল কয়েকজনকে পড়ে যেতে দেখে। তাঁদের শরীর থেকে রক্ত বের হচ্ছিল।

পুলিশ প্রথমে গুলি ছুড়েছিল মেডিকেল ব্যারাকে না ঢুকে, পরে ভেতরে ঢুকেও গুলি করেছে। সেদিন যাঁরা মারা গিয়েছিলেন, তাঁরা হলেন রফিক উদ্দিন, আবুল বরকত ও আবদুল জব্বার। সেদিন গুলিতে আহত হয়েছিলেন আব্দুস সালাম, তবে তিনি হাসপাতালে মারা যান ৭ এপ্রিল। ভাষাশহীদদের নিয়ে লেখা হবে কাল। 
২১ ফেব্রুয়ারি ২০ নম্বর ব্যারাকের ১ নম্বর কক্ষে ছিল এই কন্ট্রোল রুম। দুপুর ১২টার মধ্যে কন্ট্রোল রুম তৈরির সব ব্যবস্থা করে ফেলেন মেডিকেল ছাত্র ইয়াহিয়া। স্পিকারটি লাগানো হয়েছিল পরিষদ ভবনের নাকের ডগায়। প্রচারের লাগাতার কণ্ঠ দিয়ে যাচ্ছিলেন মেডিকেল কলেজের ছাত্র সরফুল আলম (পরে ভয়েস অব আমেরিকা, ওয়াশিংটনে ঘোষক-পাঠক), আবুল হাশিম (দীর্ঘকাল ধরে সৌদিপ্রবাসী চিকিৎসক) এবং আরও দু-একজন।

গুলি চলার পরই কন্ট্রোল রুম থেকে যে প্রচার চলছিল, তাতে দেখা দিল গুণগত পরিবর্তন। প্রচারের পাশাপাশি এবার শুরু হয় সরকারবিরোধী বক্তৃতা। ব্লাড ব্যাংকে রক্ত দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। পরিষদ সদস্য মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ এসে এখানে বক্তৃতা করেন।

যে পরিষদের সদস্যদের কাছে রাষ্ট্রভাষা-প্রসঙ্গটি তুলতে বলছিলেন শিক্ষার্থীরা, সেই পরিষদে সেদিন যে আলোচনা হয়েছিল, তার নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায় পরিষদের বিবরণীতে। পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়েছিল সেদিন সাড়ে তিনটার সময়। এরই মধ্যে ঘটে গিয়েছিল সেই রক্তক্ষয়ী ঘটনা। আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মনোরঞ্জন ধর সরকারের সমালোচনায় ফেটে পড়েন। মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন তখন পরিষদের অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন না। পরিষদ সদস্যদের বিধি মেনে চলার অনুরোধ করেন স্পিকার। কিন্তু তাঁরা বললেন, পরিষদের নেতা আগে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখে আসবেন, বিবৃতি দেবেন, তারপর পরিষদ চলবে। 

নূরুল আমীন পরিষদে এসে ছাত্রদের দোষারোপ করতে থাকেন। তার প্রতিবাদ করেন পরিষদ সদস্যদের একাংশ। কী এমন ঘটনা ঘটেছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৪৪ ধারা ধারার সময়সীমা বাড়িয়ে এক মাস করা হলো, সে বিষয়ে জানতে চান পরিষদ সদস্যরা।

অনেক বাদানুবাদের পর ২২ ফেব্রুয়ারি বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত পরিষদ মুলতবি রাখেন স্পিকার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত