Ajker Patrika

লালনসম্রাজ্ঞীর বিদায়...

চলে গেলেন লালনসম্রাজ্ঞী, রেখে গেলেন শূন্যতা। শনিবার রাতে ফরিদা পারভীনের প্রয়াণে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমেছে শোকের ছায়া। দেশ-বিদেশের শিল্পীরা শোক প্রকাশ করেছেন। শিল্পী আর শিল্পীর গাওয়া গান নিয়ে স্মৃতি হাতড়ে জানিয়েছেন নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা।

বিনোদন ডেস্ক
সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন; ছবি: সংগৃহীত
সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন; ছবি: সংগৃহীত

1

ফরিদা পারভীনের মতো শিল্পীকে হারানো আমাদের জন্য বিরাট ক্ষতি

রুনা লায়লা

এ রকম একটা খবর পেয়ে মনটা ভীষণ খারাপ। দেশের বাইরে থাকার কারণে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারলাম না। দেশে থাকলে অবশ্যই যেতাম। তার অসুস্থতার খবর শুনে অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করেছি। যেকোনো কারণে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সব সময় তার সুস্থতা কামনা করেছি। তার মৃত্যুর খবর পেয়ে খুব মর্মাহত।

ফরিদা পারভীনের মতো একজন শিল্পীকে হারানো আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য বিরাট ক্ষতি। মানুষ হিসেবেও সে ভীষণ ভালো ছিল। আমাকে খুব ভালোবাসত এবং শ্রদ্ধা করত। আমাদের খুব বেশি দেখা হয়নি। তবে যখনই দেখা হয়েছে, হাসিমুখে আমাকে বরণ করে নিয়েছে। তার ছেলের বিয়েতে যাওয়াতে সে খুব খুশি হয়েছিল। আমি দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে জান্নাত নসিব করেন। ফরিদাকে নিয়ে গুছিয়ে বলতে পারছি না। এই মুহূর্তে কিছু বলার মতো মনের অবস্থা নেই। এই শোক কাটিয়ে উঠতে তার পরিবারকে যেন আল্লাহ শক্তি দেন। এত বড় ক্ষতি যেন তারা সইতে পারে।

forida-parvin--gazi-abdul-hakim

ফরিদা পারভীনের মতো শিল্পী শতবর্ষে একবার আসেন

গাজী আবদুল হাকিম

ফরিদা পারভীনের মতো শিল্পী শতবর্ষে একবার আসেন। তাঁর চলে যাওয়ার ক্ষতি পূরণ কীভাবে হবে আমি জানি না। কারও জন্য তো কোনো কিছু আটকে থাকে না। এটাও ঠিক, ফরিদা পারভীন আর আসবেন না। কাজী নজরুল ইসলাম কি আর কোনো দিন হবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি হবে? আমি তাঁদের সঙ্গে তুলনা করছি না। কিন্তু ফরিদা পারভীন শতবর্ষে একবার আসেন।

কুষ্টিয়ার আখড়া থেকে পৃথিবীর দরবারে লালনগীতি পৌঁছে দিয়েছেন ফরিদা পারভীন। বড়লোকদের ড্রয়িংরুমে পৌঁছে দিয়েছেন। এর চেয়ে বড় কিছু তো আর হতে পারে না।

তাঁর স্মৃতি নিয়ে বাকি জীবনটুকু বেঁচে থাকতে হবে। কিন্তু এই বেঁচে থাকা অনেক কষ্টের। আমরা যুগলবন্দী ছিলাম। আমার বাঁশি আর ফরিদা পারভীনের গান যেভাবে ক্লিক করেছে, সেটা আর কোথাও হয়নি। আমি জানি না আমার বাঁশির সুরের কী হবে। হয় আমাকে ছেড়ে দিতে হবে, নাহলে আরও বেশি করে বাজাতে হবে, যাতে ওপারে সে তৃপ্তি পায় যে আমার হাকিম তো বাঁশিটা বাজাচ্ছে।

Moushumi-Bhoumik_Pro

ফরিদা পারভীনের গানের ভেতরে কোনো খাদ নেই

মৌসুমী ভৌমিক

ফরিদা পারভীন যথাস্থানে শিক্ষিত, দীক্ষিত (মোকসেদ আলী সাঁইয়ের কাছে সেই ছোটবেলা থেকে গান শিখেছেন তিনি)। ফলে তাঁর গানের একদম ভেতরটাতে কোনো খাদ নেই। ফরিদা পারভীনের গান শুনতে শুনতে একটা জিনিস খেয়াল করি, অঞ্চলের একটা ধ্বনি যে থাকে, কণ্ঠস্বরের একটা টেক্সচার, টোন—একেক অঞ্চলের শিল্পীদের গলায় বিভিন্নতার ভেতরে এই একটা মিলও শুনতে পাওয়া যায়। ফরিদা পারভীন যতই দেশ-বিদেশে, কমার্শিয়াল প্রোডাকশনে, টিভিতে, ক্যাসেটে, রেকর্ডে, কিবোর্ড প্যাডের অনুষঙ্গে গান গেয়ে থাকুন; তাঁর গান থেকে কুষ্টিয়া মুছে যায়নি বলেই আমার মনে হয়।

১৯৯৫-৯৬ সালে ঢাকার নিউমার্কেট থেকে আমার জন্য একটি ক্যাসেট তৈরি করে এনে দিয়েছিল শাহীন আখতারের বোন রোনা। মিক্সটেপ যাকে বলে। কলকাতায় ফিরে ঘরে বসে শুনে শুনে আমি সব গানের নাম লিখে রেখেছিলাম আর কিছু কিছু গান গাইতেও শিখেছিলাম। সেই প্রথম আমার ফরিদা পারভীন শুনে গান শেখা। টেপ রেকর্ডারটা সারাতে দিয়েছি, অথচ আজ এতই ইচ্ছে হচ্ছে এই ক্যাসেটটা একবার শুনি। আমি জানি, শুনতে শুরু করলে সব ইন্টারলিউড, প্রিলিউড, ফরিদা পারভীনের গলার ভাঁজ, যা আমার পক্ষে অননুকরণীয়, সব আমার মনে পড়ে যাবে। তবু গলা মিলিয়ে মিলিয়ে গাইতে থাকব, সেও আমি জানি। এসব গান আমাদের জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে বাঁধা। ভালো-মন্দের ঊর্ধ্বে।

Untitled-1

লালনের গান আধুনিকায়ন করে আমাদের কাছে উপস্থাপন করেছেন তিনি

কনকচাঁপা

ফরিদা পারভীন আপা লালনগীতিতে যে জনপ্রিয়তা তৈরি করেছিলেন, সেই পুরো জায়গাটা শূন্য করে নিজের সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন। আধুনিক জীবনে আমরা যারা লালনগীতি শুনতাম, এখনো শুনি, সেই জায়গাটা ফরিদা আপা সৃষ্টি করেছেন। যাঁরা লালন সাঁইজির আখড়ায় গান করেন, তাঁদের গান একরকম। সেই গান আধুনিকায়ন করে আমাদের কাছে উপস্থাপন করেছেন তিনি।

লালনগীতি ছাড়াও তাঁর কণ্ঠে দেশের গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর গলার সুর ছিল তিরের মতো। আল্লাহ তাঁর এতটুকুই হায়াত রেখেছিলেন। কিন্তু উনার আরও দীর্ঘদিন বাঁচার দরকার ছিল আমাদের জন্য, বাংলাদেশের শ্রোতাদের জন্য, শিল্পীদের জন্য।

সংগীতাঙ্গনে যাঁরা আমাদের মাথার ওপর বটবৃক্ষের মতো ছিলেন। যে ভরাট সংগীতাঙ্গন দেখে বড় হয়েছি, ঋদ্ধ হয়েছি; সেই অঙ্গনের অনেককে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। অসহায় হয়ে যাচ্ছি। সাধারণ মানুষ নিজের সময়কে আনন্দময় করতে গান শোনেন। কিন্তু শিল্পীর মৃত্যুর পর পাপ-পুণ্য, বেহেশত-দোজখ—এসব নিয়ে এত কথা বলে! সেই মন্তব্যগুলো দেখলে আমরা ভীত হয়ে যাই। ভেঙে পড়ি। আমার বিনীত অনুরোধ, আমাদের শিল্পীদের এত পাপী ভাববেন না।

একনজরে ফরিদা পারভীন

জন্ম : ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৫৪ (নাটোরের সিংড়া উপজেলার সাউল গ্রামে)

মা-বাবা : বাবা দেলোয়ার হোসেন, মা রউফা বেগম।

গানে হাতেখড়ি: পাঁচ বছর বয়সে ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে। পরে গান শিখেছেন মোকসেদ আলী সাঁইয়ের কাছে।

শিক্ষাজীবন: মীর মশাররফ হোসেন মাধ্যমিক বিদ্যালয় (এসএসসি), কুষ্টিয়া গার্লস কলেজ (এইচএসসি), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ (বাংলা সাহিত্যে অনার্স)

সংগীত শুরু: প্রথম জীবনে নজরুলসংগীত গাইতেন। বেশ কিছু আধুনিক এবং দেশাত্মবোধক গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন।

লালনসংগীতে আগ্রহ: স্বাধীনতার পর লালনের গান শেখা ও গাওয়া শুরু করেন।

প্রথম পরিচিতি: বাংলাদেশ টেলিভিশনের গীতি-আলেখ্য অনুষ্ঠানে ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’ এবং ‘সত্য বল সুপথে চল’ গান দুটি গেয়ে প্রথম পরিচিতি পান।

জনপ্রিয় আধুনিক ও দেশাত্মবোধক গান: ‘এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী তটে’, ‘তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম’, ‘নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে’ ইত্যাদি।

পুরস্কার ও সম্মাননা: একুশে পদক (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩), জাপান সরকারের ফুকুওয়াকা এশিয়ান কালচার পুরস্কার (২০০৮)

মৃত্যু : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ (ঢাকা)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিক্ষোভ থেকে সহিংসতায় উত্তাল ভাঙ্গা, মসজিদে আশ্রয় নিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা

দাওয়াত না দেওয়ায় মাদ্রাসার সব খাবার খেয়ে গেলেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা

উত্তাল ভাঙ্গা: থানাসহ চারটি সরকারি দপ্তরে হামলা-ভাঙচুর, পুলিশসহ আহত অনেকে

সন্তানের গলা কেটে লাশ বাবার হাতে তুলে দিলেন মা

ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনসহ ৫ দাবিতে জামায়াতের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত