Ajker Patrika

নেটফ্লিক্সের দখলে যাচ্ছে হলিউড সাম্রাজ্য, বাদ সাধতে পারে রাজনৈতিক চক্রান্ত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ৫৮
নেটফ্লিক্সের দখলে যাচ্ছে হলিউড সাম্রাজ্য, বাদ সাধতে পারে রাজনৈতিক চক্রান্ত

ওয়ার্নার ব্রাদার্স ডিসকভারির কিংবদন্তি ফিল্ম স্টুডিও এবং জনপ্রিয় এইচবিও স্ট্রিমিং নেটওয়ার্ক অধিগ্রহণ করছে জনপ্রিয় স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্স। গতকাল শুক্রবার নেটফ্লিক্স জানিয়েছে, ৭২ বিলিয়ন ডলারে ওয়ার্নার ব্রাদার্স ডিসকভারি কিনছে তারা। এটি কেবল একটি সাধারণ চুক্তি নয়—এটি একধরনের হলিউডীয় নাটক, যেখানে রয়েছে প্রভাবশালী ক্রেতা, রাজনৈতিক রহস্য এবং একাধিক টান টান উত্তেজনার নাটকীয়তা। এই অধিগ্রহণটি বাস্তবে হতে যাচ্ছে এক বিজয়ী দানবের উত্থানের গল্প। চুক্তি সম্পন্ন হলে নেটফ্লিক্সের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষমতা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে।

তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দরদাতারা এখনো মাঠে থাকায়, এই আখ্যান শেষ হতে এখনো অনেক দেরি। এই বিশাল চুক্তিটি সম্পন্ন হওয়ার আগে পাঁচটি মূল বিষয় রাজনৈতিক ও শিল্পমহলের নজর কেড়েছে:

১. নেটফ্লিক্সের অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা বৃদ্ধি

বহু বছর ধরেই নেটফ্লিক্স হলিউডে অবস্থান সুসংহত করেছে, বর্তমানে এটি বিশ্বের বৃহত্তম স্ট্রিমিং সাবস্ক্রিপশন পরিষেবা এবং নতুন কনটেন্ট নির্মাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রযোজক। কিন্তু এই চুক্তিটি—যা এই শিল্পে বহু বছরের মধ্যে বৃহত্তম, নেটফ্লিক্সকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। এর আর্কাইভে আরও যা কিছু যুক্ত হবে—

বিশাল ক্যাটালগ: নেটফ্লিক্স প্রায় এক শতাব্দীর ক্ল্যাসিক টাইটেল এবং বিখ্যাত ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর একটি ক্যাটালগ হাতে পাবে।

গ্রাহকসংখ্যা: নেটফ্লিক্স তার ৩০০ মিলিয়নের বেশি বিদ্যমান গ্রাহকসংখ্যার সঙ্গে এইচবিওর প্রায় ১২৮ মিলিয়ন গ্রাহককে যুক্ত করবে। গবেষণা সংস্থা ফরেস্টারের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক প্রউলক্স বলেছেন, নেটফ্লিক্স ইতিমধ্যেই সবচেয়ে বড় স্ট্রিমিং পরিষেবা এবং এর সঙ্গে এখন এইচবিও ম্যাক্স যুক্ত হলে, এটি তর্কাতীতভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে।

বিখ্যাত ফ্র্যাঞ্চাইজি: এই চুক্তির ফলে ‘লুনি টিউনস’, ‘হ্যারি পটার’, ‘ফ্রেন্ডস’ এবং এইচবিওর হিট শো যেমন ‘সাকসেশন’, ‘সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি’ ও ‘গেম অব থ্রোনস; নেটফ্লিক্সের ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’-এর মতো জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে একই প্ল্যাটফর্মে চলে আসবে। এই ক্রয়ের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের টিএনটি স্পোর্টসও অন্তর্ভুক্ত।

২. গ্রাহক মূল্য: বাড়বে না কমবে?

নেটফ্লিক্স আশা করছে, আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে চুক্তিটি সম্পন্ন হবে। তবে ওয়ার্নার ব্রাদার্স এবং এর ফ্ল্যাগশিপ ব্র্যান্ড এইচবিওকে কীভাবে নেটফ্লিক্সের বিদ্যমান পরিষেবার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, সে বিষয়ে নির্বাহীরা এখনো স্পষ্ট নন। নেটফ্লিক্সের সহ-প্রধান নির্বাহী গ্রেগ পিটার্স এইচবিও ব্র্যান্ডটিকে ‘খুব শক্তিশালী’ বলে অভিহিত করেছেন এবং জানিয়েছেন যে এটি তাঁদের হাতে ‘অনেক বিকল্প’ দেবে।

প্যাকেজিংয়ের সম্ভাবনা: নেটফ্লিক্স বিভিন্ন বান্ডেলে ফিল্ম এবং প্রোগ্রামগুলোকে একত্র করতে পারে। তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এইচবিও ব্র্যান্ডটি পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেলে তাঁরা অবাক হবেন।

সাবস্ক্রিপশন মূল্যের প্রভাব: নেটফ্লিক্সের আধিপত্য তাদের গ্রাহকদের কাছ থেকে বেশি চার্জ করার সুযোগ করে দিতে পারে। অন্যদিকে, যদি দর্শকেরা দুটি স্ট্রিমিং পরিষেবার পরিবর্তে একটির জন্য অর্থ দেন, তাহলে তাঁদের খরচ কমতেও পারে।

৩. স্ট্রিমিংই ভবিষ্যৎ, শেষ হচ্ছে সিনেমার স্বর্ণযুগ

ওয়ার্নার ব্রাদার্স হলো সেই স্টুডিওগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা ‘কাসাব্লাংকা’, ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ এবং ‘দ্য এক্সরসিস্ট’-এর মতো ক্ল্যাসিক নির্মাণ করে হলিউডের স্বর্ণযুগকে সংজ্ঞায়িত করেছিল। কিন্তু এই অধিগ্রহণটি স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, সিনেমার সেই সোনালি যুগ শেষ হচ্ছে।

ফরেস্টারের মাইক প্রউলক্স বলেন, গতিপথ স্পষ্ট—ভবিষ্যৎ পুরোপুরি স্ট্রিমিং-নির্ভর। তিনি আরও বলেন, ‘এই চুক্তির সঙ্গে সঙ্গে এটি আনুষ্ঠানিক: লিগ্যাসি মিডিয়ার যুগ শেষ হচ্ছে।’

নেটফ্লিক্স ডিসি সুপারহিরো ফ্র্যাঞ্চাইজি অধিগ্রহণ করছে, নিঃসন্দেহে এটি প্রেক্ষাগৃহে ভালো ব্যবসা করে। তাই তারা সিনেমা হলে চলচ্চিত্র মুক্তি অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে নেটফ্লিক্সের সহ-প্রধান নির্বাহী টেড সারান্ডোস এর আগে ‘সিনেমা দেখতে যাওয়া’কে একটি ‘সেকেলে ধারণা’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।

এই একীভূতকরণ এমন এক শিল্পে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে, যা ইতিমধ্যেই ছাঁটাই, উৎপাদন হ্রাস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) হুমকির সঙ্গে লড়াই করছে। ‘টাইটানিক’ পরিচালক জেমস ক্যামেরনসহ হলিউডের অনেকেই এই চুক্তিতে হতাশা প্রকাশ করেছেন।

৪. চুক্তির অনিশ্চিত পরিণতি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার বাধা

চুক্তি সম্পন্ন হওয়া এখনো বহু চ্যালেঞ্জের মুখে। প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে:

ওয়ার্নার ব্রাদার্সের স্পিন-অফ: প্রথমে, ওয়ার্নার ব্রাদার্স ডিসকভারিকে সিএনএন, ডিসকভারি এবং ইউরোস্পোর্টসসহ যে অংশগুলো নেটফ্লিক্সের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে না, সেগুলোর স্পিন-অফ সম্পূর্ণ করতে হবে।

প্রতিদ্বন্দ্বী দরদাতা: প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রেতা প্যারামাউন্ট স্কাইড্যান্স, যারা পুরো ওয়ার্নার ব্রাদার্স ডিসকভারি ব্যবসাটি কেনার আশা করেছিল, তারা শেয়ারহোল্ডারদের কাছে আরও ভালো বিকল্পের প্রস্তাব দিয়ে চুক্তিটি ভন্ডুল করার চেষ্টা করতে পারে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন: সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রকদের অনুমোদন মিলবে কি না। ওয়াশিংটন ডিসিতে আইনপ্রণেতারা ইতিমধ্যেই এই চুক্তির বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন, কারণ তাঁরা আশঙ্কা করছেন, এটি ভোক্তাদের সামনে পছন্দমতো প্ল্যাটফর্ম কমিয়ে দেবে এবং সাবস্ক্রিপশন ফি বাড়বে।

নেটফ্লিক্সের সহ-প্রধান নির্বাহী সারান্ডোস অবশ্য বিশ্বাস করেন, তাঁরা অনুমোদন পাবেন।

উল্লেখ্য, চুক্তিটি ভেস্তে গেলে নেটফ্লিক্সকে ওয়ার্নার ব্রাদার্সকে ৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার জরিমানা দিতে হবে।

৫. রাজনৈতিক ফ্যাক্টর

আলোচনার ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রভাব আরেকটি অপ্রত্যাশিত কারণ হিসেবে কাজ করছে। এই প্রশাসন সাধারণত একীভূতকরণের ক্ষেত্রে শিথিল নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বী দরদাতা প্যারামাউন্ট স্কাইড্যান্সের মালিক, টেক বিলিয়নিয়ার এবং রিপাবলিকান ডোনার ল্যারি এলিসন এবং তাঁর ছেলে ডেভিডকে অত্যন্ত পছন্দ করেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রকেরা এখনো কোনো মন্তব্য না করলেও সিএনবিসিকে ট্রাম্প প্রশাসনের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাঁরা নেটফ্লিক্সের প্রস্তাবটিকে ‘গভীর সন্দেহের চোখে’ দেখছেন। ফলে এই চুক্তি শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক পটভূমিতেই সম্পন্ন হবে কি না, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন থাকছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...