Ajker Patrika

কত রঙের নির্বাচন!

মীর রাকিব হাসান
কত রঙের নির্বাচন!

ঢাকা: ‘অ্যাকশন, টেনশন, সেক্স আর ভায়োলেন্স/ সবকিছু নিয়ে হবে ছবি এক পিস/ টিকিটের লাইনেতে রোজ হবে মারপিট/ হবেই হবেই হবে হিট।’ নচিকেতা চক্রবর্তীর বক্সঅফিস গানের লিরিক এটা। সব ব্যবস্থাপত্র মেনে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এবারের বিধানসভা নির্বাচন সব বিবেচনাতেই বক্সঅফিস হিট বলা যায়। ওই গানের তত্ত্ব মেনে তারার মেলা বসিয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা দলগুলো। বড় বড় তারকা সব মুখোমুখি। একেবারে ‘কেহ কারে নাহি জিনে সমানে–সমান’ দশা। টিকিটের লাইনে মারপিট না হলেও ভোটের লাইনে ঠিকই হচ্ছে। ভায়োলেন্সের চাহিদাও বেশ ভালোভাবেই পূরণ করা হচ্ছে। আর টেনশন ও অ্যাকশনের কথা না বললেও চলে।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভার পঞ্চম দফার নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষ হলো গতকাল শনিবার। এখনো তিন দফার ভোট বাকি। নির্বাচন শেষ হবে আগামী ২৯ এপ্রিল। আর ফল ঘোষণা ২ মে। কিন্তু এরই মধ্যে মূল দুই শিবির রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল ও কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) যে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে, তাতে নড়েচড়ে বসতেই হচ্ছে। এর বাইরে ৩৭ বছর ক্ষমতায় থেকে বিদায় নেওয়া বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের জোট সংযুক্ত মোর্চা যুক্ত করলে একেবারে মাস্টার–ব্লাস্টার।

ধারাটির শুরু করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসই। ২০১১ সালে তারকাদের ওপর ভর করেই ক্ষমতায় আসে তারা। এবার তৃতীয় দফা জয়ের লড়াই যখন করছে তারা, তখন নিজেদের অস্ত্রেই কাটা পড়ার দশা তাদের। অবশ্য সাধারণ মানুষের দিকটি আলাদা। তারা বেশ উত্তেজিত। রূপালি পর্দার তারকাদের নিজের দরজার সামনে দেখতে কার না ভালো লাগে।

তারায় রাঙা এ নির্বাচনে তৃণমূলের হয়ে লড়ছেন চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী, অদিতি মুন্সী, সায়নী ঘোষ, কাঞ্চন মল্লিক, রাজ চক্রবর্তী, জুন মালিয়া, কৌশানী মুখোপাধ্যায়, সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, লাভলি মৈত্ররা। গেরুয়া শিবিরও কম যায় না। তাদের আছে বাবুল সুপ্রিয়, পার্নো মিত্র, যশ দাশগুপ্ত, হিরণ, পায়েল সরকার, অঞ্জনা বসু, তনুশ্রী চক্রবর্তী, হিরণ চট্টোপাধ্যায়, শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়ের মতো তারকারা। সংযুক্ত মোর্চা তথা বামেদের একমাত্র তারকা প্রার্থী দেবদূত ঘোষ টালিগঞ্জ থেকে লড়ছেন। একাধিক কেন্দ্রে হয়েছে তারকাদের বিরুদ্ধে তারকাদের লড়াই।

চণ্ডীপুরে তারকা প্রার্থী হয়েছেন তৃণমূলের সহসভাপতি সোহম চক্রবর্তী। তাঁর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যশ দাশগুপ্তকে বেছে নিয়েছে বিজেপি। অন্যদিকে, বেহালা পূর্ব কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থী পায়েল সরকার লড়ছেন তৃণমূলের রত্না চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিপক্ষ হয়ে। সোনারপুর দক্ষিণ কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী তারকা লাভলি মৈত্রর বিরুদ্ধে লড়বেন বিজেপির প্রার্থী অভিনেত্রী অঞ্জনা দে।

প্রার্থী নন তবে আলোচিত

মিঠুন চক্রবর্তীমিঠুন চক্রবর্তী

অভিনয় জীবনে রাজনীতিকের ভূমিকায় একাধিকবার অভিনয় করেছেন মিঠুন। বাস্তব জীবনেও ছিলেন তৃণমূলের রাজ্যসভা সাংসদ। তবে সেই ইনিংস মাঝপথেই ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। বাম-তৃণমূল হয়ে সাময়িক বিরতি নিয়েছিলেন। এবার বিজেপির হাত ধরে রাজনীতিতে নতুন ইনিংস খেলছেন। প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও শেষ মুহূর্তে এমন কোনো চমক ঘটেনি। তবে নিয়মিতই প্রচারে বের হচ্ছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কটাক্ষ করে নিয়মিত বক্তব্য দিচ্ছেন বিজেপিতে যোগ দেওয়া মিঠুন চক্রবর্তী। পাল্টা জবাব দিচ্ছেন মমতাও। অতীত প্রসঙ্গ তুলে তৃণমূল প্রধান মমতা বলেন, ‘বিজেপির এখন বড় বড় নেতা হয়েছে। তারা নাকি গোখরো সাপ, কেউটে সাপ!’

জয়া বচ্চনজয়া বচ্চন

কলকাতার রাস্তায় চলছে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রোড শো। হুইলচেয়ার বসেই এগিয়ে চলেছেন মমতা। পাশে পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন সমাজবাদী পার্টির নেত্রী ও অভিনেত্রী জয়া বচ্চন। পরনে হলুদ শাড়ি, মাথায় পরিচিত সমাজবাদী পার্টির লাল টুপি। তাঁর হাত মমতার হুইলচেয়ারে। ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচনা তৈরি করে। তৃণমূল প্রার্থীদের হয়ে প্রচার করার জন্য জয়া বচ্চন এখন কলকাতায়।

এ ছাড়া দেব, নুসরাত জাহানরা নিজ নিজ দলের পক্ষে নিয়মিত প্রচারে বের হয়ে আলোচনা তৈরি করছেন।

শ্রীলেখা মিত্র

তারকা অথচ প্রার্থী নন। কোনো দলের সদস্য নন, তবে আজীবন বামদের সমর্থন করে যাবেন বলে আগেই জানিয়েছেন শ্রীলেখা। ইরই মধ্যে তিনি মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, সপ্তর্ষি দেব, সব্যসাচী জানা, দেবদূত ঘোষের হয়ে প্রচার করেছেন। পাশাপাশি তৃণমূল ও বিজেপিকেও একহাত নিয়েছেন। বিরোধী দুই দল তৃণমূল ও বিজেপিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিঁধেছেন বাক্যবাণে। প্রতিদিনই তিনি কোনো না কোনো মন্তব্য করে আলোচনায়। কথায় তিনি ছাড় দিচ্ছেন না নরেন্দ্র মোদি কিংবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। কখনো তিনি প্রতিবাদ করছেন, কখনো খোঁচাচ্ছেন, অভিনয়ে অনিয়মিত এই অভিনেত্রীর এখন এটাই একমাত্র কাজ।

আলাদা যারা

আারেক পক্ষও আছে। তারা এদের কারও সঙ্গেই নেই। এই দলও কিন্তু কম ভারী নয়। এত এত রাজনৈতিক রঙের ভিড়ে অনির্বাণ যেমন কোনো রাজনৈতিক রং বাছতে নারাজ। এমনকি নিজেকে বামপন্থী বলতেও নারাজ অনির্বাণ। তাঁর মতে, ‘টলিউডের মতো আঞ্চলিক ইন্ডাস্ট্রির একজোট হয়ে থাকা উচিত ছিল।’
 
পরমব্রতঅন্যদিকে পরমব্রতের মতে, ‘আমি এখন স্বাধীন। আর সেই স্বাধীনতা আমাকে অনেক কথা বলার জোর দেয়। কোনো দলে নাম লেখালে, অন্য সব দলের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। আর নিজের দলের কোনো কিছুতে আপত্তি থাকলে, মুখ বুজে থাকতে হবে। আর একটা জিনিসে আমি বিশ্বাস করি, দলীয় রং না লাগিয়ে কোনো মানুষ যখন কিছুর বিরোধিতা করে, জনসাধারণের কাছে তা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়।’

এ ছাড়া সব্যসাচী চক্রবর্তী, শুভদীপ গুহ, অনির্বাণ, অনুপম রায়, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, রূপঙ্কর বাগচী, উজান চট্টোপাধ্যায়, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়, ঋদ্ধি সেন, অরুণ মুখোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, সুমন মুখোপাধ্যায়, রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়, কৌশিক সেন, রেশমি সেনের মতো একঝাঁক তারকা কথা বলছেন দুই দলের বিপক্ষেই।

নির্বাচনী প্রেম

ভোটযুদ্ধে সরগরম পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি। পক্ষে-বিপক্ষের কথা চলছেই। লড়াই মূলত সবুজ ঘাসফুল ও কমলা গেরুয়া শিবিরের। মাঠ দখলের যুদ্ধে কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি পর্যন্ত ছাড়তে নারাজ। চৈত্রের তীব্র দাবদাহকেও হার মানাচ্ছে ভোটের প্রচার, পালটা প্রচারের উত্তাপ। তবে বিপক্ষে থেকেও তাঁদের প্রেমে কমতি পড়েনি।

বনি- কৌশানি

ভোটের আবহেই সকলকে চমকে দিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন বনি। তার আগেই তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন বনির মা পিয়া সেনগুপ্ত এবং প্রেমিকা কৌশানি। কৃষ্ণনগর উত্তর কেন্দ্রে হেভিওয়েট বিজেপি প্রার্থী মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে প্রার্থীও হয়েছেন কৌশানি। বিজেপিতে যোগ দিলেও বিতর্কে প্রেমিকার পাশেই থাকেন টলিউড তারকা বনি। কৌশানীর এক ভিডিও ভাইরাল হলে বনি ঠিকই সেখানে দোষ দেখেন না প্রেমিকার।

যশ- নুসরাতযশ- নুসরাত

নুসরাত জাহান ও যশ দাশগুপ্ত এখন পাওয়ার কাপল। তবে কথিত। আচার-আচরণে একজনের ছাড়া চলছেই না আরেকজনের। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে মুখে টু শব্দটি নেই কারও। এখন তো আরও নেই, কারণ নির্বাচন। কথিত প্রেমিক যশ যখন বিজেপির হয়ে নির্বাচনের মাঠ কাঁপাচ্ছেন, তখন কথিত প্রেমিকা নুসরাতও ব্যস্ত তুণমূলের হয়ে মাঠের দখল নিতে। ভিন্ন দুই দলের হয়ে লড়লেও আগ্রহীরা মুখিয়ে আছেন ভাবনায় ও কাজে নিজেদের এক প্রমাণ করতে। নির্বাচনের মাঠেও যে যশ-নুসরাত একে অন্যকে ছাড়া ভাবতে পারছেন না বা একই ধরনের কাজ করছেন, তা–ই প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে। তাদের প্রচারের ভঙ্গিও এক। এর মধ্যে একদিন ‘ডিনার ডেটে’ দেখা গেছে তাদের। তবে সেটা বোঝা গেছে একই ছবি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করার সুবাদে। আর তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হচ্ছে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ।

অতীত কী বলে

তারকা শক্তি ব্যবহারের ফর্মুলা সবসময় সফল ছিল না। যেমন—বিজেপি ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সংগীত পরিচালক বাপ্পি লাহিড়ী, সংগীত শিল্পী বাবুল সুপ্রিয়, অভিনেতা জয় বন্দ্যোপাধ্যায় ও নিমু ভৌমিককে প্রার্থী করেছিল। কিন্তু, বাবুল সুপ্রিয় ছাড়া আর কেউ জিততে পারেননি। একইভাবে, ২০১৬ সালের নির্বাচনে বাঁকুড়ার বোরজোরা থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের ব্যানারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা দর্শকপ্রিয় অভিনেতা সোহম চক্রবর্তী নির্বাচিত হননি। আবার, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে আসানসোলে বাবুল সুপ্রিয়র কাছে পরাজিত হন তৃণমূলের হেভিওয়েট তারকা প্রার্থী মুনমুন সেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত