Ajker Patrika
সাক্ষাৎকার

ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে দেশ কতটা প্রস্তুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে দেশ কতটা প্রস্তুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকা এবং এর আশপাশের এলাকায় বেশ কয়েকটি ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। গবেষকদের আশঙ্কা, যেকোনো সময় ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প দেশে আঘাত হানবে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমন মাত্রার ভূমিকম্প হলে বহুতল অন্যান্য ভবনের মতো চরম ঝুঁকিতে রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানের সচেতনতা কার্যক্রম এবং প্রস্তুতি কতটা, সেসব নিয়ে আজকের পত্রিকার সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের প্রভাষক জাওয়াদ ইবনে ফরিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. সৈয়দুর রহমান

বাংলাদেশ যে ভূমিকম্পপ্রবণ; এই বাস্তবতা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

বাংলাদেশে গত ২৫০ বছরের ভূমিকম্পের ইতিহাস বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ও শিক্ষণীয়। এই অঞ্চলে মাঝারি থেকে বড় ধরনের একাধিক ভূমিকম্প হয়েছে, যা কখনো জনজীবন স্থবির করে দিয়েছে, কখনো ভূ-আকৃতিতে পরিবর্তন এনেছে। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ অবস্থিত ভারতীয়, ইউরেশীয় ও বার্মা টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে। এই প্লেটগুলোর সংঘর্ষ ও চলাচলের ফলে ভূ-অভ্যন্তরে প্রচুর শক্তি জমা হচ্ছে। পাশাপাশি দেশে অন্তত ১৩টি সক্রিয় ফল্ট লাইন রয়েছে, এগুলোর মধ্যে ডাউকি ও মধুপুর ফল্ট লাইন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো সময় এসব থেকে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটতে পারে।

দেশের কোন কোন অঞ্চল ভূমিকম্পের বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে?

ভূমিকম্প ঝুঁকির ভিত্তিতে দেশকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে সিলেট বিভাগ; শেরপুর, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রামসহ আরও কিছু জেলা। মাঝারি ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার। আর খুলনা ও বরিশাল বিভাগ রয়েছে তুলনামূলক কম ঝুঁকিতে।

দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কতটা ঝুঁকিতে রয়েছে?

দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায়। গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ৫ শতাংশ ভবন ৭ থেকে সাড়ে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করার সক্ষমতা রাখে। পুরান ঢাকার বেশির ভাগ ভবন নির্মিত হয়েছে বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করে—শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা একই রকম। অধিকাংশ বিদ্যালয়ে জরুরি বহির্গমনের নির্দিষ্ট পথ নেই, যা সংকটকালে প্রাণহানির ঝুঁকি বাড়ায়।

অবকাঠামোগত দিক ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আর কী ধরনের দুর্বলতা বেশি দেখা যায়?

দেশের মানুষ অল্পতেই বেশি আতঙ্কিত হয়। অনেক সময় দেখা যায়, ভূমিকম্পের সময় ছোটাছুটি করতে গিয়ে হতাহত হচ্ছে অনেকে। এ বিষয়ে যে সচেতনতা থাকা প্রয়োজন, তা শিক্ষার্থী কিংবা সাধারণ মানুষের মধ্যে পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি। ফলে ভূমিকম্পের সময় কোনো প্রতিষ্ঠানে কী করতে হবে, সে ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনা নেই। আমরা যেখানে বসে কথা বলছি, অর্থাৎ কলাভবনেও নির্দিষ্ট পথে বহির্গমনের জন্য পূর্বনির্ধারিত কোনো পরিকল্পনা নেই।

ভূমিকম্প মোকাবিলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রস্তুতি কী রকম?

‘ড্রপ, কভার, হোল্ড’—এই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার কৌশল অনেকে জানেন না। নিয়মিত মহড়া ও প্রশিক্ষণের অভাবে সচেতনতা গড়ে উঠছে না। লাইকার্ট স্কেলে যদি শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতির মাত্রা পরিমাপ করা হয়, তবে তা ৩-এর নিচে থাকবে, অর্থাৎ মাঝারি প্রস্তুতিরও অনেক নিচে।

উন্নত দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের অবস্থান কেমন?

উন্নত দেশে ‘স্কুল প্রিপেয়ার্ডনেস’ নামে একটি ধারণা রয়েছে। শিশুকাল থেকে শিক্ষার্থীদের ভূমিকম্পসহ নানা দুর্যোগ সম্পর্কে জ্ঞান ও করণীয় শেখানো হয়। কিন্তু আমাদের দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত বিষয়গুলো শিক্ষানীতিতে সীমিতভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেহেতু ভূমিকম্পের আগাম সতর্কসংকেত দেওয়া সম্ভব নয়, তাই সচেতনতা বাড়ানোই হতে পারে একমাত্র প্রস্তুতি।

ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো বিশেষ বিবেচনায় রাখা উচিত?

প্রথমত, মাটি পরীক্ষা করে নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে। এ দুটি বিষয় ভবিষ্যতের বড় ক্ষয়ক্ষতি রোধে সহায়ক হবে।

ভূমিকম্পের প্রস্তুতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে?

আমরা এরই মধ্যে একাধিক মহড়ার আয়োজন করেছি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দিবসে ভূমিকম্প প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে আলোচনা ও কেস স্টাডি উপস্থাপন করেছি। এ ছাড়া নেপালে ভূমিকম্পে কাজ করা বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতা শোনানো হয়েছে শিক্ষার্থীদের। পাঠ্যক্রমেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত নানা বিষয় যুক্ত রয়েছে।

আপনি নীতিনির্ধারক হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপদ রাখার জন্য প্রথমে কোন তিনটি পদক্ষেপ নিতেন?

প্রথমত, বিভিন্ন বিভাগ বা ডিপার্টমেন্ট অনুযায়ী আলাদা না করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি পূর্ণাঙ্গ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সেল থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, আমি সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বেশ কিছু ওয়ার্কশপ ও সেমিনারের আয়োজন করতাম, যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা যায়। তারপর ফ্যাকাল্টি অনুযায়ী ভাগ করব, যাতে সবার আলাদাভাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক পরিকল্পনা থাকে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত