Ajker Patrika

যেভাবে শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে ওঠেন সুব্রত বাইন

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ২৮ মে ২০২৫, ১০: ৩৩
সুব্রত বাইন। ছবি: সংগৃহীত
সুব্রত বাইন। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার অপরাধজগতের ত্রাস, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনকে আটক করেছে সেনাবাহিনী। আজ মঙ্গলবার সকালে কুষ্টিয়া শহরের কালীশংকরপুর এলাকায় তিন ঘণ্টার এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে সহযোগীসহ তাঁকে আটক করা হয়। সরকারের একটি দায়িত্বশীল সূত্র আজকের পত্রিকাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। সূত্র বলছে, আজ যেকোনো সময় সংবাদ সম্মেলন করে অভিযানের বিস্তারিত জানানো হতে পারে।

কথিত ‘সেভেন স্টার’ বাহিনীর প্রধান ছিলেন সুব্রত বাইন। পুলিশের খাতায় তাঁর পুরো নাম ত্রিমাতি সুব্রত বাইন। বহুদিন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড কাঁপিয়ে ভারতের কারাগারে কিছু দিন বন্দী ছিলেন। সুব্রত বাইনের আদি নিবাস বরিশালের আগৈলঝাড়া থানার জোবারপাড় গ্রামে। তাঁর বাবা বিপুল বাইন ছিলেন একটি এনজিওর গাড়িচালক। মা কুমুলিনি আর তিন বোন মেরি, চেরি ও পরীকে নিয়ে ঢাকার মগবাজারের ভাড়া বাসায় থাকতেন। সুব্রত বাইন বড় সন্তান। ১৯৬৭ সালে জন্ম, হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে।

বরিশালে অক্সফোর্ড মিশন স্কুল নামে খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেন সুব্রত বাইন। সেখানে হোস্টেলে থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। সেখানে ভালো না করায় তাঁকে ঢাকায় শেরেবাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে এসএসসি। এরপর সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে সেখানকার এক নেতার সঙ্গে পরিচয়। কলেজে ভর্তি হওয়া আর হয়নি তাঁর। তখন থেকে বইয়ের বদলে হাতে ওঠে অস্ত্র।

খুব অল্প দিনেই মগবাজারে একটি সন্ত্রাসী চক্র গড়ে ওঠে সুব্রতর নেতৃত্বে। ১৯৯৩ সালের দিকে মধুবাজার বাজারে সবজিবিক্রেতা খুন হলে পুলিশের তালিকায় তাঁর নাম ওঠে। এর কিছুদিন পর মগবাজারের বিশাল সেন্টার নির্মাণের সময় চাঁদাবাজি নিয়ে গোলাগুলি হয়। এরপরই সুব্রত বাইনের নাম গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়। সুব্রত বাইন পরে বিশাল সেন্টারের দোকান মালিক সমিতির নেতাও হন। সেই পরিচয়ে চাঁদাবাজি শুরু করেন।

১৯৯১-এর নির্বাচনে তিনি বিএনপির হয়ে মগবাজার এলাকায় কাজ করেন। এতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর খুব কাছের লোক হয়ে যান। মগবাজারের মধুবাগ মাঠে একবার তাঁর জন্মদিনের উৎসবও হয়। ওই উৎসবে বিএনপির অনেক নেতা হাজির হওয়ার পর সুব্রত বাইন রাতারাতি ‘তারকা সন্ত্রাসী’ বনে যান।

সে সময় যুবলীগের লিয়াকত মগবাজার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন। লিয়াকতের কবল থেকে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে বিএনপিপন্থীরা সুব্রতকে সমর্থন দেন। এরপর ১৯৯৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ট্রিপল মার্ডারে নেতৃত্ব দেন সুব্রত। এ ছাড়া মগবাজারের রফিক, সিদ্ধেশ্বরীর খোকনসহ বেশ কয়েকজন তাঁর হাতে খুন হন। ওই সময় রমনা, মগবাজার, কারওয়ান বাজার ও মধুবাগ এলাকায় গোলাগুলি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। অবস্থা এমন হয়েছিল যে হতাহতের খবর না পেলে পুলিশও ঘটনাস্থলে যেত না। এভাবে খুব অল্প সময়ে রাজধানীর দক্ষিণাংশের একটি বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে সুব্রত বাইনের হাতে। তাঁর বিরুদ্ধে সে সময় কমপক্ষে ৩০টি মামলা ছিল। এর মধ্যে ১৯৯১ সালে আগারগাঁওয়ে জাসদ ছাত্রলীগের নেতা মুরাদ খুনের ঘটনায় তাঁর যাবজ্জীবন সাজা হয়।

১৯৯৭ সালে নয়াপল্টন এলাকার একটি হাসপাতাল থেকে গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরাম হোসেন গ্রেপ্তার করেন সুব্রত বাইনকে। বছর দেড়েক জেলে থাকার পর জামিনে বেরিয়ে যান। সুব্রত জেলে থাকার সময় তাঁর স্ত্রী লুসি গ্রুপেরই এক সদস্যের প্রেমে পড়েন। জেল থেকে বেরিয়ে ঘটনা জানার পর সুব্রত নিজেই লুসিকে সেই যুবকের সঙ্গে বিয়ে দেন। লুসির দুই সন্তান ছিল। পরে ১৯৯৯ সালে কুমিল্লায় বিউটি নামের এক নারীকে বিয়ে করেন সুব্রত। তবে বিয়ের কয়েক বছর পর বিউটিকে ডিভোর্স দেন।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০১ সালের ২৫ ডিসেম্বর ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম এবং তাঁদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে। এ তালিকায় প্রথম নামই ছিল সুব্রত বাইনের। তাঁর নামে ইন্টারপোলেও নোটিশ দেওয়া হয়। এরপর সুব্রত ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় ঘাঁটি গাড়েন। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার জামেলা নামে এক নারীকে বিয়ে করেন। সেই ঘরে একটি মেয়ে আছে।

ভারতে গিয়ে সেখানে জমি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যাবতীয় নথিপত্র তৈরি করেন সুব্রত। সুব্রতর ছোট বোন চেরির স্বামী অতুল জানান, সুব্রতর ভারতীয় নাগরিকত্বের সব কাগজপত্র আছে। এরপরও অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে ২০০৮ সালের ১১ অক্টোবর কলকাতা পুলিশ তাঁকে আটক করে। তবে বেশি দিন জেলে থাকতে হয়নি। জামিন পেয়ে দুবাই চলে যান। সেখান থেকে ফিরে কলকাতার এক চিত্রনায়িকার কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করেন। সেই ফোন কলের সূত্র ধরে ২০০৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্স তাঁকে ধাওয়া করে।

টাস্কফোর্সের তাড়া খেয়ে সুব্রত নেপালের সীমান্ত শহর কাঁকরভিটায় ঢুকে পড়েন এবং নেপালি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। প্রথমে তাঁকে পূর্ব নেপালের ভাদ্রপুর এবং পরে ঝুমকা কারাগারে নেওয়া হয়। ২০১২ সালের ৮ নভেম্বর সেই কারাগারে ৭৭ ফুট লম্বা সুড়ঙ্গ কেটে পালিয়ে যান। আবার কলকাতায় আসার কয়েক দিন পর ২৭ নভেম্বর বউবাজার এলাকা থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এরপর থেকে তিনি কলকাতার জেলেই ছিলেন।

কলকাতায় থাকার সময় সেখানে বসেই ঢাকার অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন সুব্রত বাইন। সড়ক ও জনপথের বড় বড় ঠিকাদারি কাজ ভাগাভাগি করতেন। সেই চাঁদার টাকায় নদীয়ায় ৫০ বিঘা জমিসহ এক বাগানবাড়ি কেনেন। এ ছাড়া ঢাকা ও কলকাতার ব্যবসায়ীদের টাকা আদায়ের কাজটি তিনি করতেন। কলকাতার ব্যবসায়ীদের পাওনা টাকা ঢাকার কোনো ব্যবসায়ীর কাছে আটকে গেলে সুব্রতর লোকজন আদায় করে দিত।

পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের পরিবার আগে থাকত রাজধানীর মগবাজারে। পরে তাঁরা গাজীপুরের পুবাইল হারবাইদ নয়াপাড়ায় পাঁচ কাঠা জমি কিনে বাড়ি করেন। এখন সেখানেই থাকেন সুব্রত বাইনের বাবা বিপুল বাইন ও মা কুমুলিনি বাইন। এক ভাই তিন বোনের মধ্যে সুব্রত সবার বড়। তিন বোন মেরি বাইন, চেরি সুপর্ণা বাইন ও সুপ্রভা পরির বিয়ে হয়েছে। চেরি ঢাকার এক হাসপাতালে আর পরি একটি ক্রিশ্চিয়ান সংস্থায় কাজ করেন।

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চিকিৎসক নিয়োগ: ৪৮তম বিশেষ বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হতে পারে কাল

দুই অধিদপ্তর পেল নতুন মহাপরিচালক

প্রসিকিউটর নিয়োগে আইন উপদেষ্টা কেন স্বার্থের দ্বন্দ্ব বিবেচনায় নিলেন না: ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া

ভারতীয় কোম্পানির ১৪০ কোটি ডলারের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে বিএটি

গাইবান্ধার তরুণীকে বিয়ে করে পাচারের চেষ্টা, দুই চীনা নাগরিক গ্রেপ্তার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত