Ajker Patrika

পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে পণ্য বিনিময় প্রথায় ফিরেছে রাশিয়া

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি। ছবি: ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সৌজন্যে
প্রতীকী ছবি। ছবি: ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সৌজন্যে

রাশিয়ার বৈদেশিক বাণিজ্যে আবার ফিরে এসেছে পুরোনো কালের পণ্য বিনিময় প্রথা বা বার্টার সিস্টেম। ১৯৯০-এর দশকের পর এ ধরনের বাণিজ্য প্রথমবার এতটা বাড়ল। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে ফাঁকি দিতে রাশিয়ার ব্যবসায়ীরা গমের বিনিময়ে চীনা গাড়ি কিনছে, আবার তিসি বীজের বিপরীতে আনছে নির্মাণসামগ্রী।

চীন–ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হলেও বার্টারের প্রত্যাবর্তন দেখিয়ে দিচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ কতটা বিকৃত করেছে বৈশ্বিক বাণিজ্য সম্পর্ককে। বিশ্বের অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ রপ্তানিকারক দেশটি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ১৯৯১ সালে যখন পশ্চিমাদের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে একীভূত হয়। তখন কেউ ভাবেনি তিন দশক পর আবার পণ্য বিনিময় চালু হবে।

রাশিয়া ২০২২ সালে ইউক্রেনে যুদ্ধ ও ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও তাদের মিত্ররা দেশটির ওপর ২৫ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল ২ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিকে ধসিয়ে দেওয়া ও প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সমর্থন দুর্বল করা। কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হয়নি।

আর সে কারণে, রাশিয়ার সঙ্গে এখনো যারা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের শাস্তি দেওয়ার পথে হাঁটছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপরও শুল্ক আরোপ করেছে, কারণ নয়াদিল্লি রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনছে। পুতিন দাবি করছেন, পশ্চিমাদের প্রত্যাশার চেয়ে রাশিয়ার অর্থনীতি ভালো করছে। গত দুই বছরে রাশিয়ার প্রবৃদ্ধি জি–সেভেন দেশগুলোর চেয়েও দ্রুত হয়েছে, যদিও শুরুতে ধস নামার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। তিনি ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন নিষেধাজ্ঞাকে যেভাবে হোক পাশ কাটাতে।

তবে অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, দেশটি এখন প্রযুক্তিগতভাবে মন্দায় আছে এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে বড় চাপ তৈরি করেছে ২০২২ সালে রাশিয়ান ব্যাংকগুলোকে সুইফট সিস্টেম থেকে বিচ্ছিন্ন করার পর এবং ২০২৩ সালে চীনা ব্যাংকগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা দেওয়ার পর, যাতে তারা রাশিয়ার যুদ্ধ প্রচেষ্টায় অর্থ সহায়তা না করে।

রাশিয়া আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত একটি সূত্র বলেছেন, ‘চীনা ব্যাংকগুলো ভয় পাচ্ছে সেকেন্ডারি নিষেধাজ্ঞায় পড়ার আশঙ্কায়। তাই তারা রাশিয়া থেকে অর্থ নেয় না।’ আর এ কারণেই বাড়ছে বার্টার লেনদেন, যা ট্র্যাক করা অনেক কঠিন।

সর্বশেষ, ২০২৪ সালে রাশিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয় ১৪ পাতার একটি ‘বৈদেশিক বার্টার গাইড’ প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখানো হয়েছে কীভাবে ব্যবসায়ীরা এ পদ্ধতি ব্যবহার করে নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেতে পারে। এমনকি একটি বার্টার এক্সচেঞ্জ প্ল্যাটফর্ম তৈরির প্রস্তাবও দিয়েছে তারা।

মন্ত্রণালয়ের নথিতে বলা হয়েছে, ‘বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে পণ্য ও সেবার বিনিময় আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেন ছাড়াই করা সম্ভব—নিষেধাজ্ঞার পরিস্থিতিতে এটি একটি কার্যকর পদ্ধতি।’ এর আগে, এ ধরনের বাণিজ্যে তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। তবে গত মাসে রয়টার্স জানায়, চীনের হাইনান লংপান ওয়েলফিল্ড টেকনোলজি কোম্পানি সামুদ্রিক জাহাজের ইঞ্জিনের বিনিময়ে রাশিয়াকে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম অ্যালয় দিতে আগ্রহী।

রয়টার্সের তদন্তে এ ধরনের আটটি পণ্যের–বিনিময় লেনদেন চিহ্নিত করা গেছে। এর মধ্যে কিছু রাশিয়ার কাস্টমস ও কোম্পানির বিবৃতি থেকে জানা গেছে। আগে এসব তথ্য প্রকাশিত হয়নি। লেনদেনের মোট পরিমাণ বা মূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি, কারণ সবই অস্বচ্ছ। তবে তিনজন বাণিজ্য–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বলেছেন, ‘এ ধরনের লেনদেন বাড়ছে।’

রাশিয়ান–এশিয়ান ইউনিয়ন অব ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টস অ্যান্ড এন্টারপ্রেনিউরসের সচিব ম্যাক্সিম স্পাসকি বলেছেন, ‘বার্টার বাড়ছে ডলারের ওপর নির্ভরতা কমানোর প্রচেষ্টা, নিষেধাজ্ঞার চাপ ও লেনদেন সঙ্গীদের তারল্য সমস্যার কারণে। বার্টারের পরিমাণ আরও বাড়বে।’

অন্য এক সূত্র জানিয়েছে, ডলার ও ইউরো লেনদেন থেকে রাশিয়ান ব্যাংকগুলোকে বিচ্ছিন্ন করার পর বার্টার এসব বাধা পাশ কাটাতে সাহায্য করছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বার্টারের ব্যাপ্তির একটি ইঙ্গিত হতে পারে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও কাস্টমস সার্ভিসের বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিসংখ্যানে অস্বাভাবিক ফারাক। ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে এ ব্যবধান দাঁড়ায় ৭ বিলিয়ন ডলারে।

রাশিয়ার কাস্টমস সার্ভিসও নিশ্চিত করেছে যে, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নানা পণ্যে বার্টার হচ্ছে। তবে তারা বলেছে, এটি মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের তুলনায় এখনো নগণ্য। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি–জুলাই সময়কালে রাশিয়ার বৈদেশিক বাণিজ্যের উদ্বৃত্ত এক বছর আগের তুলনায় ১৪ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ৭৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। এ সময়ে রপ্তানি কমে যায় সাড়ে ১১ বিলিয়ন ডলার, যার ফলে মোট রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় ২৩২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে আমদানি বেড়ে দাঁড়ায় ১৫৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে।

রুশ সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বার্টার নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। শুধু জানিয়েছে, এ ধরনের লেনদেন বৈধভাবে রিপোর্ট হলে সামগ্রিক তথ্যের মধ্যে হিসাব হয়।

রয়টার্সের পাওয়া এক লেনদেনের নথি থেকে দেখা গেছে, চীনা গাড়ির বিনিময়ে রাশিয়ার গম দেওয়া হচ্ছে। চীনা পক্ষ রাশিয়ান ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করেছিল শস্য দিয়ে মূল্য পরিশোধ করতে। তারা চীনে ইউয়ানে গাড়ি কিনেছিল। রাশিয়ান অংশীদার রুবলে শস্য কিনে গাড়ির মূল্য চুকিয়েছে। তবে কতটা গম ও গাড়ি লেনদেন হয়েছিল, সে তথ্য পাওয়া যায়নি।

আরও দুটি লেনদেনে তিসি বীজের বিনিময়ে চীন থেকে গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি ও নির্মাণসামগ্রী আনা হয় রাশিয়ায়। এর একটি লেনদেনের মূল্য আনুমানিক ১ লাখ ডলার বলে কাস্টমস তথ্য থেকে জানা গেছে। এ ছাড়া ধাতুর বিনিময়ে মেশিনারি, কাঁচামালের বিনিময়ে চীনা সেবা নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এমনকি পাকিস্তানের সঙ্গেও বার্টার লেনদেন হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে পশ্চিমা পণ্যও রাশিয়ায় ঢুকেছে এভাবে—অন্য দেশ হয়ে, যদিও বিস্তারিত প্রকাশ পায়নি।

গত আগস্টে কাজান এক্সপো ফোরামে চীনা উদ্যোক্তারা জানান, অর্থ লেনদেনে বাধা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে সমস্যা তৈরি করছে। হাইনান লংপান কোম্পানির চেয়ারম্যান শু শিনজিং বলেছেন, সীমিত অর্থ প্রদানের পরিস্থিতিতে বার্টার ব্যবসার জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করছে।

সোভিয়েত ভাঙনের পর নব্বইয়ের দশকে বার্টার অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছিল। বিদ্যুৎ, তেল থেকে শুরু করে আটা, চিনি, জুতা—সবকিছুর জন্য বিনিময় চুক্তি হয়েছিল। তখন দাম নির্ধারণে কারসাজি হতো, অনেকেই বিপুল অর্থ কামিয়েছিল। তখন টাকার ঘাটতি, তীব্র মুদ্রাস্ফীতি ও বারবার মুদ্রার অবমূল্যায়ন বার্টারকে জনপ্রিয় করেছিল। এখন অর্থের অভাব নেই, তবে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার চাপ এ ব্যবস্থা আবার বাড়িয়েছে। রাশিয়া বলছে, এসব নিষেধাজ্ঞা বেআইনি। আর চীন বলছে, নিষেধাজ্ঞা বৈষম্যমূলক।

বার্টার ছাড়াও বিকল্প পথ আছে। যেমন, কিছু ব্যবসায়ী ‘পেমেন্ট এজেন্ট’ ব্যবহার করছে—যারা ফি নিয়ে বিভিন্ন পদ্ধতিতে অর্থ প্রদান নিশ্চিত করে। তবে এতে ঝুঁকি বেশি। আরেকটি উপায় হলো রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় ভিটিবি ব্যাংক, যার সাংহাইয়ে শাখা আছে। কেউ কেউ ক্রিপ্টোকারেন্সিও ব্যবহার করছে, বিশেষ করে ডলারের সঙ্গে সংযুক্ত কয়েনও অনেকে ব্যবহার করছেন।

রাশিয়ার শীর্ষ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিসিএস-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট সের্গেই পুতিয়াতিনস্কি বলেন, ‘ছোট ব্যবসায়ীরা সক্রিয়ভাবে ক্রিপ্টো ব্যবহার করছে। কেউ নগদ বহন করে, কেউ অফসেট ব্যবহার করে, কেউ একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেন করে। এখনো প্রস্তুত কোনো সমাধান নেই। অর্থনীতি টিকে আছে, ব্যবসায়ীরা একসঙ্গে ১০–১৫ ধরনের অর্থ প্রদানের পদ্ধতি ব্যবহার করছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‎ডিভোর্সের পরও জোর করে রাতযাপন, বর্তমান স্বামীকে নিয়ে প্রাক্তন স্বামীকে হত্যা ‎

৯ পুলিশ পরিদর্শক বাধ্যতামূলক অবসরে

গণবিক্ষোভ আতঙ্কে মোদি সরকার, ১৯৭৪-পরবর্তী সব আন্দোলন নিয়ে গবেষণার নির্দেশ

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের ‘সন্ত্রাসী খেল’ ফাঁস করে দিলেন জঙ্গিগোষ্ঠী জইশের সদস্য

বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে আসিফ নজরুলের পুরোনো ফেসবুক পোস্ট নতুন করে ভাইরাল করলেন হাসনাত

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত