Ajker Patrika

উচ্চ খেলাপি ঋণে আস্থা হারাচ্ছে ব্যাংক, সংকুচিত হচ্ছে ব্যবসার পরিবেশ: ডিসিসিআই

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ২৮ জুন ২০২৫, ২০: ৩৯
ডিসিসিআই আয়োজিত ‘ব্যাংক খাতের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ: ঋণ গ্রহীতার প্রেক্ষিত’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত। ছবি: বাসস
ডিসিসিআই আয়োজিত ‘ব্যাংক খাতের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ: ঋণ গ্রহীতার প্রেক্ষিত’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত। ছবি: বাসস

উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংক খাতের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। ফলে খেলাপিরা দিন দিন দেশে ব্যবসার পরিবেশকেও সংকুচিত করছে। তাই দেশের আর্থিক খাতে আমূল সংস্কার ছাড়া শিল্পায়ন ও টেকসই প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়।

আজ শনিবার রাজধানীর মতিঝিলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘ব্যাংক খাতের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ: ঋণ গ্রহীতার প্রেক্ষিত’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।

ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, দেশের আর্থিক খাতে আমূল সংস্কার ছাড়া শিল্পায়ন ও টেকসই প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়। চলতি বছরে দেশের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ২ লাখ কোটি টাকা, যা মোট অনাদায়ী ঋণের ২৪ শতাংশেরও বেশি। এমন পরিস্থিতি ব্যাংক খাতের দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও সুশাসনের অভাবকেই সামনে নিয়ে এসেছে।

তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে—যা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য চাপ সৃষ্টিকারী। এই অবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি দায় এবং সাত বছরের কিস্তিতে সুদ পরিশোধ করার সুযোগ হিসেবে ঋণের মেয়াদে এক বছরের অতিরিক্ত গ্রেস পিরিয়ড ও শ্রেণিকরণে ছয় মাস বাড়ানোর আহ্বান জানান। ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত খেলাপির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ে প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করা এবং ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে দেশীয় ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অভিঘাতকে বিবেচনায় নেওয়া আহ্বান জানান তাসকীন আহমেদ।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ) ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (মুদ্রানীতি বিভাগ) ড. মো. ইজাজুল ইসলাম।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে ঋণদাতা ও গ্রহীতা উভয়কে দায়িত্বশীল হতে হবে। আমাদের অবশ্যই আনুষ্ঠানিক খাতকে রক্ষা করতে হবে, তা না হলে অনানুষ্ঠানিক খাতের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে।’ তিনি ব্যাংক খাতের কাঠামোগত সংস্কারে জোর দিয়ে বলেন, ভালো অবস্থায় থাকা ব্যাংকগুলো সুদের হার কমিয়ে উদ্যোক্তাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. ইজাজুল ইসলাম বলেন, অতীতে কিছু পরিবার আর্থিক খাতকে কবজা করে রেখেছিল, যার ফল ভুগছে সার্বিক অর্থনীতি। তিনি জানান, জুলাই-আগস্টের পরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভের স্থিতিশীলতা ও মুদ্রাবিনিময় হার বাজারভিত্তিক করায় উদ্যোক্তাদের আস্থা ফিরছে, রিজার্ভ স্থিতিশীল এবং বিনিময় হার বাজার নির্ভর হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতিমধ্যে ৪২ হাজার কোটি টাকা বেসরকারি খাতে সরবরাহ করেছে।

ইজাজুল ইসলাম বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতেও বেশ কিছু ব্যাংক বেশ ভালোভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে, যদিও তাদের ঋণের সুদের হার অনেক বেশি এবং ব্যাংকগুলো চাইলে তা কমাতে পারে, ফলে উদ্যোক্তারা আরও স্বস্তিতে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন।

মূল প্রবন্ধে ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা না হলে ব্যবসার পরিবেশ আরও সংকুচিত হবে। চলতি বছরের ঋণের গড় সুদহার ৯ থেকে ১৪ শতাংশে উন্নীত হওয়ায় বেসরকারি খাতে ১.৩৯ ট্রিলিয়ন টাকা অতিরিক্ত সুদ দিতে হচ্ছে জানিয়ে আশরাফ আহমেদ বলেন, খেলাপি ঋণের কারণে শিল্প খাতে ঋণপ্রবাহ সংকুচিত হয়, বিনিয়োগ কমছে, তাতে বেসরকারি খাত দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। দেশের ১৪টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ৪০ শতাংশ, অন্যদিকে ভালো ব্যাংকগুলোতে তা মাত্র ৫-৭ শতাংশ। তাই ব্যাংক প্রশাসনে কাঠামোগত সংস্কার এবং ঋণের পুনঃতফসিলের সুযোগ প্রসারিত করার প্রস্তাব দেন আশরাফ আহমেদ।

আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি হোসেন খালেদ আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, ‘এসএমইরা আমাদের মূল চালিকাশক্তি। এসএমই খাত বৃহৎ শিল্পের সাপ্লাই চেইনের অংশ। তাই বড় শিল্পে সংকট হলে এসএমইরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’

হোসেন খালেদ বলেন, খোলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যকার ব্যবধান ক্রমশই বাড়ছে, যা অব্যাহত থাকলে আগামীতে কারখানা চালুর রাখাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতে নেতিবাচক ঋণপ্রবাহের কারণে অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে আসবে বলে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান আবদুল হাই সরকার বলেন, আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ থাকলেও বেসরকারি খাতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ততটা সুদৃঢ় নয়, ফলে অনেক ক্ষেত্রে তারা ব্যবসা ও বিনিয়োগের প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত থাকেন না।

আব্দুল হাই সরকার বলেন, অর্থঋণ আদালতের দীর্ঘসূত্রতা এবং দুর্বল নীতির কারণে খেলাপি ঋণ আদায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি বহির্বিশ্বে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ন করতে পারে।

বিকেএমইয়ের নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, খেলাপিদের কারণে ভালো ঋণ গ্রহীতারা আর্থিক খাত হতে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। এ ছাড়া ডলারের দাম বাড়লেও ব্যাংক ঋণ না পাওয়ায় এসএমই উদ্যোক্তারা বিপাকে পড়েছেন।

র‍্যাংকস মোটরস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহানা রউফ চৌধুরী বলেন, ব্যবসায়ীদের সমস্যার অন্ত নেই এবং উৎপাদন খাতে এত বেশি সুদ হার দিয়ে টিকে থাকাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংক ঋণের পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর ওপর তিনি জোরোপ করেন। সেই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে যারা বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনে আগ্রহীদের জন্য স্বল্পসুদের তহবিল গঠন জরুরি।

মার্কেন্টাইল ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিউল হাসান বলেন, খেলাপির কারণে এখন ব্যাংক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এর প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনের প্রস্তাব দেন তিনি। গ্যাস সরবরাহের ঘাটতির কারণেই অনেক শিল্প বন্ধ হওয়ার পথে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এ ছাড়া ডিসিসিআইয়ের ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি রাজীব এইচ চৌধুরী, সহসভাপতি মো. সালিম সোলায়মানসহ পর্ষদ সদস্য ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

অরকার আক্রমণে তরুণী প্রশিক্ষকের মৃত্যু, ভাইরাল ভিডিওটি সম্পর্কে যা জানা গেল

জি এম কাদেরের সাংগঠনিক কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা ও মামলা প্রত্যাহার

ভারতকে পাকিস্তানি সেনাপ্রধানের পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি, যা বলল যুক্তরাষ্ট্র

প্লট–ফ্ল্যাট বরাদ্দে সচিব, এমপি, মন্ত্রী, বিচারপতিসহ যাঁদের কোটা বাতিল

জর্ডান-মিসরকে নিয়ে বৃহত্তর ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করতে চান নেতানিয়াহু

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত