বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক ঘোষণাতেই রপ্তানিকারকদের কপালে পড়েছিল চিন্তার বড় ভাঁজ। এই নিয়ে গত ২ এপ্রিল থেকে ঘুম উড়ে যাওয়ার দশা ব্যবসায়ী ও নীতিনির্ধারকদের। শুরু হয় মার্কিন বাণিজ্য দপ্তরের সঙ্গে দেনদরবার; বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে দেওয়া হয় নানা প্রতিশ্রুতি ও ছাড়। দফায় দফায় আলোচনা এবং সরকারের নানামুখী উদ্যোগে অবশেষে মন গলেছে ট্রাম্প প্রশাসনের। বাংলাদেশি পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক পূর্বঘোষিত ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল শুক্রবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে এমন ঘোষণা এসেছে।
পাল্টা শুল্ক পুনর্বিবেচনার এই সিদ্ধান্ত শুধু যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে নয়, বরং বৈশ্বিক বাণিজ্য নীতিতে এক বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কারণ, একই আদেশে ট্রাম্প ৬৯টি দেশের পণ্যের ওপর নতুন শুল্কহার নির্ধারণ করেছেন। বাংলাদেশ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে এই তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে। হোয়াইট হাউসের ঘোষণা অনুযায়ী, নতুন শুল্কহার ৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পাল্টা শুল্কে এই ছাড় বাংলাদেশের জন্য আপাতত স্বস্তির হলেও এর স্থায়িত্ব নির্ভর করবে যুক্তরাষ্ট্রকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের ওপর। এখন প্রশ্ন একটাই—প্রতিশ্রুতিগুলো কতটা বাস্তবসম্মত, আর সেগুলো রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতিই-বা কতটা সুসংহত?
পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশে নেমে আসায় অখুশি না হলেও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেননি বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। মার্কিন বাণিজ্য দপ্তরের সঙ্গে দর-কষাকষিতে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। হোয়াইট হাউস থেকে পাল্টা শুল্কের নতুন হার ঘোষণার পর বাণিজ্য উপদেষ্টা তাঁর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমরা যে অবস্থানে পৌঁছেছি, সেটি প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী রেখেছে। এটি আমাদের সমন্বিত কূটনৈতিক অর্জন। তবে আমরা চেয়েছিলাম, শুল্কহারটা আরও নিচে থাকুক।’
একই সঙ্গে সতর্কও করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘এখন আত্মতুষ্টির সময় নয়। ভবিষ্যতের বাণিজ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। একদিকে যেমন পোশাক খাত, অন্যদিকে আমাদের কৃষিনির্ভরতা—দুদিকেই ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।’
ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে দেনদরবার করে পাল্টা শুল্ক ৩৫ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার কাজটা সহজসাধ্য ছিল না। এটুকু অর্জনের জন্য তিন মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রকে একের পর এক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ। দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে দেওয়া এসব প্রতিশ্রুতির অনেকগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক গড় বাণিজ্য ৮ বিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে বাংলাদেশ রপ্তানি করে ৬ বিলিয়ন ডলার এবং আমদানি করে গড়ে ২ বিলিয়ন ডলারের মতো। ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি গড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ বাণিজ্য ঘাটতি ৩ বিলিয়ন ডলার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই প্রতিশ্রুতি কীভাবে বাস্তবায়ন করবে, সেই পথনকশাও জানিয়েছে দেশটিকে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম ও তুলা আমদানির আগাম চুক্তি হয়েছে। দেওয়া হয়েছে দেশটির বোয়িং কোম্পানি থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার প্রতিশ্রুতি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শুধু বাণিজ্য ঘাটতি কমানো হয়, বাংলাদেশ আরও বেশ কিছু বাণিজ্য ও অ-বাণিজ্য শর্তে রাজি হয়েই তবে পাল্টা শুল্কে এই ছাড় আদায় করেছে। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে গোপনীয়তার চুক্তির (এনডিএ) কারণে সব শর্ত প্রকাশ করা হয়নি। ফলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন অনিবার্যভাবেই থেকে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ২০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ আপাতত বাংলাদেশের জন্য সন্তোষজনক। তবে শুল্কছাড়ের পেছনে কী কী শর্ত বা প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা এখনো পরিপূর্ণভাবে জানা যায়নি—সেই বিবেচনা ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বোয়িং বিমান কেনা বা অন্য কোনো বিষয়ে সম্ভাব্য সমঝোতা থাকলেও তা কতটা বাংলাদেশের পক্ষে সহনীয়, তা বিশ্লেষণ জরুরি। তিনি আরও বলেন, এটি শুধু শুল্ক নয়, বরং অর্থনৈতিক ভারসাম্য ও কৌশলগত সিদ্ধান্তের বিষয়; যা পুরোপুরি খোলাসা করা উচিত।
অবশ্য জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান এ প্রসঙ্গে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমরা সতর্কতার সঙ্গে আলোচনা করেছি, যাতে প্রতিশ্রুতিগুলো আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। পোশাকশিল্প রক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, তবে পাশাপাশি কিছু প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে; বিশেষত মার্কিন কৃষিপণ্য আমদানি নিয়ে। গম, তুলা এমনকি বিমান আমদানির বিষয়েও আমরা ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়েছি। এটি শুধু আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য নয়, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক উন্নয়নেও সহায়ক।’
পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশে নেমে আসায় সবচেয়ে বেশি স্বস্তি পেয়েছেন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকেরা। কারণ, পাল্টা শুল্কের এই হার পোশাক খাতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী দেশগুলোর সমান বা কিছুটা কম।
এ বিষয়ে পোশাকশিল্পের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘২০ শতাংশ শুল্কহার শুনে অনেকে স্বস্তি পাচ্ছেন। কারণ, ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা—সবাই প্রায় এই হারেই রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বায়ারদের জন্য এটি একটা বাড়তি খরচ। ফলে আমাদের রপ্তানিতে কিছুটা চাপ তৈরি হবে; বিশেষ করে দামের ক্ষেত্রে।’
বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ আরও খোলামেলা বলেন, ‘২০ শতাংশ বাড়তি শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের রিটেইল মার্কেটে ভোক্তার চাহিদা প্রায় ৩৫ শতাংশ কমে যেতে পারে; বিশেষত কম দামি পোশাকের ক্ষেত্রে। ফলে আগামী এক-দেড় বছর কিছুটা অর্ডার কমতে পারে। তারপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। আমরা আশাবাদী।’
যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের বড় প্রতিযোগী ভিয়েতনাম। দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১২৩ বিলিয়ন ডলারের। এই বিশাল ঘাটতির জবাবে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে শুল্ক আলোচনায় নামে হ্যানয়। আলোচনার টেবিলে ভিয়েতনাম প্রস্তাব দেয়, তারা নিয়মিত বাণিজ্যের বাইরে অতিরিক্ত ১০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে; অর্থাৎ মোট ঘাটতির মাত্র ১০ বিলিয়ন ডলার কমাবে। এতেই যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা শুল্ক আগের ৪৫ থেকে ২৫ শতাংশে কমিয়ে নতুন হার নির্ধারণ করে মাত্র ২০ শতাংশ।
গত ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতির জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশ্বের অনেক দেশকে দায়ী করেন। এরপরই ঘোষিত হয় পাল্টা শুল্ক, যার আওতায় বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বসে। ৯ এপ্রিল আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে সেই শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখে ওয়াশিংটন। পরে ৮ জুলাই ট্রাম্প অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়ে জানান, বাংলাদেশের জন্য পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। তবে এই পাল্টা শুল্ক এড়ানোর উপায়ও বলে দেন তিনি। সেই অনুযায়ী, ৩১ জুলাইয়ের চূড়ান্ত সময়সীমার আগে ওয়াশিংটনের সঙ্গে একটি সমন্বিত বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছাতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। এই চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে বাংলাদেশের ওপর শুল্ক ২০ শতাংশ নির্ধারণ করে। তবে এটি গড় ১৫ শতাংশ বিদ্যমান শুল্কের সঙ্গে মিলিয়ে কার্যকরভাবে দাঁড়াবে ৩৫ শতাংশে।
অনেকে এটিকে বাংলাদেশের জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য হিসেবে দেখছেন। তবে ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি বিশ্ববাজারের বৃহত্তর পুনর্বিন্যাসের অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ৪১ শতাংশ শুল্ক পড়েছে সিরিয়ার ওপর, ৪০ শতাংশ মিয়ানমার ও লাওসের ওপর, ৩০ শতাংশ দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর এবং ২৫ শতাংশ ভারতের ওপর। বাংলাদেশের অবস্থান তুলনামূলকভাবে সহনীয়।
এই বাস্তবতায় শুল্ক হ্রাসকে স্বল্পমেয়াদি স্বস্তি হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান। তাঁর মতে, ‘যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর কী শুল্ক নির্ধারণ করে, সেটাই এখন বৈশ্বিক বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ দিক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ। চীনের ওপর শুল্ক বাড়লে দক্ষিণ এশিয়া ও সাউথইস্ট এশিয়ান দেশের জন্য সুযোগ তৈরি হবে, না হলে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে।’
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এই শুল্ককাঠামো প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যকে নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত করে দেখছে। এখানে শুধু ঘাটতি নয়, কে তাদের সঙ্গে চুক্তি করে, কে প্রতিশ্রুতি দেয়; সেটাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল আলোচনায় বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। শুল্ক আলোচনার মতো জটিল বিষয়ে তিনি সমালোচকদের হতাশ করেছেন।’
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ নেগোসিয়েশনে বাংলাদেশের ভারতের চেয়ে ৫ শতাংশ কম শুল্ক পাওয়াকে ‘অসামান্য অর্জন’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি এই কৃতিত্বের জন্য খলিলুর রহমান, শেখ বশিরউদ্দীনসহ পুরো আলোচক দলের প্রশংসা করেন এবং ব্যবসায়ীদের সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর আহ্বান জানান।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক ঘোষণাতেই রপ্তানিকারকদের কপালে পড়েছিল চিন্তার বড় ভাঁজ। এই নিয়ে গত ২ এপ্রিল থেকে ঘুম উড়ে যাওয়ার দশা ব্যবসায়ী ও নীতিনির্ধারকদের। শুরু হয় মার্কিন বাণিজ্য দপ্তরের সঙ্গে দেনদরবার; বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে দেওয়া হয় নানা প্রতিশ্রুতি ও ছাড়। দফায় দফায় আলোচনা এবং সরকারের নানামুখী উদ্যোগে অবশেষে মন গলেছে ট্রাম্প প্রশাসনের। বাংলাদেশি পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক পূর্বঘোষিত ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল শুক্রবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে এমন ঘোষণা এসেছে।
পাল্টা শুল্ক পুনর্বিবেচনার এই সিদ্ধান্ত শুধু যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে নয়, বরং বৈশ্বিক বাণিজ্য নীতিতে এক বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কারণ, একই আদেশে ট্রাম্প ৬৯টি দেশের পণ্যের ওপর নতুন শুল্কহার নির্ধারণ করেছেন। বাংলাদেশ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে এই তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে। হোয়াইট হাউসের ঘোষণা অনুযায়ী, নতুন শুল্কহার ৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পাল্টা শুল্কে এই ছাড় বাংলাদেশের জন্য আপাতত স্বস্তির হলেও এর স্থায়িত্ব নির্ভর করবে যুক্তরাষ্ট্রকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের ওপর। এখন প্রশ্ন একটাই—প্রতিশ্রুতিগুলো কতটা বাস্তবসম্মত, আর সেগুলো রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতিই-বা কতটা সুসংহত?
পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশে নেমে আসায় অখুশি না হলেও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেননি বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। মার্কিন বাণিজ্য দপ্তরের সঙ্গে দর-কষাকষিতে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। হোয়াইট হাউস থেকে পাল্টা শুল্কের নতুন হার ঘোষণার পর বাণিজ্য উপদেষ্টা তাঁর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমরা যে অবস্থানে পৌঁছেছি, সেটি প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী রেখেছে। এটি আমাদের সমন্বিত কূটনৈতিক অর্জন। তবে আমরা চেয়েছিলাম, শুল্কহারটা আরও নিচে থাকুক।’
একই সঙ্গে সতর্কও করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘এখন আত্মতুষ্টির সময় নয়। ভবিষ্যতের বাণিজ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। একদিকে যেমন পোশাক খাত, অন্যদিকে আমাদের কৃষিনির্ভরতা—দুদিকেই ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।’
ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে দেনদরবার করে পাল্টা শুল্ক ৩৫ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার কাজটা সহজসাধ্য ছিল না। এটুকু অর্জনের জন্য তিন মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রকে একের পর এক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ। দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে দেওয়া এসব প্রতিশ্রুতির অনেকগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক গড় বাণিজ্য ৮ বিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে বাংলাদেশ রপ্তানি করে ৬ বিলিয়ন ডলার এবং আমদানি করে গড়ে ২ বিলিয়ন ডলারের মতো। ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি গড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ বাণিজ্য ঘাটতি ৩ বিলিয়ন ডলার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই প্রতিশ্রুতি কীভাবে বাস্তবায়ন করবে, সেই পথনকশাও জানিয়েছে দেশটিকে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম ও তুলা আমদানির আগাম চুক্তি হয়েছে। দেওয়া হয়েছে দেশটির বোয়িং কোম্পানি থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার প্রতিশ্রুতি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শুধু বাণিজ্য ঘাটতি কমানো হয়, বাংলাদেশ আরও বেশ কিছু বাণিজ্য ও অ-বাণিজ্য শর্তে রাজি হয়েই তবে পাল্টা শুল্কে এই ছাড় আদায় করেছে। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে গোপনীয়তার চুক্তির (এনডিএ) কারণে সব শর্ত প্রকাশ করা হয়নি। ফলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন অনিবার্যভাবেই থেকে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ২০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ আপাতত বাংলাদেশের জন্য সন্তোষজনক। তবে শুল্কছাড়ের পেছনে কী কী শর্ত বা প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা এখনো পরিপূর্ণভাবে জানা যায়নি—সেই বিবেচনা ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বোয়িং বিমান কেনা বা অন্য কোনো বিষয়ে সম্ভাব্য সমঝোতা থাকলেও তা কতটা বাংলাদেশের পক্ষে সহনীয়, তা বিশ্লেষণ জরুরি। তিনি আরও বলেন, এটি শুধু শুল্ক নয়, বরং অর্থনৈতিক ভারসাম্য ও কৌশলগত সিদ্ধান্তের বিষয়; যা পুরোপুরি খোলাসা করা উচিত।
অবশ্য জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান এ প্রসঙ্গে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমরা সতর্কতার সঙ্গে আলোচনা করেছি, যাতে প্রতিশ্রুতিগুলো আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। পোশাকশিল্প রক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, তবে পাশাপাশি কিছু প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে; বিশেষত মার্কিন কৃষিপণ্য আমদানি নিয়ে। গম, তুলা এমনকি বিমান আমদানির বিষয়েও আমরা ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়েছি। এটি শুধু আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য নয়, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক উন্নয়নেও সহায়ক।’
পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশে নেমে আসায় সবচেয়ে বেশি স্বস্তি পেয়েছেন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকেরা। কারণ, পাল্টা শুল্কের এই হার পোশাক খাতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী দেশগুলোর সমান বা কিছুটা কম।
এ বিষয়ে পোশাকশিল্পের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘২০ শতাংশ শুল্কহার শুনে অনেকে স্বস্তি পাচ্ছেন। কারণ, ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা—সবাই প্রায় এই হারেই রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বায়ারদের জন্য এটি একটা বাড়তি খরচ। ফলে আমাদের রপ্তানিতে কিছুটা চাপ তৈরি হবে; বিশেষ করে দামের ক্ষেত্রে।’
বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ আরও খোলামেলা বলেন, ‘২০ শতাংশ বাড়তি শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের রিটেইল মার্কেটে ভোক্তার চাহিদা প্রায় ৩৫ শতাংশ কমে যেতে পারে; বিশেষত কম দামি পোশাকের ক্ষেত্রে। ফলে আগামী এক-দেড় বছর কিছুটা অর্ডার কমতে পারে। তারপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। আমরা আশাবাদী।’
যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের বড় প্রতিযোগী ভিয়েতনাম। দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১২৩ বিলিয়ন ডলারের। এই বিশাল ঘাটতির জবাবে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে শুল্ক আলোচনায় নামে হ্যানয়। আলোচনার টেবিলে ভিয়েতনাম প্রস্তাব দেয়, তারা নিয়মিত বাণিজ্যের বাইরে অতিরিক্ত ১০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে; অর্থাৎ মোট ঘাটতির মাত্র ১০ বিলিয়ন ডলার কমাবে। এতেই যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা শুল্ক আগের ৪৫ থেকে ২৫ শতাংশে কমিয়ে নতুন হার নির্ধারণ করে মাত্র ২০ শতাংশ।
গত ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতির জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশ্বের অনেক দেশকে দায়ী করেন। এরপরই ঘোষিত হয় পাল্টা শুল্ক, যার আওতায় বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বসে। ৯ এপ্রিল আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে সেই শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখে ওয়াশিংটন। পরে ৮ জুলাই ট্রাম্প অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়ে জানান, বাংলাদেশের জন্য পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। তবে এই পাল্টা শুল্ক এড়ানোর উপায়ও বলে দেন তিনি। সেই অনুযায়ী, ৩১ জুলাইয়ের চূড়ান্ত সময়সীমার আগে ওয়াশিংটনের সঙ্গে একটি সমন্বিত বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছাতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। এই চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে বাংলাদেশের ওপর শুল্ক ২০ শতাংশ নির্ধারণ করে। তবে এটি গড় ১৫ শতাংশ বিদ্যমান শুল্কের সঙ্গে মিলিয়ে কার্যকরভাবে দাঁড়াবে ৩৫ শতাংশে।
অনেকে এটিকে বাংলাদেশের জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য হিসেবে দেখছেন। তবে ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি বিশ্ববাজারের বৃহত্তর পুনর্বিন্যাসের অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ৪১ শতাংশ শুল্ক পড়েছে সিরিয়ার ওপর, ৪০ শতাংশ মিয়ানমার ও লাওসের ওপর, ৩০ শতাংশ দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর এবং ২৫ শতাংশ ভারতের ওপর। বাংলাদেশের অবস্থান তুলনামূলকভাবে সহনীয়।
এই বাস্তবতায় শুল্ক হ্রাসকে স্বল্পমেয়াদি স্বস্তি হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান। তাঁর মতে, ‘যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর কী শুল্ক নির্ধারণ করে, সেটাই এখন বৈশ্বিক বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ দিক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ। চীনের ওপর শুল্ক বাড়লে দক্ষিণ এশিয়া ও সাউথইস্ট এশিয়ান দেশের জন্য সুযোগ তৈরি হবে, না হলে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে।’
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এই শুল্ককাঠামো প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যকে নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত করে দেখছে। এখানে শুধু ঘাটতি নয়, কে তাদের সঙ্গে চুক্তি করে, কে প্রতিশ্রুতি দেয়; সেটাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল আলোচনায় বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। শুল্ক আলোচনার মতো জটিল বিষয়ে তিনি সমালোচকদের হতাশ করেছেন।’
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ নেগোসিয়েশনে বাংলাদেশের ভারতের চেয়ে ৫ শতাংশ কম শুল্ক পাওয়াকে ‘অসামান্য অর্জন’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি এই কৃতিত্বের জন্য খলিলুর রহমান, শেখ বশিরউদ্দীনসহ পুরো আলোচক দলের প্রশংসা করেন এবং ব্যবসায়ীদের সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর আহ্বান জানান।
বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশে নেমে আসায় স্বস্তি ফিরেছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। পাল্টা শুল্ক প্রতিযোগী দেশগুলোর সমান হওয়ায় এটি ব্যবস্থাপনাযোগ্য বলে জানিয়েছেন তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, এখন পাল্টা শুল্কের যে হার নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে
১৫ ঘণ্টা আগেযুক্তরাষ্ট্র পাল্টা শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করায় দেশের পোশাক উদ্যোক্তাদের আসল কাজটি এখন শুরু হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালক ও সুরমা গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়সাল সামাদ। তিনি বলেছেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজারে প্রবেশ করতে হলে
১ দিন আগেবাংলাদেশের জন্য শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আজ শুক্রবার অন্যান্য দেশের জন্য বিভিন্ন হারের পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য এই শুল্ক হার ঘোষণা করেন। হোয়াইট হাউসের এই ঘোষণাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আলোচনার পদ্ধতির জন্য একটি জয় বলে উল্লেখ করেছেন উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। সেই সঙ্গে বাণিজ্য
১ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের জন্য পারস্পরিক শুল্কহার ৩৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা দেশের রপ্তানি খাতের জন্য একটি স্বস্তির সংবাদ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।
১ দিন আগে