Ajker Patrika

নন্দিত নরকে স্বর্গের দূত

ডা. আলিম আল রাজি
নন্দিত নরকে স্বর্গের দূত

রিনি দাস যখন আইসিইউতে এলেন তখনো জানতাম না ২৮ বছরের এই মেয়েটাকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত এই গল্পটা লিখব বা লিখতে পারব।

গল্পটা শুধু ২৮ বছর বয়সী রিনি দাসের নয় এই গল্পটা তাঁর জরায়ুতে থাকা ২২ সপ্তাহের শিশুটিরও… এবং এই গল্পটা আমাদেরও।

প্রেগনেন্সি এবং কোভিড–এই শতকের সবচেয়ে ভয়ংকর যুগল! পুরো পৃথিবীর মতো আমাদের আইসিইউও সাক্ষী হয়ে আছে এমন অনেক ঘটনার। জরায়ুতে ঋণাত্মক বয়সের শিশু এবং বুকের ভেতর এক পৃথিবী স্বপ্ন নিয়ে পৃথিবী থেকেই চলে যেতে হয়েছে রোকেয়া বেগম কিংবা মরিয়ম আক্তারকে!

...রিনি দাসও চলে যাচ্ছেন! আমাদের চোখের সামনেই!

১০.৮.২০২১, রাত ১২টা ১০ মিনিট। সাব্বির এবং আমি সেই কঠিন পরিস্থিতে পড়লাম।

রিনি দাস মারা যাচ্ছেন! হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা যন্ত্রটা বিপবিপ শব্দ করছে, তাঁর পক্ষে এর চেয়ে বেশি অক্সিজেন দেওয়া সম্ভব না।

এদিকে মনিটর দেখাচ্ছে, রিনি দাসের রক্তে অক্সিজেন প্রায় নেই! ৫৬ শতাংশ!

ইসিজি বলছে, একটু পরেই হার্ট বন্ধ হয়ে যাবে!

আমার ক্ষুদ্র ডাক্তারি জীবন। তার এক-পঞ্চমাংশ অধ্যায় কেটে গেছে কোভিড আইসিইউ নামক নন্দিত নরকে। সাব্বির এবং আমি দুজনই বুঝতে পারছি, এটাই শেষ মুহূর্ত। আর কয়েক মিনিট পরই রিনি দাসের হৃৎপিণ্ড আঁকাবাঁকা নৃত্য থামিয়ে দিয়ে সরলরেখা তৈরি করবে। ...দা ফ্ল্যাট লাইন! 

রিনি দাসের চোখ বুঝে আসছে। ২৮ বছরের মেয়েটি কোটি বছরের অভিমান এবং যন্ত্রণা নিয়ে ভারী চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকাল একবার। আমরা রিনি দাস এবং তাঁর সন্তানের কিছুই করতে পারছি না! কিছুই না!

আসলে আমাদের হাতে আর কিছুই নেই। শেষ যে ভেন্টিলেটর মেশিনটা ছিল সেটা বিকেলে চলে গেছে অন্য আরেকজনের ভাগ্যে!

রিনি দাস মারা যাচ্ছেন, তাঁর ২২ সপ্তাহ বয়সী সন্তান এই গ্রহে শ্বাস নেওয়ার আগেই তার মা শেষ শ্বাস নিয়ে নিচ্ছেন!

সাব্বির আমার দিকে তাকায়, আমি সাব্বিরের দিকে তাকাই।

হঠাৎ মনে হলো, ভেন্টিলেটর মেশিন নেই তো কী হয়েছে, হাত তো আছে! ফুসফুসে টিউব দিয়ে, সেই টিউবে বেলুন চেপে অক্সিজেন দেব।

এটা একটু বেশি জুয়া হয়ে যায়। কোভিড পেশেন্টকে ইন্টুবেট করা মানে তাঁর আর মৃত্যুর দূরত্ব আরও কমিয়ে দেওয়া। তা ছাড়া হাত দিয়ে চাপবই বা কতক্ষণ!

তাও… হাত দিয়ে চেপে রাতটা যদি কাটিয়ে দেওয়া যায় তাহলে সকালে হয়তো কোনো একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

আমরা ইন্টুবেট করার যাবতীয় প্রস্তুতি নিলাম।

ঠিক তখন ঘটল একটা ঘটনা, যে ঘটনার চিত্রনাট্য পৃথিবীতে লেখা সম্ভব না। কোনো লেখকের ক্ষমতা নেই মর্ত্যের কালি দিয়ে এই চিত্রনাট্য লিখবে!

অন্য এক বেডের বৃদ্ধা রোগী রাতের খাবার খাননি। বৃদ্ধার মেয়ে রোগীর সিপ্যাপ মাস্ক অল্প একটু খুলে তাঁকে খাবার দিচ্ছিলেন। আমি একটু চোখ কচলে তাকালাম! দেখি এই মাস্ক খোলা অবস্থাতেও রোগীর অক্সিজেন লেভেল খুব একটা কমছে না। সাব্বিরকে ডাক দিয়ে দেখালাম। আমার দিকে তাকিয়ে সাব্বির সাথে সাথে বুঝে গেল কী করতে চাচ্ছি।

সাব্বির আমাকে বলল, ‘ভাই বিষয়টা কি ঠিক হবে? এই রোগীও ক্রিটিক্যাল। মেশিন রিনি দাসকে দিয়ে দেওয়ার পর এই বৃদ্ধা যদি খারাপ হন, তাহলে আমাদের তারা সোজা মেরে ফেলবে! আর একবার দিয়ে দেওয়ার পর যদি রিনি দাস থেকে আবার মেশিন খুলতে যান তাহলে রিনি দাসের আত্মীয়রা আমাদের মেরে ফেলবে।’ 

আমি বললাম, ‘মার তো খাবই, কাল সকালে পত্রিকায় ছবিসহ খবর আসবে–মেশিন কেড়ে নিয়ে রোগী মেরে ফেললেন দুই ডাক্তার!’

কিন্তু এই ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া তো উপায়ও নেই!

বৃদ্ধার স্বজনদের ডেকে বোঝালাম–২৮ বছরের অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটা মারা যাচ্ছে। আপনার মেশিনটা তাঁর লাগবে। পুরো পৃথিবীতে যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধাবস্থায় এভাবেই বাঁচতে হয়, বাঁচাতে হয়। 
খুব অনিচ্ছা নিয়ে হলেও তাঁরা রাজি হলেন।

রিনি দাসের স্বজনদের ডেকে বোঝালাম–মেশিনের বন্দোবস্ত হয়েছে। তবে যদি বৃদ্ধার আবার দরকার হয় তাহলে মেশিনটা হয়তো নিয়ে যেতে হবে। তাই এখন আপনাদের কাজ বাড়ল। আপনার রোগীর জন্যও দোয়া করতে হবে, বৃদ্ধার জন্যও দোয়া করতে হবে।

রিনি দাসকে সিপ্যাপ দেওয়া হলো। মেশিন সর্বোচ্চ প্রেশারে ধাক্কা দিয়ে অক্সিজেন পৌঁছে দিল তাঁর ফুসফুসে।

পুরা রাত ধরে ধীরে ধীরে তাঁর অক্সিজেন লেভেল বাড়তে থাকল। সকালের ইসিজিতে সাব্বির দেখল হার্টও ঠিকঠাক কাজ করছে!

আমি বাসায় ফিরলাম রাত ৩টার দিকে। আম্মা বললেন, ‘এত রাত পর্যন্ত কী করলি?’

আম্মাকে বললাম রিনি দাসের কথা।

আম্মা নামাজ পড়ে দোয়া করলেন মেয়েটার জন্য।

ওসমানী মেডিকেল কলেজ এবং শামসুদ্দিন হাসপাতাল সমন্বয় করে পরের দিন মেডিকেল বোর্ড হলো। সব ডিসিপ্লিনের বিশেষজ্ঞরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন রিনি দাসকে।

আলট্রাসনোগ্রাম করলেন ডাক্তার কান্তা নাহিদ। দেখা গেল এই মহা প্রলয়ংকরী রাত পার করেও শিশুটি এখনো বেঁচে আছে!

আমার ডিউটি শেষ হলো ১৪ তারিখ। তারপর ফয়সাল কবীর ভাই, তানভীর নাবিল মুসাসহ বাকিরা সবাই আপ্রাণ চেষ্টা করলেন।


রিনি দাসের অক্সিজেন চাহিদা ধীরে ধীরে কমে এল। এক মাস যুদ্ধের পর তাঁর অক্সিজেন লাগছে মাত্র ১ লিটার। কালকেই হয়তো তাঁকে আমরা আইসিইউ থেকে কেবিনে শিফট করে দেব। 
তারপর আমরা অপেক্ষায় থাকব সেই যুদ্ধজয়ী শিশুটির জন্য।

গত দেড় বছরে এখান থেকে কত মানুষ সুস্থ হয়ে ফিরেছেন! তবে রিনি দাসের সুস্থ হওয়াটা আমাদের জন্য অতি বিশেষ একটি ঘটনা হয়ে থাকবে। 

২. 
গল্পটা লিখে রাখলাম।

অনেক বছর পর আমার সন্তান যখন জিজ্ঞেস করবে, ‘তোমাদের আইসিইউতে কি কখনো ভালো কিছু ঘটেনি?’ তখন এই লেখাটা দেখিয়ে তাকে বলব সেই নন্দিত নরকেও মাঝে মাঝে স্বর্গের দূত নেমে আসতেন, তারপর তিনি নিজের হাতে লিখে যেতেন এই সব অপার্থিব গল্প। 

লেখক: মেডিকেল অফিসার, আইসিইউ
শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল, সিলেট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত