Ajker Patrika

‘ঘর তো দূরের কথা, ভিটারই চিহ্ন নাই—ওইখানে নদীর মতো হইয়া গেছে’

জুবাইদুল ইসলাম, শেরপুর 
রহিমা বেগমসহ কয়েকটি পরিবারের ভিটেমাটি পানিতে ভেসে গেছে। ছবি: আজকের পত্রিকা
রহিমা বেগমসহ কয়েকটি পরিবারের ভিটেমাটি পানিতে ভেসে গেছে। ছবি: আজকের পত্রিকা

‘ঘরবাড়ি সব ভাসায়া নিয়া গেছে পাহাড়ি ঢলে। ঘর তো দূরের কথা, ভিটারই কোনো চিহ্ন নাই। ওইখানে নদীর মতো হইয়া গেছে। আমগরে থাকার মতোন আর কোনো জায়গা থাকল না। পথের ভিখারি হয়ে গেলাম আমরা।’ আকস্মিক পাহাড়ি ঢলের পানিতে ঘরবাড়ি হারিয়ে এভাবেই বিলাপ করছিলেন বিধবা রহিমা বেগম।

শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার পূর্ব খৈলকুড়া গ্রামের বাসিন্দা রহিমা। প্রতিবছর ঢলের পানি তাঁর বাড়িতে উঠলেও এবার সবকিছু ভাসিয়ে নিয়েছে। ভিটেমাটির কোনো চিহ্ন আর নেই। সেখানে এখন পানি জমে রয়েছে। ছেলেকে নিয়ে রহিমা পার্শ্ববর্তী একটি বেসরকারি প্রতিবন্ধী স্কুলের শ্রেণিকক্ষে আশ্রয় নিয়েছেন। শুধু রহিমা বেগম নন, তাঁর মতো ক্ষতিগ্রস্ত ১১টি পরিবারের লোকজন ওই স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন। উপজেলা প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে তাঁদের শুকনো খাবার এবং সকালবেলা স্থানীয় উদ্যোগে রান্না করা খিচুড়ি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই আশ্রয় তো সাময়িক। সামনের দিনগুলোতে থাকবেন কোথায়, খাবেন কী—চিন্তায় দিশেহারা রহিমাসহ অন্যরা।

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য মো. জিহাদ হাসান বলেন, ‘গতকাল বৃহস্পতিবারের ঢলে আমাদের ঘরবাড়ি, ফসলাদি সব ভাসায়া নিয়া গেছে। কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট নাই। এই যে স্কুলে আইসা আশ্রয় নিছি। সকালবেলা কিছু নাশতা দিছে, সেটা খায়াই আছি। এখন সরকার আমাদের একটা ব্যবস্থা না করে দিলে আমাদের আর কিছু করার নাই।’

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি জাহিদুল হক মনির বলেন, এই ১১টি পরিবার একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাদের বাড়িঘর ভেসে গেছে। এটি পুরোপুরি পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতি। তারা যদি এই ভাঙা মেরামত করত, তাহলে এমন ক্ষতি হতো না। এই এলাকায় দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি টেকসই কংক্রিটের বাঁধ নির্মাণ জনগণের প্রাণের দাবি। নইলে এলাকার লোকজন হয়তো কিছুদিন পর তাঁদের মৌলিক অধিকার আদায়ে রাস্তায় দাঁড়াবেন।

এদিকে ঢলের পানিতে লাকড়ি ধরতে গিয়ে নিখোঁজ যুবক ইসমাইল হোসেনের লাশ ঝিনাইগাতীর পূর্ব খৈলকুড়া এলাকা থেকে আজ শুক্রবার সকালে উদ্ধার করা হয়েছে। ঝিনাইগাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আল আমীন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ইসমাইল পার্শ্ববর্তী ডাকাবর এলাকার ঝালমুড়ি বিক্রেতা মো. আব্দুল্লাহর ছেলে। এর আগে গতকাল নালিতাবাড়ীতে পাহাড়ি ঢলের পানিতে ভেসে যাওয়া হুমায়ুন (১০) নামের এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়।

গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা আকস্মিক পাহাড়ি ঢলে ঝিনাইগাতীর মহারশি ও সোমেশ্বরী এবং নালিতাবাড়ীর চেল্লাখালী ও ভোগাই নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করে। একপর্যায়ে গতকাল দুপুরে মহারশির নদীর বাঁধের পুরোনো ভাঙা অংশ দিয়ে প্রবল বেগে পানি ঢুকে পড়ে। এতে ঝিনাইগাতী উপজেলা সদরের প্রধান সড়ক, বাজার ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। এ সময় উপজেলার পূর্ব খৈলকুড়া এলাকার সাত্তার মিয়া, রহিমা বেগম, রহিম মিয়া, আব্বাস উদ্দিন, বারেক মিয়া, বাচ্চু মিয়ার পরিবারসহ অন্তত ১১টি পরিবারের বাড়িঘর ঢলের পানিতে ভেসে যায়। এ ছাড়া মহারশি নদীর দীঘিরপাড়, সোমেশ্বরী নদীর কাড়াগাঁওসহ নালিতাবাড়ীর ভোগাই নদের বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ রোপা আমন ও সবজির আবাদ তলিয়ে যায়।

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, জেলার ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় ১ হাজার ৫৭৬ হেক্টর জমির রোপা আমন আবাদ পানিতে তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে আংশিক তলিয়েছে ১ হাজার ৪০ হেক্টর এবং সম্পূর্ণ তলিয়েছে ৫৩৬ হেক্টর জমির আমন আবাদ। এ ছাড়া ৮৬ হেক্টর শীতকালীন আগাম সবজি পানিতে ডুবেছে।

সরেজমিনে আজ বিকেলে ঝিনাইগাতী উপজেলার পূর্ব খৈলকুড়া এলাকায় দেখা যায়, মহারশি নদীর পানি একেবারে কমে গেছে। ভেসে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। বহু বাড়িঘরের মালামাল ভেসে গিয়ে দূরে খেতের মধ্যে ধ্বংসাত্মক অবস্থায় পড়ে রয়েছে। অনেকে কুড়িয়ে কুড়িয়ে সেগুলো নিয়ে এক জায়গায় জড়ো করছেন। রোপা আমন আবাদের ওপর পলিমাটি পড়ে অনেক ধানগাছ একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে।

স্থানীয় কৃষক আব্বাস উদ্দিন বলেন, ‘আমার বাড়িও ভেঙে গেছে, আবার ধানের জমির ওপর পলি পড়ে আবাদও নষ্ট হয়ে গেছে। এখন সামনের দিনগুলোতে কীভাবে চলব, সেই চিন্তাই আছি। বাঁধটা তিন বছর আগে ভাঙছে। মেরামত না করায় প্রতিবছর একই জায়গায় ভাঙতেছে। এখন আমরা কোথায় যাব?’

বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আখিনুজ্জামান বলেন, পানি নেমে গেলে দ্রুত সময়ের মধ্যে আপৎকালীন কাজ হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত শুরু হবে। আর টেকসই বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন জায়গায় পরিদর্শন করে দেখেছি। পাহাড়ি ঢলের পানি দ্রুত সময়ের মধ্যে নেমে গেলে কৃষকেরা কম ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আর পলি পড়ে আবাদ নষ্ট হওয়া কৃষকদের তালিকা তৈরি করে তাঁদের প্রণোদনার সার-বীজ বিতরণের আওতায় আনা হবে।’

ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আশরাফুল আলম রাসেল বলেন, আসলে এই মহারশি নদীতে শক্ত কংক্রিটের বাঁধ নির্মাণ ছাড়া পাহাড়ি ঢলের সমস্যাটির স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন মহলকে জানানো হয়েছে। আর বরাদ্দ প্রাপ্তি সাপেক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মাঝে ঘর নির্মাণের টিন বিতরণ করা হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আফগানিস্তানের বাগরাম ঘাঁটি ফেরত চান ট্রাম্প, লক্ষ্য চীনের পারমাণবিক স্থাপনা

মাঝ আকাশে হাত ভাঙল বিমানের কেবিন ক্রুর, অঙ্গহানির আশঙ্কা

বাংলাদেশ ভ্রমণে উচ্চমাত্রার সতর্কতা জারি করল কানাডা

এরদোয়ানকে খলিফা উমর (রা.)-এর সঙ্গে খ্রিষ্টানদের চুক্তিপত্রের প্রতিলিপি উপহার দিলেন জেরুজালেমের পাদরি

রাজশাহীতে পিস্তল হাতে ভাইরাল ছাত্রলীগ নেতা, পুলিশের দাবি—নজরে আসেনি

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত