Ajker Patrika

বালু পরিবহনে ট্রেন, বদলে যাচ্ছে উত্তরের দৃশ্যপট

ফাহিম হাসান, পঞ্চগড়
আপডেট : ২৫ জুন ২০২৫, ০৭: ৪৩
পরিবহনের জন্য ট্রেনের বগিতে বালু তুলছেন শ্রমিকেরা। গতকাল পঞ্চগড় রেলস্টেশনে। ছবি: আজকের পত্রিকা
পরিবহনের জন্য ট্রেনের বগিতে বালু তুলছেন শ্রমিকেরা। গতকাল পঞ্চগড় রেলস্টেশনে। ছবি: আজকের পত্রিকা

উত্তরের সীমান্তঘেঁষা জেলা পঞ্চগড়ে নদী থেকে প্রতিদিন উত্তোলন করা হচ্ছে হাজার হাজার টন বালু। এই বালু এখন আর সীমাবদ্ধ নেই জেলার অভ্যন্তরে বা পাশের কোনো উপজেলায়। তা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে; বিশেষত ঢাকা, গাজীপুর, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, নাটোর, নওগাঁ, জয়পুরহাটের নির্মাণ প্রকল্পগুলোতে। আর এই বালু পরিবহন করা হচ্ছে এক নতুন কৌশলে, ট্রেনে করে।

একসময় ট্রাকই ছিল পরিবহনের একমাত্র ভরসা। কিন্তু সড়কপথের সীমাবদ্ধতা, উচ্চ ভাড়া, চালকের সংকট, রাস্তার নাজুক অবস্থা এবং যানজটের কারণে ব্যবসায়ীরা খুঁজছিলেন নতুন কোনো উপায়। সেই উপায় হলো রেলপথ।

পঞ্চগড় রেলওয়ে স্টেশন এখন শুধুই যাত্রীদের জায়গা নয়, হয়ে উঠেছে বালুবাজারের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিদিন সকাল-বিকেল সেখানে বালুভর্তি ডাম্পার থেকে ট্রেনের বগিতে মাল তোলা হয়। ট্রেন ছাড়ে আর পঞ্চগড়ের বালু পৌঁছে যায় দেশের বিভিন্ন শহরে।

খরচ কম, লাভ বেশি: স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী শাজাহান বলেন, এক ট্রাকে করে বালু পাঠাতে যেখানে খরচ হতো ৪৫-৪৭ হাজার টাকা, সেখানে একই পরিমাণ বালু ট্রেনে পাঠাতে খরচ হয় ৩৪ হাজার টাকা। আর একসঙ্গে বেশি পরিমাণ মাল পাঠানো যায় বলে সময়ও বাঁচে।

আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরা বালু পাঠাচ্ছি রাজশাহীর গোদাগাড়ী স্টেশন পর্যন্ত। এসএস ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছ থেকে বড় পরিমাণে বালু কিনছে। তারা নিয়মিত অর্ডার দিচ্ছে। ট্রেন না থাকলে এত বড় চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হতো না।’

ব্যবসায়ীরা বলছেন, যমুনা সেতু দিয়ে সরাসরি ট্রেনযোগে পঞ্চগড় থেকে ঢাকা পর্যন্ত বালু পাঠানো সম্ভব হবে। এতে খরচ কমবে আরও ২০-২৫ শতাংশ, যা ঢাকার নির্মাণ খাতে বড় পরিবর্তন আনবে।

বদলে গেছে শ্রমিকদের জীবন: ট্রেনভিত্তিক পরিবহন চালু হওয়ার সবচেয়ে বড় সুফল পেয়েছেন শ্রমিকেরা। নদী থেকে বালু উত্তোলন, ট্রাকে করে স্টেশনে আনা, ট্রেনের বগিতে লোড করা—এই পুরো শৃঙ্খলায় কাজ করছেন কয়েক শ মানুষ।

করতোয়া নদীর পাড়ে কাজ করা শ্রমিক সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখন প্রায় সারা বছর কাজ থাকে। সকালে বালু তুলি, দুপুরে স্টেশনে নিয়ে যাই, বিকেলে ট্রেনে ওঠাই। দিনে অন্তত ৫-৬ শিফট করে কাজ করছি।’ আরেক শ্রমিক বলেন, ‘আমাদের এলাকায় আগে রিকশা বা কৃষির ওপর নির্ভর করত সবাই। এখন অনেকে বালু পরিবহনের কাজে যুক্ত হয়েছে। আয় বেড়েছে, ঘরে শান্তিও ফিরেছে।’

পঞ্চগড় রেলস্টেশনের স্টেশনমাস্টার মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘বালু পরিবহনের কারণে মালবাহী ট্রেনের চাহিদা বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা সময়মতো মাল পাঠাতে পারছেন বলে আমাদের ওপরও আস্থা বাড়ছে।’ তিনি জানান, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বালু পরিবহনকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। প্রয়োজন হলে নতুন বগিও সংযুক্ত করা হবে।

যে কারণে ট্রেনে পরিবহন

একসময় ট্রাকই ছিল একমাত্র পরিবহন মাধ্যম। কিন্তু এক দিকে তেলের দাম বৃদ্ধি, অন্য দিকে চালক-সংকট, আবার কোনো কোনো সময় ট্রাক না পাওয়ার ভোগান্তি—এসব মিলিয়ে ব্যবসায়ীরা ভীষণ চাপের মধ্যে ছিলেন।

পরিবহন সংস্থার এক প্রতিনিধি বলেন, ‘কখনো ট্রাক পাই না, কখনো চালক আসে না। আবার পথে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। ট্রেনে এসব নেই। একবারে ট্রেনের ৩০টা বগিতে মাল পাঠানো যায়, তা-ও নির্দিষ্ট সময়ে।’

অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা

পঞ্চগড় থেকে প্রতিদিন কোটি টাকার বালু দেশের নানা প্রান্তে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে সরকার পাচ্ছে রাজস্ব, ব্যবসায়ীরা পাচ্ছেন লাভ, শ্রমিকেরা পাচ্ছেন কর্মসংস্থান। সেই সঙ্গে নির্মাণ খাত পাচ্ছে সুলভ ও মানসম্মত কাঁচামাল।

মকবুলা রহমান সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক আজাদ নূর বলেন, ‘পঞ্চগড় থেকে ট্রেনে করে বালু পরিবহন শুধু পরিবহন খরচ কমাচ্ছে না, এটি একটি পুরো অঞ্চলকে যুক্ত করছে দেশের মূলধারার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। এতে যেমন কর্মসংস্থান বাড়ছে, তেমনি পণ্য পরিবহনে রেলওয়ের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে; যা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক। আরও বড় কথা হলো, এতে নির্মাণ খাতে কাঁচামালের সরবরাহ সহজ ও সাশ্রয়ী হচ্ছে।’

আজাদ নূর আরও বলেন, ‘সরকার যদি এই প্রক্রিয়াকে সহায়তা করে, যেমন ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো, পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং পরিবেশবান্ধব বালু উত্তোলন নিশ্চিত করে, তবে পঞ্চগড় ভবিষ্যতে দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক করিডরে পরিণত হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত