Ajker Patrika

দেবী এসেছেন, আসেনি আনন্দ

 রিমন রহমান, রাজশাহী
রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে দুর্গাপূজার মণ্ডপ। ছবি: আজকের পত্রিকা
রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে দুর্গাপূজার মণ্ডপ। ছবি: আজকের পত্রিকা

দেবী দুর্গা মণ্ডপে উঠেছেন। তাঁকে তুষ্ট করতে অর্চনাও শুরু হয়েছে। কিন্তু আশপাশের গ্রামগুলোর হিন্দুপাড়াগুলোতে এবার কারও মুখে হাসি নেই। শারদীয় উৎসবের আনন্দ এবার কাউকেই ছুঁয়ে যেতে পারেনি। জ্বরে মারা যাওয়া প্রমিলা সাহা কিংবা বার্ধক্যে মারা যাওয়া কানাই কর্মকারের মৃত্যুর শোক হয়তো গ্রামের মানুষ সহ্য করে নিতেন, কিন্তু কানাইকে সমাহিত করতে যাওয়ার সময় নৌকাডুবিতে অন্য তিনজনের মৃত্যুর শোক তাঁরা সইতে পারছেন না।

তাই রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী, খেতুর, ডুমুরিয়া, পালপাড়া, কাঁঠালবাড়িয়া ও ফরাদপুর গ্রামে এবার দুর্গাপূজার উৎসব আসেনি। এসব গ্রামের হিন্দু-মুসলমান সবাই শোকাহত। এবার মহাষষ্ঠীর দিনেই প্রেমতলী দুর্গামাতা ও কালীমাতা মন্দিরে দেবী দুর্গার আগমন ঘটেছে, কিন্তু কারও মধ্যে কোনো উচ্ছ্বাস নেই। ঢুলিরা বসে আছেন, ঢাকে কাঠি পড়ছে না। ভাড়া করা বক্সও পড়ে আছে। গানবাজনাও হচ্ছে না।

অথচ প্রেমতলী এলাকায় প্রতিবছর বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে শারদীয় দুর্গোৎসব উদ্‌যাপন হয়। প্রেমতলী খেতুরেই শ্রী শ্রী নরোত্তম দাস ঠাকুরের খেতুরীধাম। এলাকাটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে তীর্থভূমি। প্রতিবছর দুর্গাপূজার পরই খেতুরীধামে নরোত্তম দাসের তিরোভাব তিথি অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশ থেকে আসেন কয়েক লাখ মানুষ।

প্রেমতলী দুর্গামাতা ও কালীমাতা মন্দিরের কাছেই বাড়ি প্রমিলা সাহার। গত শুক্রবার জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। পরদিন শনিবার মারা যান গ্রামের কানাই কর্মকার। সেদিন সকালে তাঁর মরদেহ সমাহিত করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল বাড়ির পাশের পদ্মা নদীর মাঝচরে। প্রায় ২০ বছর আগে জেগে ওঠা চরটিতেই এলাকার হিন্দুদের সমাধি দেওয়া হয়। কানাই কর্মকারের মরদেহ সমাধিস্থ করতে যাওয়ার সময় নৌকা ডুবে যায়।

কিছুক্ষণ পরই জিতেন মণ্ডল নামের একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরদিন ভেসে ওঠে দীলিপ দাস ও হরেন সাহার মরদেহ। সবার বাড়ি কাছাকাছি দূরত্বে। তাঁদের মৃত্যুতে এলাকাজুড়ে শোক। এবার কারও ঘরেই আসেনি শারদীয় দুর্গোৎসবের আনন্দ।

আজ সোমবার সকালে প্রেমতলী দুর্গামাতা ও কালীমাতা মন্দিরে গিয়ে দেখা গেল, সুন্দর করে প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। করা হয়েছে সেলফি জোন। মন্দিরে আসার রাস্তাটিও সাজানো। কিন্তু মন্দিরে তেমন কেউ নেই। শুধু পুরোহিত ও নাপিত দুজন সহযোগী নিয়ে সপ্তমীর ঘট স্থাপন করছেন। ১৭ হাজার টাকা পারিশ্রমিকে ছয় দিনের জন্য নওগাঁর মান্দা থেকে এসেছেন ঢুলি শ্যামল চন্দ্র পাল ও দীপক চন্দ্র পাল। তাঁরা ঢাক নিয়ে বসে আছেন। ঢাকে কাঠি পড়ছে না। শুধু পূজার সময় ঢাক বাজানো হবে বলে তাঁরা জানালেন।

মন্দিরের নিরাপত্তায় ছিলেন কয়েকজন আনসার সদস্য। ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, একটা খুব কষ্টের কথা। এতগুলো মানুষের মৃত্যুর পর আসলে কোনো উৎসব হচ্ছে না। পূজা করতে হবে, তাই করা। মর্মান্তিক ঘটনায় কারও মনে কোনো আনন্দ নেই। মন্দির কমিটির তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক অর্ক কুমার পাল বলেন, এই যে বক্স পড়ে আছে, বন্ধই থাকবে। ঢাক বাজবে শুধু পূজার সময়। এবার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গানবাজনা কিছুই হবে না। ১৯৮৭ সাল থেকে এখানে পূজা হয়। এ রকম করুণ পূজা আর আগে হয়নি।

মন্দির কমিটির সভাপতি মোহন কুমার পাল জানান, আশপাশের গ্রামগুলো থেকে শতাধিক হিন্দু পরিবার এখানে পূজা করে। এবার পুরো সমাজে শোকের ছায়া। তাই মহাষষ্ঠীর দিনে জনাদশেক নারী-পুরুষ এসেছিলেন। আগের বছরগুলোতে কমপক্ষে শতাধিক নারী-পুরুষ এসেছেন। এবার সপ্তমীর সকালে তো শুধু পুরোহিত আর নাপিত ঘাট স্থাপন করলেন। বাইরে থেকে একজনও আসেননি। প্যান্ডেলে বসার কেউ নেই। তিনি জানান, এলাকায় অনেক হিন্দু পরিবার থাকলেও মরদেহ দাফনের জন্য তাদের কোনো জায়গা নেই। নদীর মাঝে জেগে ওঠা একটা চরকেই তারা প্রায় ২০ বছর ধরে শ্মশান হিসেবে ব্যবহার করেন। ওই শ্মশানের সভাপতি হিসেবে তিনিই দায়িত্বে আছেন। শ্মশানটা নদীর মাঝে না হলে এ রকম মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটত না বলে তিনি মনে করেন।

মন্দিরের সামনেই বাড়ির বৈঠকঘরে মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করেন রাজকুমারী পাল। তিনি বললেন, ‘এবার উৎসব জমেনি। বিক্রিও নেই। একই এলাকায় পাঁচ-পাঁচটা লাশ দাফনের পর কি আর আনন্দ থাকে? এবার শুধু পূজা করতে হবে বলে করা। আর কিছুই না। শ্মশানটা নদীর এপারে থাকলে গ্রামজুড়ে এ রকম শোকাবহ পরিবেশ সৃষ্টি হতো না।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফয়সাল আহমেদ জানালেন, গতকাল রোববার সন্ধ্যায় তিনি গ্রামে নৌকাডুবিতে নিহত ব্যক্তিদের বাড়ি গিয়েছিলেন। কিছু সহায়তা দিয়ে এসেছেন। আরও ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হবে। আর শ্মশানটা গ্রামের ভেতরে করার ব্যাপারে তিনি ভাবছেন। এ জন্য গ্রামবাসীকে একটা আবেদন জমা দিতে বলেছেন। ইউএনও বলেন, ‘খেতুরীধামেরই অনেক জমি আছে। তারা চাইলে একটা শ্মশান করতে পারে। গ্রামবাসী আমার কাছে লিখিত আবেদনটা দিলে আমি ধামের ট্রাস্টি বোর্ডের সঙ্গে কথা বলব। কীভাবে গ্রামের ভেতরেই একটা শ্মশান করা যায়, সেটা আমি দেখব।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বেসরকারি স্কুল-কলেজে কর্মচারী নিয়োগের কর্তৃত্ব হারাল পরিচালনা পর্ষদ

কারাবন্দী সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদের মৃত্যু

ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ ভূমি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে, অপবাদে কেঁদেছেন কর্মচারীও

খাগড়াছড়ি সহিংসতা: ‘ভুয়া ধর্ষণ’ মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইলেন হান্নান মাসউদ

মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন হান্নান মাসউদ, সেই রাব্বি ফের চাঁদাবাজির অভিযোগে আটক‎

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত