Ajker Patrika

হাতে টান পড়লেই হিন্দুপাড়ায় চাঁদা তুলতেন তাঁতী দল নেতা

  • থানা ঘেরাওয়ের পর গ্রেপ্তার।
  • দল থেকে বহিষ্কার।
নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী
তাঁতী দল নেতা নবাবের হামলার পর বিচারের দাবি নিয়ে বাগমারা থানায় যান হিন্দুপাড়ার বাসিন্দারা। ছবি: সংগৃহীত
তাঁতী দল নেতা নবাবের হামলার পর বিচারের দাবি নিয়ে বাগমারা থানায় যান হিন্দুপাড়ার বাসিন্দারা। ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় হাতে টান পড়লেই হিন্দুপাড়ার বাসিন্দাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করতেন স্থানীয় এক তাঁতী দল নেতা। ধরে নিয়ে যেতেন পুকুরের মাছ, হাঁস, গাছের কলার কাঁদি। কেউ বাধা দিতে গেলেই হাঁসুয়া নিয়ে তেড়ে যেতেন। বের করতেন ছোরা। সবশেষ চাঁদা দিতে না চাইলে একজনকে মারধরের পর হিন্দুপাড়ার বাসিন্দারা থানা ঘেরাও করেন।

এরপর পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। আজ বুধবার তাঁকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাঁর নাম নবাব হোসেন ওরফে বাচ্চু (৩০)। তিনি উপজেলার গোবিন্দপাড়া ইউনিয়ন তাঁতী দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আজ তাঁতী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ ও সদস্যসচিব হাজি মজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে নবাব হোসেনকে দলীয় পদ থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কারের কথা জানানো হয়েছে।

নবাব হোসেনের বাড়ি চাঁইসাড়া গ্রামে। এ গ্রামের একপাশে প্রায় ১০০টি হিন্দু পরিবারের বাস। এলাকাটি হিন্দুপাড়া নামে পরিচিত। বছর দু-এক আগে হিন্দুপাড়ার পাশে ৩ শতক জায়গা কিনে বাড়ি করেন নবাব। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর নবাব এ পাড়ার বাসিন্দাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় শুরু করেছিলেন। তা না হলে পাড়ায় থাকতে দেবেন না বলে হুমকি দিতেন। বাধ্য হয়ে সবাই নবাবকে চাঁদা দিয়ে আসছিলেন।

পাড়ার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সপ্তাহখানেক আগে নারায়ণ ভবানী (৬০) নামের এক ব্যক্তির কাছে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন নবাব। নবাব হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, গ্রামে থাকতে হলে তাঁকে টাকা দিতে হবে। তা না হলে সমস্যায় পড়তে হবে। তবে নারায়ণ ভবানী টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে নারায়ণ ভবানীকে দেখতে পেয়ে নবাব তাঁর পথরোধ করেন। তিনি টাকা না দেওয়ার কারণ জানতে চান। নারায়ণ টাকা দেবেন না বলতেই ক্ষুব্ধ হয়ে নবাব হোসেন তাঁর ওপর হামলা চালান। এ সময় তাঁকে মারধর করে রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যান নবাব। পরে স্থানীয় লোকজন তাঁকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে ভর্তি করেন।

ঘটনাটি জানাজানি হলে চাঁইসাড়া গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক নারী-পুরুষ প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে বাগমারা থানায় গিয়ে বিক্ষোভ করেন। তাঁরা নবাব হোসেনকে গ্রেপ্তার এবং নিজেদের নিরাপত্তা দেওয়ার দাবি জানান। পরে পুলিশ মামলা নেওয়া, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের আশ্বাস দিলে বেলা আড়াইটার দিকে তাঁরা থানা চত্বর ত্যাগ করেন। বিষয়টি জানতে পেরে নবাব পালিয়ে যান। পরে রাতেই নওগাঁর মান্দা উপজেলার কালীনগর এলাকায় অভিযান চালিয়ে নবাবকে গ্রেপ্তার করে বাগমারা থানা-পুলিশের একটি দল। এর আগে রাতেই নবাব হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করেন ভুক্তভোগী নারায়ণ ভবানী।

এ বিষয়ে বাগমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তৌহিদুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা অভিযোগ পেয়েই নবাবকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছি। পাড়ার বাসিন্দারা জানিয়েছেন যে অনেক দিন ধরে নবাব চাঁদা নিচ্ছিলেন। টাকা না পেলে মাছ, হাঁস ও মুরগি ধরে নিয়ে যেতেন। তবে তাঁরা আগে আমাদের জানাননি। আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’

অতিষ্ঠ ছিল সংখ্যালঘুরা

তাঁতী দল নেতা নবাবের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন চাঁইসাড়া হিন্দুপাড়ার বাসিন্দারা। নবাব গ্রেপ্তার হলেও আতঙ্ক রয়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন, আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকে নবাব তাঁদের ‘আওয়ামী লীগ’ ট্যাগ দিয়ে বলতেন—পাড়ায় থাকতে হলে তাঁকে টাকা দিয়ে থাকতে হবে।

গ্রামের এক স্কুলশিক্ষক বলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে নবাব নিয়মিত চাঁদা নিয়ে যেতেন। কারও হয়তো পুকুরে মাছ আছে, সে মাছ ধরে নিয়ে যেতেন। পুকুরপাড় থেকে হাঁস নিয়ে যেতেন। গাছের কলার কাঁদি কেটে নিয়ে যেতেন। ধান মাড়াই করলে ধান দিতে হতো। কারও কিছু বলার সাহস ছিল না। কেউ কিছু বললে হাঁসুয়া নিয়ে এসে ভয় দেখাতেন। তাঁর কাছে সব সময় একটা ছোট ছোরা থাকত। টিপ দিলেই ছোরা বড় হয়ে যেত। এভাবে তিনি ভয় দেখাতেন।

ওই স্কুলশিক্ষক বলেন, ‘গ্রামের প্রায় প্রত্যেকেই নবাবকে টাকা দিয়েছে। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার ছিল, টাকা দিতে না চাইলে নবাব বাড়ির বয়স্ক মায়েদের গিয়ে ভয় দেখাত। বলত—আপনার ছেলেকে টাকা দিয়ে দিতে বলবেন। তা না হলে সমস্যা হবে। মায়েরা ভয়ে থাকতেন। রাস্তাঘাটে দেখা হলে ছেলেদের কাছে টাকা চাইত। দিলে ভালো, না দিলে পকেটে হাত দিয়ে যা পেত, সবই জোর করে নিয়ে নিত। বলত—এখন আমরা খাব। এটাই ছিল তার কথা।’

এ নিয়ে দলীয় স্থানীয় নেতাদের জানিয়েও প্রতিকার পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন পাড়ার বাসিন্দারা। গ্রামের আরও এক ব্যক্তি জানান, সম্প্রতি উপেন্দ্রনাথ সরকার নামের এক ব্যক্তি নবাবের এমন উৎপাতের কথা দলের লোকজনকে জানিয়েছিলেন। কয়েক দিন পর উপেন্দ্রনাথের সঙ্গে নবাবের দেখা হলে তিনি তাঁকে লক্ষ্য করে হাঁসুয়ার আঘাত করার চেষ্টা করেন। তবে উপেন্দ্রনাথ কোনো রকমে হাঁসুয়াটি ধরে ফেলেন। হাঁসুয়াটি লাগে হাতে থাকা বাজারের ব্যাগে। সম্প্রতি দামনাশ উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়েও হাঙ্গামা করেন নবাব। সেদিন তাঁকে ধরে ধারালো অস্ত্রসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। পরে তিনি ছাড়া পেয়ে যান।

গোবিন্দাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হাবিবুর রহমান বলেন, ‘হিন্দুদের ওপর তার এত অত্যাচার শুরু হয়েছিল, তা বলার মতো না। মুসলমানদেরও যারা দুর্বল মানুষ, তারাও চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছিল। গতকাল তার হাতে আহত নারায়ণ ভবানীর সঙ্গে আমি দেখা করেছি। আমাকে তিনি জানিয়েছেন যে, তাঁকে মারধর করে নবাব ১৫ হাজার টাকা কেড়ে নিয়েছে। এভাবে তো দলের নাম ভাঙিয়ে চলতে পারে না।’

তাঁতী দল নেতা নবাব হোসেনের হামলায় আহত নারায়ণ ভবানী এখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন। ছবি: সংগৃহীত
তাঁতী দল নেতা নবাব হোসেনের হামলায় আহত নারায়ণ ভবানী এখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন। ছবি: সংগৃহীত

‘হাফ ম্যাড’ বলছে বিএনপি

গত ৩১ জুলাই গোবিন্দপাড়া ইউনিয়ন তাঁতী দলের কর্মিসভা শেষে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। সেদিন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ পান নবাব হোসেন। এই কমিটি নিয়ে সেদিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। সেদিন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নবাবেরও নাম প্রকাশ হয়।

তবে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ডি এম জিয়াউর রহমান দাবি করেছেন, নবাব ‘হাফ ম্যাড’। তিনি বলেন, ‘যখন যে দলের মিছিল হয়, নবাব সে দলের মিছিলেই যোগ দেয়। সে আসলে হাফ ম্যাড। তাঁতী দলের কর্মিসভার দিন সে এসে বলে তাকে সভাপতির পদ দিতে হবে, সাধারণ সম্পাদকের পদ দিতে হবে। তখন নেতারা বলেন—ঠিক আছে, তুই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এভাবে সে এই পদ পেয়ে যায়। এখন কোনো বিতর্ক উঠলে দল কিছু শুনছে না। দায় এড়াতে সরাসরি বহিষ্কার করছে। নবাবকেও বহিষ্কার করা হয়েছে।’

জিয়াউর রহমান দাবি করেন, নবাব বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। সংখ্যালঘুদেরই যে টার্গেট করে তিনি টাকা নিতেন, এমনটি নয়। তাই হিন্দুপাড়ার বাসিন্দারা গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি দিতে চেয়েছেন। তাঁরা বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দেবেন যে—এটা দলীয় কোনো ইস্যু নয়, সংখ্যালঘু ইস্যুও নয়।

নবাব আসলেই বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী কি না—জানতে চাইলে হিন্দুপাড়ার এক বাসিন্দা বলেন, ‘জাতে মাতাল তালে ঠিক। এমন হলে সে কীভাবে বলে যে আপনারা বহুদিন ধরে আওয়ামী লীগ করেছেন, এখন আমাদের টাকা দিয়ে থাকতে হবে। এটা তো সম্ভব না। তার কিছু গুরু আছে। তারাই নবাবকে এ রকম বেপরোয়া করে তুলেছিল। এখনো আমরা ভয়ে।’

তাঁতী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নবাবের এমন কর্মকাণ্ড দলীয় সুনাম ও ভাবমূর্তি গুরুতরভাবে ক্ষুণ্ন করেছে, যা সংগঠনের গঠনতন্ত্র ও আদর্শের পরিপন্থী। তাই কেন্দ্রীয় কমিটি তাঁকে সাময়িক বহিষ্কারের জরুরি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তাঁর সঙ্গে দলীয় কোনো নেতা-কর্মীর সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ না রাখার জন্য এবং তাঁকে দেখামাত্রই আইনের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, নবাবের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা যাচাই এবং ঘটনা উদ্‌ঘাটনের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটি একটি তদন্ত টিম গঠন করেছে। এ তদন্ত টিমের রিপোর্টের ভিত্তিতে তাঁর বিরুদ্ধে স্থায়ী ও চূড়ান্ত সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত