Ajker Patrika

রাজশাহীতে বরখাস্ত হওয়া এসআইকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী
আপডেট : ২৪ আগস্ট ২০২৫, ১২: ৪৫
আহত মাহবুব হাসান। ছবি: আজকের পত্রিকা
আহত মাহবুব হাসান। ছবি: আজকের পত্রিকা

রাজশাহীতে বরখাস্ত হওয়া এক উপপরিদর্শককে (এসআই) পেটানোর পর পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। গতকাল শনিবার দিবাগত রাত ১১টার দিকে নগরের হজোর মোড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। গণপিটুনির শিকার সাবেক এই এসআইয়ের নাম মাহবুব হাসান (৩৫)। তাঁর বিরুদ্ধে নিরীহ মানুষকে হয়রানি ও ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের বহু অভিযোগ আছে।

গণপিটুনির ফলে হাসান রক্তাক্ত হয়েছেন। তাঁর মাথায় জখম দেখা গেছে। রাতে তাঁকে পুলিশে তুলে দেওয়ার সময় সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেন জামায়াতে ইসলামীর রাজশাহী মহানগরীর সাংগঠনিক সেক্রেটারি জসিম উদ্দিন সরকার ও ছাত্রশিবিরের মহানগরের সাবেক সভাপতি খাইরুল ইসলাম। জসিম উদ্দিন উপস্থিত লোকজদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন।

তিনি বলেন, ‘এই সেই হাসান, যে মানুষকে কখনো গাঁজা, কখনো হেরোইন, কখনো ইয়াবা দিয়ে মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠাত। আমার সামনে সাক্ষী সোহাগ আছে, এই সোহাগকে মারতে মারতে উলঙ্গ করে মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠিয়েছে। আমাদের রাতুলকেও মেরে আহত করে মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে। ৫ তারিখের পরে মানুষের কথা বলার সুযোগ হয়েছে, কথা বলছে। এই অপরাধী ঘাপটি মেরে এই শহরে অবস্থান করছিল।’

তিনি বলেন, ‘এই হাসান বিএনপি-জামায়াতের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে হত্যার আসামি। আমাদের আফসোস লাগে, ধিক্কার জানাই ওই ব্যবস্থাপনাকে, যারা দেখার পরেও হাসানকে গ্রেপ্তার করছিল না। বিএনপি-জামায়াত এবং সাধারণ মানুষ থানায় গিয়ে এবং তার বাড়িতে গিয়ে জনতা তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাকে আগামী দিনে আদালতের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।’

জসিম বলেন, ‘দয়া করে এই অপরাধীকে কেউ ডিফেন্স দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। অপরাধীর পক্ষ কেউ নেবেন না। এই হাসান নামক অপরাধীর পক্ষে যদি কেউ লেখালেখি থেকে শুরু করে বিবৃতি এবং নিউজ করেন, রাজশাহীবাসী মনে করবে অপরাধীর পক্ষ নিয়েছে প্রেসগুলো।’

হাসান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। ২০১৩ সালে এসআই নিয়োগে তাঁর চাকরি হয়। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি রাজশাহী নগরের মতিহার থানায় ছিলেন। পরে ২০১৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) যোগদান করেন। চাকরিজীবনের শুরু থেকেই অত্যন্ত বেপরোয়া ছিলেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয়দের ভাষ্য, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রলীগ করতেন হাসান। পরে দলীয় প্রভাবে পুলিশে চাকরি নেন এবং ডিবিতে যোগ দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে দমন-নিপীড়ন চালান। নিজেকে ‘অপরাজেয়’ ভাবা হাসান রাজশাহীতে বিএনপি, জামায়াত, ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে জখম ও পঙ্গু করেছেন।

ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলামকে আটক করে অস্ত্রসহ মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। শুধু রাজনৈতিক নেতাকর্মীই নন, সাধারণ মানুষকেও চাঁদাবাজি ও মামলা বাণিজ্যের ফাঁদে ফেলেছিলেন তিনি। এসব অপকর্মের মাধ্যমে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নেন বলে ভুক্তভোগীদের দাবি। রাজশাহীর রেলগেট এলাকার রাজিব আলী রাতুল ছিলেন এমন এক ভুক্তভোগী। তাঁকেও মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ আছে।

হাসিনা সরকারের পতনের পর রাতুলের বাবা মাসুদ রানা এই হাসানের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এজাহারে বলা হয়, ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর তৎকালীন এসআই মাহবুব হাসান সাদা পোশাকে মাসুদ রানার বাড়িতে গিয়ে তার ছেলে রাজীব আলীর মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে তাঁকে শিমলা বাগানে তুলে নিয়ে যান। এরপর মাসুদ রানাকে ফোন করে জানানো হয়, তাৎক্ষণিকভাবে ৫ লাখ টাকা না দিলে রাজীবকে ক্রসফায়ারে দেওয়া হবে। টাকা নিয়ে শিমলা বাগানে ছুটে গেলে মাসুদ রানাকে ওই টাকা হাসানের হাতে তুলে দিতে হয়।

এ সময় হাসান আশ্বাস দেন, রাজীবকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হবে। কিন্তু পরদিন তাকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। এ মামলায় দীর্ঘ ১৬ মাস কারাভোগ করেন রাজীব। জামিন পাওয়ার পর এসআই হাসানের সঙ্গে দেখা হলে রাজীব টাকা ফেরত দেওয়ার অনুরোধ করেন। তখন হাসান ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং হুমকি দেন—তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ করেছেন, টাকা চাইলে এবার মেরেই ফেলা হবে।

নগরের চন্দ্রিমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী মাসুদ বলেন, ‘আটকের পর হাসানকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আমাদের থানায় তাঁর নামে মামলা নেই। তাই তাঁকে বোয়ালিয়া থানার পুলিশের কাছে হাসপাতালেই হস্তান্তর করে দেওয়া হয়েছে।’

বোয়ালিয়া থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ জানান, তাঁর থানায় হাসানের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজির একটাই মামলা আছে। ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হবে। পরবর্তীতে অন্য কোনো মামলায় তাঁর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে সেটিতেও গ্রেপ্তার দেখানো হবে।

রাজশাহী নগর পুলিশের মুখপাত্র গাজিউর রহমান জানান, মাহবুব হাসান সর্বশেষ নগর ডিবিতে ছিলেন। এরপরই তিনি বরখাস্ত হয়েছেন। তার বিষয়ে তিনি বিস্তারিত এখনো জানেন না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত