Ajker Patrika

শিক্ষার্থী সংকটে জৌলুশ হারিয়েছে প্রায় শতবর্ষী বিদ্যালয়টি

আনোয়ার হোসেন, মনিরামপুর (যশোর) 
শিক্ষার্থী সংকটে জৌলুশ হারিয়েছে প্রায় শতবর্ষী বিদ্যালয়টি

এক সময় নিয়মিত সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে মুখরিত থাকত যশোরের মনিরামপুরের মামুদকাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ভালো ফলাফলের জন্য উপজেলা জুড়ে নামডাক ছিল বিদ্যালয়টির। পরিণত হয়েছিল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সময়ের পরিবর্তনে এখন বিদ্যালয়টি হারিয়েছে তার ঐতিহ্য। ধুঁকছে শিক্ষার্থী সংকটে।

স্থানীয়রা বলছেন, হরিহরনদীর তীরে গরিবপুর শ্মশানের অদূরে এক সময় সপ্তাহে বিকেলে হাট বসত। এরপর তীর ঘেঁষা স্থানীয়দের দেওয়া এক বিঘা জমির ওপর ১৯২৭ সালে হাটের পাশে মামুদকাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কয়েক বছর পর বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ হয়। মামুদকাটিসহ আশপাশের গরিবপুর, রঘুনাথপুর, জালালপুর, চাঁদপুর, মাঝিয়ালী গ্রাম থেকে শিক্ষার্থীরা এ বিদ্যালয়ে আসত। প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষার্থীদের ভিড়ে রমরমা ছিল বিদ্যালয়টি। এরপর ধীরে ধীরে আশপাশের সব গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয়ের পাশে একটি কওমি মাদ্রাসা হয়েছে। এ কারণে কমতে শুরু করেছে শিক্ষার্থী।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আশপাশে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও কয় বছর আগেও মামুদকাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বেশ শিক্ষার্থী ছিল। লেখাপড়ার মানও ছিল ভালো। ২০১৬ সালে বর্তমান প্রধান শিক্ষক ঝর্ণা মিত্র যোগ দেওয়ার পর থেকে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমতে শুরু করেছে। এখন সব ক্লাস মিলে এ বিদ্যালয়ে ৫০ জন শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। হয়নি অবকাঠামোগত উন্নয়ন।

স্থানীয়রা জানান, ২০১৬ সালের দিকে বিদ্যালয়ের জমি দাতার পরিবারের সদস্য বাদে টাকার বিনিময়ে মামুদকাটি গ্রামের একটি ছেলেকে অফিস সহায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ নিয়োগকে কেন্দ্র করে গ্রামের মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়েন। এ ছাড়া নিয়োগ পাওয়া ছেলেটির আজও বেতন হয়নি। এ নিয়ে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে গ্রামবাসীর বৈরিতা দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া বর্তমান প্রধান শিক্ষকও ভালো একটা মিশুক না। এ জন্য এলাকার অভিভাবকেরা এখন বাচ্চাদের এ বিদ্যালয়ে পাঠাতে চান না।

সব ক্লাস মিলে এ বিদ্যালয়ে ৫০ জন শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া কষ্টকরমামুদকাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র খোরশেদ আলম বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের আগে ওই বিদ্যালয়ে পড়তাম। তখন ৪-৫ গ্রাম থেকে ছাত্রছাত্রীরা এ বিদ্যালয়ে আসত। অনেক ছাত্রছাত্রী ছিল। ক্লাসে জায়গা ধরত না।’

অভিজিৎ বিশ্বাস নামে সাবেক আরেক ছাত্র বলে, ‘২০২০ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে আমরা ১৪ জন ছিলাম। ভালো পড়ালেখা হতো না। স্যাররা পড়া দিয়ে বাইরে যেয়ে মোবাইলে গল্প করত। এখন পঞ্চম শ্রেণিতে ১০ জনেরও কম ছাত্রছাত্রী।’

এদিকে সরেজমিন মামুদকাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানে ৫ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন। প্রথম শ্রেণিতে ৪ জন ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৩ জন শিক্ষার্থী ক্লাস করছে। এ সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তৃতীয় শ্রেণিতে ৬ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ৮ জন ও পঞ্চম শ্রেণিতেও ৫-৬ জন শিক্ষার্থী নিয়মিত হাজির হয়।

মামুদকাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘২০১০ সালের আগ পর্যন্ত ১০ বছর পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্বে ছিলাম। আমার সময় ১৩০-১৬৫ জন ছাত্রছাত্রী ছিল। মাত্র ৪ জন শিক্ষক দিয়ে লেখাপড়া পরিচালনা করে মানের দিকে উপজেলা পর্যায়ে বিদ্যালয়টি দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিল। বৃত্তিও পেয়েছিল অনেকে।’

সাবেক এ সভাপতি বলেন, ‘বিদ্যালয়ে সরকারি কত টাকা আসত সেটা আমি কখনো জানতে চাইনি। শিক্ষকদের বলেছি, ওটা আপনারা ইচ্ছেমতো খরচ করেন। আমি শুধু লেখাপড়া চাই। কোনো শিক্ষক তখন সময় ক্লাস ফাঁকি দিতে পারেননি। ক্লাসে বাচ্চাদের বসিয়ে পড়া মুখস্থ করে দিতে হতো শিক্ষার্থীদের।’

আক্ষেপ করে এ সভাপতি বলেন, ‘এখন আর ওদিকে যাই না। বিদ্যালয়ের ভঙ্গুর দশা দেখলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। সঠিক তদারকির অভাবে আজ বিদ্যালয়টির এ অবস্থা।’

বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক ঝর্ণা মিত্র বলেন, ‘বিদ্যালয়ের আশপাশে বাড়িঘর বেশ দূরে হওয়ায় বাচ্চারা এখানে আসতে চায় না। করোনার কারণে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় মামুদকাটি এলাকায় দুটি কওমি মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। অনেক বাচ্চা সেখানে চলে গেছে। করোনার পর আর আশানুরূপ শিক্ষার্থী পাওয়া যায়নি।’

এদিকে সম্প্রতি মামুদকাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিকটবর্তী মাধ্যমিক বিদ্যালয় বাদ রেখে অন্য এলাকা থেকে এক শিক্ষক প্রতিনিধিকে এনে সভাপতি করা হয়েছে। এ নিয়েও স্থানীয়দের মাঝে অসন্তোষ বিরাজ করছে। এ ছাড়া আগের কমিটির সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের জটিলতায় বিদ্যালয়ের উন্নয়নে বরাদ্দ ২ লাখ টাকা উত্তোলন আটকে আছে বলে জানা গেছে।

তবে কীভাবে দূরের বিদ্যালয় থেকে শিক্ষক এনে সভাপতি করা হয়েছে সে ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি প্রধান শিক্ষক ঝর্ণা রানী।

খেদাপাড়া গুচ্ছের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা দেবব্রত সরকার বলেন, ‘গত সপ্তাহে মামুদকাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়েছি। প্রাক প্রাথমিকে ১৬ জন শিক্ষার্থী পেয়েছি। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে শিক্ষার্থী কম ছিল।’

দেবব্রত সরকার বলেন, ‘শিক্ষার্থী কম দেখে প্রধান শিক্ষককে ৭ দিনের মধ্যে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে।’

মনিরামপুর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সেহেলী ফেরদৌস বলেন, ‘যে সব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হাজিরা কম সেগুলো চিহ্নিত করে শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ চলছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত