Ajker Patrika

ভয়াবহ জঙ্গি হামলার সাক্ষী হোলি আর্টিজান আজ সুনসান

আমানুর রহমান রনি, ঢাকা 
আপডেট : ০১ জুলাই ২০২৫, ২৩: ০০
হামলার আগে হোলি আর্টিজান বেকারি। ছবি: সংগৃহীত
হামলার আগে হোলি আর্টিজান বেকারি। ছবি: সংগৃহীত

চারদিকে পিনপতন নীরবতা। কোথাও কোনো শব্দ নেই। নেই কোনো প্রাণের স্পন্দন। রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের বুকে এভাবেই মূক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে হোলি আর্টিজান বেকারি।

অথচ একসময় এই বাড়িতে ভেসে বেড়াত কফির মন চনমন করা ঘ্রাণ; হতো প্রাণবন্ত আড্ডা; রেস্তোরাঁর সুস্বাদু খাবার খেতে ভিড় জমাতেন শহরের অভিজাত শ্রেণির লোকজন।

সবকিছু থামিয়ে দেওয়া হয় এক রাতেই।

এই সেই বাড়ি, যেখানে ২০১৬ সালের আজকের দিনে সংঘটিত হয় দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা, যাতে প্রাণ হারান ২২ জন।

সেদিনের পর থেকে বাড়িটিতে কোলাহল একেবারে থেমে গেলেও এর গায়ের ইটগুলো আজও বলে যাচ্ছে ভয়াল সেই রাতের কাহিনি।

প্রতিবছর ১ জুলাই এলেই হোলি আর্টিজানের সামনে রাষ্ট্রদূত, কূটনীতিক, রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করতে দেখা যায়। ফুল দিয়ে দিনটি স্মরণ করা হয় জাপানি, ইতালীয়, ভারতীয়সহ নিহত দেশি-বিদেশি নাগরিকদের।

তবে এ বছর জঙ্গি হামলার ৯ বছর পূর্তিতে তেমন কিছুই চোখে পড়ল না। অন্য বছরের মতো এ বছর বাড়িটির সামনে ছিল না কোনো আনুষ্ঠানিকতা, ছিল না শ্রদ্ধাঞ্জলির আয়োজন।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, আগে প্রতিবছরই দিনটিকে ঘিরে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হতো। এলাকা ঘিরে রাখত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এবার কিছুই হয়নি।

আজ মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, হোলি আর্টিজান বেকারির মূল ভবন সবুজে ডুবে রয়েছে। সীমানাপ্রাচীরজুড়ে বেয়ে উঠেছে লতানো গাছ, মাথা উঁচু করে যেন তারা উঁকি দিতে চাইছে ভবনের ভেতরটা। সীমানাপ্রাচীরের ভেতরেও দাঁড়িয়ে রয়েছে বড় গাছ।

প্রধান ফটকটি বন্ধ। ফটকের বিপরীত পাশে লেক ভিউ ক্লিনিকের সামনে দাঁড়িয়ে তিন নিরাপত্তা প্রহরী।

কিছুক্ষণ পর এক নারী এলেন। তাঁকে দেখে নিরাপত্তারক্ষীরা হোলি আর্টিজানের ফটকের পকেট গেট খুলে দেন। ভেতরে প্রবেশ করেন তিনি। এ সময় ওই নারীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি রাজি হননি।

সবুজে ছেয়ে যাওয়া হোলি আর্টিজান বেকারি। ছবি: আজকের পত্রিকা
সবুজে ছেয়ে যাওয়া হোলি আর্টিজান বেকারি। ছবি: আজকের পত্রিকা

নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আজ সকালে কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী বেকারিতে আসেন। তবে শ্রদ্ধা জানাতে কেউ আসেননি। এখন আর সাধারণ মানুষদের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। গত বছর বাড়ির সামনের দেয়ালে একটি ব্যানার টানিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর ব্যবস্থা করা হলেও এবার তা করা হয়নি।

এখন বাড়িটিতে একটি পরিবার থাকে। তাদের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাতে পারেননি নিরাপত্তারক্ষীরা।

কী ঘটেছিল

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত পৌনে ৯টার দিকে গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের পাঁচ নম্বর প্লটের হোলি আর্টিজান বেকারি ও রেস্টুরেন্টে নারকীয় হামলায় চালায় জঙ্গিরা। এতে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জন নিহত হন।

নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৯ জন ইতালীয় নাগরিক, সাতজন জাপানি, একজন ভারতীয়, একজন বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিক এবং অন্য দুজন ছিলেন বাংলাদেশি নাগরিক।

রাতভর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে জঙ্গিরা ওই বেকারিতে বেশ কয়েকজন অতিথি ও বেকারির কর্মচারীকে জিম্মি করে রাখে। পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোর নেতৃত্বে পুলিশ ও র‍্যাবের যৌথ অভিযানে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালিত হয়।

অভিযানে পাঁচ জঙ্গি নিহত হয় এবং জিম্মি থাকা অন্তত ৩৫ জনকে উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

আলোচিত ওই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে গুলশান থানায় মামলা করে। মামলার তদন্তে নারকীয় সেই হামলার সঙ্গে মোট ২১ জনের সম্পৃক্ততা পায় তদন্ত সংস্থা।

এর মধ্যে পাঁচ জঙ্গি ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এ ছাড়া হামলাপরবর্তী বিভিন্ন সময়ে পুলিশ ও র‍্যাবের বিভিন্ন অভিযানে আটজন নিহত হয়। জীবিত অন্য আটজনকে আসামি করে ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, গুলশানে হামলায় জড়িত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক ও হামলার মূল পরিকল্পনকারী তামিম আহমেদ চৌধুরী এবং নব্য জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্য নুরুল ইসলাম মারজান, সরোয়ার জাহান, তানভীর কাদেরী, বাশারুজ্জামান চকলেট, মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান ও রায়হানুল কবির রায়হান বিভিন্ন অভিযানে নিহত হন।

হামলার সময়ই কমান্ডো অভিযানে নিহত হন পাঁচ জঙ্গি—রোহান ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, শফিকুল ইসলাম উজ্জল ও খায়রুল ইসলাম পায়েল।

মামলায় ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর নব্য জেএমবির সাত সদস্যকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন বিচারিক আদালত। পরে মামলার নথিপত্র পাঠানো হয় হাইকোর্টে।

হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে ওই সাতজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন। সম্প্রতি হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে লিপ টু আপিল করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ভয়াবহ সেই ঘটনার পর হোলি আর্টিজান বেকারি বন্ধ করে দেওয়া হয়। বেকারির স্বত্বাধিকারী পরে গুলশানেই অন্য এক জায়গায় আরেক রেস্তোরাঁ খোলেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত