Ajker Patrika

পাঠ্যপুস্তকে জাতীয় কবি কি উপেক্ষিত?

রাফাত মিশু
আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২২, ১৭: ১৫
পাঠ্যপুস্তকে জাতীয় কবি কি উপেক্ষিত?

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) কেন বড় কবি, সেটি এখন আর কোনো অমীমাংসিত বিষয় নয়। বাংলা কবিতার ইতিহাসে শুধু নয়, বাংলা জনাঞ্চলের আর্থরাজনৈতিক পটভূমিতেও কাজী নজরুলের একটি স্বতন্ত্র অবস্থান আছে। সেই পরম্পরায় নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে ভূষিত হয়েছেন এবং মৃত্যুর পর তাঁর সমাধি এই বাংলাদেশের মাটিতেই সংরক্ষিত আছে। ফলে বাংলাদেশে নজরুল-বিচার কেবল সাহিত্য-শিল্প-নন্দনের মাপকাঠি দিয়ে চলে না এবং সেটা হয়ওনি। এর সঙ্গে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে থাকে বাংলাদেশের জাতীয় চেতনা এবং জাতীয় চেতনার রূপান্তর। নজরুল তো সেই ১৯৪২ সালেই নির্বাক হয়ে যান। এর আগে সবাক নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, খেলাফত আন্দোলন, স্বরাজসহ প্রায় প্রতিটি জাতীয় আন্দোলনে সক্রিয় থেকেছেন এবং নিজের অবস্থান অকুণ্ঠভাবেই প্রকাশ করেছেন স্লোগানে, গানে, কবিতায়, কথাসাহিত্যে—সর্বত্র। বেঁচে থাকার পুরোটা সময় চেতনশীল থাকলে নিশ্চয়ই চল্লিশের দশকের দ্বিজাতিতত্ত্ব-ভিত্তিক পাকিস্তান আন্দোলন, ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা, বিভাগ-পরবর্তী ভারত ও পাকিস্তানের রাজনীতি এবং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে তিনি তাঁর অবস্থানের জানান দিতেন। তিনি সেই সুযোগ পাননি। কিন্তু পাঠক-অনুরাগীদের কাছে নজরুল যেমন নানা মাত্রিক ইতিবাচকতার মধ্য দিয়ে, বিপ্লবী চেতনার মধ্য দিয়ে গৃহীত হয়েছেন, তেমনি বিভিন্ন আমলের শাসকগোষ্ঠীও নানাভাবে নজরুলকে বিবেচনায় এনেছে। বিশেষত পাকিস্তান-পর্বের আইয়ুবি কালো দশকে নজরুলের কবিতা ও গানে নানা ধরনের কাটাছেঁড়া ও শব্দ পুনঃস্থাপনের যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়, তা থেকে নজরুলপাঠে রাজনীতি সাপেক্ষতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একাত্তর-পরবর্তীকালে নজরুলকে ঢাকায় নিয়ে আসা, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া, জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা দেওয়া, তাঁকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করা—একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার, নজরুল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা—এ সবই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও বিবেচনার ফলাফল। ফলে নজরুলসাহিত্যের চর্চা, তার প্রসার এবং জাতীয় জীবনে নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা অনুসন্ধান ইত্যাদি বিষয়-আশয় রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে। বাংলাদেশ একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত। তাই রাষ্ট্রীয় বিষয়গুলো এখানে জাতীয় বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। রাষ্ট্রের নানান গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের মধ্যে তাঁর শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কারণ রাষ্ট্র তার ভবিষ্যৎ নাগরিকদের কীভাবে গড়ে নিতে চায়, তার অনেকখানি এই বিষয়ের ওপর নির্ভর করে এবং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। যেকোনো রাষ্ট্রের ইতিহাসপাঠের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পাঠ্যপুস্তকের স্বরূপ ও রূপান্তর অন্বেষণের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। সেই বিবেচনায় রাষ্ট্র কীভাবে নজরুলকে, অর্থাৎ তার জাতীয় কবিকে পেতে চায়, তা জানার জন্য পাঠ্যপুস্তকে নজরুল কীভাবে আছেন সেটি বুঝে নেওয়া জরুরি। 

কাজী নজরুল এক অর্থে সব্যসাচী লেখক। গান-কবিতা-ছড়া-উপন্যাস-গল্প-প্রবন্ধ-পত্র-অভিভাষণ—সবই লিখেছেন। এসব রচনার মধ্যে নজরুলের সমকালের অভিঘাত আছে, আছে শিল্পসৃজনের বহুস্তরিক কলাকৌশল, তত্ত্ব ও মতবাদের ঘনিষ্ঠতা। তেমনি বর্তমানে দাঁড়িয়ে শতবর্ষকাল আগের নজরুলকে দেখার মধ্য দিয়ে বর্তমানের চোখটিও যুক্ত হয়ে যায় অনিবার্যভাবে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পাঠ্যপুস্তককে যে চোখ দিয়ে পাঠ করানো হয়, তা কেবল ব্যক্তি অথবা সমষ্টির থাকে না; সেটি মূলত রাষ্ট্রেরই চোখ হয়ে ওঠে। অন্য যেকোনো পাঠের মতো নজরুলপাঠও তাই কেবল অতীতের বিষয় হয়ে থাকে না। স্বাধীন বাংলাদেশের আগে-পরে নজরুল ও নজরুলসাহিত্য পাঠ্যতালিকায় সব সময়ই কমবেশি ছিল। শিল্পের তাত্ত্বিকদের কাছে নজরুল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাত্রায় গৃহীত হয়েছেন—কখনো কম, কখনো বেশি; কখনো শুরু, কখনো গুরু। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে শিশু থেকে তরুণ সবাই নজরুলসাহিত্যের কিছু দিক সম্পর্কে অবহিত থেকেছে। ফলে বাংলাদেশের সাক্ষর-শিক্ষিতদের চেতনাস্রোতে নজরুলের অবস্থান বেশ স্থায়ী। কিন্তু নজরুলপাঠ তো বড় বিষয়; পাঠ্যপুস্তকে নজরুলের সব সৃজনকর্ম অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভবও নয়। তাই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে নজরুল কীভাবে, কোন দৃষ্টিকোণ থেকে এবং কত পরিমাণে উপস্থিত থাকছেন, তা জানার মধ্য দিয়ে জাতীয়ভাবে নজরুলের একটি প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ পাঠ গ্রহণ করা যায়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বহুধারায় বিভক্ত, সেগুলো নিয়ে আছে নানা বিতর্ক—বর্তমান আলোচনার ক্ষেত্র সেটা নয়। এখানে কেবল বাংলাদেশের পুস্তক প্রণয়নসংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রণীত বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে নজরুলরচনার পরিচয় ও সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ের কার্যকারণ বোঝার চেষ্টা করা হবে। ২০২২ সালে প্রণীত পাঠ্যপুস্তকই বর্তমান আলোচনার উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে। এর মধ্য দিয়ে বর্তমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চোখ ও নজরুলচেতনার মধ্যে একটি দৃষ্টিভঙ্গিগত সাদৃশ্য, বৈচিত্র্য ও বিপ্রতীপতা অনুধাবন করা সম্ভব হবে। 

প্রথম থেকে দ্বাদশ—এই বারোটি শ্রেণির আবশ্যিক হিসেবে বাংলা বিষয়ের বই প্রণয়ন করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড নামক প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি শ্রেণির বাংলা বইয়ে নজরুলকৃত সাহিত্যকর্মকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়, অর্থাৎ প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ের নাম অভিন্ন—‘আমার বাংলা বই’। প্রথম শ্রেণির বইয়ে আছে কাজী নজরুলের ‘ঝিঙে ফুল’ (১৯২৬) কাব্যগ্রন্থভুক্ত জনপ্রিয় শিশুতোষ ছড়া ‘প্রভাতী’র কিছু অংশ; অর্থাৎ সবার পরিচিত ‘ভোর হলো/দোর খোল/খুকুমণি ওঠরে!’ যদিও পাঠ্যবইয়ে কবিতার নামকরণ করা হয়েছে ‘ভোর হলো’। হয়তো প্রথম শ্রেণির শিশু শিক্ষার্থীদের ‘প্রভাতী’র র-ফলা পাঠের জটিলতা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা। দ্বিতীয় শ্রেণির বইয়ে আছে ‘আমি হব সকাল বেলার পাখি। সবার আগে কুসুমবাগে উঠব আমি ডাকি।’ এর নামকরণ করা হয়েছে ‘আমি হব’। এটি মূলত নজরুলের ‘সাত ভাই চম্পা’র প্রথম অংশ। তৃতীয় শ্রেণিতে আছে বিখ্যাত রণসংগীত হিসেবে পরিচিত ‘সন্ধ্যা’ (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থের ‘নতুনের গান’ কবিতার প্রথম অংশ: ‘চল্ চল্ চল্’। চতুর্থ শ্রেণির বইয়ে আছে ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থভুক্ত ‘মা’ কবিতা: ‘যেখানেতে দেখি যাহা/মা-এর মতন আহা/একটি কথায় এত সুধা মেশে নাই...’। পঞ্চম শ্রেণিতে নজরুলের ‘সংকল্প’ কবিতা (অগ্রন্থিত) অর্থাৎ ‘থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,’ কবিতার সংক্ষেপিত রূপ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা বই ‘চারুপাঠ’-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে আরও একটি বহুল পঠিত ছড়া-কবিতা ‘ঝিঙে ফুল’। সপ্তম শ্রেণির ‘সপ্তবর্ণা’য় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সাম্যবাদী (১৯২৫) কাব্যগ্রন্থভুক্ত ‘কুলি-মজুর’ কবিতার সংক্ষেপিত রূপ। সপ্তম শ্রেণির ‘আনন্দপাঠ’ (দ্রুতপঠন) নামক বইয়ে নজরুলের ‘জাগো সুন্দর’ নামক নাটিকা আছে; যদিও এর মূল নাম ‘জাগো সুন্দর চিরকিশোর’। অষ্টম শ্রেণির ‘সাহিত্য কণিকা’ বইয়ে কাজী নজরুলের দুটি রচনা স্থান পেয়েছে: একটি প্রবন্ধ ‘ভাব ও কাজ’ (যুগবাণী), অপরটি কবিতা ‘নারী’ (সাম্যবাদী)। নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য প্রণীত ‘বাংলা সাহিত্য’ বইয়ে নজরুলের তিনটি রচনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে: প্রবন্ধ ‘উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন’ (যুগবাণী), কবিতা ‘দোলন-চাঁপা’ (১৯২৩) কাব্যগ্রন্থভুক্ত ‘আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে’ এবং কবিতা ‘মানুষ’ (সাম্যবাদী); এগুলোর মধ্যে শিক্ষার্থীদের যেকোনো দুটি পাঠ্য। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ‘সাহিত্যপাঠ’ বইয়েও তিনটি নজরুলরচনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে: একটি প্রবন্ধ ‘রুদ্রমঙ্গল’ (১৯২৭) গ্রন্থভুক্ত ‘আমার পথ’ এবং দুটি কবিতা ‘অগ্নি-বীণা’ (১৯২২) কাব্যগ্রন্থভুক্ত ‘বিদ্রোহী’ ও ‘সাম্যবাদী’। এ ছাড়া চতুর্থ শ্রেণির ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইয়ে কাজী নজরুল রচিত ‘শোন শোন ইয়া ইলাহী আমার মোনাজাত’ সূচক ‘হামদে ইলাহী’ সংযোজিত হয়েছে।

আগেই বলা হয়েছে, নজরুলের রচনাসম্ভার আয়তনে অনেক বড়। নজরুলরচনার কী কী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তার তালিকা হবে অসীমের মতো দীর্ঘ। কী কী রাখা যেত, সেটাও অনেকখানি আপেক্ষিক। তাই নজরুলকৃত যেসব রচনা পাঠ্যপুস্তকভুক্ত হয়েছে, সেসব কী রূপে ও কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সেটাই এই আলোচনায় মুখ্যতা পাবে। নজরুলের সাহিত্যকর্ম যে সব পর্যায়ে পাঠ্যভুক্ত আছে, এ থেকে বোঝা যায়, রাষ্ট্র নজরুলকে পাঠ করতে আগ্রহী। প্রাথমিক শ্রেণি পর্যায়ে নজরুলের যেসব ছড়া ও কবিতাজাতীয় রচনা পাঠ্যভুক্ত হয়েছে, সেসবের পাঠ সহৃদয়তা তৈরি, ছন্দ ও শ্রুতিমাধুর্য, ভাষার বর্ণ-শব্দ-উচ্চারণে সাবলীলতা সম্পর্কে শিশুদের পরিচিতকরণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। প্রকৃতিচেতনা, কর্তব্যবোধ, মাতৃভক্তি, জ্ঞানের প্রতি কৌতূহল—এই বিষয়গুলোও ওইজাতীয় রচনার সঙ্গে জড়িত। মাধ্যমিক শ্রেণিতে কবিতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রবন্ধ। নজরুলের সাংগীতিক কাব্যবোধের সঙ্গে মনন ও চিন্তার যুক্তিশৃঙ্খলা সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা অবহিত হয় প্রবন্ধপাঠের মাধ্যমে। এই পর্বে নজরুলের বেশির ভাগ প্রবন্ধ গ্রহণ করা হয়েছে যুগবাণী (১৯২২) প্রবন্ধগ্রন্থ থেকে। যুগবাণীর বেশির ভাগ প্রবন্ধ ‘দৈনিক নবযুগ’ (১৯২০) পত্রিকার সম্পাদকীয় হিসেবে রচিত হয়েছিল। পুরো প্রবন্ধগ্রন্থে তৎকালের অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের উত্তাপ এবং নজরুলের বিপ্লবী অবস্থান অনুধাবন করা যায়। ‘উগ্র জাতীয়তাবাদ’ ছড়ানোর অভিযোগে যুগবাণী একসময় ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধঘোষিত হয় (১৯২২)। যদিও পাঠ্যপুস্তকে বিপ্লবাত্মক কোনো প্রবন্ধ নির্বাচন করা হয়নি। মানুষকে কর্মমুখী করে তোলা, তার সদর্থক গুণাবলির বিকাশ ঘটানো এবং সেই সূত্রে নজরুলের কর্মমুখরতা সম্পর্কে জানানোর জন্য প্রবন্ধগুলো নির্বাচন করা হয়ে থাকতে পারে। কবিতার ক্ষেত্রে নজরুলের নিজস্ব ধাঁচের সাম্যবাদী চিন্তা, মানবমুখিতা, শোষণহীন সমাজ, লিঙ্গসমতা, বৈষম্যমুক্তি গুরুত্ব পেয়েছে। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে, অর্থাৎ সাধারণ বাংলা শিক্ষা গ্রহণের সর্বোচ্চ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে নজরুলের যুগচিহ্নিত কবিতা ‘বিদ্রোহী’; পুরোটা নয়, সংক্ষেপিত। পাঠ্যপুস্তকে অনেক সময় বড় রচনাকে সংক্ষেপিত ও পরিমার্জনা করা হয় মূলত শিক্ষার্থীদের পঠনপরিধি, বয়সের সঙ্গে সংগতি রক্ষা এবং আধুনিক বানান সমন্বয়ের বিষয় বিবেচনায় রেখে। একই বিবেচনায় হয়তো প্রাথমিক শ্রেণি পর্যায়ে কিছু কবিতার নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। যদিও কবিতার মূল নাম জানাটাও শিক্ষার একটি অংশ। কিন্তু একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির মতো পরিণত পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রণীত বাংলা সাহিত্যের বইয়ে ‘বিদ্রোহী’র মতো গুরুত্বপূর্ণ কবিতা কেন সংক্ষেপিত আকারে প্রকাশ করা হলো, তা ভাবনার দাবি রাখে। আর কবিতাটি যেভাবে বইয়ে মুদ্রিত রয়েছে, তাতে কবিতার মাত্রা-তাল-লয় ও ছন্দবোধ অনেকখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অতিপর্ব, স্তবকবিন্যাস—এই বিষয়গুলো নেই হয়ে গেছে। আর সংক্ষিপ্তকরণের নামে যা যা ছেঁটে ফেলা হয়েছে, তা আরও ভাবিয়ে তোলে। আমরা সবাই জানি, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নজরুলের ‘আমিত্ব’বোধের জাগরণের আগ্নেয়গিরিসম সৃষ্টি। এখানে যে বিদ্রোহ উপস্থিত আছে, তার রূপ নানামাত্রিক ও বহুকৌণিক। এই বিদ্রোহ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ; অশুভ শক্তি, জড়তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং উপনিবেশ-শৃঙ্খলিত শোষিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তি-আকাঙ্ক্ষায় নজরুলের এই বিদ্রোহ। নজরুল তাঁর বিদ্রোহের স্বরূপ প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি নিজের ধর্মগত ঐতিহ্য ও জাতিগত সংস্কৃতি দুই জায়গা থেকেই উপকরণ সংগ্রহ করেছেন। সে কারণে তাঁর পুরাণ-চেতনায় ঘটে পশ্চিম এশীয় ও ভারতীয় চেতনার দারুণ মিথস্ক্রিয়া; অনেকে দুই প্রবণতাকে মুসলিম ঐতিহ্য ও হিন্দু ঐতিহ্য বলেও চিহ্নিত করে থাকে। কিন্তু আমরা যখন পাঠ্যবইয়ের ‘বিদ্রোহী’ পড়ি, তখন কিছু প্রসঙ্গের সচেতন অবলুপ্তি নজরুলের স্বরূপ চিনতে বাধাগ্রস্ত করে। যেমন মূল পাঠের সপ্তম-অষ্টম-নবম পঙ্‌ক্তিতে আছে—‘ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া, /উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাত্রীর’। মূল পাঠেই ‘আরশ’ শব্দটি যে আক্ষরিক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, তা বোঝাতে একে উদ্ধরণ চিহ্নের (‘’) মধ্যে রাখা হয়েছে। আর এই ‘খোদার আরশ’ যে ঔপনিবেশিক শক্তির ক্ষমতাকেন্দ্র, আক্ষরিক ইসলাম ধর্মের আল্লাহর আরশ নয়, তা নজরুল-সমকালেই সাহিত্যপাঠকেরা শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। অথচ পাঠ্যবইয়ে সেই পঙ্‌ক্তি বাদ পড়ে গেল। ‘বিদ্রোহী’ অগ্নিবীণার শতবর্ষে এসে শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হতে হয় এক আপসী পরিস্থিতির। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে আরও একটি পঙ্‌ক্তি বাদ হয়ে গেছে—‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন!’ এটিও আজ কারোর অজানা নয় যে, এই ভগবান ব্রিটিশ শোষকেরই রূপক। সবাই জানলেও রাষ্ট্র ঝুঁকি নিতে চায় না। আর তাই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পাঠ্যবইয়ে জায়গা পেলেও নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার পূর্ণরূপ অনেকটাই অধরা থেকে যায়। হয়তো রাষ্ট্র এমন এক বিদ্রোহী নজরুলকে পরিচিত করাতে চায় যে ‘সীমিত মাত্রার বিদ্রোহী’, সে চায় না কোনো বিপ্লবীকেও। রাষ্ট্র তার পূর্বসূরি বিপ্লবীদের ইতিহাসের আবদ্ধ মলাটের মধ্যে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বাংলা সাহিত্যে নজরুলই সম্পূর্ণত অসাম্প্রদায়িক ও আপসহীন কবি। কিন্তু রাষ্ট্রের চোখে আমরা যে নজরুলকে পাঠ করি, তার স্বরূপটিও অনেকখানি রাষ্ট্রসাপেক্ষ থেকে যায়। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের মনস্তত্ত্ব ও চারিত্র্যও টের পাওয়া যায়। এটি নতুন কোনো বিষয় নয়। পাকিস্তান পর্বে নজরুলের কবিতায় ‘সজীব করিব মহাশ্মশান’-এর বদলে ‘সজীব করিব গোরস্থান’-এর বহুল প্রচলন, শ্যামাসংগীত নিষিদ্ধকরণ, কেবল হামদ-নাত পরিবেশন—এসবও রাষ্ট্রকৃত বিষয়ই ছিল। তার বিপরীতে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামের ফসলই আমাদের বর্তমানের বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তককে হতে হবে অসংকোচ, দ্বিধাহীন ও প্রাগ্রসর। সেই সঙ্গে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে নজরুলপাঠ ও রাষ্ট্রের চোখে নজরুল—এই দুইয়ের মধ্যে থাকবে না কোনো নীতিগত বিপ্রতীপতা—এ-ই আমাদের প্রত্যাশা। 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

তৌহিদুল হকের গুচ্ছ কবিতা

তৌহিদুল হক
তৌহিদুল হকের গুচ্ছ কবিতা

রক্ত লাল

আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে

গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায়

ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের

জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।

যা স্বভাববিদ্ধ, তবে কতটা উপকারী বা বাঁচিয়ে

রাখার নিরলস অভিপ্রায়। মানুষের তরে

প্রাণীর অফুরন্ত প্রাচুর্য বিস্তৃতকরণে, কিংবা

উদ্ভিদের অন্তিম প্রেমে বসন্তের অভিষেকে।

কতটা জ্বলতে হয় পরের জন্য, কতটা ফুটন্ত

শরীর নিয়ে চালিয়ে যায় সেবার পরিধি।

এক চিরন্তন শিক্ষা, আবার উদিত হয়

দিনের শুরুতে, বিদায় প্রান্তিক অপূর্ব

মায়ায়-দিনের শেষ প্রান্তে।

এতটুকু কার্পণ্য রেখে যায়নি, হয়তো মুখ

ফিরিয়ে নিবে না কোনো দিন। তবে ভাবনার

অন্তিমে শেষ দৃশ্যের সংলাপে ভেসে

ওঠে জনদরদি রাজার মুখ। যেখানে রক্ত ঝরে

বন্যার বেগে সেখানেও প্রতিদিন ফুল ফোটে ফুল হয়ে।

যত দেখি

যত দেখি তৃপ্ত হই, শীতল হয়ে

জড়িয়ে পড়ি তোমার সমস্ত শরীরে। এক অজানা

শিহরণ ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের সমস্ত পৃষ্ঠা জুড়ে।

যেন দীর্ঘদিনের শুষ্কতা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে।

হারিয়ে যাওয়া রস ফিরছে মূলে, নিয়ে যাচ্ছে আদিপর্বে।

যেমন নেয় নদীর কূল, জোয়ারের ফেনা।

ভাবনার অতলে অদ্ভুত মায়া, দীর্ঘক্ষণ মোহগ্রস্ত

করে রাখে চোখের পলক, তাকিয়ে থাকি মায়ার মায়ায়। কী অপরূপ মায়া!

সেখানেও দেখি তৃষ্ণার ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষারত কান্না।

জীবনের তল্লাটে হারিয়ে খুঁজি আজ

আমারও জীবন ছিল। মায়ায় ভরা নির্বিঘ্ন আয়োজন, কলমিলতার মতো নিষ্পাপ।

তৃপ্ত হই ঘাসে, বাতাসের বেহায়া আঘাতে

অভিমানের মোড়ক ছুড়ে ফেলে হাতে তুলে নেই

কচু পাতায় টলোমলো জলের লজ্জা। এ জীবনের চাহিদা তোমায় দেখার

প্রয়োজনে তপ্ত, হয় উত্তপ্ত অথবা সহ্যের অতীত শীতল।

এ যেন কেমন

গহিন অরণ্যে সবুজ পাতার মতো, মগজে

চিন্তার রাজ্যে ভাবের উদয়, আকুল বিন্যাসে

একটু একটু করে এগিয়ে নেয়, আবার ভরা কলসির

মতো বসিয়ে রাখে-ভবের রাজ্যে। একদিন সমস্ত ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে

এদিক-ওদিক চলন, জীবন্ত মরণ! মানুষ

কেন বাঁচে, কীভাবে বাঁচে-প্রশ্নের সমাধা

আজ তর্কপ্রিয় সন্ধানে, মূর্ত প্রার্থনা।

সকল প্রিয়জন পরিত্যাগে, নিগূঢ় যত্নে হৃদয়ে প্রবেশ করে

নিজের অপরিচিত চেহারা, সব জিজ্ঞাসার

অন্ত-ক্রিয়ার এক উচ্চতম বিলাস।

জীবনের মানে অর্থশুন্য ভবিতব্য! এ কী হয়?

চোখের পলকে নিষ্পাপ দৃশ্যলোক-পেছন ডাকে বারবার

যেখানে থাকে আবার দেখার ইচ্ছা, নামে যে মুক্তকরণ। মিলনকান্তির আবাস।

চতুর্মুখ সমীকরণে খেলে যায় সময়ের ঝাঁজালো সিদ্ধান্ত। কেউ কী অপ্রিয় হয় কারও?

যেখানে ভেসে ওঠে নীলপদ্ম, অতীতের নিটোল কিতাব। সে-তো মানুষের ছবি!

চলে আসুন সবজি বাজারে

মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি অনেক কিছু

যা মানুষের নয়। অ-মানুষের জন্ম-উত্তর বাঁচার

উপায় হতে পারে। পোশাকে সজ্জিত দেহ কতভাবে

হিংস্র হয়, গোপনে, অন্ধের গহনে।

প্রবেশের আগেই পেয়েছি সংকেত। কত নোংরা, পচা, আবর্জনায় ভরা একটি থালার মতো

পড়ে আছে সম্মুখে। কেউ কি দেখেছে?

হয়তো মেনে নিয়েছে সবাই, সবার আগে সে

যে ভেবেছে, কী বা আছে উপায়!

চারপাশে কত কিছুর ঘ্রাণ, চোখ যা বলে তা কি মেনে নেয় স্বাস্থ্যবার্তা

ফুটে আছে ফুলের মতো দোকানের পসরা। খেতে বা কেনায় বারণ বালাই নেই।

যা পাচ্ছে নিচ্ছে, অনেকে। কেউ গায়ে কেউ পেটে।

আহা! দেখার কেউ নেই!

এক অন্ধকারে হাঁটছে আমাদের পা।

কেউ কি আছে কোথাও, আলো নিয়ে হাতে? ভেবেছে কি কেউ

কেন আমাদের আয়োজনে সবাই নেই?

কেউ এসে শুধু একবার বলুক, এই নিন-আপনাদের জীবন টিকিট যা উত্তরণ।

চলে আসুন সবজির বাজারে, সবুজের খোঁজে।

ইতিহাস

আজ স্পষ্ট ঘোষণা, আমার চোখের সামনে কেউ নেই

নেই কেউ ভাবের অন্তিম ঘরে। এক অস্পৃশ্য অনুভব

ছুঁয়ে চলে, ভাসিয়ে দেয় অগণিত স্রোতের তুমুল আলিঙ্গনে।

আজ কিছু ভেবে বলছি না, সরাসরি জবাব---

আমি নই কারও!

সব বাতাসের সাথে মিশে থাকা চোখের প্রেম

ভাবনার বিলাসে জড়িয়ে পড়ার বাসনা----সকলের অগোচরে

অথবা সকলের মাঝে। জীবনের অর্থে হৃদয়ের গুড়গুড় আলাপ

ঘুটঘুটে অন্ধকারে হৃদয়ে খোলা আকাশ, শুধু

এক মুখচ্ছবি।

আজ কোনো ক্ষমা নেই---নিজের প্রতি! নিজের পাপে

হাঁটি আমি, সবার মাঝে একলা হয়ে। বেদনার

কালো রং নিয়ে। শুধু দেখে যাই, শুধু দেখতে যাই।

কত রং বিরাজ করে ভাবনার গরমিলে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রই।

দাঁড়িয়ে থেকেও হেঁটে যাই!

আজকের না বলা কথা, কোনো দিন বলা হবে না

হবে না দাঁড়িয়ে আবার ভাবা আর একটু বসলে

ভালো হতো। যে বসিয়ে রাখে যে আশায় বসে থাকে

সবকিছুর-ই সময় থাকে---

এরপর---ইতিহাস!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিদায় নেওয়া হুমায়ূন এখনো আছেন

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৮: ৪২
হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’ জবাবে ফারুক বললেন, ‘কী আশ্চর্য ভাই?’ হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘এই যে প্রকৃতি, জোছনা, বৃষ্টি, নদী— কী সুন্দর! একদিন হয়তো আমি এসব আর দেখতে পারব না। একুশের বইমেলা হবে। লোকেদের ভিড়, আড্ডা; আমি সেখানে থাকব না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! হায় রে জীবন!’

‘আমার না বলা কথা’ বইয়ে ফারুক আহমেদ এই স্মৃতিচারণ করেছেন। লিখেছেন, ‘আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। একসময় তাকিয়ে দেখলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের দুচোখের কোনায় পানি।’

হুমায়ূন আহমেদ নেই। তবে তিনি রয়েছেন দেশের তরুণদের মনে। যে বইমেলায় তিনি থাকবেন না বলে আক্ষেপ, সেই বইমেলায় তাঁর বইয়ের স্টলে তরুণদের ঢলের মধ্যে আছেন।

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম এই দিনে (১৩ নভেম্বর); ভারত ভাগের এক বছর পরে ১৯৪৮ সালে। ছোট সময়ে তাঁর নাম ছিল শামসুর রহমান। তাঁর বাবা ছেলেমেয়েদের নাম পাল্টে ফেলতেন। তাঁর নাম পাল্টে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। শুধু কথাসাহিত্যেই নয়; ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’,

‘আজ রবিবার’-এর মতো নাটক বানিয়েছেন, তৈরি করেছেন ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’র মতো চলচ্চিত্র।

হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি, জোছনা ভালোবাসতেন। তাঁর লেখায় সেসব উঠে এসেছে বারবার। ২০১২ সালের জুলাইয়ে বর্ষাতেই তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ওপারে।

তিনি নেই। কিন্তু তাঁর লেখায় উঠে আসা চান্নিপসর, বৃষ্টি বিলাস আজও আছে তরুণদের মনে। ফারুক আহমেদ তাঁর ওই বইয়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে—‘এক বিকেলে শুটিং শেষে তাঁর প্রিয় লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে আছেন হুমায়ূন। সেখানে ঝুলছে পাকা লিচু। তিনি তাঁর কেয়ারটেকার মুশাররফকে ডেকে গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে এলেন। তাদের বললেন, গাছে উঠে যে যত পারে লিচু খেতে। বাচ্চারা কেউ গাছে উঠে লিচু খাচ্ছে, হইচই করছে। কেউ পকেটে ভরছে। হুমায়ূন আহমেদ অবাক হয়ে সেই লিচু খাওয়া দেখতে লাগলেন।’

ফারুক আহমেদ লিখেছেন, ‘হুমায়ূন ভাই একসময় আমাকে বললেন, এমন সুন্দর দৃশ্য তুমি কখনো দেখেছো? এমন ভালো লাগার অনুভূতি কি অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায়? আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, না ভাই এমন ভালো লাগার অনুভূতি কোনোভাবেই পাওয়া যায় না।’

হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ঘিরে রাজধানীসহ জন্মস্থান নেত্রকোনাতে রয়েছে নানা আয়োজন। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের কুতুবপুরে হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে। সকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোরআন খতম করবেন। এরপর শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ প্রাঙ্গণ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী এবং হুমায়ূনভক্তদের আনন্দ শোভাযাত্রা বের হবে। পরে লেখকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জন্মদিনের কেক কাটা, বৃক্ষরোপণ, কুইজ, হুমায়ূন আহমেদের রচিত নাটক ও সিনেমার অংশবিশেষ নিয়ে অভিনয়, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া রাজধানীতে হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র নিয়ে চলচ্চিত্র সপ্তাহ, হুমায়ূন প্রতিযোগিতা, হুমায়ূন জন্মোৎসব, টেলিভিশন চ্যানেলে নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচারসহ নানা আয়োজনে মুখর থাকছে দিনটি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘হীরক রাজার দেশে’ মঞ্চস্থ করল স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।

মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্‌যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।

হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।

নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।

শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

গবেষণায় বেরিয়ে এল আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’র গল্প

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।

কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’

গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।

ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’

মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’

মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত