Ajker Patrika

সাম্প্রতিক কালে রবীন্দ্রসাহিত্য কতখানি প্রাসঙ্গিক? 

সুমন সাজ্জাদ
আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২২, ১৪: ৫০
সাম্প্রতিক কালে রবীন্দ্রসাহিত্য কতখানি প্রাসঙ্গিক? 

সাম্প্রতিক কালে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসাহিত্য কতখানি প্রাসঙ্গিক—এ রকম একটি প্রশ্ন কেউ কেউ তুলতে চান, তুলেও থাকেন। সাহিত্যের দীক্ষিত পাঠক থেকে শুরু করে অদীক্ষিত শখের পাঠকও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন—আদতেই রবীন্দ্রনাথ কিংবা রবীন্দ্রসাহিত্যের ‘দরকার’ আছে কি না! প্রশ্নটি অথবা প্রশ্নগুচ্ছে জড়িয়ে থাকে প্রায়োগিক জীবনব্যবস্থার চিহ্ন। যেমন করে আমরা প্রশ্ন তুলে থাকি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, নাসার মঙ্গল অভিযান কিংবা শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহারিক গুরুত্ব আছে কি নেই! একইভাবে যেন জিজ্ঞাসা জন্মায়, ফলিত বিশ্বে রবীন্দ্রনাথ দরকারি কি না! মজার ব্যাপার এই যে, প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিকতার প্রশ্ন তোলা যায় আরও আরও মহাজন প্রসঙ্গে। তবে ঘুরেফিরে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে এই প্রশ্নের মরা গাঙে জোয়ার আসে। 

গ্রিক তরুণ কবিরা নিশ্চয়ই দল বেঁধে প্রশ্ন তুলতে পারেন, দেউলিয়া ও ঋণগ্রস্ত সমকালীন গ্রিসে হোমারের প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? হোমারের প্রাচীন লেখাপত্র পড়েই-বা কী লাভ? হোমারের কলাকৌশল একালের গ্রিক কবিতাকে কতটুকু উৎকর্ষের দিকে নিয়ে যাবে? প্রযুক্তি আচ্ছাদিত দুনিয়ায় সফোক্লিস, কালিদাস, ওভিদেরই বা কোন প্রাসঙ্গিকতা পাওয়া যাবে? এসব প্রশ্নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাঙালি নবীন কবি-লেখকেরাও তুলতে পারেন সমান তালের প্রশ্ন। প্রশ্ন তুলতে সমস্যা নেই। তবে প্রশ্নটি নিজেই যৌক্তিক কি না, সে বিষয়ে ভাবার সুযোগ আছে। 

রবীন্দ্রসাহিত্যকে অনেকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চান। কিন্তু ইতিহাসের মুষ্টাঘাতে তুড়ি ঠিক তালে তাল ঠুকে বাজে না। কারণটা এই: নন্দনতাত্ত্বিকতা ছাড়িয়েই রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছেন বাংলা অঞ্চলের সাংস্কৃতিক প্রতীক। এক দিন-দুই দিনের আনুষ্ঠানিক আলাপ আর বৈঠকে বসে তাঁকে সম্মিলিতভাবে প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি। ইতিহাসের এক দীর্ঘ পর্ব তাঁকে নির্মাণ করেছে। সময়ের সঙ্গে সাড়া দিয়ে, সময়কে নেড়েচেড়ে নিজের মতো গড়েপিটে তিনিও সময়কে নিজের জন্য নির্মাণ করে নিয়েছেন। তাহলে ঐতিহাসিকতা আর ঐতিহাসিক পাঠই কি সাহিত্যের প্রতীক-প্রতিম কবি-লেখকদের জন্য পরম নিয়তি? সেই সূত্রেই ধেয়ে আসে অপর এক জিজ্ঞাসা : নন্দনতাত্ত্বিকভাবে রবীন্দ্রনাথ কি প্রাসঙ্গিক নন? জরুরি নন?

বিনা দ্বিধায় বলা যায়, ঘোরতরভাবে প্রাসঙ্গিক। আমাদের মনে রাখতে হবে, উনিশ শতকের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বাংলা একটি অবিকশিত প্রাদেশিক ভাষামাত্র। ওড়িয়া, অসমিয়া ভাষার মতোই বাংলা খুঁজে বেড়াচ্ছে ভবিষ্যতের দিশা। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে একদিকে চলছে ঔপনিবেশিক পণ্ডিত ও কর্মকর্তাদের অনুশীলন, অন্যদিকে চলছে সংস্কৃতসেবীদের শুদ্ধি অভিযান। তার ওপর সবকিছু টপকে গিয়ে চূড়ায় বসে আছে নব্য বাঙালির ইংরেজিয়ানা। ভাষাগত এই পটভূমির ওপর গড়ে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর প্রাসঙ্গিকতা ফুরিয়ে যাবে, দুম করে এমন কথা বলা যায় না। 

শিল্প-সাহিত্যের নানা নিরীক্ষায় রবীন্দ্রনাথ হতে পারেন প্রেরণার উৎসভূমি। আমরা হয়তো জানি না যে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টিশীল নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টি করেছেন। কবিতাকে করেছেন নাটক, কাব্যনাট্যকে করেছেন গীতিনাট্য। যেমন—‘পরিশোধ’ কবিতাটি হয়ে গেল নৃত্যনাট্য শ্যামা। চিত্রাঙ্গদার কাহিনি পেয়ে গেল নৃত্যনাট্যের রূপ। লেখার এই রূপান্তরের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ জুড়ে দিয়েছেন ব্যাখ্যা। শেষ জীবনে ঝুঁকেছিলেন চিত্রকলায়। সেখানেও ফলেছে নতুন শস্য।

সাহিত্যের ভাব ও ভাষার খোঁজে অনেক পথ খুঁড়তে হয়েছে তাঁকে। তরুণ রবীন্দ্রনাথের সামনে ছিল মধুসূদন-বঙ্কিমচন্দ্র অধ্যুষিত পথ। আজ আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও অসম্ভব যে উনিশ শতকের বাংলা কবিতায় মধুসূদন কতখানি প্রভাববিস্তারী হয়ে উঠেছিলেন; নানাবিধ ‘বধ-কাব্যে’ ভরে উঠেছিল বাংলা কবিতা। নতুন কবিদের জন্য মধুসূদন ছিলেন এক বিরাট বাধা। মধুসূদনকে অনুসরণ করতে গিয়ে প্রভাবের চোরাবালিতে ডুবে মরেছেন অনেক অনেক কবি। ব্যতিক্রমী ছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তী। রবীন্দ্রনাথ যাঁর খাঁটি ঐতিহাসিক ও নন্দনতাত্ত্বিক মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন। 

বাংলা সাহিত্যের বাজারে তত দিনে এসে গেছেন শেক্‌সপিয়ার, মিলটন, শেলি, কিটস, বায়রন। বিহারীলালের মতো করেই রবীন্দ্রনাথ বেছে নিলেন গীতিকবিতার পথ। বিরহী রাধার নূপুরধ্বনির মতো তাঁর কবিতায় শোনা গেল বৈষ্ণব কবিতার মৃদুমন্দ স্বর। ব্রজেন্দ্রনাথ শীলকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘বৈষ্ণব সাহিত্য ও উপনিষদ বিমিশ্রিত হইয়া আমার মনের হাওয়া তৈরি করিয়াছে।’ আর সেই হাওয়াতেই রচিত হলো গীতবিতানের কতশত গান।

ছোটগল্প নামক সাহিত্য আঙ্গিকটিকে নানা ভঙ্গিতে বিস্তৃত করেছেন তিনি। তাঁর হাতেই পাচ্ছি ‘ঘাটের কথা’, ‘রাজপথের কথা’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘গুপ্তধন’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘নষ্টনীড়ে’র মতো বিচিত্র ভঙ্গি ও স্বাদের গল্প; প্রয়োজন মাফিক তিনি বদলে নিয়েছেন কথকের রীতিগত অবস্থান, বেড়ে গিয়েছে গল্পের আকার ও প্রকার; আমাদের মনে পড়বে ‘রবিবার’ কিংবা ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পের কথা। গল্প লেখার হুলুস্থুল কাণ্ডকে নিজেই ব্যঙ্গ করে বলেছেন, ‘উল্কাবৃষ্টি’।

বঙ্কিমচন্দ্র-শাসিত কথকতায় রবীন্দ্রনাথ বের করে আনতে চাইলেন ‘আঁতের কথা’; ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের সূচনায় জানান দিয়েছেন, নতুন এই উপন্যাস শুধু তাঁর নিজের জন্য নয়, সেকালের বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেই এক ‘আকস্মিক’ ঘটনা। আরও বললেন, ‘এবারকার গল্প বানাতে হবে এ যুগের কারখানা ঘরে।’ কিন্তু কী আছে সেই ঘরে? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মনের সংসারের সেই কারখানা-ঘরে যেখানে আগুনের জ্বলুনি হাতুড়ির পিটুনি থেকে দৃঢ় ধাতুর মূর্তি জেগে উঠতে থাকে।’ আর তারপর? তিনি লিখলেন, ‘যেন পশুশালার দরজা খুলে দেওয়া হল, বেরিয়ে পড়ল হিংস্র ঘটনাগুলো অসংযত হয়ে।’ যার সঙ্গে মিশে আছে মানুষের ঈর্ষা, রিপু। রবীন্দ্রনাথ চিনতে চাইলেন মানুষের অন্ধ কুঠুরি। কারণ, ‘সাহিত্যের নবপর্যায়ের পদ্ধতি হচ্ছে ঘটনাপরম্পরার বিবরণ দেওয়া নয়, বিশ্লেষণ করে তাদের আঁতের কথা বের করে দেখানো।’ ‘চোখের বালি’তে এই পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটালেন তিনি; আবার এ-ও বলতে ভুললেন না যে গল্প লেখার দিনগুলোতেই চলছিল তাঁর প্রস্তুতি।

রবিঠাকুর সম্পর্কে সাধারণ ধারণা এই যে অলৌকিক আন্তর প্রেরণায় অভিভূত হয়ে রবীন্দ্রনাথ একের পর এক সাহিত্য সৃজন করে গিয়েছেন। তাঁর ওপর ভর করেছেন ‘জীবনদেবতা’, যিনি তাঁকে দিয়ে সবকিছু লিখিয়ে নিয়েছেন। রবীন্দ্রভাষ্য মোতাবেক এ কথা সত্যের এক পিঠ মাত্র। অপর পিঠে লুকিয়ে আছে অন্য এক সত্য; যেখানে রবীন্দ্রনাথ অনবরত লিখে যাচ্ছেন ফরমাশের চাপে; সৃষ্টিশীল আবেগের চেয়েও মনের ওপর জোরালোভাবে চেপে বসেছে নিরীক্ষার তাড়না। আসলে বলতে চাইছি, রবীন্দ্রনাথ আমাদের সেই বিরল প্রতিভা, ঋতুবদলের সঙ্গে সঙ্গে যিনি ধারণ করেছেন নতুন মুখ ও মুখশ্রী। 
 
ব্যক্তির আত্মসচেতনতা, বিরাট ব্রহ্মাণ্ডে নিজেকে শনাক্ত করতে পারার দীক্ষা মেলে রবীন্দ্রসাহিত্যে। আর কে না জানে রোমান্টিক এই আত্মসচেতনতা আধুনিকতারও উৎস। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জন্য অহমের আত্মকেন্দ্রিকতা ছিল একেবারেই না-পছন্দ ব্যাপার। তার বদলে তিনি বলেন আত্মশক্তির কথা, যা সামষ্টিকতার অংশ। সবার সঙ্গে সবাই মেলার আয়োজন হিসেবে জাতীয় সাহিত্যকে পছন্দ করলেও জাতীয়তাবাদের সমালোচনায় তিনি দাঁড়াতে গেলেন ভিন্ন পাটাতনে। অথচ বাঙালির জাতীয় চৈতন্য ও জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠার পেছনে শেষ পর্যন্ত প্রবল প্রভাব রেখেছে রবীন্দ্রসাহিত্য। অনুমান করি, আজকের যুগের কট্টর জাতীয়তাবাদী প্রকাশগুলোর বিরুদ্ধে তিনি ভিন্ন মতই প্রকাশ করতেন।

প্রতিরোধের চৈতন্য বোঝার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ হতে পারেন দারুণ এক শক্তি। তাঁর এই দিকটি নিয়ে দরকারি আলোচনার ভাগ কম বলেই মনে হয়। আমরা রবীন্দ্রনাথকে একজন নিষ্ক্রিয় রোমান্টিক হিসেবে দেখতেই অভ্যস্ত। অথচ তাঁর বিস্তৃত জীবনজুড়ে খুঁজে পাব সক্রিয় সব কর্মযজ্ঞের ইতিহাস। তাঁর মধ্যে ব্যাপকভাবে বিদ্যমান সমকালকে বোঝার তাগিদ। আপন দেশ ও বিশ্বপরিস্থিতিকে তিনি চমৎকারভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। সেই সবের ঐতিহাসিক সাক্ষ্য হয়ে আছে কালান্তর বইয়ের প্রবন্ধগুলো। আমি বিশেষভাবে বলব তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধটির কথা। এই প্রবন্ধে ঔপনিবেশিক শাসন ও সাম্রাজ্যবাদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। আশি বছরব্যাপী প্রসারিত জীবনের পটভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ যেন দাঁড়িয়ে ছিলেন আত্মসমীক্ষার সামনে। তাঁর মনে হয়েছে, তিনি এবং তাঁর দেশের ‘মনোবৃত্তির পরিণতি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে।’ গভীরতরভাবে বাসা বেঁধেছে বিচ্ছিন্নতা। 

রবীন্দ্রনাথের উপনিবেশিত মন আজ যেন বুঝতে পারল ‘সাম্রাজ্যমদমত্ততা’য় ভরা ইংরেজদের কলুষিত হৃদয়। তার আগ পর্যন্ত নব্য শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোকের সাংস্কৃতিক সূত্র মেনে রবীন্দ্রনাথও মুগ্ধ ছিলেন ‘বার্কের বাগ্মিতায়, মেকলের ভাষাপ্রবাহের তরঙ্গভঙ্গে’; সাহিত্যিক সংস্পর্শ হিসেবে অন্তরের অন্দরমহলে টোকা দিয়েছিল শেকশপিয়রের নাটক, বায়রনের কবিতা। ইংরেজের রাজনীতি সম্পর্কে উপলব্ধি ছিল ‘সর্বমানবের বিজয়ঘোষণা’। ইংল্যান্ড ছিল ‘অত্যাচারপ্রপীড়িত জাতির আশ্রয়স্থল’। স্মৃতির অন্দর হাতড়ে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘মানবমৈত্রীর বিশুদ্ধ পরিচয় দেখেছি ইংরেজ-চরিত্রে, তাই আন্তরিক শ্রদ্ধা নিয়ে ইংরেজকে হৃদয়ের উচ্চাসনে বসিয়েছিলেম।’ অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের মনে আসন পেয়েছিল ইউরোপের উদার মানবিকতাবাদ।

কিন্তু প্রৌঢ়ত্বের গোধূলিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন অন্য কথা; ‘সভ্যতা’র ধারণাটিই আজ তাঁর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি দেখতে পেলেন, ‘সভ্যতাকে যারা চরিত্র-উৎস থেকে উৎসারিতরূপে স্বীকার করেছে, রিপুর প্রবর্তনায় তারা তাকে কী অনায়াসে লঙ্ঘন করতে পারে।’ ইংরেজি সাহিত্যের ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’ ঘটল রবীন্দ্রনাথের। উন্মোচিত হলো অন্য এক দৃশ্যপট। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘নিভৃতে সাহিত্যের রস সম্ভোগের উপকরণের বেষ্টন হতে একদিন আমাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। সেদিন ভারতবর্ষের জনসাধারণের যে নিদারুণ দারিদ্র্য আমার সম্মুখে উদ্‌ঘাটিত হলো, তা হৃদয়বিদারক। অন্ন বস্ত্র পানীয় শিক্ষা আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের শরীর-মনের পক্ষে যা-কিছু অত্যাবশ্যক, তার এমন নিরতিশয় অভাব বোধ হয় পৃথিবীর আধুনিক শাসনচালিত কোনো দেশেই ঘটেনি। অথচ এই দেশ ইংরেজকে দীর্ঘকাল ধরে তার ঐশ্বর্য জুগিয়ে এসেছে। যখন সভ্যজগতের মহিমা ধ্যানে একান্ত মনে নিবিষ্ট ছিলেম, তখন কোনো দিন সভ্য নামধারী মানব-আদর্শের এত বড়ো নিষ্ঠুর বিকৃত রূপ কল্পনা করতেই পারিনি ; অবশেষে দেখছি, একদিন এই বিকারের ভেতর দিয়ে বহু কোটি জনসাধারণের প্রতি সভ্য জাতির অপরিসীম অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদাসীন্য।’

একই দেহে লীন সভ্যতা ও সাম্রাজ্যবাদের জাতিক ও আন্তর্জাতিক বিস্তার তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছে। আর তাই ভাবনার পরিসরে এসে গেছে সেকালের চীন, জাপান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, ইরান। ইউরোপ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘সমস্ত ইউরোপে বর্বরতা কী রকম নখদন্ত বিকাশ করে বিভীষিকা বিস্তার করতে উদ্যত। এই মানবপীড়নের মহামারি পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভেতর থেকে জাগ্রত হয়ে উঠে আজ মানবাত্মার অপমানে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত বাতাস কলুষিত করে দিয়েছে।’ রবীন্দ্রনাথের এই সব উক্তি ও উপলব্ধি আজও কি প্রাসঙ্গিক নয়? খানিকটা আত্মগ্লানিতে ভরা মন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আমাদের হতভাগ্য নিঃসহায় নীরন্ধ্র অকিঞ্চনতার মধ্যে আমরা কি তার কোনো আভাস পাইনি?’

আভাস নিশ্চয়ই তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ বলে যিনি জ্ঞান করেন, তার পক্ষে ‘সমালোচনাত্মক’ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা খানিকটা মুশকিলের ব্যাপার। তবে তিনি ঠিকঠাক বুঝতে পেরেছিলেন, ‘ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে এই ভারত সাম্রাজ্য ত্যাগ করে যেতে হবে।’ পরিত্যক্ত ভারতবর্ষের জন্য তারা রেখে যাবে ‘দীনতার আবর্জনা’, ‘বিস্তীর্ণ পঙ্কশয্যা’, ‘দুর্বিষহ নিষ্ফলতা’; বিশেষণে ঢাকা এসব চিত্রায়ণের পর রবীন্দ্রনাথ স্বীকারোক্তি করছেন, ‘জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম য়ুরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল।’ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য কী রেখে গেলেন? 

রবীন্দ্রনাথ দিয়ে গেলেন বিপুল সাহিত্যসম্ভার, বিকশিত বাংলা ভাষা, বহুবিধ সাংস্কৃতিক কৃত্য, জাতীয় চৈতন্য আর এক সর্বগ্রাহী মন। বাঙালির মনে অবচেতনে রেখে গেলেন স্বপ্নগ্রস্ত ‘ইউটোপিয়া’। শান্তিনিকেতন, তপোবন, আশ্রমকেন্দ্রিক প্রকল্পনা এখনো ধরা দেয় কোনো কোনো বাঙালির স্বপ্ন ও কল্পনায়। ব্রাহ্মধর্ম ও ব্রহ্মবিশ্বাসের সুতো দিয়ে বেঁধে নিয়ে এই ইউটোপিয়াকে যাঁরা পড়তে চান, তাঁরা পড়তে পারেন; তার আগে কল্পনা করে দেখুন, একজন দিগন্তবিহারী কবি মগ্ন হয়ে ভাবছেন প্রকৃতি-আশ্রিত শিক্ষা প্রসঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে যোগ করে নিচ্ছেন উৎসব ও আনন্দকে, সনাতন গ্রাম-কৃষি ও কৃষকের সম্পর্ককে দিতে চাইছেন নতুন এক বন্দোবস্ত, প্রকৃতি ও মানুষের চিরায়ত সম্বন্ধকে বুঝতে চাইছেন দার্শনিক ও প্রায়োগিকভাবে। একালে এই সব ভাবনা কি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে? রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার বিপরীতে হাল আমলের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বঙ্গদেশে এত হাহাকার কেন? প্রকৃতি কিংবা ছয় ঋতু ‘গেল গেল’, ‘নেই নেই’ বলে এত কোলাহল কেন? অসহিষ্ণু মন নিয়ে কেন এত মাথাব্যথা আমাদের? 

সত্যি বলতে কি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির জন্য এক মহাবয়ান। ‘উচ্চ সংস্কৃতি’র অভিযোগে মামলা দায়ের করে এই বয়ানের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা যায়; একে ভাঙা যায়, হ্যাঁচকা টানও দেওয়া যায়, কিন্তু উপড়ে ফেলা যায় না। যদি তা-ই হতো, রুশ বিপ্লবের পর একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়তেন লিয়েফ তলস্তয়। উল্টো ভ্লাদিমির লেনিন তাঁকে বললেন রুশ বিপ্লবের দর্পণ। এই ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতীককে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নবায়নও করে নিতে হয়। যেমন শেক্‌সপিয়র নবায়িত হন ভিন্ন দেশের ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষার ভেতর দিয়ে, যেমন বহু ভাষায় নবায়িত হয়েছেন হোমার। আমরা কি প্রস্তুত রবীন্দ্রনাথকে ‘নতুন করে পাবো বলে’? নাকি তাঁকে আটকে রাখব প্রাতিষ্ঠানিক খোঁয়াড়ে? তাঁর সাহিত্য ও সৃষ্টিশীলতাকে কতখানি ভাঙব, কতখানি গড়ব, প্যারোডি আর ক্যারিকেচারের ঠোঙায় কতখানি মোড়াব তাঁর লেখাকে—সেটুকু কাণ্ডজ্ঞান কি আমাদের হয়েছে? নাকি জ্ঞানকাণ্ডের বোঝার ভারে মূলসহ নিজেরাই উপড়ে পড়ছি লন্ডভণ্ড কাণ্ডকারখানায়?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

তৌহিদুল হকের গুচ্ছ কবিতা

তৌহিদুল হক
তৌহিদুল হকের গুচ্ছ কবিতা

রক্ত লাল

আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে

গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায়

ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের

জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।

যা স্বভাববিদ্ধ, তবে কতটা উপকারী বা বাঁচিয়ে

রাখার নিরলস অভিপ্রায়। মানুষের তরে

প্রাণীর অফুরন্ত প্রাচুর্য বিস্তৃতকরণে, কিংবা

উদ্ভিদের অন্তিম প্রেমে বসন্তের অভিষেকে।

কতটা জ্বলতে হয় পরের জন্য, কতটা ফুটন্ত

শরীর নিয়ে চালিয়ে যায় সেবার পরিধি।

এক চিরন্তন শিক্ষা, আবার উদিত হয়

দিনের শুরুতে, বিদায় প্রান্তিক অপূর্ব

মায়ায়-দিনের শেষ প্রান্তে।

এতটুকু কার্পণ্য রেখে যায়নি, হয়তো মুখ

ফিরিয়ে নিবে না কোনো দিন। তবে ভাবনার

অন্তিমে শেষ দৃশ্যের সংলাপে ভেসে

ওঠে জনদরদি রাজার মুখ। যেখানে রক্ত ঝরে

বন্যার বেগে সেখানেও প্রতিদিন ফুল ফোটে ফুল হয়ে।

যত দেখি

যত দেখি তৃপ্ত হই, শীতল হয়ে

জড়িয়ে পড়ি তোমার সমস্ত শরীরে। এক অজানা

শিহরণ ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের সমস্ত পৃষ্ঠা জুড়ে।

যেন দীর্ঘদিনের শুষ্কতা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে।

হারিয়ে যাওয়া রস ফিরছে মূলে, নিয়ে যাচ্ছে আদিপর্বে।

যেমন নেয় নদীর কূল, জোয়ারের ফেনা।

ভাবনার অতলে অদ্ভুত মায়া, দীর্ঘক্ষণ মোহগ্রস্ত

করে রাখে চোখের পলক, তাকিয়ে থাকি মায়ার মায়ায়। কী অপরূপ মায়া!

সেখানেও দেখি তৃষ্ণার ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষারত কান্না।

জীবনের তল্লাটে হারিয়ে খুঁজি আজ

আমারও জীবন ছিল। মায়ায় ভরা নির্বিঘ্ন আয়োজন, কলমিলতার মতো নিষ্পাপ।

তৃপ্ত হই ঘাসে, বাতাসের বেহায়া আঘাতে

অভিমানের মোড়ক ছুড়ে ফেলে হাতে তুলে নেই

কচু পাতায় টলোমলো জলের লজ্জা। এ জীবনের চাহিদা তোমায় দেখার

প্রয়োজনে তপ্ত, হয় উত্তপ্ত অথবা সহ্যের অতীত শীতল।

এ যেন কেমন

গহিন অরণ্যে সবুজ পাতার মতো, মগজে

চিন্তার রাজ্যে ভাবের উদয়, আকুল বিন্যাসে

একটু একটু করে এগিয়ে নেয়, আবার ভরা কলসির

মতো বসিয়ে রাখে-ভবের রাজ্যে। একদিন সমস্ত ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে

এদিক-ওদিক চলন, জীবন্ত মরণ! মানুষ

কেন বাঁচে, কীভাবে বাঁচে-প্রশ্নের সমাধা

আজ তর্কপ্রিয় সন্ধানে, মূর্ত প্রার্থনা।

সকল প্রিয়জন পরিত্যাগে, নিগূঢ় যত্নে হৃদয়ে প্রবেশ করে

নিজের অপরিচিত চেহারা, সব জিজ্ঞাসার

অন্ত-ক্রিয়ার এক উচ্চতম বিলাস।

জীবনের মানে অর্থশুন্য ভবিতব্য! এ কী হয়?

চোখের পলকে নিষ্পাপ দৃশ্যলোক-পেছন ডাকে বারবার

যেখানে থাকে আবার দেখার ইচ্ছা, নামে যে মুক্তকরণ। মিলনকান্তির আবাস।

চতুর্মুখ সমীকরণে খেলে যায় সময়ের ঝাঁজালো সিদ্ধান্ত। কেউ কী অপ্রিয় হয় কারও?

যেখানে ভেসে ওঠে নীলপদ্ম, অতীতের নিটোল কিতাব। সে-তো মানুষের ছবি!

চলে আসুন সবজি বাজারে

মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি অনেক কিছু

যা মানুষের নয়। অ-মানুষের জন্ম-উত্তর বাঁচার

উপায় হতে পারে। পোশাকে সজ্জিত দেহ কতভাবে

হিংস্র হয়, গোপনে, অন্ধের গহনে।

প্রবেশের আগেই পেয়েছি সংকেত। কত নোংরা, পচা, আবর্জনায় ভরা একটি থালার মতো

পড়ে আছে সম্মুখে। কেউ কি দেখেছে?

হয়তো মেনে নিয়েছে সবাই, সবার আগে সে

যে ভেবেছে, কী বা আছে উপায়!

চারপাশে কত কিছুর ঘ্রাণ, চোখ যা বলে তা কি মেনে নেয় স্বাস্থ্যবার্তা

ফুটে আছে ফুলের মতো দোকানের পসরা। খেতে বা কেনায় বারণ বালাই নেই।

যা পাচ্ছে নিচ্ছে, অনেকে। কেউ গায়ে কেউ পেটে।

আহা! দেখার কেউ নেই!

এক অন্ধকারে হাঁটছে আমাদের পা।

কেউ কি আছে কোথাও, আলো নিয়ে হাতে? ভেবেছে কি কেউ

কেন আমাদের আয়োজনে সবাই নেই?

কেউ এসে শুধু একবার বলুক, এই নিন-আপনাদের জীবন টিকিট যা উত্তরণ।

চলে আসুন সবজির বাজারে, সবুজের খোঁজে।

ইতিহাস

আজ স্পষ্ট ঘোষণা, আমার চোখের সামনে কেউ নেই

নেই কেউ ভাবের অন্তিম ঘরে। এক অস্পৃশ্য অনুভব

ছুঁয়ে চলে, ভাসিয়ে দেয় অগণিত স্রোতের তুমুল আলিঙ্গনে।

আজ কিছু ভেবে বলছি না, সরাসরি জবাব---

আমি নই কারও!

সব বাতাসের সাথে মিশে থাকা চোখের প্রেম

ভাবনার বিলাসে জড়িয়ে পড়ার বাসনা----সকলের অগোচরে

অথবা সকলের মাঝে। জীবনের অর্থে হৃদয়ের গুড়গুড় আলাপ

ঘুটঘুটে অন্ধকারে হৃদয়ে খোলা আকাশ, শুধু

এক মুখচ্ছবি।

আজ কোনো ক্ষমা নেই---নিজের প্রতি! নিজের পাপে

হাঁটি আমি, সবার মাঝে একলা হয়ে। বেদনার

কালো রং নিয়ে। শুধু দেখে যাই, শুধু দেখতে যাই।

কত রং বিরাজ করে ভাবনার গরমিলে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রই।

দাঁড়িয়ে থেকেও হেঁটে যাই!

আজকের না বলা কথা, কোনো দিন বলা হবে না

হবে না দাঁড়িয়ে আবার ভাবা আর একটু বসলে

ভালো হতো। যে বসিয়ে রাখে যে আশায় বসে থাকে

সবকিছুর-ই সময় থাকে---

এরপর---ইতিহাস!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিদায় নেওয়া হুমায়ূন এখনো আছেন

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৮: ৪২
হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’ জবাবে ফারুক বললেন, ‘কী আশ্চর্য ভাই?’ হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘এই যে প্রকৃতি, জোছনা, বৃষ্টি, নদী— কী সুন্দর! একদিন হয়তো আমি এসব আর দেখতে পারব না। একুশের বইমেলা হবে। লোকেদের ভিড়, আড্ডা; আমি সেখানে থাকব না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! হায় রে জীবন!’

‘আমার না বলা কথা’ বইয়ে ফারুক আহমেদ এই স্মৃতিচারণ করেছেন। লিখেছেন, ‘আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। একসময় তাকিয়ে দেখলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের দুচোখের কোনায় পানি।’

হুমায়ূন আহমেদ নেই। তবে তিনি রয়েছেন দেশের তরুণদের মনে। যে বইমেলায় তিনি থাকবেন না বলে আক্ষেপ, সেই বইমেলায় তাঁর বইয়ের স্টলে তরুণদের ঢলের মধ্যে আছেন।

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম এই দিনে (১৩ নভেম্বর); ভারত ভাগের এক বছর পরে ১৯৪৮ সালে। ছোট সময়ে তাঁর নাম ছিল শামসুর রহমান। তাঁর বাবা ছেলেমেয়েদের নাম পাল্টে ফেলতেন। তাঁর নাম পাল্টে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। শুধু কথাসাহিত্যেই নয়; ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’,

‘আজ রবিবার’-এর মতো নাটক বানিয়েছেন, তৈরি করেছেন ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’র মতো চলচ্চিত্র।

হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি, জোছনা ভালোবাসতেন। তাঁর লেখায় সেসব উঠে এসেছে বারবার। ২০১২ সালের জুলাইয়ে বর্ষাতেই তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ওপারে।

তিনি নেই। কিন্তু তাঁর লেখায় উঠে আসা চান্নিপসর, বৃষ্টি বিলাস আজও আছে তরুণদের মনে। ফারুক আহমেদ তাঁর ওই বইয়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে—‘এক বিকেলে শুটিং শেষে তাঁর প্রিয় লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে আছেন হুমায়ূন। সেখানে ঝুলছে পাকা লিচু। তিনি তাঁর কেয়ারটেকার মুশাররফকে ডেকে গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে এলেন। তাদের বললেন, গাছে উঠে যে যত পারে লিচু খেতে। বাচ্চারা কেউ গাছে উঠে লিচু খাচ্ছে, হইচই করছে। কেউ পকেটে ভরছে। হুমায়ূন আহমেদ অবাক হয়ে সেই লিচু খাওয়া দেখতে লাগলেন।’

ফারুক আহমেদ লিখেছেন, ‘হুমায়ূন ভাই একসময় আমাকে বললেন, এমন সুন্দর দৃশ্য তুমি কখনো দেখেছো? এমন ভালো লাগার অনুভূতি কি অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায়? আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, না ভাই এমন ভালো লাগার অনুভূতি কোনোভাবেই পাওয়া যায় না।’

হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ঘিরে রাজধানীসহ জন্মস্থান নেত্রকোনাতে রয়েছে নানা আয়োজন। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের কুতুবপুরে হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে। সকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোরআন খতম করবেন। এরপর শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ প্রাঙ্গণ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী এবং হুমায়ূনভক্তদের আনন্দ শোভাযাত্রা বের হবে। পরে লেখকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জন্মদিনের কেক কাটা, বৃক্ষরোপণ, কুইজ, হুমায়ূন আহমেদের রচিত নাটক ও সিনেমার অংশবিশেষ নিয়ে অভিনয়, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া রাজধানীতে হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র নিয়ে চলচ্চিত্র সপ্তাহ, হুমায়ূন প্রতিযোগিতা, হুমায়ূন জন্মোৎসব, টেলিভিশন চ্যানেলে নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচারসহ নানা আয়োজনে মুখর থাকছে দিনটি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘হীরক রাজার দেশে’ মঞ্চস্থ করল স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।

মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্‌যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।

হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।

নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।

শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

গবেষণায় বেরিয়ে এল আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’র গল্প

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।

কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’

গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।

ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’

মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’

মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত