সুমন কায়সার, ঢাকা
‘এই লোক বলেন এক কথা, করেন ঠিক আরেকটা’—মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে বাংকার বাস্টার বোমা ফেলবেন কি না, তা নিয়ে যখন ব্যাপক গুঞ্জন; তখনই এ মন্তব্য করেন এক রাজনৈতিক ভাষ্যকার। ট্রাম্পের কাজকর্মের ধরন সম্পর্কে তাঁর এ কথায় একমত লোকের অভাব হবে না, তা ভরসা নিয়েই বলা যায়। আর জনমনের সেই ধারণা সত্যি প্রমাণ করেই যেন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বিধ্বংসী হামলা করে বসেছেন ট্রাম্প।
সংলাপ-সমঝোতার জন্য দুই সপ্তাহ সময় দিয়ে ট্রাম্প বোমারু বিমান পাঠালেন দুই দিনের মধ্যেই। ভয়ালদর্শন মার্কিন বিমান ততোধিক ভয়াবহ ৩০ হাজার পাউন্ডের ১৪টি বোমা ফেলল এক ফোরদোতেই। নাতাঞ্জ আর ইস্পাহানের কেন্দ্র ধ্বংসে বরাদ্দ ছিল ৩০টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। যুক্তরাষ্ট্রের ‘মিডনাইট হ্যামার’ নামের এই আচানক হামলা কেবল তিন ইরানি পারমাণবিক কেন্দ্রকেই আঘাত করেনি, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সংঘাত ছড়িয়ে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে তা। বলা হচ্ছে, খোদ যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাঝুঁকি বাড়িয়ে দিল এ ঘটনা।
রোববার ভোরের মার্কিন হামলা ইরান-ইসরায়েল সংঘাতকে আরও তীব্র করে তুলে সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা হুট করেই অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। বলা হচ্ছে, গত কয়দিনের যুদ্ধের গতিধারাই বদলে দিয়েছে এ ঘটনা। মধ্যপ্রাচ্যকে আরেক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের চক্করেও তা ফেলে দিতে পারে। ‘যুক্তরাষ্ট্র আর অন্যের যুদ্ধে জড়াচ্ছে না’, ‘সবার আগে আমেরিকার স্বার্থ’—এসব বোলচাল দিয়ে ৭ কোটি ৭০ লাখ নাগরিকের ভোটে ক্ষমতায় আসা ট্রাম্প হয়তো আরেকবার তাঁর নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হতে চলেছেন। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর ওয়াদার বরখেলাপের তালিকা এরই মধ্যে দীর্ঘ।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত এখন কোন দিকে রূপ নেবে, তা অনেকটাই নির্ভর করছে ইরান ও তার মিত্রদের প্রতিক্রিয়ার ওপর। মার্কিন হামলার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইরান বলেছে, এর ‘প্রতিক্রিয়া হবে চিরস্থায়ী’। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা গত সপ্তাহেই বলে দিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র এ সংঘাতে যোগ দিলে তার ‘নিঃসন্দেহে অপূরণীয় ক্ষতি হবে’। হামলার ঘটনার পর পর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি উত্তেজনা কমাতে কূটনীতির পক্ষে কথা বললেও জানিয়ে দিয়েছেন, মার্কিন হামলার সামরিক জবাব অনিবার্য। গতকাল সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমার দেশের ওপর হামলা হয়েছে। আমাদের অবশ্যই এর জবাব দিতে হবে...।’
যুক্তরাষ্ট্রকে আগেই সাবধান করে দিয়েছে ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা। শনিবারই তারা বলেছিল, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষে এ সংঘাতে যোগ দিলে লোহিতসাগর দিয়ে যাওয়া মার্কিন জাহাজগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হবে।
ইরান এখন ঠিক কী করবে, তা তাৎক্ষণিকভাবে জোর দিয়ে বলা মুশকিল। দেশটির অবশিষ্ট সামরিক কমান্ডার, আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিসহ শীর্ষ নেতারা নিশ্চয় এ নিয়েই ব্যতিব্যস্ত এখন। উত্তেজনা এখন চরমে। কোনো পক্ষেরই পিছু হটার উপায় নেই; বিশেষ করে মার্কিন হস্তক্ষেপের পরিণতি নিয়ে এত জোর গলায় কথা বলার পর হাত গুটিয়ে বসে থাকা ইরানের নেতৃত্বের জন্য রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক হবে। ইসরায়েলের একতরফা হামলার পর দেশজুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয় সংহতিও তাদের সাহস জোগাবে। দীর্ঘদিনের অবরোধের কারণে সামরিক ক্ষমতায় নাজুক অবস্থায় থাকা ইরান যেভাবে বলদর্পী অত্যাধুনিক অস্ত্রধারী ইসরায়েলের হামলার জবাব দিয়ে যাচ্ছে, তা জাতি হিসেবে তাদের সংগ্রামী ঐতিহ্য ও অনমনীয়তারই প্রমাণ। কিন্তু বিশ্বের এক নম্বর সামরিক শক্তির সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়ানো আলাদা কথা। সে জন্য ধরে নেওয়া যায়, মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে ইরানের জবাব খুব সম্ভবত হবে সীমিত পর্যায়ের। সংগত কারণেই হতাহত বেশি না হওয়া বা উত্তেজনা বেশি বাড়িয়ে না দেওয়ার দিকে সতর্ক নজর থাকবে তাদের। প্রসঙ্গত, অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যে কয়েকটি সম্ভাব্য চিত্রের কথা বিশ্লেষকেরা বলাবলি করছেন, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে আরও ভয়ংকর মার্কিন হামলা এড়াতে প্রতিশোধমূলক কিছুই না করা, সর্বশক্তি দিয়ে মার্কিন স্বার্থে হামলা চালানো অথবা আপাতত মুখ বুজে থেকে পরে সুবিধামতো হামলা করা।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি ৫০টির মতো। এগুলোতে অস্ত্র-সরঞ্জাম ছাড়াও ৪০ হাজারের বেশি সেনা আছে বলে ধারণা করা হয়। শুধু দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নয়, ড্রোনসহ অন্যান্য কিছু অস্ত্রের পাল্লায়ও তা পড়ে। কাতারের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মেহরান কামরাভাকে আল জাজিরা টিভিতে বলতে দেখা যায়, ‘একজন ইরানি কমান্ডার একদা তাঁকে বলেছিলেন, তার মানে হচ্ছে, এই ৪০ হাজারই আমাদের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।’
পারস্য উপসাগরের অদূরে আছে মার্কিন সামরিক-বেসামরিক জাহাজ। সেখানে হামলা হলে প্রভাব পড়বে নৌবাণিজ্যের ওপরও। বিশ্বের ২০ শতাংশ জ্বালানি তেল পরিবহনের নৌপথ হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার হুমকি ইরানে আগেই দিয়ে রেখেছে। ইরানি বাহিনী নিজেরা ছাড়াও ইরাক, সিরিয়া, লেবাননে থাকা তাদের সমর্থকগোষ্ঠীগুলো নিজ দায়িত্বে প্রতিশোধের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। তারা তেহরানের নির্দেশনার অপেক্ষায় বসে না-ও থাকতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য অধ্যয়ন বিভাগের পরিচালক স্টিফেন জিউনেস বলেছেন, ইরানিরা ওপরের কোনো না কোনো লক্ষ্যে হামলা না করলেই তিনি বিস্মিত হবেন।
সংঘাতের ওপর তাৎক্ষণিক প্রভাব
মার্কিন হামলার পর ইসরায়েলে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ এবং ক্ষয়ক্ষতির খবর থেকে সম্ভবত ইরানের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার একটা আভাস পাওয়া যায়। তেল আবিব ও হাইফায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছে বেশ কয়েকজন ইসরায়েলি। ঠিক মার্কিন হামলার প্রতিশোধ হিসেবেই হামলার মাত্রা বাড়ানো হয়েছে, নাকি তা চলমান অভিযানেরই ধারাবাহিকতা, সেটা হয়তো এখনই বলা যাবে না। তবে আইআরজিসি বাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, ইসরায়েলে ইরানের ২০তম ক্ষেপণাস্ত্র হামলা মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে শুরু হয়েছে। আর প্রতিশোধমূলক হামলায় সবচেয়ে উন্নত ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর একটি খাইবার শেকান মোতায়েন করা হয়েছে। ইরানি হামলার তীব্রতায় গতকালই অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ফ্লাইট স্থগিত ঘোষণা করেছে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় তিন বিমান সংস্থা। যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিশেষ মিত্র’ যুক্তরাজ্য যে ইসরায়েল ও অধিকৃত পশ্চিম তীর থেকে নিজের আগ্রহী নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিচ্ছে, তা-ও হয়তো কাকতালীয় বিষয় নয়।
পরমাণু কর্মসূচির কী হবে
ইরান এরই মধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাবে। উদ্দেশ্য—শান্তিপূর্ণ বেসামরিক কার্যক্রম বা বোমা তৈরি করা—যেটাই হোক, তারা এখন হয়তো আরও গোপনে আরও সুরক্ষিতভাবে কর্মসূচি চালাবে। তিনটি বড় পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলার অর্থ (তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিশ্চিত নয়) এই নয় যে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির মৃত্যু ঘটেছে। প্রযুক্তিটা যেমন তাদের বিজ্ঞানীদের মাথায় রয়ে গেছে, ইউরেনিয়ামসহ যন্ত্র-উপকরণগুলোও হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে না। ইরানি কর্মকর্তারা এরই মধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, মার্কিন হামলার আগেই কিছু স্পর্শকাতর সরঞ্জাম কেন্দ্রগুলো থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। স্যাটেলাইট চিত্র সরবরাহকারী কোম্পানি ম্যাক্সার ১৯ ও ২০ জুন ফোরদো পারমাণবিক কেন্দ্রের আশপাশে অস্বাভাবিক যানবাহন চলাচল চিহ্নিত করার কথা বলেছে, তা এই বক্তব্যকে কিছুটা হলেও বিশ্বাসযোগ্যতা দেয়।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি যে যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলসহ তার মিত্রদের জন্য তাৎক্ষণিক বিপদ ছিল না, এ ব্যাপারে অনেকে একমত। মার্কিন গোয়েন্দারাই বলেছিল, ইরান বোমা তৈরির খুব কাছে নেই। তবে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড দৃশ্যত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চাপেই অতি সম্প্রতি মত কিছুটা বদলে বলেন, ইরান চাইলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বোমা তৈরিতে সক্ষম।
যুগপৎ ইসরায়েলি ও মার্কিন হামলার শিকার হয়ে এখন ইরান মনে করতে পারে, ‘বোমাতেই উদ্ধার!’ নতুন উৎসাহে পরমাণু কর্মসূচি শুরু করতে পারে তারা। মার্কিন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্র্যাফটের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ট্রিটা পারসিও এমনটাই মনে করেন। তাঁর মতে, ইরানের সবচেয়ে মূল্যবান পারমাণবিক সম্পদ হলো তাদের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত। যে পর্যন্ত তাদের কাছে তা থাকবে, সে পর্যন্ত বলা যাবে তাদের পরমাণু কর্মসূচি বহাল রয়েছে, যা এখনো অস্ত্রে পরিণত হতে পারে। ট্রিটা পারসি মনে করেন, প্রমাণ ছাড়া ইরানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হামলা বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক অস্ত্রহীন অনেক রাষ্ট্রকেই শঙ্কিত করবে। এই পরিস্থিতিতে ইরান আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশে পরিণত হবে। পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) থেকে বেরিয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়। মার্কিন হামলার প্রতিক্রিয়ায় একজন পার্লামেন্টারি নেতা এমন কথাও মুখ ফুটে বলেছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি গতকাল রোববারই মস্কো সফরে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। পুরোনো মিত্র রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আজ সোমবার বৈঠক হবে তাঁর। ইরানের সঙ্গে কয়েক মাস আগে কৌশলগত চুক্তি করা রাশিয়ার সর্বেসর্বা পুতিন এ পর্যন্ত চলতি সংঘাতে মধ্যস্থতা করার আগ্রহ ব্যক্ত করা ছাড়া প্রকাশ্য ভূমিকা রাখেননি। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার পর এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়টিও মাথায় রাখার মতো বিষয়। আব্বাস আরাঘচি মস্কো থেকে কী বার্তা নিয়ে ফেরেন, তা ইরানের পরবর্তী করণীয়র ওপর নিশ্চিতভাবেই প্রভাব ফেলবে।
‘এই লোক বলেন এক কথা, করেন ঠিক আরেকটা’—মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে বাংকার বাস্টার বোমা ফেলবেন কি না, তা নিয়ে যখন ব্যাপক গুঞ্জন; তখনই এ মন্তব্য করেন এক রাজনৈতিক ভাষ্যকার। ট্রাম্পের কাজকর্মের ধরন সম্পর্কে তাঁর এ কথায় একমত লোকের অভাব হবে না, তা ভরসা নিয়েই বলা যায়। আর জনমনের সেই ধারণা সত্যি প্রমাণ করেই যেন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বিধ্বংসী হামলা করে বসেছেন ট্রাম্প।
সংলাপ-সমঝোতার জন্য দুই সপ্তাহ সময় দিয়ে ট্রাম্প বোমারু বিমান পাঠালেন দুই দিনের মধ্যেই। ভয়ালদর্শন মার্কিন বিমান ততোধিক ভয়াবহ ৩০ হাজার পাউন্ডের ১৪টি বোমা ফেলল এক ফোরদোতেই। নাতাঞ্জ আর ইস্পাহানের কেন্দ্র ধ্বংসে বরাদ্দ ছিল ৩০টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। যুক্তরাষ্ট্রের ‘মিডনাইট হ্যামার’ নামের এই আচানক হামলা কেবল তিন ইরানি পারমাণবিক কেন্দ্রকেই আঘাত করেনি, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সংঘাত ছড়িয়ে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে তা। বলা হচ্ছে, খোদ যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাঝুঁকি বাড়িয়ে দিল এ ঘটনা।
রোববার ভোরের মার্কিন হামলা ইরান-ইসরায়েল সংঘাতকে আরও তীব্র করে তুলে সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা হুট করেই অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। বলা হচ্ছে, গত কয়দিনের যুদ্ধের গতিধারাই বদলে দিয়েছে এ ঘটনা। মধ্যপ্রাচ্যকে আরেক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের চক্করেও তা ফেলে দিতে পারে। ‘যুক্তরাষ্ট্র আর অন্যের যুদ্ধে জড়াচ্ছে না’, ‘সবার আগে আমেরিকার স্বার্থ’—এসব বোলচাল দিয়ে ৭ কোটি ৭০ লাখ নাগরিকের ভোটে ক্ষমতায় আসা ট্রাম্প হয়তো আরেকবার তাঁর নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হতে চলেছেন। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর ওয়াদার বরখেলাপের তালিকা এরই মধ্যে দীর্ঘ।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত এখন কোন দিকে রূপ নেবে, তা অনেকটাই নির্ভর করছে ইরান ও তার মিত্রদের প্রতিক্রিয়ার ওপর। মার্কিন হামলার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইরান বলেছে, এর ‘প্রতিক্রিয়া হবে চিরস্থায়ী’। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা গত সপ্তাহেই বলে দিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র এ সংঘাতে যোগ দিলে তার ‘নিঃসন্দেহে অপূরণীয় ক্ষতি হবে’। হামলার ঘটনার পর পর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি উত্তেজনা কমাতে কূটনীতির পক্ষে কথা বললেও জানিয়ে দিয়েছেন, মার্কিন হামলার সামরিক জবাব অনিবার্য। গতকাল সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমার দেশের ওপর হামলা হয়েছে। আমাদের অবশ্যই এর জবাব দিতে হবে...।’
যুক্তরাষ্ট্রকে আগেই সাবধান করে দিয়েছে ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা। শনিবারই তারা বলেছিল, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষে এ সংঘাতে যোগ দিলে লোহিতসাগর দিয়ে যাওয়া মার্কিন জাহাজগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হবে।
ইরান এখন ঠিক কী করবে, তা তাৎক্ষণিকভাবে জোর দিয়ে বলা মুশকিল। দেশটির অবশিষ্ট সামরিক কমান্ডার, আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিসহ শীর্ষ নেতারা নিশ্চয় এ নিয়েই ব্যতিব্যস্ত এখন। উত্তেজনা এখন চরমে। কোনো পক্ষেরই পিছু হটার উপায় নেই; বিশেষ করে মার্কিন হস্তক্ষেপের পরিণতি নিয়ে এত জোর গলায় কথা বলার পর হাত গুটিয়ে বসে থাকা ইরানের নেতৃত্বের জন্য রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক হবে। ইসরায়েলের একতরফা হামলার পর দেশজুড়ে গড়ে ওঠা জাতীয় সংহতিও তাদের সাহস জোগাবে। দীর্ঘদিনের অবরোধের কারণে সামরিক ক্ষমতায় নাজুক অবস্থায় থাকা ইরান যেভাবে বলদর্পী অত্যাধুনিক অস্ত্রধারী ইসরায়েলের হামলার জবাব দিয়ে যাচ্ছে, তা জাতি হিসেবে তাদের সংগ্রামী ঐতিহ্য ও অনমনীয়তারই প্রমাণ। কিন্তু বিশ্বের এক নম্বর সামরিক শক্তির সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়ানো আলাদা কথা। সে জন্য ধরে নেওয়া যায়, মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে ইরানের জবাব খুব সম্ভবত হবে সীমিত পর্যায়ের। সংগত কারণেই হতাহত বেশি না হওয়া বা উত্তেজনা বেশি বাড়িয়ে না দেওয়ার দিকে সতর্ক নজর থাকবে তাদের। প্রসঙ্গত, অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যে কয়েকটি সম্ভাব্য চিত্রের কথা বিশ্লেষকেরা বলাবলি করছেন, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে আরও ভয়ংকর মার্কিন হামলা এড়াতে প্রতিশোধমূলক কিছুই না করা, সর্বশক্তি দিয়ে মার্কিন স্বার্থে হামলা চালানো অথবা আপাতত মুখ বুজে থেকে পরে সুবিধামতো হামলা করা।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি ৫০টির মতো। এগুলোতে অস্ত্র-সরঞ্জাম ছাড়াও ৪০ হাজারের বেশি সেনা আছে বলে ধারণা করা হয়। শুধু দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নয়, ড্রোনসহ অন্যান্য কিছু অস্ত্রের পাল্লায়ও তা পড়ে। কাতারের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মেহরান কামরাভাকে আল জাজিরা টিভিতে বলতে দেখা যায়, ‘একজন ইরানি কমান্ডার একদা তাঁকে বলেছিলেন, তার মানে হচ্ছে, এই ৪০ হাজারই আমাদের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।’
পারস্য উপসাগরের অদূরে আছে মার্কিন সামরিক-বেসামরিক জাহাজ। সেখানে হামলা হলে প্রভাব পড়বে নৌবাণিজ্যের ওপরও। বিশ্বের ২০ শতাংশ জ্বালানি তেল পরিবহনের নৌপথ হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার হুমকি ইরানে আগেই দিয়ে রেখেছে। ইরানি বাহিনী নিজেরা ছাড়াও ইরাক, সিরিয়া, লেবাননে থাকা তাদের সমর্থকগোষ্ঠীগুলো নিজ দায়িত্বে প্রতিশোধের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। তারা তেহরানের নির্দেশনার অপেক্ষায় বসে না-ও থাকতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য অধ্যয়ন বিভাগের পরিচালক স্টিফেন জিউনেস বলেছেন, ইরানিরা ওপরের কোনো না কোনো লক্ষ্যে হামলা না করলেই তিনি বিস্মিত হবেন।
সংঘাতের ওপর তাৎক্ষণিক প্রভাব
মার্কিন হামলার পর ইসরায়েলে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ এবং ক্ষয়ক্ষতির খবর থেকে সম্ভবত ইরানের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার একটা আভাস পাওয়া যায়। তেল আবিব ও হাইফায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছে বেশ কয়েকজন ইসরায়েলি। ঠিক মার্কিন হামলার প্রতিশোধ হিসেবেই হামলার মাত্রা বাড়ানো হয়েছে, নাকি তা চলমান অভিযানেরই ধারাবাহিকতা, সেটা হয়তো এখনই বলা যাবে না। তবে আইআরজিসি বাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, ইসরায়েলে ইরানের ২০তম ক্ষেপণাস্ত্র হামলা মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে শুরু হয়েছে। আর প্রতিশোধমূলক হামলায় সবচেয়ে উন্নত ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর একটি খাইবার শেকান মোতায়েন করা হয়েছে। ইরানি হামলার তীব্রতায় গতকালই অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ফ্লাইট স্থগিত ঘোষণা করেছে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় তিন বিমান সংস্থা। যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিশেষ মিত্র’ যুক্তরাজ্য যে ইসরায়েল ও অধিকৃত পশ্চিম তীর থেকে নিজের আগ্রহী নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিচ্ছে, তা-ও হয়তো কাকতালীয় বিষয় নয়।
পরমাণু কর্মসূচির কী হবে
ইরান এরই মধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাবে। উদ্দেশ্য—শান্তিপূর্ণ বেসামরিক কার্যক্রম বা বোমা তৈরি করা—যেটাই হোক, তারা এখন হয়তো আরও গোপনে আরও সুরক্ষিতভাবে কর্মসূচি চালাবে। তিনটি বড় পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলার অর্থ (তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিশ্চিত নয়) এই নয় যে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির মৃত্যু ঘটেছে। প্রযুক্তিটা যেমন তাদের বিজ্ঞানীদের মাথায় রয়ে গেছে, ইউরেনিয়ামসহ যন্ত্র-উপকরণগুলোও হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে না। ইরানি কর্মকর্তারা এরই মধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, মার্কিন হামলার আগেই কিছু স্পর্শকাতর সরঞ্জাম কেন্দ্রগুলো থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। স্যাটেলাইট চিত্র সরবরাহকারী কোম্পানি ম্যাক্সার ১৯ ও ২০ জুন ফোরদো পারমাণবিক কেন্দ্রের আশপাশে অস্বাভাবিক যানবাহন চলাচল চিহ্নিত করার কথা বলেছে, তা এই বক্তব্যকে কিছুটা হলেও বিশ্বাসযোগ্যতা দেয়।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি যে যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলসহ তার মিত্রদের জন্য তাৎক্ষণিক বিপদ ছিল না, এ ব্যাপারে অনেকে একমত। মার্কিন গোয়েন্দারাই বলেছিল, ইরান বোমা তৈরির খুব কাছে নেই। তবে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড দৃশ্যত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চাপেই অতি সম্প্রতি মত কিছুটা বদলে বলেন, ইরান চাইলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বোমা তৈরিতে সক্ষম।
যুগপৎ ইসরায়েলি ও মার্কিন হামলার শিকার হয়ে এখন ইরান মনে করতে পারে, ‘বোমাতেই উদ্ধার!’ নতুন উৎসাহে পরমাণু কর্মসূচি শুরু করতে পারে তারা। মার্কিন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্র্যাফটের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ট্রিটা পারসিও এমনটাই মনে করেন। তাঁর মতে, ইরানের সবচেয়ে মূল্যবান পারমাণবিক সম্পদ হলো তাদের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত। যে পর্যন্ত তাদের কাছে তা থাকবে, সে পর্যন্ত বলা যাবে তাদের পরমাণু কর্মসূচি বহাল রয়েছে, যা এখনো অস্ত্রে পরিণত হতে পারে। ট্রিটা পারসি মনে করেন, প্রমাণ ছাড়া ইরানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হামলা বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক অস্ত্রহীন অনেক রাষ্ট্রকেই শঙ্কিত করবে। এই পরিস্থিতিতে ইরান আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশে পরিণত হবে। পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) থেকে বেরিয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়। মার্কিন হামলার প্রতিক্রিয়ায় একজন পার্লামেন্টারি নেতা এমন কথাও মুখ ফুটে বলেছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি গতকাল রোববারই মস্কো সফরে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। পুরোনো মিত্র রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আজ সোমবার বৈঠক হবে তাঁর। ইরানের সঙ্গে কয়েক মাস আগে কৌশলগত চুক্তি করা রাশিয়ার সর্বেসর্বা পুতিন এ পর্যন্ত চলতি সংঘাতে মধ্যস্থতা করার আগ্রহ ব্যক্ত করা ছাড়া প্রকাশ্য ভূমিকা রাখেননি। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার পর এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়টিও মাথায় রাখার মতো বিষয়। আব্বাস আরাঘচি মস্কো থেকে কী বার্তা নিয়ে ফেরেন, তা ইরানের পরবর্তী করণীয়র ওপর নিশ্চিতভাবেই প্রভাব ফেলবে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাতের বিমান হামলায় ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর পুরো অঞ্চলজুড়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে। ইরান পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, এই হামলার ‘চিরস্থায়ী পরিণতি’ হবে।
১৫ ঘণ্টা আগেইরানের তিনটি পারমাণবিক কেন্দ্রে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব নতুন মোড় নিয়েছে। আর এই দ্বন্দ্বে চীনের অবস্থান হয়ে উঠছে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ। বেইজিং এই সংকটে এমন এক কৌশলী অবস্থান নিয়েছে, যেখানে একদিকে ইরানের প্রতি কৌশলগত সমর্থন দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে ইসরায়েলের সঙ্গেও সম্পর্কের সেতু ধরে
১৯ ঘণ্টা আগেইরান-ইসরায়েল সংঘাত গতকাল শনিবার নবম দিনে গড়িয়েছে। এই ৯ দিনে দুপক্ষই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে, যদিও ইরানের ক্ষয়ক্ষতি ইসরায়েলের তুলনায় অনেক বেশি। অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে চলেছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়ালে ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে..
২ দিন আগেইরানের উত্তরাঞ্চলে গতকাল শুক্রবার মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের এই সময়ে ভূকম্পন ইরানের গোপন পারমাণবিক পরীক্ষা কি না, তা নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছে।
২ দিন আগে