Ajker Patrika

শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের পর নেপালে সরকার পতন: ফের অপ্রস্তুত অবস্থায় ভারত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩: ৪০
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

বিগত কয়েক বছরের মধ্যে ভারতের প্রতিবেশীদের মধ্যে তৃতীয় দেশ হিসেবে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন হয়েছে নেপালে। দেশটিতে গত সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) শুরু হওয়া জেন-জি আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে অন্তত ২৯ জন নিহত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি পদত্যাগ করেন।

মূলত নেপালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তরুণেরা এই আন্দোলন শুরু করেন। পরে তা খুব দ্রুতই সরকারের নেতাদের সন্তানদের বিলাসী ও তাঁদের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। পুলিশ গুলি চালালে আন্দোলন সহিংসতায় পরিণত হয়। তরুণেরা দেশটির পার্লামেন্ট ও রাজনৈতিক নেতাদের বাড়িতে আগুন দেন ও ভাঙচুর চালান। সরকার পতনের পর সেনাবাহিনী দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়, কারফিউ জারি করে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

অনেকে মনে করছেন, কাঠমান্ডুতে যা ঘটেছে, তা মূলত গত বছর বাংলাদেশে ও ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হলেও নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা অন্য মাত্রায়। বিশেষ করে, দুই দেশের জনগণের মধ্যে যে সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের আলোকে এটাকে আলাদা করেই দেখতে হয়।

ভারতের পাঁচ রাজ্য—উত্তরাখন্ড, উত্তর প্রদেশ, সিকিম, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে নেপালের ১ হাজার ৭৫০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। নেপালে চলমান অস্থিরতার কারণে দিল্লি সীমান্তের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এমনকি নেপালে আন্দোলন শুরু হওয়ার পরপরই গত মঙ্গলবার নরেন্দ্র মোদি প্রতিক্রিয়া জানান। এক্সে শেয়ার করা এক পোস্টে মোদি বলেন, ‘নেপালের সহিংসতার ঘটনা হৃদয়বিদারক। তরুণদের প্রাণহানিতে আমি বেদনাতুর।’

মোদি জোর দিয়ে বলেন, ‘নেপালের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।’ এ সময় তিনি নেপালিদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমার নেপালি ভাই-বোনেরা, আপনারা শান্তির পক্ষে থাকুন।’ ওই দিনই নেপাল পরিস্থিতি আলোচনা করতে এক জরুরি নিরাপত্তাবিষয়ক বৈঠকও করেন তিনি।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালের গণ-অভ্যুত্থানের মতোই এবারও হঠাৎ করে বিপাকে পড়েছে ভারত। সে সময় দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এবার নেপালের ঘটনাপ্রবাহও ভারতকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলেছে। কারণ, কে পি শর্মা অলি নয়াদিল্লি সফরে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগেই প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়লেন।

নেপালে অস্থিতিশীলতা ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ। দেশটির ভূরাজনৈতিক অবস্থান এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নেপালবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অশোক মেহতা বিবিসিকে বলেন, চীনের ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ড নেপালের ঠিক ওপারেই অবস্থিত। আর ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমিতে যাওয়ার পথ সরাসরি নেপালের ভেতর দিয়ে যায়।

এই অস্থিরতা ভারতের ভেতরে থাকা বিশাল নেপালি প্রবাসী সমাজের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। অনুমান করা হয়, প্রায় ৩৫ লাখ নেপালি ভারতে বসবাস বা কাজ করেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা এরচেয়ে আরও বেশি হতে পারে। নেপাল মূলত হিন্দু-অধ্যুষিত দেশ। সীমান্তের ওপারেও বহু পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশের নাগরিকদের ভিসা বা পাসপোর্ট ছাড়াই যাতায়াতের সুযোগ রয়েছে। ১৯৫০ সালের এক চুক্তির অধীনে নেপালিরা ভারতে অবাধে কাজ করার অধিকার পান—এমন সুবিধা দক্ষিণ এশিয়ায় কেবল নেপাল ও ভুটানের জন্য রয়েছে।

এ ছাড়া দীর্ঘদিনের বিশেষ এক চুক্তির আওতায় নেপালের প্রায় ৩২ হাজার খ্যাতনামা গোর্খা সেনা বর্তমানে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) অধ্যাপক সঙ্গীতা ঠাপলিয়াল বলেন, সীমান্ত খোলা থাকায় দুই পাশের মানুষ প্রতিদিনের জীবনে পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশা করেন। উভয় পাশে থাকা পরিবারগুলো একে অপরের সঙ্গে অবিরাম যোগাযোগ রাখে।

নেপালে হিন্দুদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান রয়েছে। এর মধ্যে হিমালয়ের ওপারের মুক্তিনাথ মন্দির বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রতিবছর হাজারো ভারতীয় হিন্দু ভক্ত এই মন্দিরে তীর্থযাত্রায় যান। অন্যদিকে কাঠমান্ডু ভারতীয় রপ্তানির ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল। বিশেষ করে, জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে। ভারত-নেপালের বার্ষিক দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বলে অনুমান করা হয়।

গতকাল বুধবার কাঠমান্ডুতে অস্থায়ী শান্তি ফিরলেও বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারতের সামনে এখন কূটনৈতিকভাবে এক সরু পথে হাঁটার চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। কারণ, নেপালে আন্দোলনরত মানুষ তিন প্রধান রাজনৈতিক দল—যারা পালাক্রমে দেশ শাসন করেছে— তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ।

তবে ভারত সব দলের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখেছে। এর মধ্যে রয়েছে অলির নেতৃত্বাধীন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিএন-ইউএমএল), শেরবাহাদুর দেউবার নেতৃত্বাধীন নেপালি কংগ্রেস এবং পুষ্পকমল দাহালের নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী–সেন্টার)।

হিমালয়ের কৌশলগত অবস্থানের কারণে নেপালে প্রভাব বিস্তারে ভারত ও চীন উভয়েই প্রতিযোগিতা করছে। ফলে দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠছে এশিয়ার দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধেই। অলির পদত্যাগের পর নেপালে কী ধরনের প্রশাসন গঠিত হবে এবং তা আন্দোলনরত জনগণের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়।

নতুন সরকার বা নেতৃত্বের রূপ এখনো স্পষ্ট নয়। তাই ভারত সতর্ক থাকবে বলে মনে করেন অধ্যাপক সঙ্গীতা ঠাপলিয়াল। তাঁর ভাষায়, তারা নেপালে আরও একটি বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতি চায় না।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে, কারণ, ভারত হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে। নেপাল ও ভারতের মধ্যেও দীর্ঘদিনের কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। এবার সেগুলো সামলাতে হবে বাড়তি সতর্কতার সঙ্গে।

২০১৯ সালে ভারত নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে, যেখানে নেপালের দাবি করা কিছু এলাকা—চীনের সীমান্তঘেঁষা পশ্চিমাঞ্চলের ভূখণ্ড—ভারতের অংশ হিসেবে দেখানো হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয় কাঠমান্ডু। এরপর নেপাল নিজস্ব মানচিত্র প্রকাশ করে, যেখানে বিতর্কিত এলাকাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

সম্প্রতি ভারত ও চীন নেপালের দাবি করা একটি সীমান্ত অঞ্চলে বাণিজ্য পুনরায় শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। গত মাসে চীন সফরে গিয়ে নেপালের নেতা অলি এ বিষয়ে আপত্তি জানান। তিনি বলেন, লিপুলেখ পাসকে বাণিজ্যপথ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন সরকারের সঙ্গে ভারতের দ্রুত যোগাযোগ বাড়ানো দরকার। একই সঙ্গে ক্ষুব্ধ নেপালি তরুণ প্রজন্মের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে হবে। অধ্যাপক ঠাপলিয়াল বলেন, নেপালের তরুণদের জন্য দেশে সুযোগ-সুবিধা সীমিত। ভারতকে বেশি সংখ্যায় ফেলোশিপ দেওয়ার কথা ভাবতে হবে। পাশাপাশি নেপালি তরুণদের জন্য আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা উচিত।

দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) বহুদিন ধরেই নিষ্ক্রিয়। ফলে প্রতিবেশী দেশগুলোর রাজনৈতিক পরিবর্তন ও অস্থিতিশীলতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ভারতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। নেপালের সংকট এমন সময়ে সামনে এল, যখন পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তলানিতে, বাংলাদেশের সঙ্গে টানাপোড়েন চলছে এবং মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে জর্জরিত।

অশোক মেহতা বলেন, ভারত তার মহাশক্তি হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় প্রতিবেশী অঞ্চলের প্রতি নজর কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—সেই লক্ষ্য পূরণে একটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল প্রতিবেশ নিশ্চিত করতেই হবে।

বিসিসি থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তৌকীর-বিপাশা বিদেশে স্থায়ী হয়েছেন যে কারণে

ফিলিস্তিনকে আজই রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেবে আরও ৬ দেশ, বিরোধিতা ইসরায়েল–যুক্তরাষ্ট্রের

ধর্ষণের শিকার শিশুর স্বজনকে মারতে উদ্যত হওয়া সেই চিকিৎসক বরখাস্ত

আশ্বিনে ৯ ঘণ্টায় ১০৫ মিলিমিটার বৃষ্টি কি স্বাভাবিক, যা বলছে আবহাওয়া অধিদপ্তর

সখীপুরে বনপ্রহরীদের ওপর হামলা: ইউপি সদস্য, বিএনপি নেতাসহ ৭ জনের নামে মামলা

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত