Ajker Patrika

একাধিপত্য হারিয়ে পশ্চিম গোলার্ধে নজর ফেরাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, নাকের ডগায় ভেনেজুয়েলা

একুশ শতকের শুরু থেকেই বৈশ্বিক রাজনীতির পট দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। এই পরিবর্তনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ক্রমেই বহু মেরু বিশ্বের ধারণা জোরালো হওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য খর্ব হওয়া। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বৈশ্বিক আধিপত্যের পাট চুকিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আপাতত ‘নিজ আঙিনা’ বলে পরিচিত পশ্চিম গোলার্ধ অর্থাৎ দুই আমেরিকা মহাদেশে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে। আর সেই চাওয়ার পথে নাকের ডগায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ভেনেজুয়েলা। ভেনেজুয়েলা উপকূলে মার্কিন রণ সাজ কেন এবং কী কারণে সেই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন নিয়ে দ্য ক্রেডলে লিখেছেন এইডেন জে. সিমার্ডোন। আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য লেখাটি অনুবাদ করেছেন পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবার ভেনেজুয়েলায় স্থল অভিযানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। ছবি: সংগৃহীত
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবার ভেনেজুয়েলায় স্থল অভিযানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলায় মার্কিন আক্রমণ আসন্ন বলেই মনে হচ্ছে। ১৯৯৪ সালের পর দেশটির উপকূলে যুক্তরাষ্ট্র এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়েছে। ভেনেজুয়েলার সঙ্গে মার্কিন শত্রুতার শুরু ২০০২ সালে, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ দায়িত্ব গ্রহণের পর। এখন প্রশ্ন হলো—ভেনেজুয়েলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এই শত্রুতা ‘কী কারণে’ এবং ‘এখনই কেন।’

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এক মেরু বিশ্ব ক্ষয়ে যাওয়ায় এবং ইউরেশিয়ার ডিটারেন্ট বা বাইরের শক্তিকে প্রতিরোধ করার সক্ষমতায় বেড়ে যাওয়ায় ওয়াশিংটনের শেষ কার্যকর প্রকল্প হলো—নিজেদের তথাকথিত ‘পেছনের আঙিনা’ কাবু করা। দেশটির নীতিনির্ধারণী মহল বুঝতে পেরেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এখন চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি মোকাবিলা করে পারবে না। বিশ্বব্যাপী মার্কিন আধিপত্য বিস্তার ব্যর্থ হলে তাই বিকল্প পরিকল্পনা হলো—অন্তত পশ্চিম গোলার্ধ নিয়ন্ত্রণে রাখা। এই কৌশলটি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে আরও দ্রুত এগিয়ে চলছে।

পশ্চিম গোলার্ধে নিজ নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় করার জন্য, ভেনেজুয়েলার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। কারণ, দেশটির আছে বিশ্বের সর্বোচ্চ তেলের মজুত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই আকাঙ্ক্ষার পথে বাধা ভেনেজুয়েলার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সরকার। অর্থনৈতিক চাপ দিয়ে সরকার পতনে ব্যর্থ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের এখন একমাত্র বিকল্প সামরিক শক্তি। কিন্তু এটি বিপরীত ফল দিতে পারে। বিশেষ করে, আঞ্চলিক মিত্ররা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যেতে পারে এবং ভেনেজুয়েলাকে সাহায্য দিতে পারে বেইজিং, মস্কো এবং তেহরান। তখন ট্রাম্পকে অন্য কোথাও পালানোর পথ খুঁজতে হবে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন যুক্তরাষ্ট্রকে অনন্য অসাধারণ বৈশ্বিক আধিপত্য এনে দিয়েছিল। শক্তির শীর্ষে থাকা অবস্থায় ওয়াশিংটন বিভিন্ন দেশে সামরিক অভিযান চালিয়েছে। কুয়েত থেকে ইরাককে বের করে দিয়েছে, যুগোস্লাভিয়া ভেঙেছে এবং হাইতির শাসন পরিবর্তন করেছে। এসবই করা হয়েছে মার্কিন আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য।

অতীতের ঘটনা থেকে আত্মবিশ্বাসী হয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ শুরু করেন পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ায় নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় করার জন্য। দ্রুত বিজয় না পাওয়ায় এবং স্থানীয় প্রতিরোধের মুখে ইরাক ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রায় দুই দশক আটকে পড়েছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের মার্কিনরা বুঝে যায়, বিশ্বের জ্বালানি ভান্ডার নিয়ন্ত্রণের স্বপ্ন ব্যর্থ হয়েছে।

একই সময়ে, চীন মার্কিন করপোরেট সিস্টেম আউটসোর্স করে তার অর্থনীতি দ্রুত শক্তিশালী করেছে। এই সময়েই রাশিয়া চেচেন বিদ্রোহ দমন করেছে, প্রতিবেশী অঞ্চলে প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে এবং জর্জিয়া, মলদোভা ও ইউক্রেনে ন্যাটোর সম্প্রসারণ বাধা দিয়েছে। এই অবস্থায় মাল্টিপোলার বা বহু মেরু বিশ্বের বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর পরিবর্তে, ওয়াশিংটন আরও ইউনিপোলার ব্যবস্থায় জোর দিয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় তারা রুশ সীমান্তের দিকে ন্যাটো সম্প্রসারণ, পূর্ব ইউরোপ ও ককেশিয়ায় কালার রেভোলিউশনকে সমর্থন, দক্ষিণ চীন সাগরে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন, প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ায় মিত্রদের সাহায্য করেছে। এসব মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিপোলার ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার কোশেশ।

এসব প্রচেষ্টা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেনে নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়েছে এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে উঠেছে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ তেমন প্রভাব ফেলেনি। বরং, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশগুলো ডলারের ব্যবহার কমিয়েছে। সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতন হয়েছে, কিন্তু গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে হামাসের প্রতিরোধের প্রতি সমর্থন বাড়িয়েছে।

ইউরোপীয় পুনর্গঠন ও উন্নয়ন ব্যাংকের আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা ফাদি লামা ২০২২ সালে লিখেছিলেন, ‘রাশিয়া, ইরান, চীনের (আরআইসি) ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক প্রভাব বিবেচনা করে পশ্চিমের একমাত্র কার্যকর কৌশল হলো—বিশ্বকে (বিভিন্ন প্রভাব বলয়ে) বিভক্ত করে প্রতিযোগিতা সমাপ্ত করা।’

এরপর থেকে, ট্রাম্পের সময়ে পশ্চিম গোলার্ধে মার্কিন আধিপত্য বিস্তারের নীতি আরও দ্রুত এগিয়েছে। ইউরোপের নিরাপত্তা আমেরিকা নিশ্চিত করার পরিবর্তে ট্রাম্প এটিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটো সদস্যদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন এবং সম্প্রতি রোমানিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন।

নিশ্চয়ই, ট্রাম্প প্রশাসনে এখনো নব্য–রক্ষণশীল ঘরানার তীক্ষ্ণ নীতির লোক রয়েছে। ট্রাম্প ইসরায়েল ও ইউক্রেনে বিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্য পাঠিয়েছেন, রাশিয়ার ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন এবং সোমালিয়ায় ড্রোন হামলাসহ লোহিত সাগর এলাকায় কার্যক্রম বাড়িয়েছেন। কিন্তু ট্রাম্প নিজে কখনো প্রচলিত নব্য–রক্ষণশীল পরিকল্পনা অনুসরণ করেননি।

দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে প্রবেশের পরপরই ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেন এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে। তিনি আশা করেছিলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হলে রাশিয়া আবার পশ্চিমা জোটে ফিরবে, আর এতে চীনের সঙ্গে মস্কোর সম্পর্ক দুর্বল হবে। কিন্তু রাশিয়া যেভাবে ইউক্রেনে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে যুদ্ধ থামানোর কোনো যৌক্তিকতা তারা দেখছে না। বরং, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে রাশিয়া আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে বেইজিংয়ের সঙ্গে।

এই সময়ে ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধও বেড়ে গেছে। চীনা পণ্যের ওপর ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। জবাবে চীন গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রপ্তানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে। শেষে যুক্তরাষ্ট্র নীরবে সেই শুল্ক কমিয়ে ৪৭ শতাংশে নামায়। এমনকি তাইওয়ানও এখন কার্যত ট্রাম্প প্রশাসনের আলোচ্যসূচি থেকে হারিয়ে গেছে। অথচ, এক সময় তাইওয়ান মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম মূল আলোচ্য বিষয় ছিল।

ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি অনেকেই ভুলভাবে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বা ‘শান্তিপ্রিয়’ বলে ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। চীন ও রাশিয়াকে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে ট্রাম্প এখন আমেরিকা মহাদেশকে—পাতাগোনিয়া থেকে গ্রিনল্যান্ড পর্যন্ত—ওয়াশিংটনের প্রভাববলয়ে আনতে চাইছেন।

এটি আসলে মনরো নীতিরই নতুন সংস্করণ। প্রায় ২০০ বছর ধরে এই নীতিই বলছে, পশ্চিম গোলার্ধ যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বভুক্ত এলাকা। তবে এবার ট্রাম্প তা প্রকাশ্যে বলছেন এবং হুমকি দিয়েছেন—প্রয়োজনে সামরিক শক্তি বাড়িয়ে সংযুক্তিকরণ নিশ্চিত করবেন। দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতেই তিনি কানাডা, গ্রিনল্যান্ড ও পানামাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত করার আহ্বান জানান। উদারপন্থী বিশ্লেষকেরা একে পাগলামি বললেও এতে বাস্তব ফল এসেছে।

কানাডা সীমান্তে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ডেনমার্ক যুক্তরাষ্ট্রের চাপে গ্রিনল্যান্ডে সেনা মোতায়েন বাড়িয়েছে, যাতে চীন ওই অঞ্চলের খনিজসম্পদে প্রবেশাধিকার না পায়। পানামা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্প বাতিল করেছে এবং হংকংভিত্তিক সিকে হাচিনসনের সঙ্গে খাল ব্যবস্থাপনার চুক্তি বাতিল করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে মেক্সিকো চীনা পণ্যে শুল্ক বাড়াতে সম্মত হয়েছে। আর্জেন্টিনা ৪০ বিলিয়ন ডলার মার্কিন সহায়তা পেয়েছে, যা তাদের মার্কিনপন্থী সরকারকে জাতীয় নির্বাচনে জিততে সাহায্য করেছে। কোস্টারিকা ও গুয়াতেমালা যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অভিবাসীদের ফেরত নিতে রাজি হয়েছে, বিনিময়ে তারা কম শুল্ক সুবিধা পেয়েছে। এভাবে ঘুষ, হুমকি ও সামরিক ভয়ের মুখে একে একে অঞ্চলটির দেশগুলো আবারও ওয়াশিংটনের প্রভাব বলয়ে ফিরছে।

তবে এক ব্যতিক্রম ভেনেজুয়েলা। ২০০২ সাল থেকে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের শাসন পরিবর্তনের চেষ্টার, নিষেধাজ্ঞা আর অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে টিকে আছে। শুরুতে মনে হয়েছিল, ওয়াশিংটনের চাপে দেশটি ভেঙে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেনেজুয়েলার সঙ্গে লেনদেন বন্ধ করে দেয়। এর ফলে দেশটির জিডিপি ৭৪ শতাংশ কমে যায়, মুদ্রাস্ফীতি দুই মিলিয়ন শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, আর প্রায় ৭৯ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে পালায়। তখন মনে হয়েছিল, সরকার ভেঙে পড়া শুধু সময়ের ব্যাপার। কিন্তু তা হয়নি।

এখন ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি দ্রুত বাড়ছে, মানুষ দেশে ফিরছে, মুদ্রাস্ফীতিও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। এ সাফল্যের পেছনে আছে ভেনেজুয়েলার জনগণের স্থিতিশীলতা। তবে এর বড় অংশের কৃতিত্ব চীনেরও। বেইজিং দেশটিতে ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে, যা ভেনেজুয়েলার মোট অর্থনীতির অর্ধেকের বেশি। এই বিনিয়োগের মাধ্যমে চীন দেশটিকে সাহায্য করছে নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে পণ্য রপ্তানি করতে। রাশিয়াও সামরিক সহযোগিতা ও গোয়েন্দা সহায়তায় ভেনেজুয়েলাকে সহায়তা দিচ্ছে। ইরানও পাশে আছে, তারা দেশটিতে কয়েক মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল পাঠিয়েছে।

এতে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে দুটি বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে। প্রথমত, ভেনেজুয়েলার টিকে থাকা অন্য দেশগুলোকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। ইতিমধ্যে ব্রাজিল, চিলি, কলম্বিয়া, হন্ডুরাস, মেক্সিকো ও নিকারাগুয়ায় বামপন্থী সরকার ক্ষমতায় এসেছে। ইকুয়েডর ও পেরুর গণবিক্ষোভও ইঙ্গিত দিচ্ছে—তারা শিগগিরই নির্বাচনের মাধ্যমে বা লড়াইয়ের পথ ধরে এই ধারায় যোগ দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, ভেনেজুয়েলার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উল্টো ফল দিয়েছে। এই পদক্ষেপ চীন ও রাশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘পেছনের উঠোনে’ প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভেনেজুয়েলাকে দুর্বল করা অর্থনৈতিক যুদ্ধের সব অস্ত্র এখন প্রায় শেষ। তাই এবার সামরিক বিকল্পের পালা। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে ক্যারিবীয় অঞ্চলে বিশাল নৌবহর পাঠিয়েছে—১৯৯৪ সালের পর এটিই সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি। নতুন কৌশল অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্য ও প্রশান্ত মহাসাগর থেকে কিছু সামরিক সরঞ্জাম সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ভেনেজুয়েলার উপকূলে। ভয় দেখানোর অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র মাদক পাচারের অভিযোগে কয়েকটি নৌকা লক্ষ্য করে হামলাও চালিয়েছে।

কিন্তু ভেনেজুয়েলা এই উসকানিতে পা দিচ্ছে না। তারা রাশিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করতে ও ভাগনার বাহিনীর সামরিক প্রশিক্ষক পাঠাতে। এমনকি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে আলোচনার খবরও শোনা যাচ্ছে। লাতিন আমেরিকায় প্রতিরোধও বাড়ছে। ব্রাজিলের ১৫ লাখ সদস্যের ভূমিহীন কৃষক আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে সংহতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মেক্সিকো ও কলম্বিয়া যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে। কারাকাস শহুরে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে স্থানীয় মিলিশিয়াদের অস্ত্র দিয়েছে।

ভেনেজুয়েলার সেনাবাহিনী পরাজিত হলেও নাগরিক মিলিশিয়াদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে, যেন লড়াই চালিয়ে যাওয়া যায়। এই হস্তক্ষেপ, সর্বোচ্চ, ইরাক যুদ্ধের মতোই হবে—দীর্ঘ, অজনপ্রিয় ও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ।

ট্রাম্প আমেরিকার কৌশল ছোট করে আনছেন। আগে ছিল বৈশ্বিক আধিপত্য, তারপর ছিল এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ‘পিভট’, এখন লক্ষ্য পশ্চিম গোলার্ধ। কিন্তু ভেনেজুয়েলা সেই পথে বড় বাধা। যদি ভেনেজুয়েলা সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে টিকে যায়, তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের শেষ ভ্রমও ভেঙে পড়বে। তখন হয়তো সাম্রাজ্য আংশিক নিয়ন্ত্রণেই সন্তুষ্ট হবে—কেবল উপকূলীয় কিছু সম্পদপূর্ণ অঞ্চলে আধিপত্য বজায় রেখে, ক্রমাগত যুদ্ধ চালিয়ে যাবে কাঁচামাল আহরণের জন্য।

এরই মধ্যে ইঙ্গিত মিলছে, যুক্তরাষ্ট্র দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিতে চাইছে। ট্রাম্প নাইজেরিয়াকে ‘খ্রিষ্টানদের ওপর গণহত্যা’ চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। বিদেশে হস্তক্ষেপের অজুহাত হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায়ই এ ধরনের অভিযোগ ব্যবহার করে। জাতিগত ও ধর্মীয় বিভাজনে জর্জরিত নাইজেরিয়া ভেঙে যেতে পারে। তেলসমৃদ্ধ দক্ষিণাঞ্চল আলাদা হয়ে যেতে পারে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তরাঞ্চল থেকে। কিন্তু নাইজেরিয়াও সহজ লক্ষ্য নয়। সেখানে হস্তক্ষেপ করতে গেলে বিপুল খরচ ও মানবিক বিপর্যয় ঘটবে। তবু এক মরিয়া সাম্রাজ্যের চোখে হয়তো ঝুঁকিটা নেওয়ার মতোই মূল্যবান মনে হতে পারে।

বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক কৌশল এখন রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নব্য রক্ষণশীলরা পুরোনো আধিপত্য ধরে রাখতে চায়—তারা চায় ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান বজায় রাখুক, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপকে সমর্থন দিক, আর চীনকে ঠেকিয়ে রাখুক। পুরোপুরি পশ্চাদপসরণে সময় লাগবে, কিন্তু ট্রাম্প তার প্রথম ইঙ্গিত দিয়েছেন। এই ধারা ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির সঙ্গেই শেষ হবে না। বৃহত্তর মার্কিন অভিজাত মহল ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে, একক আধিপত্যের যুগ শেষ। তাই তারা ভাবছে, যদি বিশ্বকে শাসন করা না যায়, তবে অন্তত নিজের অঞ্চলটাকেই শাসন করা হোক।

কিন্তু সেটাও হয়তো ব্যর্থ হবে। যদি ভেনেজুয়েলা টিকে থাকে, যদি গ্লোবাল সাউথ একত্র হয়, আর যদি লাতিন আমেরিকার জনগণ পরাধীনতার বদলে সার্বভৌমত্বে এক হয়—তাহলে আমেরিকার জন্য পশ্চিম গোলার্ধও আর নিরাপদ থাকবে না। তাই যুক্তরাষ্ট্র প্রভাবের পরবর্তী অধ্যায় হয়তো ‘বিচ্ছিন্নতা’ নয়—বরং এক প্রকার পশ্চাদপসরণ। সেটি ছদ্মবেশে, আক্রমণাত্মক রূপে, তবুও বিপজ্জনক হবে। তবে সেটি আর ‘আধিপত্য’ নয়।

লেখক: এইডেন জে. সিমার্ডোন কানাডিয়ান অভিবাসন আইনজীবী। এ ছাড়া, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর মাস্টার অফ গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স ডিগ্রি রয়েছে। তিনি ন্যাটোর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন, উইলসন সেন্টার এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংগঠনে কাজ করেছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ