হুসাইন আহমদ
আজকের বিশ্বে প্রযুক্তি কেবল সরঞ্জাম নয়, আমাদের চেতনা, পরিচয় ও আচরণ বদলে দিচ্ছে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সার্চ ইঞ্জিন ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম; নিরবে পর্যবেক্ষণ ও প্রভাবিত করছে আমাদের মনোযোগ, অনুভূতি এবং আচরণকে। এই সব মাধ্যমগুলোর মালিকরা যা করছে, তা নিরব বিপ্লব—ধীর, কিন্তু গভীর।
দেড় দশক আগে যখন এগুলোর প্রভাব এতটা প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়নি, তখন ফরাসি দার্শনিক বার্নার্ড স্টিগলার এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। ‘টেকিং কেয়ার অব ইয়ুথ অ্যান্ড জেনারেশন’ শীর্ষক বইতে তিনি লিখেছেন, ডিজিটাল প্রযুক্তি আমাদের চেতনার মধ্যস্থতাকারী হয়ে উঠছে—আমাদের মনোযোগ, ইচ্ছা ও যত্নকে প্রভাবিত করছে। আমাদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য প্রতিটি নোটিফিকেশন, ফিড, বা সার্চ রেজাল্ট সুকৌশলে ডিজাইন করা হয়েছে। এর ফলে আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা এবং স্বায়ত্তশাসন ক্রমাগত ক্ষয় হচ্ছে। আমরা আর নিজের পছন্দে নয়, বরং অ্যালগরিদ-নির্ধারিত তথ্যপ্রবাহে চালিত হচ্ছি।
২০২৩ সালের মে মাসে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের তরুণ ভোক্তাদের ক্রয় সিদ্ধান্তে সোশ্যাল মিডিয়া বিজ্ঞাপনের প্রভাব’ শীর্ষক ঢাকা শহরে পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, তরুণদের ক্রয় সিদ্ধান্তে ৫৩.৫% প্রভাব ফেলে ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ার বিজ্ঞাপন। বিশেষ করে তথ্যের উৎস, অভিনব বিজ্ঞাপন, সময় সাশ্রয়, নিরাপত্তা, অর্ডার করার সুবিধা ও ফিডব্যাক এই সিদ্ধান্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মানুষের সামাজিক জীবনে প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে কাজ করেছেন মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী শেরি টার্কল। তাঁর মতে, প্রযুক্তি আমাদের সংযোগের সুযোগ সৃষ্টি করলেও তা এক ধরনের নতুন নিঃসঙ্গতা ও আবেগীয় সম্পৃক্ততার ঘাটতি তৈরি করতে পারে।
২০১১ সালে প্রকাশিত ‘অ্যালোন টুগেদার: হোয়াই উই এক্সপেক্ট মোর ফ্রম টেকনোলজি অ্যান্ড লেস ফ্রম ইচ আদার’ বইতে তিনি দেখিয়েছেন, মানুষের সঙ্গে সংযোগ গড়তে আমরা যেভাবে ক্রমাগত প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি, তাতে আমাদের সম্পর্ক, অন্তরঙ্গতা এবং এমনকি নিজেদের পরিচয়বোধও প্রভাবিত হচ্ছে। এই ‘সিমুলেটেড কানেকশন’ বা কৃত্রিম সংযোগ আমাদের মধ্যে বাস্তব যোগাযোগের চাহিদা কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে আমরা একে অপরের কাছ থেকে কম প্রত্যাশা করি, অথচ প্রযুক্তির কাছে প্রত্যাশা করি আরও বেশি।
প্রযুক্তিনির্ভর জীবনের সামাজিক ও মানসিক দিকগুলো নিয়ে গভীর সতর্কবার্তা দেয় তাঁর বই। তিনি লিখেছেন, ঘনিষ্ঠতার পেছনেই ছোটে প্রযুক্তি, কিন্তু প্রকৃত মানবিক সম্পর্কের পরিবর্তে অ্যালগরিদমের তৈরি ইন্টারঅ্যাকশন বা মিথস্ক্রিয়া দেয়। আমরা নিজেদের সংযুক্ত মনে করি, কিন্তু আসলে ক্রমশ একা হয়ে পড়ছি। আমাদের মন প্রযুক্তির ছন্দে নাচছে; পরিণতিতে সর্বাধিক মুনাফার জন্য ডিজাইন করা ‘মনোযোগ অর্থনীতির’ নিস্ক্রিয় অংশগ্রহণকারী হয়ে উঠছে।
অ্যালগরিদমিক ডিজাইন: মন নিয়ে খেলা
আমাদের উপলব্ধিকে প্রভাবিত করার জন্য পরিকল্পিতভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর নকশা তৈরি করা হয়েছে। দ্য রিলেভেন্স অব অ্যালগরদিম শীর্ষক বইতে টারলেটন গিলেসপি এবং অ্যালগরিদম অব অপরেসন শীর্ষক বইতে সাফিয়া নোবেলে বলছেন, অ্যালগরিদমগুলো নিরপেক্ষ নয়—এগুলো কর্পোরেট ডিজাইনারদের সুর্নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে তৈরি। এগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য হল ব্যবহারকারীদের আচরণ সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া এবং তা প্রভাবিত করে বিজ্ঞাপন ও পরিষেবা বিক্রির মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করা।
তুর্কি সমাজবিজ্ঞানী জেইনেপ টুফেকচির গবেষণা দেখিয়েছে, ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর এনগেজমেন্টভিত্তিক অ্যালগরিদম ব্যবহারকারীদের ধীরে ধীরে চরম ও বিভ্রান্তিকর বিষয়বস্তুর দিকে ঠেলে দেয়। এর ফলে মানব মনে ধ্রুব মনস্তাত্ত্বিক নীরিক্ষা চলতে; ব্যবহারকারীরা কার্যত প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর পরীক্ষাগারে পরিণত হয়।
হাইপার-পারসনালাইজেশন ও আত্ম পণ্যায়ন
প্রযুক্তির মূল শক্তি ব্যবহারকারীদের আচরণগত এবং বায়োমেট্রিক ডেটা সংগ্রহ করা, বিশ্লেষণ করা এবং তার ভিত্তিতে তাদের সামনে নির্দিষ্ট তথ্য ও পণ্য তুলে ধরা। এতে একধরনের রিঅ্যাকশন লুপ তৈরি হয়, যেখানে ব্যবহারকারীরা যা দেখে তা-ই বিশ্বাস করতে শুরু করে এবং যা বিশ্বাস করে তা আরও দেখে।
শোশানা জুবফ (২০১৯) এই বাস্তবতার নাম দিয়েছেন ‘সার্ভেইলেন্স ক্যাপিটালিজম’ বা নজরদারি পুঁজিবাদ, যেখানে মানুষের ব্যক্তিগত অভ্যাস, চিন্তা ও অনুভূতি পর্যবেক্ষণ করে তা বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত করা হয়। এটি কেবল বাণিজ্যিক কৌশল নয়—নতুন ধরণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তির নির্মাণ।
২০২৩ সালে এই মডেলের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক সাফল্য দেখা গেছে। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই মডেল ব্যবহার করে ওই বছর অ্যাপল ৯৭ বিলিয়ন, অ্যালফাবেট (গুগল) ৭৩.৮ বিলিয়ন, মেটা (ফেসবুক) ৩৯.১ বিলিয়ন ও অ্যামাজন ৩০.৪ বিলিয়ন ডলার মুনাফা হাতিয়েছে। আর এই মুনাফা এসেছে মানুষের মনোযোগ এবং আচরণ বিক্রি করে—ঐতিহ্যবাহী উৎপাদন বা শ্রমের মাধ্যমে নয়।
প্ল্যাটফর্ম ক্যাপিটালিজমের বাস্তব অভিঘাত
এই প্রযুক্তিভিত্তিক শোষণ কেবল ভার্চুয়াল জগতে সীমাবদ্ধ নয়—এটি বাস্তব জগতে ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়েছে। তার কিছু বাস্তব দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো।
রোহিঙ্গা গণহত্যা (মিয়ানমার) : ঘৃণাত্মক বক্তব্য ছড়াতে ফেসবুক ব্যবহার হয়েছে। এটি মূল অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে বলে জাতিসংঘের ভাষ্য।
ইথিওপিয়ার সংঘাতেও ফেসবুক ও টুইটারে ভুল তথ্য ছড়িয়ে জাতিগত সহিংসতা উসকে দেয়া হয়।
কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতি: ইনস্টাগ্রামের কনটেন্ট শরীর নিয়ে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে কিশোরীদের মধ্যে।
ক্যাপিটল হিল হামলা (যুক্তরাষ্ট্র, ২০২১) : ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ব্যবহার করে ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্ব ছড়ানো হয়েছে, যা সহিংসতায় রূপ নিয়েছে।
ভারতে গণপিটুনি ও সহিংসতা: হোয়াটসঅ্যাপে ভুয়া বার্তা ভাইরাল হয়ে মৃত্যুর কারণ হয়েছে।
লাইভস্ট্রিমকৃত গণহত্যা: ক্রাইস্টচার্চ (নিউজিল্যান্ড) ও বাফেলো (যুক্তরাষ্ট্র) হামলায় খুনিরা হামলার দৃশ্য লাইভস্ট্রিম করে, অনলাইন দর্শকদের সামনে ট্র্যাজেডিকে বিনোদনে পরিণত করে।
অনলাইন হয়রানি ও আত্মহত্যা: সোশ্যাল মিডিয়াতে হয়রানির ফলে কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যা করেছে।
এই সব ঘটনা প্রমাণ করে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর অ্যালগরিদম ও নজরদারি কৌশল কীভাবে বিশ্বজুড়ে চরম মানসিক ও শারীরিক ক্ষতির কারণ হয়েছে।
মুনাফায় প্রযুক্তি কোম্পানির পোয়াবারো
২০২৪ সালে বিশ্বের সর্বাধিক লাভজনক শীর্ষ ১০টি কোম্পানির তালিকায় প্রযুক্তি খাতভুক্ত কোম্পানিগুলোর অবস্থান ছিল উল্লেখযোগ্য। ফরচুন ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, এই শীর্ষ দশে মোট চারটি প্রযুক্তি কোম্পানি জায়গা করে নিয়েছে। বিগ টেকের মুনাফা শুধু বিপুল নয়, তুলনামূলক বিশ্লেষণও বিস্ময়কর।
এই তালিকায় দ্বিতীয় শীর্ষ কোম্পানি অ্যাপল। গত বছর ৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মুনাফা করেছিল এই কোম্পানি। তেল কোম্পানি এক্সনমোবিল (৩৬ বিলিয়ন ডলার) ও বিশ্বখ্যাত গাড়িনির্মাতা টয়োটা (২৯ বিলিয়ন ডলার) সম্মিলিত মুনাফার চেয়ে বেশি।
তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে আছে গুগলের মালিক প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট, যার মুনাফা ৭৩.৮ বিলিয়ন ডলার। মানুষের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ প্রস্তুতকারক ফাইজারের তুলনায় দ্বিগুণ এই মুনাফা। অ্যালফাবেটের পরেই মাইক্রোসফটের অবস্থান, কোম্পানিটি ৭২.৪ বিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছে।
মুনাফায় শীর্ষ ১০ কোম্পানির তালিকায় নবম স্থানে আছে বিশ্বের শীর্ষ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের মালিক প্রতিষ্ঠান মেটা। মার্ক জাকার্বার্গের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি ২০২৪ সালে ৩৯.১ বিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছে। মেটার লাভ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ভোগ্যপণ্য নির্মাতা কোম্পানি প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের প্রায় তিনগুণ।
তাদের সম্মিলিত মুনাফা ছিল প্রায় ২৮২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই প্রতিষ্ঠানগুলো সফটওয়্যার ও ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্যের উপরে ভর করে দুর্দান্ত মুনাফা করেছে, যেখানে মানব শ্রম বা প্রকৃত উৎপাদনের ভূমিকা নিতান্ত নগন্য।
ডিজিটাল শ্রম এবং শোষণের নতুন রূপ
এই মুনাফার পেছনে যে শ্রম রয়েছে তা আমাদের চোখে পড়ে না। আমরা যখন ফেসবুকে পোস্ট করি, ইউটিউবে ভিডিও দেখি, বা টিকটকে স্ক্রল করি, তখন আমরা যে শুধু এই প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করছি তা নয়, আমরা শ্রমও দিচ্ছি— এটিই ‘ডিজিটাল শ্রম’। ব্যবহারকারীদের সময়, মনোযোগ ও ডেটার অনবরত প্রবাহকে বিশ্লেষণ করে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো হাজার হাজার গুণ মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে।
ইতালীয় মার্ক্সবাদী পণ্ডিতরা এটিকে ‘আনজাস্ট এনক্লোজার’ অর্থাৎ ‘যৌথ চেতনার ব্যক্তিগত মালিকানা’ আখ্যা দিয়েছেন। এই নতুন রূপের শোষণে শ্রমিকের শরীর নয়, ব্যবহৃত হচ্ছে মন ও আবেগ।
মুক্তির পথ কোথায়
প্রযুক্তি আমাদের চেতনায় যে প্রভাব ফেলছে, তা নিছক প্রযুক্তিগত ইস্যু নয়—এটি একটি নৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংকট। আমাদের মনকে পণ্যে পরিণত করা হচ্ছে, এবং আমরা অজান্তেই বিগ টেক তথা আগ্রাসী প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর উপনিবেশিকরণের অংশ হয়ে পড়েছি। এই পরিস্থিতির বদল না হলে আমরা প্রযুক্তির বন্দী হয়ে যাব নিজেদের অজান্তেই।
পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য নৈতিকভাবে দায়িত্বশীল প্রযুক্তি নীতিমালা গ্রহণ অপরিহার্য। তার সঙ্গে দরকার ব্যবহারকারীর তথ্যের উপর সম্পূর্ণ নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ এবং প্রযুক্তি কোম্পনিগুলোর পক্ষ থেকে অ্যালগরিদমের স্বচ্ছতা। সর্বোপরি শিক্ষার মাধ্যমে ডিজিটাল সচেতনতা বৃদ্ধি এবং বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও রাজনৈতিক চাপের মাধ্যমেই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব।
লেখক:
সহকারী বার্তা সম্পাদক
আজকের পত্রিকা
আজকের বিশ্বে প্রযুক্তি কেবল সরঞ্জাম নয়, আমাদের চেতনা, পরিচয় ও আচরণ বদলে দিচ্ছে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সার্চ ইঞ্জিন ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম; নিরবে পর্যবেক্ষণ ও প্রভাবিত করছে আমাদের মনোযোগ, অনুভূতি এবং আচরণকে। এই সব মাধ্যমগুলোর মালিকরা যা করছে, তা নিরব বিপ্লব—ধীর, কিন্তু গভীর।
দেড় দশক আগে যখন এগুলোর প্রভাব এতটা প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়নি, তখন ফরাসি দার্শনিক বার্নার্ড স্টিগলার এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। ‘টেকিং কেয়ার অব ইয়ুথ অ্যান্ড জেনারেশন’ শীর্ষক বইতে তিনি লিখেছেন, ডিজিটাল প্রযুক্তি আমাদের চেতনার মধ্যস্থতাকারী হয়ে উঠছে—আমাদের মনোযোগ, ইচ্ছা ও যত্নকে প্রভাবিত করছে। আমাদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য প্রতিটি নোটিফিকেশন, ফিড, বা সার্চ রেজাল্ট সুকৌশলে ডিজাইন করা হয়েছে। এর ফলে আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা এবং স্বায়ত্তশাসন ক্রমাগত ক্ষয় হচ্ছে। আমরা আর নিজের পছন্দে নয়, বরং অ্যালগরিদ-নির্ধারিত তথ্যপ্রবাহে চালিত হচ্ছি।
২০২৩ সালের মে মাসে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের তরুণ ভোক্তাদের ক্রয় সিদ্ধান্তে সোশ্যাল মিডিয়া বিজ্ঞাপনের প্রভাব’ শীর্ষক ঢাকা শহরে পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, তরুণদের ক্রয় সিদ্ধান্তে ৫৩.৫% প্রভাব ফেলে ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ার বিজ্ঞাপন। বিশেষ করে তথ্যের উৎস, অভিনব বিজ্ঞাপন, সময় সাশ্রয়, নিরাপত্তা, অর্ডার করার সুবিধা ও ফিডব্যাক এই সিদ্ধান্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মানুষের সামাজিক জীবনে প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে কাজ করেছেন মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী শেরি টার্কল। তাঁর মতে, প্রযুক্তি আমাদের সংযোগের সুযোগ সৃষ্টি করলেও তা এক ধরনের নতুন নিঃসঙ্গতা ও আবেগীয় সম্পৃক্ততার ঘাটতি তৈরি করতে পারে।
২০১১ সালে প্রকাশিত ‘অ্যালোন টুগেদার: হোয়াই উই এক্সপেক্ট মোর ফ্রম টেকনোলজি অ্যান্ড লেস ফ্রম ইচ আদার’ বইতে তিনি দেখিয়েছেন, মানুষের সঙ্গে সংযোগ গড়তে আমরা যেভাবে ক্রমাগত প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি, তাতে আমাদের সম্পর্ক, অন্তরঙ্গতা এবং এমনকি নিজেদের পরিচয়বোধও প্রভাবিত হচ্ছে। এই ‘সিমুলেটেড কানেকশন’ বা কৃত্রিম সংযোগ আমাদের মধ্যে বাস্তব যোগাযোগের চাহিদা কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে আমরা একে অপরের কাছ থেকে কম প্রত্যাশা করি, অথচ প্রযুক্তির কাছে প্রত্যাশা করি আরও বেশি।
প্রযুক্তিনির্ভর জীবনের সামাজিক ও মানসিক দিকগুলো নিয়ে গভীর সতর্কবার্তা দেয় তাঁর বই। তিনি লিখেছেন, ঘনিষ্ঠতার পেছনেই ছোটে প্রযুক্তি, কিন্তু প্রকৃত মানবিক সম্পর্কের পরিবর্তে অ্যালগরিদমের তৈরি ইন্টারঅ্যাকশন বা মিথস্ক্রিয়া দেয়। আমরা নিজেদের সংযুক্ত মনে করি, কিন্তু আসলে ক্রমশ একা হয়ে পড়ছি। আমাদের মন প্রযুক্তির ছন্দে নাচছে; পরিণতিতে সর্বাধিক মুনাফার জন্য ডিজাইন করা ‘মনোযোগ অর্থনীতির’ নিস্ক্রিয় অংশগ্রহণকারী হয়ে উঠছে।
অ্যালগরিদমিক ডিজাইন: মন নিয়ে খেলা
আমাদের উপলব্ধিকে প্রভাবিত করার জন্য পরিকল্পিতভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর নকশা তৈরি করা হয়েছে। দ্য রিলেভেন্স অব অ্যালগরদিম শীর্ষক বইতে টারলেটন গিলেসপি এবং অ্যালগরিদম অব অপরেসন শীর্ষক বইতে সাফিয়া নোবেলে বলছেন, অ্যালগরিদমগুলো নিরপেক্ষ নয়—এগুলো কর্পোরেট ডিজাইনারদের সুর্নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে তৈরি। এগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য হল ব্যবহারকারীদের আচরণ সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া এবং তা প্রভাবিত করে বিজ্ঞাপন ও পরিষেবা বিক্রির মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করা।
তুর্কি সমাজবিজ্ঞানী জেইনেপ টুফেকচির গবেষণা দেখিয়েছে, ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর এনগেজমেন্টভিত্তিক অ্যালগরিদম ব্যবহারকারীদের ধীরে ধীরে চরম ও বিভ্রান্তিকর বিষয়বস্তুর দিকে ঠেলে দেয়। এর ফলে মানব মনে ধ্রুব মনস্তাত্ত্বিক নীরিক্ষা চলতে; ব্যবহারকারীরা কার্যত প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর পরীক্ষাগারে পরিণত হয়।
হাইপার-পারসনালাইজেশন ও আত্ম পণ্যায়ন
প্রযুক্তির মূল শক্তি ব্যবহারকারীদের আচরণগত এবং বায়োমেট্রিক ডেটা সংগ্রহ করা, বিশ্লেষণ করা এবং তার ভিত্তিতে তাদের সামনে নির্দিষ্ট তথ্য ও পণ্য তুলে ধরা। এতে একধরনের রিঅ্যাকশন লুপ তৈরি হয়, যেখানে ব্যবহারকারীরা যা দেখে তা-ই বিশ্বাস করতে শুরু করে এবং যা বিশ্বাস করে তা আরও দেখে।
শোশানা জুবফ (২০১৯) এই বাস্তবতার নাম দিয়েছেন ‘সার্ভেইলেন্স ক্যাপিটালিজম’ বা নজরদারি পুঁজিবাদ, যেখানে মানুষের ব্যক্তিগত অভ্যাস, চিন্তা ও অনুভূতি পর্যবেক্ষণ করে তা বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত করা হয়। এটি কেবল বাণিজ্যিক কৌশল নয়—নতুন ধরণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তির নির্মাণ।
২০২৩ সালে এই মডেলের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক সাফল্য দেখা গেছে। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই মডেল ব্যবহার করে ওই বছর অ্যাপল ৯৭ বিলিয়ন, অ্যালফাবেট (গুগল) ৭৩.৮ বিলিয়ন, মেটা (ফেসবুক) ৩৯.১ বিলিয়ন ও অ্যামাজন ৩০.৪ বিলিয়ন ডলার মুনাফা হাতিয়েছে। আর এই মুনাফা এসেছে মানুষের মনোযোগ এবং আচরণ বিক্রি করে—ঐতিহ্যবাহী উৎপাদন বা শ্রমের মাধ্যমে নয়।
প্ল্যাটফর্ম ক্যাপিটালিজমের বাস্তব অভিঘাত
এই প্রযুক্তিভিত্তিক শোষণ কেবল ভার্চুয়াল জগতে সীমাবদ্ধ নয়—এটি বাস্তব জগতে ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়েছে। তার কিছু বাস্তব দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো।
রোহিঙ্গা গণহত্যা (মিয়ানমার) : ঘৃণাত্মক বক্তব্য ছড়াতে ফেসবুক ব্যবহার হয়েছে। এটি মূল অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে বলে জাতিসংঘের ভাষ্য।
ইথিওপিয়ার সংঘাতেও ফেসবুক ও টুইটারে ভুল তথ্য ছড়িয়ে জাতিগত সহিংসতা উসকে দেয়া হয়।
কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতি: ইনস্টাগ্রামের কনটেন্ট শরীর নিয়ে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে কিশোরীদের মধ্যে।
ক্যাপিটল হিল হামলা (যুক্তরাষ্ট্র, ২০২১) : ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ব্যবহার করে ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্ব ছড়ানো হয়েছে, যা সহিংসতায় রূপ নিয়েছে।
ভারতে গণপিটুনি ও সহিংসতা: হোয়াটসঅ্যাপে ভুয়া বার্তা ভাইরাল হয়ে মৃত্যুর কারণ হয়েছে।
লাইভস্ট্রিমকৃত গণহত্যা: ক্রাইস্টচার্চ (নিউজিল্যান্ড) ও বাফেলো (যুক্তরাষ্ট্র) হামলায় খুনিরা হামলার দৃশ্য লাইভস্ট্রিম করে, অনলাইন দর্শকদের সামনে ট্র্যাজেডিকে বিনোদনে পরিণত করে।
অনলাইন হয়রানি ও আত্মহত্যা: সোশ্যাল মিডিয়াতে হয়রানির ফলে কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যা করেছে।
এই সব ঘটনা প্রমাণ করে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর অ্যালগরিদম ও নজরদারি কৌশল কীভাবে বিশ্বজুড়ে চরম মানসিক ও শারীরিক ক্ষতির কারণ হয়েছে।
মুনাফায় প্রযুক্তি কোম্পানির পোয়াবারো
২০২৪ সালে বিশ্বের সর্বাধিক লাভজনক শীর্ষ ১০টি কোম্পানির তালিকায় প্রযুক্তি খাতভুক্ত কোম্পানিগুলোর অবস্থান ছিল উল্লেখযোগ্য। ফরচুন ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, এই শীর্ষ দশে মোট চারটি প্রযুক্তি কোম্পানি জায়গা করে নিয়েছে। বিগ টেকের মুনাফা শুধু বিপুল নয়, তুলনামূলক বিশ্লেষণও বিস্ময়কর।
এই তালিকায় দ্বিতীয় শীর্ষ কোম্পানি অ্যাপল। গত বছর ৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মুনাফা করেছিল এই কোম্পানি। তেল কোম্পানি এক্সনমোবিল (৩৬ বিলিয়ন ডলার) ও বিশ্বখ্যাত গাড়িনির্মাতা টয়োটা (২৯ বিলিয়ন ডলার) সম্মিলিত মুনাফার চেয়ে বেশি।
তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে আছে গুগলের মালিক প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট, যার মুনাফা ৭৩.৮ বিলিয়ন ডলার। মানুষের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ প্রস্তুতকারক ফাইজারের তুলনায় দ্বিগুণ এই মুনাফা। অ্যালফাবেটের পরেই মাইক্রোসফটের অবস্থান, কোম্পানিটি ৭২.৪ বিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছে।
মুনাফায় শীর্ষ ১০ কোম্পানির তালিকায় নবম স্থানে আছে বিশ্বের শীর্ষ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের মালিক প্রতিষ্ঠান মেটা। মার্ক জাকার্বার্গের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি ২০২৪ সালে ৩৯.১ বিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছে। মেটার লাভ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ভোগ্যপণ্য নির্মাতা কোম্পানি প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের প্রায় তিনগুণ।
তাদের সম্মিলিত মুনাফা ছিল প্রায় ২৮২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই প্রতিষ্ঠানগুলো সফটওয়্যার ও ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্যের উপরে ভর করে দুর্দান্ত মুনাফা করেছে, যেখানে মানব শ্রম বা প্রকৃত উৎপাদনের ভূমিকা নিতান্ত নগন্য।
ডিজিটাল শ্রম এবং শোষণের নতুন রূপ
এই মুনাফার পেছনে যে শ্রম রয়েছে তা আমাদের চোখে পড়ে না। আমরা যখন ফেসবুকে পোস্ট করি, ইউটিউবে ভিডিও দেখি, বা টিকটকে স্ক্রল করি, তখন আমরা যে শুধু এই প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করছি তা নয়, আমরা শ্রমও দিচ্ছি— এটিই ‘ডিজিটাল শ্রম’। ব্যবহারকারীদের সময়, মনোযোগ ও ডেটার অনবরত প্রবাহকে বিশ্লেষণ করে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো হাজার হাজার গুণ মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে।
ইতালীয় মার্ক্সবাদী পণ্ডিতরা এটিকে ‘আনজাস্ট এনক্লোজার’ অর্থাৎ ‘যৌথ চেতনার ব্যক্তিগত মালিকানা’ আখ্যা দিয়েছেন। এই নতুন রূপের শোষণে শ্রমিকের শরীর নয়, ব্যবহৃত হচ্ছে মন ও আবেগ।
মুক্তির পথ কোথায়
প্রযুক্তি আমাদের চেতনায় যে প্রভাব ফেলছে, তা নিছক প্রযুক্তিগত ইস্যু নয়—এটি একটি নৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংকট। আমাদের মনকে পণ্যে পরিণত করা হচ্ছে, এবং আমরা অজান্তেই বিগ টেক তথা আগ্রাসী প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর উপনিবেশিকরণের অংশ হয়ে পড়েছি। এই পরিস্থিতির বদল না হলে আমরা প্রযুক্তির বন্দী হয়ে যাব নিজেদের অজান্তেই।
পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য নৈতিকভাবে দায়িত্বশীল প্রযুক্তি নীতিমালা গ্রহণ অপরিহার্য। তার সঙ্গে দরকার ব্যবহারকারীর তথ্যের উপর সম্পূর্ণ নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ এবং প্রযুক্তি কোম্পনিগুলোর পক্ষ থেকে অ্যালগরিদমের স্বচ্ছতা। সর্বোপরি শিক্ষার মাধ্যমে ডিজিটাল সচেতনতা বৃদ্ধি এবং বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও রাজনৈতিক চাপের মাধ্যমেই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব।
লেখক:
সহকারী বার্তা সম্পাদক
আজকের পত্রিকা
পুতিন যখন যুদ্ধে জয় নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী মনোভাব দেখাচ্ছেন, ঠিক তখনই রাশিয়ার ভেতরে ড্রোন হামলা চালিয়ে অন্তত ৪০টি বোমারু বিমান ধ্বংস করে দিয়েছে ইউক্রেন। এগুলোর মধ্যে কিছু পারমাণবিক অস্ত্রবাহী যুদ্ধবিমানও ছিল।
২ দিন আগেবিশ্বের ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা ও ‘রুশ আগ্রাসনের নতুন যুগে’ প্রতিরক্ষা খাতে বড় পরিসরে বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্য। গত সোমবার (২ জুন) প্রকাশিত যুক্তরাজ্যের কৌশলগত প্রতিরক্ষা পর্যালোচনায় (এসডিআর) উঠে এসেছে পারমাণবিক অস্ত্র, সাবমেরিন ও গোলাবারুদ তৈরির নতুন কারখানায় বিনিয়োগের পরিকল্পনা।
২ দিন আগেসত্য কী? অধিকাংশ মানুষের কাছে সত্য মানে হলো, যা বাস্তব তথ্যের সঙ্গে মিলে। অবশ্য আজকাল ‘বিকল্প সত্য’ নামে নতুন এক ধারণা অনেকে হাজির করছেন। সে যাই হোক, অভিজ্ঞতা বলে, সত্য শুধু বস্তুনিষ্ঠ হওয়াটাই যথেষ্ট নয়, সত্য প্রকাশের উপযুক্ত লগ্ন, সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য খুবই জরুরি।
২ দিন আগেভারত-মিয়ানমার সীমান্তে প্রস্তাবিত ১ হাজার মাইল দীর্ঘ বেড়া সেখানকার সাপ্তাহিক আয়োজন, ব্যবসা-বাণিজ্য, অভিবাসন, ঐতিহাসিক ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ব্যাহত করার হুমকি দিচ্ছে। এসবই করা হচ্ছে নিরাপত্তার নামে। ভারত সরকার মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের তেমন কোনো সম্পৃক্ততা ছাড়াই এই পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।
৩ দিন আগে