Ajker Patrika

সিএনএনের প্রতিবেদন /ভারত-পাকিস্তানের আকস্মিক যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ কী

অনলাইন ডেস্ক
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ভারত ও পাকিস্তান আকস্মিকভাবে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দুই প্রতিবেশীর মধ্যে এটিই ছিল বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘাত। যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল, ঠিক তখনই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই যুদ্ধবিরতির খবর জানান এবং কৃতিত্ব দাবি করেন। তবে এই চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার মাত্রা সম্পর্কে ভারত ও পাকিস্তান পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছে।

যুদ্ধবিরতির ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই উভয় পক্ষ থেকে লঙ্ঘনের খবর পাওয়া গেছে। এতে এই শান্তি কত দিন স্থায়ী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মার্কিন সময় গতকাল শনিবার সকাল ৮টার ঠিক আগে—ভারত-পাকিস্তানে বিকেল ৫টার দিকে—ট্রাম্প নিজ মালিকানাধীন ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন।

ট্রাম্প বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় দীর্ঘ রাতের আলোচনার পর আমি আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি যে ভারত ও পাকিস্তান একটি পূর্ণাঙ্গ এবং তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।’ তিনি উভয় দেশের নেতাদের ‘সাধারণ জ্ঞান এবং দারুণ বুদ্ধিমত্তা’ ব্যবহারের জন্য অভিনন্দন জানান।

এর পরপরই মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট মার্কো রুবিও দাবি করেন, ভারত-পাকিস্তান শুধু যুদ্ধবিরতিতেই সম্মত হয়নি, বরং একটি নিরপেক্ষ স্থানে বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা শুরু করতেও রাজি হয়েছে। রুবিও জানান, তিনি ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স গত দুদিন ধরে দুই দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার পরেই এই যুদ্ধবিরতি এসেছে।

এক মিনিট পরই পাকিস্তান নিশ্চিত করে যে, যুদ্ধবিরতি অবিলম্বে কার্যকর হচ্ছে। এর কিছুক্ষণ পরেই ভারতও নিশ্চিত করে। তবে ভারতের তথ্য মন্ত্রণালয় জানায়, এই চুক্তি ‘দুই দেশের মধ্যে সরাসরি’ হয়েছে। এর মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততাকে খাটো করে দেখা হয় এবং ট্রাম্পের দাবিকে অস্বীকার করা হয়। মন্ত্রণালয় আরও জানায়, পরবর্তী আলোচনা নিয়ে ‘কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’

অন্যদিকে, পাকিস্তানি কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনের প্রশংসা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেন, ‘এই অঞ্চলে শান্তির জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্ব এবং সক্রিয় ভূমিকার জন্য আমরা তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।’ আলোচনার সঙ্গে জড়িত পাকিস্তানের একটি সূত্র সিএনএনকে জানিয়েছে, এই চুক্তি সম্পাদনে যুক্তরাষ্ট্র—বিশেষ করে রুবিও—গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সূত্রটি জানায়, যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আলোচনা নিয়ে সংশয় ছিল।

চির বৈরী এই দুই দেশ যুদ্ধবিরতি কীভাবে এল—সে সম্পর্কে যে পরস্পরবিরোধী বয়ান দিয়েছে, তা খুব একটা আশ্চর্যজনক নয়। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারত নিজেকে উদীয়মান পরাশক্তি হিসেবে দেখে এবং দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার ব্যাপারে রক্ষণশীল। অন্যদিকে, পাকিস্তান বিদেশি সাহায্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হওয়ায় দেশটি এটিকে স্বাগত জানায়।  

ওয়াশিংটন ডিসির হাডসন ইনস্টিটিউটের ইন্ডিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার রিসার্চ ফেলো ড. অপর্ণা পান্ডে বলেছেন, ‘ভারত কখনোই কোনো বিবাদে মধ্যস্থতা মেনে নেয়নি, তা ভারত-পাকিস্তান হোক বা ভারত-চীন, বা অন্য কোনো।’ তিনি আরও বলেন, ‘অন্যদিকে, পাকিস্তান সব সময় আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা চেয়েছে, তাই তারা এর প্রশংসা করবে।’ তিনি যোগ করেন, কাশ্মীর বিবাদ নিয়ে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আলোচনা ও সমাধানের এটাই ‘একমাত্র উপায়।’

শনিবারের যুদ্ধবিরতির আগের লড়াইয়ে উভয় পক্ষ থেকে দাবি, পাল্টা দাবি এবং অপতথ্য ছড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছিল। এখন সংঘাত থামার পর, উভয় পক্ষই লড়াইয়ে তারা কী অর্জন করেছে এবং কীভাবে এর অবসান হয়েছে সে সম্পর্কে ধারণা তৈরি করতে তাদের প্রচেষ্টা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

শনিবার বিকেলে আকস্মিক যুদ্ধবিরতি ছিল বিস্ময়কর। কারণ, সকালে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক লড়াই চলছিল। শনিবার ভোরে পাকিস্তান জানায়, ভারত তাদের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছে। দেশটি জানায়, পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর থেকে শুরু করে রাজধানী ইসলামাবাদের কাছে একটি সামরিক ঘাঁটি পর্যন্ত এসব হামলা হয়েছে।

জবাবে পাকিস্তান ভারতের সামরিক বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালায়। দেশটির সামরিক বাহিনী এক বিবৃতিতে বলে, ‘চোখের বদলে চোখ’ নীতি অনুসরণ করে এই হামলা চালানো হয়েছে। কয়েক ঘণ্টা পর ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরেও বিস্ফোরণের খবর আসে। কাশ্মীরের সবচেয়ে বড় শহর শ্রীনগর ও জম্মু শহরেও ব্যাপক বিস্ফোরণ হয়। শাহবাজ শরিফ বলেন, পাকিস্তান ভারতীয় আগ্রাসনের ‘জবাব দিয়েছে।’

চার দিন ধরে একে অপরের ভূখণ্ডে সরাসরি সামরিক হামলার পর অনেকে আশঙ্কা করছিলেন, কার্যকর আন্তর্জাতিক চাপ না থাকলে এই হামলা-পাল্টা হামলা চলতেই থাকবে এবং পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

এই দফায় সংঘাতের শুরু কাশ্মীরে। এই বিতর্কিত অঞ্চলটি ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই উত্তেজনাপূর্ণ এলাকা। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান ব্রিটিশ ভারতের রক্তাক্ত বিভাজনের পর পুরো কাশ্মীর নিজেদের বলে দাবি করে। তবে বর্তমানে উভয় দেশ এর কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। স্বাধীন হওয়ার কয়েক মাস পরই তারা এই এলাকা নিয়ে প্রথম যুদ্ধ করে। এরপর আরও দুটি যুদ্ধ হয়েছে।

গত ২৬ এপ্রিল ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রে বন্দুকধারীরা পর্যটকদের ওপর গুলি চালায়। এই হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত হন। ঘটনার পরপরই দিল্লি ইসলামাবাদকে দায়ী করে। তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘সীমান্ত সন্ত্রাসবাদকে’ সমর্থন করার অভিযোগ আনে। পাকিস্তান অবশ্য এই হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে।

পেহেলগামের ঘটনার দুই সপ্তাহ পর বুধবার ভারত পাকিস্তানের ওপর এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের অংশে বেশ কয়েকটি হামলা চালায়। ভারত এই অভিযানের নাম দেয় ‘অপারেশন সিন্দুর।’ এরপর থেকে সংঘাতের এলাকা আগের চেয়ে অনেক বিস্তৃত হয়েছে। উভয় পক্ষই একে অপরের ভূখণ্ডের গভীরে হামলা চালিয়েছে।

মাত্র দুদিন আগে জেডি ভ্যান্স ভারত-পাকিস্তান সংঘাত বৃদ্ধি পেলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব খাটো করে দেখিয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার ফক্স নিউজকে ভ্যান্স বলেছিলেন, ‘আমরা এই দুই পক্ষকে উত্তেজনা কমাতে উৎসাহিত করার চেষ্টা করতে পারি, কিন্তু এটি এমন একটি যুদ্ধ যার সঙ্গে আমাদের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই এবং যা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আমেরিকার নেই। আমরা এর মধ্যে জড়াব না।’

ভ্যান্সের এই অবস্থান পরিবর্তনই প্রমাণ করে যে, দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে সংঘাত বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কতটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা সিএনএনকে বলেছেন, শুক্রবার সংঘাত কতটা বাড়তে পারে সে সম্পর্কে উদ্বেগজনক গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার পর স্টেট ডিপার্টমেন্ট মনে করেছে, দুই পক্ষের আলোচনায় আরও বড় ভূমিকা পালন করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না।

যুদ্ধবিরতি কি টিকবে?

ভারত ও পাকিস্তান আপাতত যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে সরে এলেও, যুদ্ধবিরতি টিকবে কিনা তা দেখার বিষয়। শনিবার ভারত-নিয়ন্ত্রিত এবং পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত উভয় কাশ্মীরেই বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাওয়ার পর ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি পাকিস্তানকে বারবার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করেছেন। পাকিস্তানও ভারতের বিরুদ্ধে লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে। তবে দেশটি জোর দিয়ে বলেছে যে তারা ‘যুদ্ধবিরতি আন্তরিকভাবে মেনে চলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

পর্যটকদের ওপর হামলার পর উভয় পক্ষ আরও কিছু প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা ঘোষণা করেছিল। এর মধ্যে ছিল ভিসা স্থগিত করা, বাণিজ্য নিষিদ্ধ করা এবং ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ পানিবণ্টন চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া। এসব পদক্ষেপ প্রত্যাহার হবে কিনা তা এখনো স্পষ্ট নয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পাকিস্তানের সামরিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ভারত: ব্রিটিশ বিশ্লেষক

কী লিখেছিলেন মাহফুজ আলম, ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ডিলিট করলেন কেন

প্রশাসনিক আদেশে জামায়াত নিষিদ্ধ ভুল, আ.লীগের কার্যক্রম বন্ধ সঠিক: বিএনপি

এবার ‘পাকিস্তানপন্থার’ বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন আসিফ মাহমুদ

প্রথম ভাষণে গাজা প্রসঙ্গে যা বললেন পোপ লিও চতুর্দশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত