জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ

বয়স, পেশা ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বয়োজ্যেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বাংলা সিনেমার অভিনয়ের সম্রাট, মহানায়ক উত্তম কুমারের একনিষ্ঠ অনুরাগী। তারা একান্তে উত্তমকে বাঁচিয়ে রেখেছেন স্মৃতির মণিকোঠায়। তারা উপলব্ধি করেছেন, সংবেদনশীল ও মানব দরদি উত্তম কুমার তাঁর সিনেমায় জীবনের থেকেও বড়, চিরন্তন এক প্রেমিক-প্রতিমূর্তি গড়েছিলেন অভিনয়ের মাধ্যমে এবং তিনি তা করেছিলেন জেনে-বুঝেই। দেখে মনে হয়, একাডেমিশিয়ানরা সিনেমায় উত্তম কুমারের অভিনয়ের ব্যাপারটা পূর্বধারণা বা ঘরানার নিরিখে দেখলেও দর্শক তা দেখেছে হৃদয় দিয়ে। তাই আমাদের সিনেমা পণ্ডিতেরা উত্তম কুমারকে বুঝে উঠতে পারেননি, বোঝার চেষ্টাও করেননি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংগঠক ও চলচ্চিত্র আন্দোলনের নেতাদের মনে এ বিষয়ে সচেতনতা ও সুস্পষ্ট বোঝাপড়া সৃষ্টি না হওয়ার কারণেই সম্ভবত পাশের বাড়ির অভিনয় শিল্পীর বিরাটত্বের বিষয়টি তাদের কাছে যোগ্য মর্যাদা পায়নি বা অবহেলিতই থেকে গেছে।
অভিনয়ের বরপুত্র উত্তম কুমারের ৪১ তম প্রয়াণবার্ষিকীতে এ কথা বলতেই হচ্ছে, কালেভদ্রে সংবাদপত্রের বিনোদন পাতা ছাড়া, বাংলাদেশের একাডেমিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিমণ্ডলে বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মহানায়ক’ উত্তম কুমারকে নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হয় না বললেই চলে। অনলাইনে কিছু গ্রুপ অ্যাকটিভিটি থাকলেও উত্তম-চর্চার কোনো সাংগঠনিক কাঠামোর ভিত্তি বা তৎপরতা বাংলাদেশে এখনো দৃশ্যমান নয়। এর কারণ হতে পারে ঐতিহাসিক ও খণ্ডিত ভৌগোলিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপট, বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষভাবে উত্তম কুমার সম্পর্কে জানাশোনার সুযোগ ও সময় দুটোই কম পেয়েছে।
এখানকার চলচ্চিত্রের অভিনয়ের মান এখনো অপরিপক্ব অবস্থায় রয়েছে। তা ছাড়া যাত্রা, পালাগান ও মঞ্চ অধ্যুষিত বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের অভিনয়ের স্বাতন্ত্র্যের বিষয়টি এখনো উপেক্ষিত। এমনকি সম্প্রতি যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র বিভাগ খোলা হয়েছে এবং সরকারিভাবে যে ‘বাংলাদেশ সিনেমা ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট’ (বিসিটিআই) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর কারিকুলামেও অভিনয়ের বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব পায়নি এখনো। একদল একাডেমিশিয়ানের মনে এ ধারণাও বদ্ধমূল হয়তো—উত্তম কুমার বাণিজ্যিক সিনেমার অভিনেতা, তিনি ইউরোপীয় সিনেমার কেউ নন, তাঁকে নিয়ে এত মাতামাতির কী আছে? তাঁরা উপমহাদেশের চলচ্চিত্র আলোচনার ক্ষেত্রে সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক–এর বাইরে ইদানীং অপর্ণা সেন-ঋতুপর্ণ ঘোষ-মণিকাউল-মীরা নায়ার, আর নানামুখী আলোচনায় স্মিতা পাতিল-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-শাবানা আজমি পর্যন্ত আলোচনা করতে রাজি আছেন, এর বাইরে একদম নয়।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলের যখন এই ঘোর অমানিশা, তখন প্রশ্ন হলো এ দেশের মানুষের কাছে উত্তম কুমার এত জনপ্রিয় হলেন কীভাবে? বিশেষত, মৃত্যুর চার দশক পরও কীভাবে তিনি দর্শক হৃদয়ে অক্ষয়–অব্যয় আসন ধরে রাখতে পারলেন? মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশের উত্তম কুমার দেশভাগ-পরবর্তী সময়ের চলচ্চিত্রের প্রতিনিধি। তখন সার্বিকভাবে দেশভাগের পর বেদনা-জর্জরিত ছিল বাংলার উভয় অংশের মানুষের মন। দেশভাগের দগদগে ক্ষত এবং আর্থিক সমস্যা তখন বিভক্ত দুই বাংলার ঘরে ঘরে। সাধারণ দর্শক এই দৈন্য ও দুর্দশার বিপরীতে বাংলা ছবির পর্দায় তাদেরই জীবনের ছোট ছোট সাফল্য ও অবদমিত আকাঙ্ক্ষার চিত্রায়ণ দেখতে পায়। বিগত শতাব্দীর সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই এমন সব চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল অভিনয় করতে শুরু করেন উত্তম কুমার। পশ্চিমবঙ্গের মতো পূর্ববঙ্গের দর্শকেরও তখন মনে হয়, ছেলেটা তাদের মনের কথা বলছে। যুবক-যুবতীরা ভাবত উত্তমের ফ্যাশনের কথা। পত্রিকার কাটতি হতো উত্তম কুমার কী খাচ্ছেন, কার সঙ্গে প্রেম করছেন—এসব খবর ছেপে! তা নিয়ে তুমুল তর্ক হতো চায়ের স্টলে, বাঙালির আড্ডায়। নরসুন্দরের দোকানের দেয়ালে টানানো থাকত খবরের কাগজে ছাপা উত্তম কুমারের ছবি। স্কুল–কলেজে, বাজারে–খেয়াঘাটে, রান্নাঘরে, ড্রয়িংরুমে—সর্বত্র সবারই মনে হতো, যদি উত্তম হতে পারতাম! এভাবেই উত্তম কুমার চলচ্চিত্র তারকার গণ্ডি টপকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ঘরে ঢোকেন এবং হয়ে ওঠেন মধ্যবিত্ত বাঙালির স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিরূপ। এভাবেই বাঙালি দর্শকের মনে রোমান্টিক শিল্পী উত্তম কুমারের জাদুকরী প্রভাব বলয়ের সৃষ্টি হয়।
সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উত্তমের উত্থান হলেও চেনা উত্তম কুমারকে পাড়ার অভিনেতা থেকে ‘মহানায়ক উত্তম কুমার’ হয়ে উঠতে কিন্তু বিপুল পরিশ্রম করতে হয়েছে! ছোটবেলার খেলার সাথি ও প্রাণাধিক প্রিয় দিদির মৃত্যুর নিদারুণ শোক আজীবন বয়ে বেড়ানো ছাড়াও তাঁকে দীর্ঘ স্নায়ুক্ষয়ী সংগ্রামের দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়। সংগীত রচনা থেকে অশ্বারোহণ, ঘরের বেড়া দেওয়া থেকে সাঁতার কাটা, জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সবই শিখতে হয়েছিল জীবন থেকে। এই পরিক্রমায় তাঁকে সময়ের অভিঘাত পর্যবেক্ষণ ও মর্মস্থ করতে হয়, মাতৃভাষা ছাড়াও হিন্দি ও ইংরেজিসহ অনেক ভাষাও মজ্জাগত করতে হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, অনেকের চক্রান্তে তাঁর প্রযোজনায় নির্মিত হিন্দি ছবি ছোটিসি মুলাকাত (১৯৬৭)–এ অপরিমেয় ব্যয়ের পরও ছবিটি ফ্লপ হয়। তিনি প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে যান। টাকার জন্য তিনি তখন বিভিন্ন মঞ্চেও গান গেয়েছেন।
বিশেষত সংগীতের প্রতি উত্তমের ছিল অসীম একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও ভালোবাসা। প্রাথমিক জীবনে গানের শিক্ষক হিসেবেই কিন্তু তিনি টিকে থাকার চেষ্টা করেছিলেন। স্ত্রী গৌরী দেবীর সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও হয়েছিল এই গান শেখানোর মধ্য দিয়ে। অসামান্য গলা আর অসাধারণ গায়ন রীতির অধিকারী ছিলেন তিনি। অভিনয় যদি তিনি না করতেন, তাহলে উত্তম কুমার হয়তো হতেন উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী। উত্তম গান শিখেছিলেন ক্ল্যাসিক সংগীত শিল্পী নিদান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। প্রায় ৩০টি রাগের ওপর তিনি দীক্ষা দিয়েছিলেন উত্তম কুমারকে। উত্তমকে তিনি স্পেশাল সারগাম প্র্যাকটিস করাতেন, যাতে সুরের ওপর তিনি স্পষ্ট দখল প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। শৈশব থেকেই মঞ্চনাটক, গান, আর যাত্রাপালার ভক্ত ছিলেন; ছিলেন সম্পৃক্তও। উত্তম কুমার একসময় স্টার থিয়েটারে নিয়মিত অভিনয় করতেন। তাঁর অভিনীত শ্যামলী (১৯৫৩) নাটকটিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। যৌবনে ভারতবর্ষ পরাধীন থাকাকালের উন্মাতাল বৈশ্বিক রাজনীতি এবং আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতি তাঁর মনে স্বাজাত্যবোধ, সাম্য ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা উসকে দিয়েছিল। তাই পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও মাতৃভূমির স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিতে শুরু করেন উত্তম কুমার। তরুণ বয়স থেকেই রচনা করতে শুরু করেন দেশাত্মবোধক গান ও বিপ্লবী গণসংগীত। এসব গানে সুর দিয়ে স্বকণ্ঠে ও সদলবলে গাইতেন সভা-সমিতিতে, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মিছিলেও অংশ নিতেন। স্বদেশি ও স্বাধীনতা আন্দোলন এবং কুৎসিত সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে গিয়ে আত্মগোপনে থাকতে এমনকি জীবনের ঝুঁকি নিতেও দেখা গেছে তাঁকে। দেশের মানুষ এই রোমান্টিক-বিপ্লবী ও সংগ্রামী উত্তমকে ভালোবাসত।
ভাবলে অবাক লাগে ১৯৪৭ সালে মুক্তি না-পাওয়া হিন্দি সিনেমা মায়াডোর-এ মাত্র পাঁচ-সিকা পারিশ্রমিকে মূকাভিনয়ের মাধ্যমে একস্ট্রা শিল্পী হিসেবে অভিনয় জীবন শুরু করেন উত্তম কুমার। সে ছবি কখনো আলোর মুখ দেখেনি। এরই মধ্যে সাহসী ছেলেটি বাড়ি থেকে পালিয়ে পাড়ার মেয়ে ও নিজের গানের ছাত্রী গৌরী দেবীকে বিয়ে করে ফেললেন। সিনেমাপাড়ার ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’ (এফএমজি) তখনো অসফলতার ধারাবাহিকতায় ছবিতে নাম পাল্টাচ্ছেন একের পর এক। প্রথমে অরুণ কুমার থেকে অরূপ কুমার, তারপর অরূপ কুমার থেকে উত্তম কুমার। অতঃপর পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করলেন বসু পরিবার (১৯৫২) ছবিতে। অভিনয়ের জন্য এবার প্রশংসিত হলেন। ভাগ্যদেবী তাঁর প্রতি সুপ্রসন্ন হলেন প্রথমবারের মতো। সেখান থেকেই একটু একটু করে জনপ্রিয়তার শিখরে ওঠার শুরু। ক্যারিয়ারের ৩৩ বছরে অন্তত ৫০টি অসাধারণ মানের ছবিসহ বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে প্রায় আড়াই শ ছবি উপহার দিয়ে হয়ে উঠলেন একাধারে চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনয় শিল্পী, প্রযোজক, পরিচালক, সংগীত পরিচালক ও সংগঠক। এভাবে নিজেই বাংলা চলচ্চিত্রের এক ইন্ডাস্ট্রিতে রূপান্তরিত হলেন।
উত্তম কুমার তাঁর যুগের এবং বাংলা সিনেমার সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক। মঞ্চ ও যাত্রার ফর্ম ভেঙে দিয়ে, তিনিই প্রথম বাংলা চলচ্চিত্রে পরিশীলিত অভিনয় রীতির প্রবর্তন করেন। বিচিত্র ছিল তাঁর অভিনয় প্রতিভা। সিনেমার চিত্রভাষা বুঝতেন তিনি। বাঙালির মন ও রুচি ভালো করেই বুঝতেন। তিনি জানতেন বাঙালি-মানস প্রেমের জলে হাবুডুবু খায় ঠিকই, কিন্তু প্রকাশ্যে বিবাহপূর্ব মেলামেশা অনুমোদন করে না কিছুতেই। দৈহিক সম্পর্ক দেখালে ‘ভদ্র-বাঙালি’ পরিবার নিয়ে সিনেমা দেখতে আসে না। কিন্তু লুকিয়ে বাইজি নাচের আসরে তার নিত্য আসা যাওয়া। তিনি আরও জানতেন, বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে প্রেমিকের বাহ্যিক আচরণ অভিভাবকসুলভ। তাই শারীরিক সান্নিধ্য ছাড়াই তিনি প্রেমের রসায়ন জমিয়ে দিলেন বাংলা সিনেমার পর্দায়। আর মধ্যবিত্তের অবদমিত আকাঙ্ক্ষা, বেদনা ও সংযম পরিশীলন; শিক্ষা ও রুচিশীলতার চর্চা; ইতিহাস, দেশাত্মবোধ ও রাজনৈতিক চেতনার পরিচর্যা ও পরিমিতিবোধের লালন—এসবই ছিল উত্তম কুমারের অভিনয়ের মৌলিক উপাদান! তাই তো তাঁর অভিনয়ে প্রতিফলন ঘটল বাঙালির ভদ্রতার মুখোশ ও আদর্শ—দুটোরই।
উত্তম কুমার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে ও শ্যামল মিত্রের গানে অবলীলায় ঠোঁট মিলিয়েছেন। কারণ, গানটা তিনি বুঝতেন। জীবনের শুরুতেই গানের সঙ্গে বোঝা-পড়াটা তাঁর হয়েছিল একবারে অন্তর্গতভাবেই। আর এসব অমর গান বাংলাদেশের মানুষের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া করে তোলে। রোমান্টিক প্রেমের ছবির পাশাপাশি প্রচুর ভিন্ন স্বাদের ছবিতেও অভিনয় করেন তিনি। কমেডি ও ট্র্যাজেডিতেও ছিলেন সমান পারদর্শী। মানুষের সঙ্গে একদম তার মতো মিশে যেতে পারতেন। যে চরিত্রে অভিনয় করতেন, মনে হতো তিনি সেই মানুষটাই। প্রতিটি চরিত্রের জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতেন। চরিত্রটির মতো হয়ে ওঠার জন্য আর তাঁর সেন্স অব টাইমিং ছিল অসাধারণ। অভিনয়ের এই নিষ্ঠার জন্য মূল্য দিতে গিয়ে ১৯৭১ সালে নকশালদের হাতে খুন হতে হতেও বেঁচে যান। কিন্তু এ জন্য তিনি ভয় পেয়ে অভিনয় ছেড়ে দেননি। কিছুদিন লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে বিপুল সাহসের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসেন। বন্যা-ঝঞ্ঝা-খরা ও নিপীড়িত বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের কাছে তাই এই হার না-মানা সংগ্রামী উত্তম কুমার ভীষণ পছন্দের; একান্ত আপনার।
বাংলাদেশের পাবনার মেয়ে সুচিত্রা সেন এবং ঢাকার মেয়ে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়সহ সিনেমায় উত্তমের নায়িকা হয়েছিলেন সর্বমোট ৪৬ জন। প্রথম ছয় বছরে নয়জন বয়োজ্যেষ্ঠ নায়িকার সঙ্গে উত্তমের অভিনয় তাঁর ক্যারিয়ারে নেতিবাচক প্রভাব ফেললেও এরপরই শুরু হয় কিংবদন্তি উত্তম-সুচিত্রা যুগের। তরুণী নায়িকা সুচিত্রা সেনকে পাশে পেয়ে অভিনয়ে মনপ্রাণ ঢেলে দেন উত্তম। তিনি নিজেই বলেন—‘সুচিত্রা পাশে না থাকলে আমি কখনোই উত্তম কুমার হতে পারতাম না।’ বাংলাদেশের মানুষ এ জন্য এখনো গর্ববোধ করে এবং তারা কথাটা বিশ্বাসও করে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই উত্তম-সুচিত্রা জুটি এক অপার বিস্ময়ের নাম।
তাঁদের প্রথম ছবি সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩)-এর পর থেকেই বাংলা চলচ্চিত্রের এক জাদুকরী রসায়নের নাম হয়ে ওঠেন উত্তম-সুচিত্রা। এ যেন প্রেমিক-প্রেমিকা দুজনের একসঙ্গে স্ট্রাগল করা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাপোষণ করা, দুজন দুজনার আশ্রয় হয়ে ওঠা—বাঙালি রুচির এমন ধারণার সমার্থক চিরকালীন রোমান্টিক তারকা জুটি! বাংলা সিনেমায় রোমান্টিসিজমের ধারাই পাল্টে দেন তাঁরা। অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪), সবার উপরে (১৯৫৫), শাপ মোচন (১৯৫৫), শিল্পী (১৯৫৬), সাগরিকা (১৯৫৬), পথে হলো দেরী (১৯৫৭), হারানো সুর (১৯৫৭), রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮), সপ্তপদী (১৯৬১), আলো আমার আলো (১৯৭১)-সহ একে একে ৩১টি ছবিতে অভিনয় করে তাঁরা হয়ে যান বাংলা চলচ্চিত্রের চিরকালীন রোমান্টিক আইকন। বাংলাদেশের দর্শকের কাছে উত্তম-সুচিত্রা তাই এক ও অদ্বিতীয়, অবিচ্ছেদ্য, চিরসবুজ ও চিরতরুণ জুটির নাম। উত্তমকে ছাড়া সুচিত্রাকে কিংবা সুচিত্রাকে ছাড়া উত্তমকে বাঙালি দর্শক একেবারেই দেখতে চান না। কারণ, দুর্দিনে বাঙালিকে যে হাসিয়ে-কাঁদিয়ে উত্তেজনায় কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন এঁরা! তাই তো উত্তমের মৃত্যুর দীর্ঘ চার দশক পর এখনো কান পাতলে শোনা যায় পর্দায় উত্তম-সুচিত্রা জুটির বিচ্ছেদ-ব্যথায় কাতর প্রৌঢ় বাঙালির দীর্ঘশ্বাস।
সমকালীন অন্য ডাকসাইটে নায়িকাদের মধ্যে উত্তম কুমারের হৃদয়ের রানি ছিলেন আরেক কিংবদন্তিতুল্য নায়িকা সুপ্রিয়া দেবী। সাজগোজ নিয়ে আধুনিকা সুপ্রিয়ার ছিল না কোনো মাথাব্যথা, ছিল পড়াশোনার নেশা। উত্তম কুমারকে সাম্প্রতিক সাহিত্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলতেন তিনি। নির্মল দের বসু পরিবার (১৯৫২) ছবিতে উত্তম তাঁর বন্ধুর বোন বেণু ওরফে সুপ্রিয়া দেবীকে পেয়েছিলেন সহ–অভিনেত্রী হিসেবে। পরে তিনিই পর্দায় উত্তমের অন্যতম সফল সিনেমা-জুটি এবং ব্যক্তি ও দাম্পত্যজীবনে প্রেরণাদাত্রী হয়ে ওঠেন। বাস্তব জীবনেও তাঁরা ছিলেন সত্যিকারের জুটি। উত্তম-সুপ্রিয়া উত্তরায়ণ (১৯৬৩), কাল তুমি আলেয়া (১৯৬৬), বন পলাশীর পদাবলী (১৯৭৩), বাঘ বন্দীর খেলা (১৯৭৫), সন্ন্যাসী রাজা (১৯৭৫) প্রভৃতি তুমুল জনপ্রিয় ছবিতে জুটি বেঁধে অভিনয় করেন। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে উত্তম কুমারের সঙ্গে ঢাকার মেয়ে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের জুটিও জনপ্রিয় হয়। তাঁর অভিনয়গুণে মুগ্ধ ছিলেন মহানায়ক। হাত বাড়ালেই বন্ধু (১৯৬০), দুই ভাই (১৯৬১), মোমের আলো (১৯৬৮), নিশি পদ্ম (১৯৭০) ইত্যাদি সিনেমায় তাঁদের জুটিও প্রশংসিত হয়। ধন্যি মেয়ে (১৯৭১), মৌচাক (১৯৭৫)-এর মত কমেডি ছবিতে সাবিত্রী-উত্তম জুটির অভিনয় রীতিমতো কিংবদন্তি হয়ে আছে।
পঞ্চাশের দশকে যখন চলচ্চিত্রের আকাশ রাঙিয়ে দিতে শুরু করেন, তখন থেকেই বাংলাদেশের মানুষের কাছেও আপন হয়ে আছেন উত্তম কুমার। কারণ, ১৯৪৭-এ দেশভাগ হলেও এ দেশের সিনেমা হলগুলোতে তখনো ভারতীয় বাংলা সিনেমা প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল না। পরে পাকিস্তানে ভারত-বিদ্বেষ প্রকট ও নিষেধাজ্ঞা জারি হলে সেই সুযোগ সীমিত হয়ে হয়ে পড়ে। কিন্তু তত দিনে উত্তম-সুচিত্রা জুটির স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে বাঙালি দর্শকের ঘরে ঘরে, অন্দর মহলে। উত্তমের সাবলীল অভিনয়ই তাঁর প্রতি মানুষের এই আকর্ষণের চুম্বকশক্তি। এখনো বাংলা সিনেমার পুরোনো দর্শকেরা তাই উত্তম কুমারকেই খুঁজে ফেরে। সিনেমা হলে ভিএইচএস ক্যাসেটে, সিডি/ডিভিডিতে, ইন্টারনেটে যে ফর্মেই হোক, বাংলাদেশে ‘উত্তমকুমারের সিনেমা’ দেখার জোয়ার কমেনি কখনো। এমনকি করোনাকালীন লকডাউনের সময়েও ওটিটি প্ল্যাটফর্মে উত্তম কুমারের দর্শক বেড়েছে; তারা ঘুরেফিরে বারবারই দেখছেন উত্তম কুমার অভিনীত ছবি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও চলচ্চিত্রের বন্দিদশা কিন্তু রয়ে গেছে আগের মতোই। ছিটেফোঁটা ছাড়া ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অবাধ চলচ্চিত্র বিনিময় বন্ধ রয়েছে যথারীতি আগের মতোই। বাণিজ্যিক স্বার্থের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের সিনেমা হলে ভারতীয় বাংলা ছবিই প্রদর্শিত হচ্ছে না, আর পুরোনো দিনের সিনেমা তো একদমই নিষিদ্ধ বস্তু। কিন্তু ওই বস্তুর প্রতিই বাঙালির অমোঘ আকর্ষণের পেছনের কারণ সেই উত্তম কুমারই। আকাশ সংস্কৃতি আর অন্তর্জালের দুনিয়া আজ সব বাধা-বিপত্তি বানের জলের মতো ঘুচিয়ে দিয়েছে। রাত জেগে, নিজের ঘরে বসে অথবা হাতের তালুতে অবাধে উত্তম কুমারের সংবর্ধনা রচনা করছে বাংলাদেশের মানুষ। তাঁর ছবি গোগ্রাসে গিলছে মধ্যবয়সী নারী ও পুরুষ থেকে নতুন প্রজন্ম পর্যন্ত সবাই। শুনেছি বাংলাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও এখন ‘টেলিভিশনের খবরে, সিনেমার পর্দায়, বাস্তবে—সর্বত্রই মানুষ প্রতিনিয়ত জটিল ও নিম্ন রুচির কনটেন্ট আর অশ্লীলতা ও ভায়োলেন্স দেখানো হয়, যা দর্শকের মনে স্বস্তি দিতে পারে না। বিশেষ করে, মানুষ যখন দৈনন্দিন জীবনের জটিলতায় বিধ্বস্ত, তখন সে রূঢ়-বাস্তবতা থেকে পালিয়ে মুক্তি পেতে চায়। উত্তমের ছবিতে সেই স্বস্তির সন্ধান আছে, আজকের বাঙালি নির্বিশেষে তাই ফিরে যেতে চায় সেই রোমান্টিকতার জগতে! বাংলা সিনেমার রোমান্টিক নায়ক হিসেবে তাই এখনো উত্তম কুমারই সবার পছন্দ। প্রয়াণ দিবসে তাই আমিও মহানায়ক উত্তম কুমারকে জানাই প্রাণের প্রণতি।
জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ: কবি, গবেষক ও চলচ্চিত্রকার
আরও পড়ুন

বয়স, পেশা ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বয়োজ্যেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বাংলা সিনেমার অভিনয়ের সম্রাট, মহানায়ক উত্তম কুমারের একনিষ্ঠ অনুরাগী। তারা একান্তে উত্তমকে বাঁচিয়ে রেখেছেন স্মৃতির মণিকোঠায়। তারা উপলব্ধি করেছেন, সংবেদনশীল ও মানব দরদি উত্তম কুমার তাঁর সিনেমায় জীবনের থেকেও বড়, চিরন্তন এক প্রেমিক-প্রতিমূর্তি গড়েছিলেন অভিনয়ের মাধ্যমে এবং তিনি তা করেছিলেন জেনে-বুঝেই। দেখে মনে হয়, একাডেমিশিয়ানরা সিনেমায় উত্তম কুমারের অভিনয়ের ব্যাপারটা পূর্বধারণা বা ঘরানার নিরিখে দেখলেও দর্শক তা দেখেছে হৃদয় দিয়ে। তাই আমাদের সিনেমা পণ্ডিতেরা উত্তম কুমারকে বুঝে উঠতে পারেননি, বোঝার চেষ্টাও করেননি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংগঠক ও চলচ্চিত্র আন্দোলনের নেতাদের মনে এ বিষয়ে সচেতনতা ও সুস্পষ্ট বোঝাপড়া সৃষ্টি না হওয়ার কারণেই সম্ভবত পাশের বাড়ির অভিনয় শিল্পীর বিরাটত্বের বিষয়টি তাদের কাছে যোগ্য মর্যাদা পায়নি বা অবহেলিতই থেকে গেছে।
অভিনয়ের বরপুত্র উত্তম কুমারের ৪১ তম প্রয়াণবার্ষিকীতে এ কথা বলতেই হচ্ছে, কালেভদ্রে সংবাদপত্রের বিনোদন পাতা ছাড়া, বাংলাদেশের একাডেমিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিমণ্ডলে বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মহানায়ক’ উত্তম কুমারকে নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হয় না বললেই চলে। অনলাইনে কিছু গ্রুপ অ্যাকটিভিটি থাকলেও উত্তম-চর্চার কোনো সাংগঠনিক কাঠামোর ভিত্তি বা তৎপরতা বাংলাদেশে এখনো দৃশ্যমান নয়। এর কারণ হতে পারে ঐতিহাসিক ও খণ্ডিত ভৌগোলিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপট, বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষভাবে উত্তম কুমার সম্পর্কে জানাশোনার সুযোগ ও সময় দুটোই কম পেয়েছে।
এখানকার চলচ্চিত্রের অভিনয়ের মান এখনো অপরিপক্ব অবস্থায় রয়েছে। তা ছাড়া যাত্রা, পালাগান ও মঞ্চ অধ্যুষিত বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের অভিনয়ের স্বাতন্ত্র্যের বিষয়টি এখনো উপেক্ষিত। এমনকি সম্প্রতি যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র বিভাগ খোলা হয়েছে এবং সরকারিভাবে যে ‘বাংলাদেশ সিনেমা ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট’ (বিসিটিআই) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর কারিকুলামেও অভিনয়ের বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব পায়নি এখনো। একদল একাডেমিশিয়ানের মনে এ ধারণাও বদ্ধমূল হয়তো—উত্তম কুমার বাণিজ্যিক সিনেমার অভিনেতা, তিনি ইউরোপীয় সিনেমার কেউ নন, তাঁকে নিয়ে এত মাতামাতির কী আছে? তাঁরা উপমহাদেশের চলচ্চিত্র আলোচনার ক্ষেত্রে সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক–এর বাইরে ইদানীং অপর্ণা সেন-ঋতুপর্ণ ঘোষ-মণিকাউল-মীরা নায়ার, আর নানামুখী আলোচনায় স্মিতা পাতিল-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-শাবানা আজমি পর্যন্ত আলোচনা করতে রাজি আছেন, এর বাইরে একদম নয়।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলের যখন এই ঘোর অমানিশা, তখন প্রশ্ন হলো এ দেশের মানুষের কাছে উত্তম কুমার এত জনপ্রিয় হলেন কীভাবে? বিশেষত, মৃত্যুর চার দশক পরও কীভাবে তিনি দর্শক হৃদয়ে অক্ষয়–অব্যয় আসন ধরে রাখতে পারলেন? মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশের উত্তম কুমার দেশভাগ-পরবর্তী সময়ের চলচ্চিত্রের প্রতিনিধি। তখন সার্বিকভাবে দেশভাগের পর বেদনা-জর্জরিত ছিল বাংলার উভয় অংশের মানুষের মন। দেশভাগের দগদগে ক্ষত এবং আর্থিক সমস্যা তখন বিভক্ত দুই বাংলার ঘরে ঘরে। সাধারণ দর্শক এই দৈন্য ও দুর্দশার বিপরীতে বাংলা ছবির পর্দায় তাদেরই জীবনের ছোট ছোট সাফল্য ও অবদমিত আকাঙ্ক্ষার চিত্রায়ণ দেখতে পায়। বিগত শতাব্দীর সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই এমন সব চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল অভিনয় করতে শুরু করেন উত্তম কুমার। পশ্চিমবঙ্গের মতো পূর্ববঙ্গের দর্শকেরও তখন মনে হয়, ছেলেটা তাদের মনের কথা বলছে। যুবক-যুবতীরা ভাবত উত্তমের ফ্যাশনের কথা। পত্রিকার কাটতি হতো উত্তম কুমার কী খাচ্ছেন, কার সঙ্গে প্রেম করছেন—এসব খবর ছেপে! তা নিয়ে তুমুল তর্ক হতো চায়ের স্টলে, বাঙালির আড্ডায়। নরসুন্দরের দোকানের দেয়ালে টানানো থাকত খবরের কাগজে ছাপা উত্তম কুমারের ছবি। স্কুল–কলেজে, বাজারে–খেয়াঘাটে, রান্নাঘরে, ড্রয়িংরুমে—সর্বত্র সবারই মনে হতো, যদি উত্তম হতে পারতাম! এভাবেই উত্তম কুমার চলচ্চিত্র তারকার গণ্ডি টপকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ঘরে ঢোকেন এবং হয়ে ওঠেন মধ্যবিত্ত বাঙালির স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিরূপ। এভাবেই বাঙালি দর্শকের মনে রোমান্টিক শিল্পী উত্তম কুমারের জাদুকরী প্রভাব বলয়ের সৃষ্টি হয়।
সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উত্তমের উত্থান হলেও চেনা উত্তম কুমারকে পাড়ার অভিনেতা থেকে ‘মহানায়ক উত্তম কুমার’ হয়ে উঠতে কিন্তু বিপুল পরিশ্রম করতে হয়েছে! ছোটবেলার খেলার সাথি ও প্রাণাধিক প্রিয় দিদির মৃত্যুর নিদারুণ শোক আজীবন বয়ে বেড়ানো ছাড়াও তাঁকে দীর্ঘ স্নায়ুক্ষয়ী সংগ্রামের দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়। সংগীত রচনা থেকে অশ্বারোহণ, ঘরের বেড়া দেওয়া থেকে সাঁতার কাটা, জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সবই শিখতে হয়েছিল জীবন থেকে। এই পরিক্রমায় তাঁকে সময়ের অভিঘাত পর্যবেক্ষণ ও মর্মস্থ করতে হয়, মাতৃভাষা ছাড়াও হিন্দি ও ইংরেজিসহ অনেক ভাষাও মজ্জাগত করতে হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, অনেকের চক্রান্তে তাঁর প্রযোজনায় নির্মিত হিন্দি ছবি ছোটিসি মুলাকাত (১৯৬৭)–এ অপরিমেয় ব্যয়ের পরও ছবিটি ফ্লপ হয়। তিনি প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে যান। টাকার জন্য তিনি তখন বিভিন্ন মঞ্চেও গান গেয়েছেন।
বিশেষত সংগীতের প্রতি উত্তমের ছিল অসীম একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও ভালোবাসা। প্রাথমিক জীবনে গানের শিক্ষক হিসেবেই কিন্তু তিনি টিকে থাকার চেষ্টা করেছিলেন। স্ত্রী গৌরী দেবীর সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও হয়েছিল এই গান শেখানোর মধ্য দিয়ে। অসামান্য গলা আর অসাধারণ গায়ন রীতির অধিকারী ছিলেন তিনি। অভিনয় যদি তিনি না করতেন, তাহলে উত্তম কুমার হয়তো হতেন উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী। উত্তম গান শিখেছিলেন ক্ল্যাসিক সংগীত শিল্পী নিদান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। প্রায় ৩০টি রাগের ওপর তিনি দীক্ষা দিয়েছিলেন উত্তম কুমারকে। উত্তমকে তিনি স্পেশাল সারগাম প্র্যাকটিস করাতেন, যাতে সুরের ওপর তিনি স্পষ্ট দখল প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। শৈশব থেকেই মঞ্চনাটক, গান, আর যাত্রাপালার ভক্ত ছিলেন; ছিলেন সম্পৃক্তও। উত্তম কুমার একসময় স্টার থিয়েটারে নিয়মিত অভিনয় করতেন। তাঁর অভিনীত শ্যামলী (১৯৫৩) নাটকটিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। যৌবনে ভারতবর্ষ পরাধীন থাকাকালের উন্মাতাল বৈশ্বিক রাজনীতি এবং আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতি তাঁর মনে স্বাজাত্যবোধ, সাম্য ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা উসকে দিয়েছিল। তাই পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও মাতৃভূমির স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিতে শুরু করেন উত্তম কুমার। তরুণ বয়স থেকেই রচনা করতে শুরু করেন দেশাত্মবোধক গান ও বিপ্লবী গণসংগীত। এসব গানে সুর দিয়ে স্বকণ্ঠে ও সদলবলে গাইতেন সভা-সমিতিতে, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মিছিলেও অংশ নিতেন। স্বদেশি ও স্বাধীনতা আন্দোলন এবং কুৎসিত সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে গিয়ে আত্মগোপনে থাকতে এমনকি জীবনের ঝুঁকি নিতেও দেখা গেছে তাঁকে। দেশের মানুষ এই রোমান্টিক-বিপ্লবী ও সংগ্রামী উত্তমকে ভালোবাসত।
ভাবলে অবাক লাগে ১৯৪৭ সালে মুক্তি না-পাওয়া হিন্দি সিনেমা মায়াডোর-এ মাত্র পাঁচ-সিকা পারিশ্রমিকে মূকাভিনয়ের মাধ্যমে একস্ট্রা শিল্পী হিসেবে অভিনয় জীবন শুরু করেন উত্তম কুমার। সে ছবি কখনো আলোর মুখ দেখেনি। এরই মধ্যে সাহসী ছেলেটি বাড়ি থেকে পালিয়ে পাড়ার মেয়ে ও নিজের গানের ছাত্রী গৌরী দেবীকে বিয়ে করে ফেললেন। সিনেমাপাড়ার ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’ (এফএমজি) তখনো অসফলতার ধারাবাহিকতায় ছবিতে নাম পাল্টাচ্ছেন একের পর এক। প্রথমে অরুণ কুমার থেকে অরূপ কুমার, তারপর অরূপ কুমার থেকে উত্তম কুমার। অতঃপর পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করলেন বসু পরিবার (১৯৫২) ছবিতে। অভিনয়ের জন্য এবার প্রশংসিত হলেন। ভাগ্যদেবী তাঁর প্রতি সুপ্রসন্ন হলেন প্রথমবারের মতো। সেখান থেকেই একটু একটু করে জনপ্রিয়তার শিখরে ওঠার শুরু। ক্যারিয়ারের ৩৩ বছরে অন্তত ৫০টি অসাধারণ মানের ছবিসহ বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে প্রায় আড়াই শ ছবি উপহার দিয়ে হয়ে উঠলেন একাধারে চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনয় শিল্পী, প্রযোজক, পরিচালক, সংগীত পরিচালক ও সংগঠক। এভাবে নিজেই বাংলা চলচ্চিত্রের এক ইন্ডাস্ট্রিতে রূপান্তরিত হলেন।
উত্তম কুমার তাঁর যুগের এবং বাংলা সিনেমার সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক। মঞ্চ ও যাত্রার ফর্ম ভেঙে দিয়ে, তিনিই প্রথম বাংলা চলচ্চিত্রে পরিশীলিত অভিনয় রীতির প্রবর্তন করেন। বিচিত্র ছিল তাঁর অভিনয় প্রতিভা। সিনেমার চিত্রভাষা বুঝতেন তিনি। বাঙালির মন ও রুচি ভালো করেই বুঝতেন। তিনি জানতেন বাঙালি-মানস প্রেমের জলে হাবুডুবু খায় ঠিকই, কিন্তু প্রকাশ্যে বিবাহপূর্ব মেলামেশা অনুমোদন করে না কিছুতেই। দৈহিক সম্পর্ক দেখালে ‘ভদ্র-বাঙালি’ পরিবার নিয়ে সিনেমা দেখতে আসে না। কিন্তু লুকিয়ে বাইজি নাচের আসরে তার নিত্য আসা যাওয়া। তিনি আরও জানতেন, বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে প্রেমিকের বাহ্যিক আচরণ অভিভাবকসুলভ। তাই শারীরিক সান্নিধ্য ছাড়াই তিনি প্রেমের রসায়ন জমিয়ে দিলেন বাংলা সিনেমার পর্দায়। আর মধ্যবিত্তের অবদমিত আকাঙ্ক্ষা, বেদনা ও সংযম পরিশীলন; শিক্ষা ও রুচিশীলতার চর্চা; ইতিহাস, দেশাত্মবোধ ও রাজনৈতিক চেতনার পরিচর্যা ও পরিমিতিবোধের লালন—এসবই ছিল উত্তম কুমারের অভিনয়ের মৌলিক উপাদান! তাই তো তাঁর অভিনয়ে প্রতিফলন ঘটল বাঙালির ভদ্রতার মুখোশ ও আদর্শ—দুটোরই।
উত্তম কুমার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে ও শ্যামল মিত্রের গানে অবলীলায় ঠোঁট মিলিয়েছেন। কারণ, গানটা তিনি বুঝতেন। জীবনের শুরুতেই গানের সঙ্গে বোঝা-পড়াটা তাঁর হয়েছিল একবারে অন্তর্গতভাবেই। আর এসব অমর গান বাংলাদেশের মানুষের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া করে তোলে। রোমান্টিক প্রেমের ছবির পাশাপাশি প্রচুর ভিন্ন স্বাদের ছবিতেও অভিনয় করেন তিনি। কমেডি ও ট্র্যাজেডিতেও ছিলেন সমান পারদর্শী। মানুষের সঙ্গে একদম তার মতো মিশে যেতে পারতেন। যে চরিত্রে অভিনয় করতেন, মনে হতো তিনি সেই মানুষটাই। প্রতিটি চরিত্রের জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতেন। চরিত্রটির মতো হয়ে ওঠার জন্য আর তাঁর সেন্স অব টাইমিং ছিল অসাধারণ। অভিনয়ের এই নিষ্ঠার জন্য মূল্য দিতে গিয়ে ১৯৭১ সালে নকশালদের হাতে খুন হতে হতেও বেঁচে যান। কিন্তু এ জন্য তিনি ভয় পেয়ে অভিনয় ছেড়ে দেননি। কিছুদিন লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে বিপুল সাহসের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসেন। বন্যা-ঝঞ্ঝা-খরা ও নিপীড়িত বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের কাছে তাই এই হার না-মানা সংগ্রামী উত্তম কুমার ভীষণ পছন্দের; একান্ত আপনার।
বাংলাদেশের পাবনার মেয়ে সুচিত্রা সেন এবং ঢাকার মেয়ে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়সহ সিনেমায় উত্তমের নায়িকা হয়েছিলেন সর্বমোট ৪৬ জন। প্রথম ছয় বছরে নয়জন বয়োজ্যেষ্ঠ নায়িকার সঙ্গে উত্তমের অভিনয় তাঁর ক্যারিয়ারে নেতিবাচক প্রভাব ফেললেও এরপরই শুরু হয় কিংবদন্তি উত্তম-সুচিত্রা যুগের। তরুণী নায়িকা সুচিত্রা সেনকে পাশে পেয়ে অভিনয়ে মনপ্রাণ ঢেলে দেন উত্তম। তিনি নিজেই বলেন—‘সুচিত্রা পাশে না থাকলে আমি কখনোই উত্তম কুমার হতে পারতাম না।’ বাংলাদেশের মানুষ এ জন্য এখনো গর্ববোধ করে এবং তারা কথাটা বিশ্বাসও করে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই উত্তম-সুচিত্রা জুটি এক অপার বিস্ময়ের নাম।
তাঁদের প্রথম ছবি সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩)-এর পর থেকেই বাংলা চলচ্চিত্রের এক জাদুকরী রসায়নের নাম হয়ে ওঠেন উত্তম-সুচিত্রা। এ যেন প্রেমিক-প্রেমিকা দুজনের একসঙ্গে স্ট্রাগল করা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাপোষণ করা, দুজন দুজনার আশ্রয় হয়ে ওঠা—বাঙালি রুচির এমন ধারণার সমার্থক চিরকালীন রোমান্টিক তারকা জুটি! বাংলা সিনেমায় রোমান্টিসিজমের ধারাই পাল্টে দেন তাঁরা। অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪), সবার উপরে (১৯৫৫), শাপ মোচন (১৯৫৫), শিল্পী (১৯৫৬), সাগরিকা (১৯৫৬), পথে হলো দেরী (১৯৫৭), হারানো সুর (১৯৫৭), রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮), সপ্তপদী (১৯৬১), আলো আমার আলো (১৯৭১)-সহ একে একে ৩১টি ছবিতে অভিনয় করে তাঁরা হয়ে যান বাংলা চলচ্চিত্রের চিরকালীন রোমান্টিক আইকন। বাংলাদেশের দর্শকের কাছে উত্তম-সুচিত্রা তাই এক ও অদ্বিতীয়, অবিচ্ছেদ্য, চিরসবুজ ও চিরতরুণ জুটির নাম। উত্তমকে ছাড়া সুচিত্রাকে কিংবা সুচিত্রাকে ছাড়া উত্তমকে বাঙালি দর্শক একেবারেই দেখতে চান না। কারণ, দুর্দিনে বাঙালিকে যে হাসিয়ে-কাঁদিয়ে উত্তেজনায় কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন এঁরা! তাই তো উত্তমের মৃত্যুর দীর্ঘ চার দশক পর এখনো কান পাতলে শোনা যায় পর্দায় উত্তম-সুচিত্রা জুটির বিচ্ছেদ-ব্যথায় কাতর প্রৌঢ় বাঙালির দীর্ঘশ্বাস।
সমকালীন অন্য ডাকসাইটে নায়িকাদের মধ্যে উত্তম কুমারের হৃদয়ের রানি ছিলেন আরেক কিংবদন্তিতুল্য নায়িকা সুপ্রিয়া দেবী। সাজগোজ নিয়ে আধুনিকা সুপ্রিয়ার ছিল না কোনো মাথাব্যথা, ছিল পড়াশোনার নেশা। উত্তম কুমারকে সাম্প্রতিক সাহিত্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলতেন তিনি। নির্মল দের বসু পরিবার (১৯৫২) ছবিতে উত্তম তাঁর বন্ধুর বোন বেণু ওরফে সুপ্রিয়া দেবীকে পেয়েছিলেন সহ–অভিনেত্রী হিসেবে। পরে তিনিই পর্দায় উত্তমের অন্যতম সফল সিনেমা-জুটি এবং ব্যক্তি ও দাম্পত্যজীবনে প্রেরণাদাত্রী হয়ে ওঠেন। বাস্তব জীবনেও তাঁরা ছিলেন সত্যিকারের জুটি। উত্তম-সুপ্রিয়া উত্তরায়ণ (১৯৬৩), কাল তুমি আলেয়া (১৯৬৬), বন পলাশীর পদাবলী (১৯৭৩), বাঘ বন্দীর খেলা (১৯৭৫), সন্ন্যাসী রাজা (১৯৭৫) প্রভৃতি তুমুল জনপ্রিয় ছবিতে জুটি বেঁধে অভিনয় করেন। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে উত্তম কুমারের সঙ্গে ঢাকার মেয়ে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের জুটিও জনপ্রিয় হয়। তাঁর অভিনয়গুণে মুগ্ধ ছিলেন মহানায়ক। হাত বাড়ালেই বন্ধু (১৯৬০), দুই ভাই (১৯৬১), মোমের আলো (১৯৬৮), নিশি পদ্ম (১৯৭০) ইত্যাদি সিনেমায় তাঁদের জুটিও প্রশংসিত হয়। ধন্যি মেয়ে (১৯৭১), মৌচাক (১৯৭৫)-এর মত কমেডি ছবিতে সাবিত্রী-উত্তম জুটির অভিনয় রীতিমতো কিংবদন্তি হয়ে আছে।
পঞ্চাশের দশকে যখন চলচ্চিত্রের আকাশ রাঙিয়ে দিতে শুরু করেন, তখন থেকেই বাংলাদেশের মানুষের কাছেও আপন হয়ে আছেন উত্তম কুমার। কারণ, ১৯৪৭-এ দেশভাগ হলেও এ দেশের সিনেমা হলগুলোতে তখনো ভারতীয় বাংলা সিনেমা প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল না। পরে পাকিস্তানে ভারত-বিদ্বেষ প্রকট ও নিষেধাজ্ঞা জারি হলে সেই সুযোগ সীমিত হয়ে হয়ে পড়ে। কিন্তু তত দিনে উত্তম-সুচিত্রা জুটির স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে বাঙালি দর্শকের ঘরে ঘরে, অন্দর মহলে। উত্তমের সাবলীল অভিনয়ই তাঁর প্রতি মানুষের এই আকর্ষণের চুম্বকশক্তি। এখনো বাংলা সিনেমার পুরোনো দর্শকেরা তাই উত্তম কুমারকেই খুঁজে ফেরে। সিনেমা হলে ভিএইচএস ক্যাসেটে, সিডি/ডিভিডিতে, ইন্টারনেটে যে ফর্মেই হোক, বাংলাদেশে ‘উত্তমকুমারের সিনেমা’ দেখার জোয়ার কমেনি কখনো। এমনকি করোনাকালীন লকডাউনের সময়েও ওটিটি প্ল্যাটফর্মে উত্তম কুমারের দর্শক বেড়েছে; তারা ঘুরেফিরে বারবারই দেখছেন উত্তম কুমার অভিনীত ছবি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও চলচ্চিত্রের বন্দিদশা কিন্তু রয়ে গেছে আগের মতোই। ছিটেফোঁটা ছাড়া ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অবাধ চলচ্চিত্র বিনিময় বন্ধ রয়েছে যথারীতি আগের মতোই। বাণিজ্যিক স্বার্থের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের সিনেমা হলে ভারতীয় বাংলা ছবিই প্রদর্শিত হচ্ছে না, আর পুরোনো দিনের সিনেমা তো একদমই নিষিদ্ধ বস্তু। কিন্তু ওই বস্তুর প্রতিই বাঙালির অমোঘ আকর্ষণের পেছনের কারণ সেই উত্তম কুমারই। আকাশ সংস্কৃতি আর অন্তর্জালের দুনিয়া আজ সব বাধা-বিপত্তি বানের জলের মতো ঘুচিয়ে দিয়েছে। রাত জেগে, নিজের ঘরে বসে অথবা হাতের তালুতে অবাধে উত্তম কুমারের সংবর্ধনা রচনা করছে বাংলাদেশের মানুষ। তাঁর ছবি গোগ্রাসে গিলছে মধ্যবয়সী নারী ও পুরুষ থেকে নতুন প্রজন্ম পর্যন্ত সবাই। শুনেছি বাংলাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও এখন ‘টেলিভিশনের খবরে, সিনেমার পর্দায়, বাস্তবে—সর্বত্রই মানুষ প্রতিনিয়ত জটিল ও নিম্ন রুচির কনটেন্ট আর অশ্লীলতা ও ভায়োলেন্স দেখানো হয়, যা দর্শকের মনে স্বস্তি দিতে পারে না। বিশেষ করে, মানুষ যখন দৈনন্দিন জীবনের জটিলতায় বিধ্বস্ত, তখন সে রূঢ়-বাস্তবতা থেকে পালিয়ে মুক্তি পেতে চায়। উত্তমের ছবিতে সেই স্বস্তির সন্ধান আছে, আজকের বাঙালি নির্বিশেষে তাই ফিরে যেতে চায় সেই রোমান্টিকতার জগতে! বাংলা সিনেমার রোমান্টিক নায়ক হিসেবে তাই এখনো উত্তম কুমারই সবার পছন্দ। প্রয়াণ দিবসে তাই আমিও মহানায়ক উত্তম কুমারকে জানাই প্রাণের প্রণতি।
জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ: কবি, গবেষক ও চলচ্চিত্রকার
আরও পড়ুন
জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ

বয়স, পেশা ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বয়োজ্যেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বাংলা সিনেমার অভিনয়ের সম্রাট, মহানায়ক উত্তম কুমারের একনিষ্ঠ অনুরাগী। তারা একান্তে উত্তমকে বাঁচিয়ে রেখেছেন স্মৃতির মণিকোঠায়। তারা উপলব্ধি করেছেন, সংবেদনশীল ও মানব দরদি উত্তম কুমার তাঁর সিনেমায় জীবনের থেকেও বড়, চিরন্তন এক প্রেমিক-প্রতিমূর্তি গড়েছিলেন অভিনয়ের মাধ্যমে এবং তিনি তা করেছিলেন জেনে-বুঝেই। দেখে মনে হয়, একাডেমিশিয়ানরা সিনেমায় উত্তম কুমারের অভিনয়ের ব্যাপারটা পূর্বধারণা বা ঘরানার নিরিখে দেখলেও দর্শক তা দেখেছে হৃদয় দিয়ে। তাই আমাদের সিনেমা পণ্ডিতেরা উত্তম কুমারকে বুঝে উঠতে পারেননি, বোঝার চেষ্টাও করেননি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংগঠক ও চলচ্চিত্র আন্দোলনের নেতাদের মনে এ বিষয়ে সচেতনতা ও সুস্পষ্ট বোঝাপড়া সৃষ্টি না হওয়ার কারণেই সম্ভবত পাশের বাড়ির অভিনয় শিল্পীর বিরাটত্বের বিষয়টি তাদের কাছে যোগ্য মর্যাদা পায়নি বা অবহেলিতই থেকে গেছে।
অভিনয়ের বরপুত্র উত্তম কুমারের ৪১ তম প্রয়াণবার্ষিকীতে এ কথা বলতেই হচ্ছে, কালেভদ্রে সংবাদপত্রের বিনোদন পাতা ছাড়া, বাংলাদেশের একাডেমিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিমণ্ডলে বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মহানায়ক’ উত্তম কুমারকে নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হয় না বললেই চলে। অনলাইনে কিছু গ্রুপ অ্যাকটিভিটি থাকলেও উত্তম-চর্চার কোনো সাংগঠনিক কাঠামোর ভিত্তি বা তৎপরতা বাংলাদেশে এখনো দৃশ্যমান নয়। এর কারণ হতে পারে ঐতিহাসিক ও খণ্ডিত ভৌগোলিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপট, বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষভাবে উত্তম কুমার সম্পর্কে জানাশোনার সুযোগ ও সময় দুটোই কম পেয়েছে।
এখানকার চলচ্চিত্রের অভিনয়ের মান এখনো অপরিপক্ব অবস্থায় রয়েছে। তা ছাড়া যাত্রা, পালাগান ও মঞ্চ অধ্যুষিত বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের অভিনয়ের স্বাতন্ত্র্যের বিষয়টি এখনো উপেক্ষিত। এমনকি সম্প্রতি যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র বিভাগ খোলা হয়েছে এবং সরকারিভাবে যে ‘বাংলাদেশ সিনেমা ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট’ (বিসিটিআই) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর কারিকুলামেও অভিনয়ের বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব পায়নি এখনো। একদল একাডেমিশিয়ানের মনে এ ধারণাও বদ্ধমূল হয়তো—উত্তম কুমার বাণিজ্যিক সিনেমার অভিনেতা, তিনি ইউরোপীয় সিনেমার কেউ নন, তাঁকে নিয়ে এত মাতামাতির কী আছে? তাঁরা উপমহাদেশের চলচ্চিত্র আলোচনার ক্ষেত্রে সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক–এর বাইরে ইদানীং অপর্ণা সেন-ঋতুপর্ণ ঘোষ-মণিকাউল-মীরা নায়ার, আর নানামুখী আলোচনায় স্মিতা পাতিল-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-শাবানা আজমি পর্যন্ত আলোচনা করতে রাজি আছেন, এর বাইরে একদম নয়।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলের যখন এই ঘোর অমানিশা, তখন প্রশ্ন হলো এ দেশের মানুষের কাছে উত্তম কুমার এত জনপ্রিয় হলেন কীভাবে? বিশেষত, মৃত্যুর চার দশক পরও কীভাবে তিনি দর্শক হৃদয়ে অক্ষয়–অব্যয় আসন ধরে রাখতে পারলেন? মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশের উত্তম কুমার দেশভাগ-পরবর্তী সময়ের চলচ্চিত্রের প্রতিনিধি। তখন সার্বিকভাবে দেশভাগের পর বেদনা-জর্জরিত ছিল বাংলার উভয় অংশের মানুষের মন। দেশভাগের দগদগে ক্ষত এবং আর্থিক সমস্যা তখন বিভক্ত দুই বাংলার ঘরে ঘরে। সাধারণ দর্শক এই দৈন্য ও দুর্দশার বিপরীতে বাংলা ছবির পর্দায় তাদেরই জীবনের ছোট ছোট সাফল্য ও অবদমিত আকাঙ্ক্ষার চিত্রায়ণ দেখতে পায়। বিগত শতাব্দীর সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই এমন সব চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল অভিনয় করতে শুরু করেন উত্তম কুমার। পশ্চিমবঙ্গের মতো পূর্ববঙ্গের দর্শকেরও তখন মনে হয়, ছেলেটা তাদের মনের কথা বলছে। যুবক-যুবতীরা ভাবত উত্তমের ফ্যাশনের কথা। পত্রিকার কাটতি হতো উত্তম কুমার কী খাচ্ছেন, কার সঙ্গে প্রেম করছেন—এসব খবর ছেপে! তা নিয়ে তুমুল তর্ক হতো চায়ের স্টলে, বাঙালির আড্ডায়। নরসুন্দরের দোকানের দেয়ালে টানানো থাকত খবরের কাগজে ছাপা উত্তম কুমারের ছবি। স্কুল–কলেজে, বাজারে–খেয়াঘাটে, রান্নাঘরে, ড্রয়িংরুমে—সর্বত্র সবারই মনে হতো, যদি উত্তম হতে পারতাম! এভাবেই উত্তম কুমার চলচ্চিত্র তারকার গণ্ডি টপকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ঘরে ঢোকেন এবং হয়ে ওঠেন মধ্যবিত্ত বাঙালির স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিরূপ। এভাবেই বাঙালি দর্শকের মনে রোমান্টিক শিল্পী উত্তম কুমারের জাদুকরী প্রভাব বলয়ের সৃষ্টি হয়।
সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উত্তমের উত্থান হলেও চেনা উত্তম কুমারকে পাড়ার অভিনেতা থেকে ‘মহানায়ক উত্তম কুমার’ হয়ে উঠতে কিন্তু বিপুল পরিশ্রম করতে হয়েছে! ছোটবেলার খেলার সাথি ও প্রাণাধিক প্রিয় দিদির মৃত্যুর নিদারুণ শোক আজীবন বয়ে বেড়ানো ছাড়াও তাঁকে দীর্ঘ স্নায়ুক্ষয়ী সংগ্রামের দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়। সংগীত রচনা থেকে অশ্বারোহণ, ঘরের বেড়া দেওয়া থেকে সাঁতার কাটা, জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সবই শিখতে হয়েছিল জীবন থেকে। এই পরিক্রমায় তাঁকে সময়ের অভিঘাত পর্যবেক্ষণ ও মর্মস্থ করতে হয়, মাতৃভাষা ছাড়াও হিন্দি ও ইংরেজিসহ অনেক ভাষাও মজ্জাগত করতে হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, অনেকের চক্রান্তে তাঁর প্রযোজনায় নির্মিত হিন্দি ছবি ছোটিসি মুলাকাত (১৯৬৭)–এ অপরিমেয় ব্যয়ের পরও ছবিটি ফ্লপ হয়। তিনি প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে যান। টাকার জন্য তিনি তখন বিভিন্ন মঞ্চেও গান গেয়েছেন।
বিশেষত সংগীতের প্রতি উত্তমের ছিল অসীম একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও ভালোবাসা। প্রাথমিক জীবনে গানের শিক্ষক হিসেবেই কিন্তু তিনি টিকে থাকার চেষ্টা করেছিলেন। স্ত্রী গৌরী দেবীর সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও হয়েছিল এই গান শেখানোর মধ্য দিয়ে। অসামান্য গলা আর অসাধারণ গায়ন রীতির অধিকারী ছিলেন তিনি। অভিনয় যদি তিনি না করতেন, তাহলে উত্তম কুমার হয়তো হতেন উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী। উত্তম গান শিখেছিলেন ক্ল্যাসিক সংগীত শিল্পী নিদান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। প্রায় ৩০টি রাগের ওপর তিনি দীক্ষা দিয়েছিলেন উত্তম কুমারকে। উত্তমকে তিনি স্পেশাল সারগাম প্র্যাকটিস করাতেন, যাতে সুরের ওপর তিনি স্পষ্ট দখল প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। শৈশব থেকেই মঞ্চনাটক, গান, আর যাত্রাপালার ভক্ত ছিলেন; ছিলেন সম্পৃক্তও। উত্তম কুমার একসময় স্টার থিয়েটারে নিয়মিত অভিনয় করতেন। তাঁর অভিনীত শ্যামলী (১৯৫৩) নাটকটিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। যৌবনে ভারতবর্ষ পরাধীন থাকাকালের উন্মাতাল বৈশ্বিক রাজনীতি এবং আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতি তাঁর মনে স্বাজাত্যবোধ, সাম্য ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা উসকে দিয়েছিল। তাই পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও মাতৃভূমির স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিতে শুরু করেন উত্তম কুমার। তরুণ বয়স থেকেই রচনা করতে শুরু করেন দেশাত্মবোধক গান ও বিপ্লবী গণসংগীত। এসব গানে সুর দিয়ে স্বকণ্ঠে ও সদলবলে গাইতেন সভা-সমিতিতে, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মিছিলেও অংশ নিতেন। স্বদেশি ও স্বাধীনতা আন্দোলন এবং কুৎসিত সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে গিয়ে আত্মগোপনে থাকতে এমনকি জীবনের ঝুঁকি নিতেও দেখা গেছে তাঁকে। দেশের মানুষ এই রোমান্টিক-বিপ্লবী ও সংগ্রামী উত্তমকে ভালোবাসত।
ভাবলে অবাক লাগে ১৯৪৭ সালে মুক্তি না-পাওয়া হিন্দি সিনেমা মায়াডোর-এ মাত্র পাঁচ-সিকা পারিশ্রমিকে মূকাভিনয়ের মাধ্যমে একস্ট্রা শিল্পী হিসেবে অভিনয় জীবন শুরু করেন উত্তম কুমার। সে ছবি কখনো আলোর মুখ দেখেনি। এরই মধ্যে সাহসী ছেলেটি বাড়ি থেকে পালিয়ে পাড়ার মেয়ে ও নিজের গানের ছাত্রী গৌরী দেবীকে বিয়ে করে ফেললেন। সিনেমাপাড়ার ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’ (এফএমজি) তখনো অসফলতার ধারাবাহিকতায় ছবিতে নাম পাল্টাচ্ছেন একের পর এক। প্রথমে অরুণ কুমার থেকে অরূপ কুমার, তারপর অরূপ কুমার থেকে উত্তম কুমার। অতঃপর পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করলেন বসু পরিবার (১৯৫২) ছবিতে। অভিনয়ের জন্য এবার প্রশংসিত হলেন। ভাগ্যদেবী তাঁর প্রতি সুপ্রসন্ন হলেন প্রথমবারের মতো। সেখান থেকেই একটু একটু করে জনপ্রিয়তার শিখরে ওঠার শুরু। ক্যারিয়ারের ৩৩ বছরে অন্তত ৫০টি অসাধারণ মানের ছবিসহ বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে প্রায় আড়াই শ ছবি উপহার দিয়ে হয়ে উঠলেন একাধারে চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনয় শিল্পী, প্রযোজক, পরিচালক, সংগীত পরিচালক ও সংগঠক। এভাবে নিজেই বাংলা চলচ্চিত্রের এক ইন্ডাস্ট্রিতে রূপান্তরিত হলেন।
উত্তম কুমার তাঁর যুগের এবং বাংলা সিনেমার সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক। মঞ্চ ও যাত্রার ফর্ম ভেঙে দিয়ে, তিনিই প্রথম বাংলা চলচ্চিত্রে পরিশীলিত অভিনয় রীতির প্রবর্তন করেন। বিচিত্র ছিল তাঁর অভিনয় প্রতিভা। সিনেমার চিত্রভাষা বুঝতেন তিনি। বাঙালির মন ও রুচি ভালো করেই বুঝতেন। তিনি জানতেন বাঙালি-মানস প্রেমের জলে হাবুডুবু খায় ঠিকই, কিন্তু প্রকাশ্যে বিবাহপূর্ব মেলামেশা অনুমোদন করে না কিছুতেই। দৈহিক সম্পর্ক দেখালে ‘ভদ্র-বাঙালি’ পরিবার নিয়ে সিনেমা দেখতে আসে না। কিন্তু লুকিয়ে বাইজি নাচের আসরে তার নিত্য আসা যাওয়া। তিনি আরও জানতেন, বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে প্রেমিকের বাহ্যিক আচরণ অভিভাবকসুলভ। তাই শারীরিক সান্নিধ্য ছাড়াই তিনি প্রেমের রসায়ন জমিয়ে দিলেন বাংলা সিনেমার পর্দায়। আর মধ্যবিত্তের অবদমিত আকাঙ্ক্ষা, বেদনা ও সংযম পরিশীলন; শিক্ষা ও রুচিশীলতার চর্চা; ইতিহাস, দেশাত্মবোধ ও রাজনৈতিক চেতনার পরিচর্যা ও পরিমিতিবোধের লালন—এসবই ছিল উত্তম কুমারের অভিনয়ের মৌলিক উপাদান! তাই তো তাঁর অভিনয়ে প্রতিফলন ঘটল বাঙালির ভদ্রতার মুখোশ ও আদর্শ—দুটোরই।
উত্তম কুমার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে ও শ্যামল মিত্রের গানে অবলীলায় ঠোঁট মিলিয়েছেন। কারণ, গানটা তিনি বুঝতেন। জীবনের শুরুতেই গানের সঙ্গে বোঝা-পড়াটা তাঁর হয়েছিল একবারে অন্তর্গতভাবেই। আর এসব অমর গান বাংলাদেশের মানুষের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া করে তোলে। রোমান্টিক প্রেমের ছবির পাশাপাশি প্রচুর ভিন্ন স্বাদের ছবিতেও অভিনয় করেন তিনি। কমেডি ও ট্র্যাজেডিতেও ছিলেন সমান পারদর্শী। মানুষের সঙ্গে একদম তার মতো মিশে যেতে পারতেন। যে চরিত্রে অভিনয় করতেন, মনে হতো তিনি সেই মানুষটাই। প্রতিটি চরিত্রের জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতেন। চরিত্রটির মতো হয়ে ওঠার জন্য আর তাঁর সেন্স অব টাইমিং ছিল অসাধারণ। অভিনয়ের এই নিষ্ঠার জন্য মূল্য দিতে গিয়ে ১৯৭১ সালে নকশালদের হাতে খুন হতে হতেও বেঁচে যান। কিন্তু এ জন্য তিনি ভয় পেয়ে অভিনয় ছেড়ে দেননি। কিছুদিন লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে বিপুল সাহসের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসেন। বন্যা-ঝঞ্ঝা-খরা ও নিপীড়িত বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের কাছে তাই এই হার না-মানা সংগ্রামী উত্তম কুমার ভীষণ পছন্দের; একান্ত আপনার।
বাংলাদেশের পাবনার মেয়ে সুচিত্রা সেন এবং ঢাকার মেয়ে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়সহ সিনেমায় উত্তমের নায়িকা হয়েছিলেন সর্বমোট ৪৬ জন। প্রথম ছয় বছরে নয়জন বয়োজ্যেষ্ঠ নায়িকার সঙ্গে উত্তমের অভিনয় তাঁর ক্যারিয়ারে নেতিবাচক প্রভাব ফেললেও এরপরই শুরু হয় কিংবদন্তি উত্তম-সুচিত্রা যুগের। তরুণী নায়িকা সুচিত্রা সেনকে পাশে পেয়ে অভিনয়ে মনপ্রাণ ঢেলে দেন উত্তম। তিনি নিজেই বলেন—‘সুচিত্রা পাশে না থাকলে আমি কখনোই উত্তম কুমার হতে পারতাম না।’ বাংলাদেশের মানুষ এ জন্য এখনো গর্ববোধ করে এবং তারা কথাটা বিশ্বাসও করে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই উত্তম-সুচিত্রা জুটি এক অপার বিস্ময়ের নাম।
তাঁদের প্রথম ছবি সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩)-এর পর থেকেই বাংলা চলচ্চিত্রের এক জাদুকরী রসায়নের নাম হয়ে ওঠেন উত্তম-সুচিত্রা। এ যেন প্রেমিক-প্রেমিকা দুজনের একসঙ্গে স্ট্রাগল করা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাপোষণ করা, দুজন দুজনার আশ্রয় হয়ে ওঠা—বাঙালি রুচির এমন ধারণার সমার্থক চিরকালীন রোমান্টিক তারকা জুটি! বাংলা সিনেমায় রোমান্টিসিজমের ধারাই পাল্টে দেন তাঁরা। অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪), সবার উপরে (১৯৫৫), শাপ মোচন (১৯৫৫), শিল্পী (১৯৫৬), সাগরিকা (১৯৫৬), পথে হলো দেরী (১৯৫৭), হারানো সুর (১৯৫৭), রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮), সপ্তপদী (১৯৬১), আলো আমার আলো (১৯৭১)-সহ একে একে ৩১টি ছবিতে অভিনয় করে তাঁরা হয়ে যান বাংলা চলচ্চিত্রের চিরকালীন রোমান্টিক আইকন। বাংলাদেশের দর্শকের কাছে উত্তম-সুচিত্রা তাই এক ও অদ্বিতীয়, অবিচ্ছেদ্য, চিরসবুজ ও চিরতরুণ জুটির নাম। উত্তমকে ছাড়া সুচিত্রাকে কিংবা সুচিত্রাকে ছাড়া উত্তমকে বাঙালি দর্শক একেবারেই দেখতে চান না। কারণ, দুর্দিনে বাঙালিকে যে হাসিয়ে-কাঁদিয়ে উত্তেজনায় কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন এঁরা! তাই তো উত্তমের মৃত্যুর দীর্ঘ চার দশক পর এখনো কান পাতলে শোনা যায় পর্দায় উত্তম-সুচিত্রা জুটির বিচ্ছেদ-ব্যথায় কাতর প্রৌঢ় বাঙালির দীর্ঘশ্বাস।
সমকালীন অন্য ডাকসাইটে নায়িকাদের মধ্যে উত্তম কুমারের হৃদয়ের রানি ছিলেন আরেক কিংবদন্তিতুল্য নায়িকা সুপ্রিয়া দেবী। সাজগোজ নিয়ে আধুনিকা সুপ্রিয়ার ছিল না কোনো মাথাব্যথা, ছিল পড়াশোনার নেশা। উত্তম কুমারকে সাম্প্রতিক সাহিত্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলতেন তিনি। নির্মল দের বসু পরিবার (১৯৫২) ছবিতে উত্তম তাঁর বন্ধুর বোন বেণু ওরফে সুপ্রিয়া দেবীকে পেয়েছিলেন সহ–অভিনেত্রী হিসেবে। পরে তিনিই পর্দায় উত্তমের অন্যতম সফল সিনেমা-জুটি এবং ব্যক্তি ও দাম্পত্যজীবনে প্রেরণাদাত্রী হয়ে ওঠেন। বাস্তব জীবনেও তাঁরা ছিলেন সত্যিকারের জুটি। উত্তম-সুপ্রিয়া উত্তরায়ণ (১৯৬৩), কাল তুমি আলেয়া (১৯৬৬), বন পলাশীর পদাবলী (১৯৭৩), বাঘ বন্দীর খেলা (১৯৭৫), সন্ন্যাসী রাজা (১৯৭৫) প্রভৃতি তুমুল জনপ্রিয় ছবিতে জুটি বেঁধে অভিনয় করেন। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে উত্তম কুমারের সঙ্গে ঢাকার মেয়ে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের জুটিও জনপ্রিয় হয়। তাঁর অভিনয়গুণে মুগ্ধ ছিলেন মহানায়ক। হাত বাড়ালেই বন্ধু (১৯৬০), দুই ভাই (১৯৬১), মোমের আলো (১৯৬৮), নিশি পদ্ম (১৯৭০) ইত্যাদি সিনেমায় তাঁদের জুটিও প্রশংসিত হয়। ধন্যি মেয়ে (১৯৭১), মৌচাক (১৯৭৫)-এর মত কমেডি ছবিতে সাবিত্রী-উত্তম জুটির অভিনয় রীতিমতো কিংবদন্তি হয়ে আছে।
পঞ্চাশের দশকে যখন চলচ্চিত্রের আকাশ রাঙিয়ে দিতে শুরু করেন, তখন থেকেই বাংলাদেশের মানুষের কাছেও আপন হয়ে আছেন উত্তম কুমার। কারণ, ১৯৪৭-এ দেশভাগ হলেও এ দেশের সিনেমা হলগুলোতে তখনো ভারতীয় বাংলা সিনেমা প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল না। পরে পাকিস্তানে ভারত-বিদ্বেষ প্রকট ও নিষেধাজ্ঞা জারি হলে সেই সুযোগ সীমিত হয়ে হয়ে পড়ে। কিন্তু তত দিনে উত্তম-সুচিত্রা জুটির স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে বাঙালি দর্শকের ঘরে ঘরে, অন্দর মহলে। উত্তমের সাবলীল অভিনয়ই তাঁর প্রতি মানুষের এই আকর্ষণের চুম্বকশক্তি। এখনো বাংলা সিনেমার পুরোনো দর্শকেরা তাই উত্তম কুমারকেই খুঁজে ফেরে। সিনেমা হলে ভিএইচএস ক্যাসেটে, সিডি/ডিভিডিতে, ইন্টারনেটে যে ফর্মেই হোক, বাংলাদেশে ‘উত্তমকুমারের সিনেমা’ দেখার জোয়ার কমেনি কখনো। এমনকি করোনাকালীন লকডাউনের সময়েও ওটিটি প্ল্যাটফর্মে উত্তম কুমারের দর্শক বেড়েছে; তারা ঘুরেফিরে বারবারই দেখছেন উত্তম কুমার অভিনীত ছবি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও চলচ্চিত্রের বন্দিদশা কিন্তু রয়ে গেছে আগের মতোই। ছিটেফোঁটা ছাড়া ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অবাধ চলচ্চিত্র বিনিময় বন্ধ রয়েছে যথারীতি আগের মতোই। বাণিজ্যিক স্বার্থের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের সিনেমা হলে ভারতীয় বাংলা ছবিই প্রদর্শিত হচ্ছে না, আর পুরোনো দিনের সিনেমা তো একদমই নিষিদ্ধ বস্তু। কিন্তু ওই বস্তুর প্রতিই বাঙালির অমোঘ আকর্ষণের পেছনের কারণ সেই উত্তম কুমারই। আকাশ সংস্কৃতি আর অন্তর্জালের দুনিয়া আজ সব বাধা-বিপত্তি বানের জলের মতো ঘুচিয়ে দিয়েছে। রাত জেগে, নিজের ঘরে বসে অথবা হাতের তালুতে অবাধে উত্তম কুমারের সংবর্ধনা রচনা করছে বাংলাদেশের মানুষ। তাঁর ছবি গোগ্রাসে গিলছে মধ্যবয়সী নারী ও পুরুষ থেকে নতুন প্রজন্ম পর্যন্ত সবাই। শুনেছি বাংলাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও এখন ‘টেলিভিশনের খবরে, সিনেমার পর্দায়, বাস্তবে—সর্বত্রই মানুষ প্রতিনিয়ত জটিল ও নিম্ন রুচির কনটেন্ট আর অশ্লীলতা ও ভায়োলেন্স দেখানো হয়, যা দর্শকের মনে স্বস্তি দিতে পারে না। বিশেষ করে, মানুষ যখন দৈনন্দিন জীবনের জটিলতায় বিধ্বস্ত, তখন সে রূঢ়-বাস্তবতা থেকে পালিয়ে মুক্তি পেতে চায়। উত্তমের ছবিতে সেই স্বস্তির সন্ধান আছে, আজকের বাঙালি নির্বিশেষে তাই ফিরে যেতে চায় সেই রোমান্টিকতার জগতে! বাংলা সিনেমার রোমান্টিক নায়ক হিসেবে তাই এখনো উত্তম কুমারই সবার পছন্দ। প্রয়াণ দিবসে তাই আমিও মহানায়ক উত্তম কুমারকে জানাই প্রাণের প্রণতি।
জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ: কবি, গবেষক ও চলচ্চিত্রকার
আরও পড়ুন

বয়স, পেশা ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বয়োজ্যেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বাংলা সিনেমার অভিনয়ের সম্রাট, মহানায়ক উত্তম কুমারের একনিষ্ঠ অনুরাগী। তারা একান্তে উত্তমকে বাঁচিয়ে রেখেছেন স্মৃতির মণিকোঠায়। তারা উপলব্ধি করেছেন, সংবেদনশীল ও মানব দরদি উত্তম কুমার তাঁর সিনেমায় জীবনের থেকেও বড়, চিরন্তন এক প্রেমিক-প্রতিমূর্তি গড়েছিলেন অভিনয়ের মাধ্যমে এবং তিনি তা করেছিলেন জেনে-বুঝেই। দেখে মনে হয়, একাডেমিশিয়ানরা সিনেমায় উত্তম কুমারের অভিনয়ের ব্যাপারটা পূর্বধারণা বা ঘরানার নিরিখে দেখলেও দর্শক তা দেখেছে হৃদয় দিয়ে। তাই আমাদের সিনেমা পণ্ডিতেরা উত্তম কুমারকে বুঝে উঠতে পারেননি, বোঝার চেষ্টাও করেননি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংগঠক ও চলচ্চিত্র আন্দোলনের নেতাদের মনে এ বিষয়ে সচেতনতা ও সুস্পষ্ট বোঝাপড়া সৃষ্টি না হওয়ার কারণেই সম্ভবত পাশের বাড়ির অভিনয় শিল্পীর বিরাটত্বের বিষয়টি তাদের কাছে যোগ্য মর্যাদা পায়নি বা অবহেলিতই থেকে গেছে।
অভিনয়ের বরপুত্র উত্তম কুমারের ৪১ তম প্রয়াণবার্ষিকীতে এ কথা বলতেই হচ্ছে, কালেভদ্রে সংবাদপত্রের বিনোদন পাতা ছাড়া, বাংলাদেশের একাডেমিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিমণ্ডলে বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মহানায়ক’ উত্তম কুমারকে নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হয় না বললেই চলে। অনলাইনে কিছু গ্রুপ অ্যাকটিভিটি থাকলেও উত্তম-চর্চার কোনো সাংগঠনিক কাঠামোর ভিত্তি বা তৎপরতা বাংলাদেশে এখনো দৃশ্যমান নয়। এর কারণ হতে পারে ঐতিহাসিক ও খণ্ডিত ভৌগোলিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপট, বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষভাবে উত্তম কুমার সম্পর্কে জানাশোনার সুযোগ ও সময় দুটোই কম পেয়েছে।
এখানকার চলচ্চিত্রের অভিনয়ের মান এখনো অপরিপক্ব অবস্থায় রয়েছে। তা ছাড়া যাত্রা, পালাগান ও মঞ্চ অধ্যুষিত বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের অভিনয়ের স্বাতন্ত্র্যের বিষয়টি এখনো উপেক্ষিত। এমনকি সম্প্রতি যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র বিভাগ খোলা হয়েছে এবং সরকারিভাবে যে ‘বাংলাদেশ সিনেমা ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট’ (বিসিটিআই) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর কারিকুলামেও অভিনয়ের বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব পায়নি এখনো। একদল একাডেমিশিয়ানের মনে এ ধারণাও বদ্ধমূল হয়তো—উত্তম কুমার বাণিজ্যিক সিনেমার অভিনেতা, তিনি ইউরোপীয় সিনেমার কেউ নন, তাঁকে নিয়ে এত মাতামাতির কী আছে? তাঁরা উপমহাদেশের চলচ্চিত্র আলোচনার ক্ষেত্রে সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক–এর বাইরে ইদানীং অপর্ণা সেন-ঋতুপর্ণ ঘোষ-মণিকাউল-মীরা নায়ার, আর নানামুখী আলোচনায় স্মিতা পাতিল-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-শাবানা আজমি পর্যন্ত আলোচনা করতে রাজি আছেন, এর বাইরে একদম নয়।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলের যখন এই ঘোর অমানিশা, তখন প্রশ্ন হলো এ দেশের মানুষের কাছে উত্তম কুমার এত জনপ্রিয় হলেন কীভাবে? বিশেষত, মৃত্যুর চার দশক পরও কীভাবে তিনি দর্শক হৃদয়ে অক্ষয়–অব্যয় আসন ধরে রাখতে পারলেন? মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশের উত্তম কুমার দেশভাগ-পরবর্তী সময়ের চলচ্চিত্রের প্রতিনিধি। তখন সার্বিকভাবে দেশভাগের পর বেদনা-জর্জরিত ছিল বাংলার উভয় অংশের মানুষের মন। দেশভাগের দগদগে ক্ষত এবং আর্থিক সমস্যা তখন বিভক্ত দুই বাংলার ঘরে ঘরে। সাধারণ দর্শক এই দৈন্য ও দুর্দশার বিপরীতে বাংলা ছবির পর্দায় তাদেরই জীবনের ছোট ছোট সাফল্য ও অবদমিত আকাঙ্ক্ষার চিত্রায়ণ দেখতে পায়। বিগত শতাব্দীর সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই এমন সব চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল অভিনয় করতে শুরু করেন উত্তম কুমার। পশ্চিমবঙ্গের মতো পূর্ববঙ্গের দর্শকেরও তখন মনে হয়, ছেলেটা তাদের মনের কথা বলছে। যুবক-যুবতীরা ভাবত উত্তমের ফ্যাশনের কথা। পত্রিকার কাটতি হতো উত্তম কুমার কী খাচ্ছেন, কার সঙ্গে প্রেম করছেন—এসব খবর ছেপে! তা নিয়ে তুমুল তর্ক হতো চায়ের স্টলে, বাঙালির আড্ডায়। নরসুন্দরের দোকানের দেয়ালে টানানো থাকত খবরের কাগজে ছাপা উত্তম কুমারের ছবি। স্কুল–কলেজে, বাজারে–খেয়াঘাটে, রান্নাঘরে, ড্রয়িংরুমে—সর্বত্র সবারই মনে হতো, যদি উত্তম হতে পারতাম! এভাবেই উত্তম কুমার চলচ্চিত্র তারকার গণ্ডি টপকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ঘরে ঢোকেন এবং হয়ে ওঠেন মধ্যবিত্ত বাঙালির স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিরূপ। এভাবেই বাঙালি দর্শকের মনে রোমান্টিক শিল্পী উত্তম কুমারের জাদুকরী প্রভাব বলয়ের সৃষ্টি হয়।
সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উত্তমের উত্থান হলেও চেনা উত্তম কুমারকে পাড়ার অভিনেতা থেকে ‘মহানায়ক উত্তম কুমার’ হয়ে উঠতে কিন্তু বিপুল পরিশ্রম করতে হয়েছে! ছোটবেলার খেলার সাথি ও প্রাণাধিক প্রিয় দিদির মৃত্যুর নিদারুণ শোক আজীবন বয়ে বেড়ানো ছাড়াও তাঁকে দীর্ঘ স্নায়ুক্ষয়ী সংগ্রামের দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়। সংগীত রচনা থেকে অশ্বারোহণ, ঘরের বেড়া দেওয়া থেকে সাঁতার কাটা, জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সবই শিখতে হয়েছিল জীবন থেকে। এই পরিক্রমায় তাঁকে সময়ের অভিঘাত পর্যবেক্ষণ ও মর্মস্থ করতে হয়, মাতৃভাষা ছাড়াও হিন্দি ও ইংরেজিসহ অনেক ভাষাও মজ্জাগত করতে হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, অনেকের চক্রান্তে তাঁর প্রযোজনায় নির্মিত হিন্দি ছবি ছোটিসি মুলাকাত (১৯৬৭)–এ অপরিমেয় ব্যয়ের পরও ছবিটি ফ্লপ হয়। তিনি প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে যান। টাকার জন্য তিনি তখন বিভিন্ন মঞ্চেও গান গেয়েছেন।
বিশেষত সংগীতের প্রতি উত্তমের ছিল অসীম একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও ভালোবাসা। প্রাথমিক জীবনে গানের শিক্ষক হিসেবেই কিন্তু তিনি টিকে থাকার চেষ্টা করেছিলেন। স্ত্রী গৌরী দেবীর সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও হয়েছিল এই গান শেখানোর মধ্য দিয়ে। অসামান্য গলা আর অসাধারণ গায়ন রীতির অধিকারী ছিলেন তিনি। অভিনয় যদি তিনি না করতেন, তাহলে উত্তম কুমার হয়তো হতেন উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী। উত্তম গান শিখেছিলেন ক্ল্যাসিক সংগীত শিল্পী নিদান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। প্রায় ৩০টি রাগের ওপর তিনি দীক্ষা দিয়েছিলেন উত্তম কুমারকে। উত্তমকে তিনি স্পেশাল সারগাম প্র্যাকটিস করাতেন, যাতে সুরের ওপর তিনি স্পষ্ট দখল প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। শৈশব থেকেই মঞ্চনাটক, গান, আর যাত্রাপালার ভক্ত ছিলেন; ছিলেন সম্পৃক্তও। উত্তম কুমার একসময় স্টার থিয়েটারে নিয়মিত অভিনয় করতেন। তাঁর অভিনীত শ্যামলী (১৯৫৩) নাটকটিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। যৌবনে ভারতবর্ষ পরাধীন থাকাকালের উন্মাতাল বৈশ্বিক রাজনীতি এবং আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতি তাঁর মনে স্বাজাত্যবোধ, সাম্য ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা উসকে দিয়েছিল। তাই পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও মাতৃভূমির স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিতে শুরু করেন উত্তম কুমার। তরুণ বয়স থেকেই রচনা করতে শুরু করেন দেশাত্মবোধক গান ও বিপ্লবী গণসংগীত। এসব গানে সুর দিয়ে স্বকণ্ঠে ও সদলবলে গাইতেন সভা-সমিতিতে, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মিছিলেও অংশ নিতেন। স্বদেশি ও স্বাধীনতা আন্দোলন এবং কুৎসিত সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে গিয়ে আত্মগোপনে থাকতে এমনকি জীবনের ঝুঁকি নিতেও দেখা গেছে তাঁকে। দেশের মানুষ এই রোমান্টিক-বিপ্লবী ও সংগ্রামী উত্তমকে ভালোবাসত।
ভাবলে অবাক লাগে ১৯৪৭ সালে মুক্তি না-পাওয়া হিন্দি সিনেমা মায়াডোর-এ মাত্র পাঁচ-সিকা পারিশ্রমিকে মূকাভিনয়ের মাধ্যমে একস্ট্রা শিল্পী হিসেবে অভিনয় জীবন শুরু করেন উত্তম কুমার। সে ছবি কখনো আলোর মুখ দেখেনি। এরই মধ্যে সাহসী ছেলেটি বাড়ি থেকে পালিয়ে পাড়ার মেয়ে ও নিজের গানের ছাত্রী গৌরী দেবীকে বিয়ে করে ফেললেন। সিনেমাপাড়ার ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’ (এফএমজি) তখনো অসফলতার ধারাবাহিকতায় ছবিতে নাম পাল্টাচ্ছেন একের পর এক। প্রথমে অরুণ কুমার থেকে অরূপ কুমার, তারপর অরূপ কুমার থেকে উত্তম কুমার। অতঃপর পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করলেন বসু পরিবার (১৯৫২) ছবিতে। অভিনয়ের জন্য এবার প্রশংসিত হলেন। ভাগ্যদেবী তাঁর প্রতি সুপ্রসন্ন হলেন প্রথমবারের মতো। সেখান থেকেই একটু একটু করে জনপ্রিয়তার শিখরে ওঠার শুরু। ক্যারিয়ারের ৩৩ বছরে অন্তত ৫০টি অসাধারণ মানের ছবিসহ বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে প্রায় আড়াই শ ছবি উপহার দিয়ে হয়ে উঠলেন একাধারে চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনয় শিল্পী, প্রযোজক, পরিচালক, সংগীত পরিচালক ও সংগঠক। এভাবে নিজেই বাংলা চলচ্চিত্রের এক ইন্ডাস্ট্রিতে রূপান্তরিত হলেন।
উত্তম কুমার তাঁর যুগের এবং বাংলা সিনেমার সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক। মঞ্চ ও যাত্রার ফর্ম ভেঙে দিয়ে, তিনিই প্রথম বাংলা চলচ্চিত্রে পরিশীলিত অভিনয় রীতির প্রবর্তন করেন। বিচিত্র ছিল তাঁর অভিনয় প্রতিভা। সিনেমার চিত্রভাষা বুঝতেন তিনি। বাঙালির মন ও রুচি ভালো করেই বুঝতেন। তিনি জানতেন বাঙালি-মানস প্রেমের জলে হাবুডুবু খায় ঠিকই, কিন্তু প্রকাশ্যে বিবাহপূর্ব মেলামেশা অনুমোদন করে না কিছুতেই। দৈহিক সম্পর্ক দেখালে ‘ভদ্র-বাঙালি’ পরিবার নিয়ে সিনেমা দেখতে আসে না। কিন্তু লুকিয়ে বাইজি নাচের আসরে তার নিত্য আসা যাওয়া। তিনি আরও জানতেন, বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে প্রেমিকের বাহ্যিক আচরণ অভিভাবকসুলভ। তাই শারীরিক সান্নিধ্য ছাড়াই তিনি প্রেমের রসায়ন জমিয়ে দিলেন বাংলা সিনেমার পর্দায়। আর মধ্যবিত্তের অবদমিত আকাঙ্ক্ষা, বেদনা ও সংযম পরিশীলন; শিক্ষা ও রুচিশীলতার চর্চা; ইতিহাস, দেশাত্মবোধ ও রাজনৈতিক চেতনার পরিচর্যা ও পরিমিতিবোধের লালন—এসবই ছিল উত্তম কুমারের অভিনয়ের মৌলিক উপাদান! তাই তো তাঁর অভিনয়ে প্রতিফলন ঘটল বাঙালির ভদ্রতার মুখোশ ও আদর্শ—দুটোরই।
উত্তম কুমার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে ও শ্যামল মিত্রের গানে অবলীলায় ঠোঁট মিলিয়েছেন। কারণ, গানটা তিনি বুঝতেন। জীবনের শুরুতেই গানের সঙ্গে বোঝা-পড়াটা তাঁর হয়েছিল একবারে অন্তর্গতভাবেই। আর এসব অমর গান বাংলাদেশের মানুষের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া করে তোলে। রোমান্টিক প্রেমের ছবির পাশাপাশি প্রচুর ভিন্ন স্বাদের ছবিতেও অভিনয় করেন তিনি। কমেডি ও ট্র্যাজেডিতেও ছিলেন সমান পারদর্শী। মানুষের সঙ্গে একদম তার মতো মিশে যেতে পারতেন। যে চরিত্রে অভিনয় করতেন, মনে হতো তিনি সেই মানুষটাই। প্রতিটি চরিত্রের জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতেন। চরিত্রটির মতো হয়ে ওঠার জন্য আর তাঁর সেন্স অব টাইমিং ছিল অসাধারণ। অভিনয়ের এই নিষ্ঠার জন্য মূল্য দিতে গিয়ে ১৯৭১ সালে নকশালদের হাতে খুন হতে হতেও বেঁচে যান। কিন্তু এ জন্য তিনি ভয় পেয়ে অভিনয় ছেড়ে দেননি। কিছুদিন লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে বিপুল সাহসের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসেন। বন্যা-ঝঞ্ঝা-খরা ও নিপীড়িত বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের কাছে তাই এই হার না-মানা সংগ্রামী উত্তম কুমার ভীষণ পছন্দের; একান্ত আপনার।
বাংলাদেশের পাবনার মেয়ে সুচিত্রা সেন এবং ঢাকার মেয়ে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়সহ সিনেমায় উত্তমের নায়িকা হয়েছিলেন সর্বমোট ৪৬ জন। প্রথম ছয় বছরে নয়জন বয়োজ্যেষ্ঠ নায়িকার সঙ্গে উত্তমের অভিনয় তাঁর ক্যারিয়ারে নেতিবাচক প্রভাব ফেললেও এরপরই শুরু হয় কিংবদন্তি উত্তম-সুচিত্রা যুগের। তরুণী নায়িকা সুচিত্রা সেনকে পাশে পেয়ে অভিনয়ে মনপ্রাণ ঢেলে দেন উত্তম। তিনি নিজেই বলেন—‘সুচিত্রা পাশে না থাকলে আমি কখনোই উত্তম কুমার হতে পারতাম না।’ বাংলাদেশের মানুষ এ জন্য এখনো গর্ববোধ করে এবং তারা কথাটা বিশ্বাসও করে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই উত্তম-সুচিত্রা জুটি এক অপার বিস্ময়ের নাম।
তাঁদের প্রথম ছবি সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩)-এর পর থেকেই বাংলা চলচ্চিত্রের এক জাদুকরী রসায়নের নাম হয়ে ওঠেন উত্তম-সুচিত্রা। এ যেন প্রেমিক-প্রেমিকা দুজনের একসঙ্গে স্ট্রাগল করা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাপোষণ করা, দুজন দুজনার আশ্রয় হয়ে ওঠা—বাঙালি রুচির এমন ধারণার সমার্থক চিরকালীন রোমান্টিক তারকা জুটি! বাংলা সিনেমায় রোমান্টিসিজমের ধারাই পাল্টে দেন তাঁরা। অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪), সবার উপরে (১৯৫৫), শাপ মোচন (১৯৫৫), শিল্পী (১৯৫৬), সাগরিকা (১৯৫৬), পথে হলো দেরী (১৯৫৭), হারানো সুর (১৯৫৭), রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮), সপ্তপদী (১৯৬১), আলো আমার আলো (১৯৭১)-সহ একে একে ৩১টি ছবিতে অভিনয় করে তাঁরা হয়ে যান বাংলা চলচ্চিত্রের চিরকালীন রোমান্টিক আইকন। বাংলাদেশের দর্শকের কাছে উত্তম-সুচিত্রা তাই এক ও অদ্বিতীয়, অবিচ্ছেদ্য, চিরসবুজ ও চিরতরুণ জুটির নাম। উত্তমকে ছাড়া সুচিত্রাকে কিংবা সুচিত্রাকে ছাড়া উত্তমকে বাঙালি দর্শক একেবারেই দেখতে চান না। কারণ, দুর্দিনে বাঙালিকে যে হাসিয়ে-কাঁদিয়ে উত্তেজনায় কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন এঁরা! তাই তো উত্তমের মৃত্যুর দীর্ঘ চার দশক পর এখনো কান পাতলে শোনা যায় পর্দায় উত্তম-সুচিত্রা জুটির বিচ্ছেদ-ব্যথায় কাতর প্রৌঢ় বাঙালির দীর্ঘশ্বাস।
সমকালীন অন্য ডাকসাইটে নায়িকাদের মধ্যে উত্তম কুমারের হৃদয়ের রানি ছিলেন আরেক কিংবদন্তিতুল্য নায়িকা সুপ্রিয়া দেবী। সাজগোজ নিয়ে আধুনিকা সুপ্রিয়ার ছিল না কোনো মাথাব্যথা, ছিল পড়াশোনার নেশা। উত্তম কুমারকে সাম্প্রতিক সাহিত্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলতেন তিনি। নির্মল দের বসু পরিবার (১৯৫২) ছবিতে উত্তম তাঁর বন্ধুর বোন বেণু ওরফে সুপ্রিয়া দেবীকে পেয়েছিলেন সহ–অভিনেত্রী হিসেবে। পরে তিনিই পর্দায় উত্তমের অন্যতম সফল সিনেমা-জুটি এবং ব্যক্তি ও দাম্পত্যজীবনে প্রেরণাদাত্রী হয়ে ওঠেন। বাস্তব জীবনেও তাঁরা ছিলেন সত্যিকারের জুটি। উত্তম-সুপ্রিয়া উত্তরায়ণ (১৯৬৩), কাল তুমি আলেয়া (১৯৬৬), বন পলাশীর পদাবলী (১৯৭৩), বাঘ বন্দীর খেলা (১৯৭৫), সন্ন্যাসী রাজা (১৯৭৫) প্রভৃতি তুমুল জনপ্রিয় ছবিতে জুটি বেঁধে অভিনয় করেন। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে উত্তম কুমারের সঙ্গে ঢাকার মেয়ে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের জুটিও জনপ্রিয় হয়। তাঁর অভিনয়গুণে মুগ্ধ ছিলেন মহানায়ক। হাত বাড়ালেই বন্ধু (১৯৬০), দুই ভাই (১৯৬১), মোমের আলো (১৯৬৮), নিশি পদ্ম (১৯৭০) ইত্যাদি সিনেমায় তাঁদের জুটিও প্রশংসিত হয়। ধন্যি মেয়ে (১৯৭১), মৌচাক (১৯৭৫)-এর মত কমেডি ছবিতে সাবিত্রী-উত্তম জুটির অভিনয় রীতিমতো কিংবদন্তি হয়ে আছে।
পঞ্চাশের দশকে যখন চলচ্চিত্রের আকাশ রাঙিয়ে দিতে শুরু করেন, তখন থেকেই বাংলাদেশের মানুষের কাছেও আপন হয়ে আছেন উত্তম কুমার। কারণ, ১৯৪৭-এ দেশভাগ হলেও এ দেশের সিনেমা হলগুলোতে তখনো ভারতীয় বাংলা সিনেমা প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল না। পরে পাকিস্তানে ভারত-বিদ্বেষ প্রকট ও নিষেধাজ্ঞা জারি হলে সেই সুযোগ সীমিত হয়ে হয়ে পড়ে। কিন্তু তত দিনে উত্তম-সুচিত্রা জুটির স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে বাঙালি দর্শকের ঘরে ঘরে, অন্দর মহলে। উত্তমের সাবলীল অভিনয়ই তাঁর প্রতি মানুষের এই আকর্ষণের চুম্বকশক্তি। এখনো বাংলা সিনেমার পুরোনো দর্শকেরা তাই উত্তম কুমারকেই খুঁজে ফেরে। সিনেমা হলে ভিএইচএস ক্যাসেটে, সিডি/ডিভিডিতে, ইন্টারনেটে যে ফর্মেই হোক, বাংলাদেশে ‘উত্তমকুমারের সিনেমা’ দেখার জোয়ার কমেনি কখনো। এমনকি করোনাকালীন লকডাউনের সময়েও ওটিটি প্ল্যাটফর্মে উত্তম কুমারের দর্শক বেড়েছে; তারা ঘুরেফিরে বারবারই দেখছেন উত্তম কুমার অভিনীত ছবি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও চলচ্চিত্রের বন্দিদশা কিন্তু রয়ে গেছে আগের মতোই। ছিটেফোঁটা ছাড়া ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অবাধ চলচ্চিত্র বিনিময় বন্ধ রয়েছে যথারীতি আগের মতোই। বাণিজ্যিক স্বার্থের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের সিনেমা হলে ভারতীয় বাংলা ছবিই প্রদর্শিত হচ্ছে না, আর পুরোনো দিনের সিনেমা তো একদমই নিষিদ্ধ বস্তু। কিন্তু ওই বস্তুর প্রতিই বাঙালির অমোঘ আকর্ষণের পেছনের কারণ সেই উত্তম কুমারই। আকাশ সংস্কৃতি আর অন্তর্জালের দুনিয়া আজ সব বাধা-বিপত্তি বানের জলের মতো ঘুচিয়ে দিয়েছে। রাত জেগে, নিজের ঘরে বসে অথবা হাতের তালুতে অবাধে উত্তম কুমারের সংবর্ধনা রচনা করছে বাংলাদেশের মানুষ। তাঁর ছবি গোগ্রাসে গিলছে মধ্যবয়সী নারী ও পুরুষ থেকে নতুন প্রজন্ম পর্যন্ত সবাই। শুনেছি বাংলাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও এখন ‘টেলিভিশনের খবরে, সিনেমার পর্দায়, বাস্তবে—সর্বত্রই মানুষ প্রতিনিয়ত জটিল ও নিম্ন রুচির কনটেন্ট আর অশ্লীলতা ও ভায়োলেন্স দেখানো হয়, যা দর্শকের মনে স্বস্তি দিতে পারে না। বিশেষ করে, মানুষ যখন দৈনন্দিন জীবনের জটিলতায় বিধ্বস্ত, তখন সে রূঢ়-বাস্তবতা থেকে পালিয়ে মুক্তি পেতে চায়। উত্তমের ছবিতে সেই স্বস্তির সন্ধান আছে, আজকের বাঙালি নির্বিশেষে তাই ফিরে যেতে চায় সেই রোমান্টিকতার জগতে! বাংলা সিনেমার রোমান্টিক নায়ক হিসেবে তাই এখনো উত্তম কুমারই সবার পছন্দ। প্রয়াণ দিবসে তাই আমিও মহানায়ক উত্তম কুমারকে জানাই প্রাণের প্রণতি।
জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ: কবি, গবেষক ও চলচ্চিত্রকার
আরও পড়ুন

বিহারের বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সী ক্লেরেন্স টপ্পো তাঁর এক বন্ধুর কাছে জানতে পারেন, তাঁর মা মারা গেছেন। ঘটনা চলতি বছরের আগস্টের শুরুর দিকের। টপ্পো খবর পেয়ে বেশ অবাক হন। কারণ, তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকেন, মা সুস্থ শরীরে বহাল তবিয়তে। কিন্তু ৭৪ বছর বয়সী মেরি টপ্পো ভারত সরকারের নথিতে মৃত।
১৭ ঘণ্টা আগে
দশকের পর দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে একটি পরিবার। নেহরু–গান্ধী পরিবার। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী এবং বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী ও সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র...
২ দিন আগে
সংযুক্ত আরব আমিরাতই প্রথম আরব দেশ হিসেবে সহিষ্ণুতা মন্ত্রণালয় চালু করেছিল। আবার প্রথম আরব দেশ হিসেবে গণহত্যার অভিযোগেও অভিযুক্ত দেশটি। গত ১০ এপ্রিল সুদানের পক্ষের আইনজীবীরা আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) এই অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করেন। তাঁদের অভিযোগ, আরব আমিরাত মাসালিত জাতিগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা
২ দিন আগে
আরএসএফ সম্প্রতি সুদানের উত্তর দারফুরের রাজধানী আল-ফাশের দখল করার পর সেখানে ব্যাপক নৃশংসতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ৫০০ দিনেরও বেশি অবরোধের পর এই বিজয়ের পর আরএসএফ যোদ্ধারা বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যা, এমনকি হাসপাতালেও নির্বিচারে হত্যার ভিডিও ধারণ করেছে।
৪ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

বিহারের বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সী ক্লেরেন্স টপ্পো তাঁর এক বন্ধুর কাছে জানতে পারেন, তাঁর মা মারা গেছেন। ঘটনা চলতি বছরের আগস্টের শুরুর দিকের। টপ্পো খবর পেয়ে বেশ অবাক হন। কারণ, তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকেন, মা সুস্থ শরীরে বহাল তবিয়তে। কিন্তু ৭৪ বছর বয়সী মেরি টপ্পো ভারত সরকারের নথিতে মৃত।
ভারতের বিহার রাজ্যে ভোটার তালিকা যাচাইয়ের বিশাল কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। লক্ষ্য—প্রতিটি নিবন্ধিত ভোটারের পরিচয় যাচাই করা এবং রাজ্যের বাইরে থাকা ও মৃত ব্যক্তিদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া। ক্লেরেন্স টপ্পো এই যাচাই অভিযানের কথা জানতেন। কিন্তু তাঁর পরিবারের কাছে কেউ কোনো নথি দেখতে আসেনি, নাগরিকদেরও কেউ নিজ গরজে কাগজপত্র জমা দিতে যায়নি।
টপ্পোর জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। তিনি জানতে পারেন, যে বিহারে যিনি জন্মেছেন, বড় হয়েছেন, সেখানেই নাকি তাঁর নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কারণ, নথিপত্র দেখাচ্ছে তিনি নাকি রাজ্যের বাইরে চলে গেছেন। তাঁর দুই ভাইয়ের নামও অনুপস্থিতদের তালিকায়। অথচ, তিন ভাইয়ের মধ্যে কেবল একজন অন্য রাজ্যে গেছেন। টপ্পো বলেন, ‘আমি খুব অবাক হয়েছি। আমি ভারতে থাকার পরও যদি আমার ভোটার পরিচয় কেড়ে নেওয়া হয়—তাহলে সেটা তো অনেক বড় ব্যাপার।’
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে অনেক সংখ্যালঘুর সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি খ্রিষ্টান সম্প্রদায়, টপ্পো এই ধর্মের মানুষ। পাশাপাশি তিনি দলিত, অর্থাৎ ভারতের বর্ণ প্রথায় ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর সদস্য। রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার সংখ্যালঘুদের অধিকার উপেক্ষা করছে—এমনটা ভেবে টপ্পো চেয়েছিলেন নভেম্বরের রাজ্য নির্বাচনে ‘পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দিতে’। কিন্তু পরিবারের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ার খবর শোনার পর তাঁর সেই আশাও শেষ! টপ্পো বলেন, ‘ভোট আমাদের দেশের লাগাম ধরার অধিকার। এটা আমাদের মৌলিক অধিকার।’
বিহারে চলমান ভোটার যাচাই প্রক্রিয়ায় লাখ লাখ মানুষ কার্যত ভোটাধিকার হারিয়েছেন। নাগরিক সমাজ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, এটি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনী মাঠ ক্ষমতাসীনদের পক্ষে নেওয়ার নতুন কৌশল। বিহারের প্রায় ৬৮ লাখ ভোটারের নাম, অর্থাৎ মোট ৭ কোটি ৯০ লাখ ভোটারের প্রায় ৮ শতাংশ, এই যাচাই প্রক্রিয়ায় বাদ দেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার নাম দেওয়া হয়েছে— স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর। এই প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে মামলা চলছে সুপ্রিম কোর্টে। রায় এলে নতুন ভোটার তালিকা বাতিলও হতে পারে।
এসআইআর-এর প্রথম ধাপে নির্বাচন কমিশনের (ইসিআই) কর্মীদের এক মাসের মধ্যে বিহারের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে ভোটারদের কাছ থেকে নথি সংগ্রহ করে একটি খসড়া তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয় এবং হয়ওনি। বিহার পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজের (পিইউসিএল) সাধারণ সম্পাদক সরফরাজ উদ্দিন বলেন, ‘এক মাসে প্রতিটি ঘরে যাওয়া, প্রতিটি ভোটারের সঙ্গে দেখা করা, ফরম নেওয়া এবং নথি সংযুক্ত করা—একেবারেই অসম্ভব।’
সরফরাজ জানান, ২০০৩ সালে এসআইআর সম্পূর্ণ করতে এক বছর লেগেছিল। কিন্তু এবার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়নি, তবু প্রত্যেককে এক মাসে প্রায় ৯০০ ভোটারের সঙ্গে যোগাযোগ করার কাজ দেওয়া হয়। ফলে অনেকেই শর্টকাটে কাজ শেষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যখন মাঠকর্মীরা কাউকে খুঁজে পেতেন না, তখন নিজেরাই ফরম পূরণ করে সেখানে নিজের স্বাক্ষর দিয়ে জমা দিতেন। ফলে অনেক প্রকৃত ভোটার বাদ পড়েছেন, আবার যারা বিহারে নেই তাদের অনেকের নাম তালিকায় থেকে গেছে।’
পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, এই প্রক্রিয়া কেবল অসতর্কতার ফল নয়, এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। দিল্লির আইনজীবী ও এই প্রক্রিয়ার সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা প্রশান্ত ভূষণ বলেন, ‘যদি তারা সচেতনভাবে সেই সব মানুষকে ভোটের বাইরে রাখে, যারা সরকারের পক্ষে ভোট দেয় না, তাহলে এর প্রভাব বিশাল হবে। সাধারণত নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণ হয় মাত্র ৪ থেকে ৬ শতাংশ ভোটে।’
মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য বিহার। এই দারিদ্র্যের মূল কারণ—ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের দমনমূলক নীতি, দুর্বল শাসনব্যবস্থা, আর খনিজ সমৃদ্ধ অঞ্চল ঝাড়খণ্ডের আলাদা হয়ে যাওয়া। ২০০০ সালে ঝাড়খন্ড পৃথক রাজ্য হয়। বিহারকে বলা হয় জাতপাতভিত্তিক অস্থির রাজনীতির এক ফুটন্ত কড়াই। একই নেতা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজ্য শাসন করছেন—একবার এই জোটে, আরেকবার প্রতিদ্বন্দ্বী জোটে যোগ দিয়ে। বিহারের সংবাদমাধ্যম ডেমোক্রেটিক চরখার সম্পাদক আমির আব্বাস বলেন, এই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণেই হয়তো বিহারকে বলা হয় ‘ভারতীয় রাজনীতির পরীক্ষাগার’।
কোভিড মহামারি ছড়িয়ে পড়লেও ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রথম রাজ্য হিসেবে বিধানসভা নির্বাচন আয়োজন করে বিহার। ফলে রাজনীতিকেরা দেশজুড়ে তীব্র সংক্রমণের মধ্যেও মুখে মাস্ক না পরে, স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে না মেনেই বিশাল জনসভা করেন। দুই বছর পর, বিহার আবারও প্রথম রাজ্য হিসেবে জনগণনার সময় জাতিগত তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। এই তথ্য পরে সর্বভারতীয় জনগণনায়ও অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
আমির আব্বাসের আশঙ্কা, এবার যে এসআইআর প্রক্রিয়া চালু হয়েছে, সেটিও রাজনৈতিকভাবে ভোটারদের বঞ্চিত করার এক নতুন পরীক্ষা। সমালোচকেরা বলছেন, এই প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে বিশেষ করে মুসলিম, খ্রিষ্টান ও নিম্নবর্ণের মানুষদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে—যাঁরা সাধারণত নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বিরোধী জোটকে সমর্থন করেন।
ভারতের নির্বাচন কমিশন প্রথমে জানিয়েছিল, নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য ১১ ধরনের কাগজপত্রের যেকোনো একটি গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু বিহারের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের কাছে থাকা, সবচেয়ে পরিচিত ও প্রচলিত পরিচয়পত্র আধার কার্ড ওই তালিকায় ছিল না। আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ বলেন, বরং যে নথিগুলো এসআইআর প্রক্রিয়ায় চাওয়া হয়েছিল—যেমন দশম শ্রেণির ভর্তি ফর্ম বা জমির দলিল—সেগুলো রাজ্যের বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছেই নেই।
গত ৮ সেপ্টেম্বর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, আধার কার্ডকেও নাগরিকত্ব যাচাইয়ের বৈধ প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এসআইআর–এর দ্বিতীয় ধাপে, যাঁরা ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন, তাঁরা আপত্তি জানিয়ে পুনরায় ভোটার হিসেবে নিবন্ধন করতে পারতেন। কিন্তু রাজ্যে সাক্ষরতার হার মাত্র ৭০ শতাংশ। ফলে অনেকে নিজের নাম বাদ পড়েছে কিনা, সেটিই যাচাই করতে পারেননি। খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশিত হয় ১ আগস্ট। কিন্তু যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁদের নামের তালিকা প্রকাশ পায় আরও দুই সপ্তাহ পর—১৭ আগস্ট।
এই খবর সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের কর্মীরা। কয়েক সপ্তাহ ধরে পাটনার মুসলিম অধ্যুষিত ফুলওয়ারি শরিফ এলাকায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে লোকজনকে জানান দিচ্ছিলেন সমাজকর্মী জাহিব আজমল। তিনি তাঁদের জানাচ্ছিলেন—তাঁদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ গেছে। আজমল বলেন, অনেকেই তাঁকে বলেছেন, ‘আমরা তো জানিই না কীভাবে তালিকা দেখতে হয়। আমাদের নাম কখনো বাদ পড়েনি। তাহলে কেন বাদ যাবে?’ তিনি আরও বলেন, ‘শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রবল ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।’
সরকারি এই এসআইআর তালিকায় অস্পষ্ট ঠিকানা আর ভুল তথ্যের কারণে কর্মীদের কাজ আরও কঠিন হয়ে পড়ে। আজমল বলেন, ‘তথ্য এমনভাবে দেওয়া হয়েছে যে, যাদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে, তাদের আমরা খুঁজেই পাচ্ছি না। কোনো একটি এলাকায় যদি আপনার কেউ পরিচিত না থাকে তাহলে সেখানে কেবল তালিকা ধরে কাউকে খুঁজে পাবেন না।’
প্রথম ধাপের নির্বাচনী নিবন্ধন যাচাই (এসআইআর) শেষে প্রায় ২২ লাখ মানুষ ভোটার নিবন্ধন করেন। তবে ভারতের নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, তাদের বেশির ভাগই নতুন ভোটার। তারা আগের তালিকায় ছিলেন না। অন্যদিকে, শুধু বিহারেই প্রায় ৬৮ লাখ মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
ভারতের নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক নির্দেশনাও দিয়েছিল বলে অভিযোগ করেন প্রশান্ত ভূষণ। তাঁর অভিযোগ, কমিশন ‘আসলে বিজেপির এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে।’ তিনি বলেন, ‘তারা যদি ইচ্ছা করে সংখ্যালঘু ও দলিতদের মতো নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে তালিকা থেকে বাদ দিতে পারে, আর এমন ভোটারদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারে—যারা বিজেপিকে ভোট দেয়, তাহলে তারা অবশ্যই সেটা করবে।’
তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী টপ্পো মনে করেন, তাঁর পরিবারের দ্বৈত সংখ্যালঘু পরিচয়ই (দলিত ও খ্রিষ্টান) হয়তো তালিকা থেকে বাদ যাওয়ার কারণ। তিনি বলেন, ‘একে আমি তফসিলি জাতির মানুষ, আবার খ্রিষ্টানও। এ কারণে আমার নাম কেটে দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।’ অবশ্য পরে, স্থানীয় এক সাংবাদিক টপ্পোর ঘটনা প্রকাশ করার পর, এক নির্বাচনী কর্মকর্তা এসে তাঁর পরিবারের তিন সদস্যের নাম পুনরায় নিবন্ধন করেন।
ভোটার যাচাই অভিযানের প্রভাব শুধু ভোটাধিকারেই সীমাবদ্ধ নয়। বিহারের এই যাচাই প্রক্রিয়ার পাশাপাশি মোদি সরকার এমন এক উদ্যোগ চালাচ্ছে, যার মাধ্যমে বৈধ কাগজপত্রবিহীন মুসলমানদের জোর করে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। বিহারেও নির্বাচন কমিশন দাবি করছে, এই যাচাই প্রক্রিয়া অবৈধ বিদেশিদের ভোট দেওয়া ঠেকাবে।
তবে বিরোধী দল ও অধিকারকর্মীরা আশঙ্কা করছেন, যাদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ছে, ভবিষ্যতে তাদের একইভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হতে পারে। ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির (লেনিনবাদী) মুখপাত্র কুমার পারভেজ বলেন, ‘যদি তাদের নাম ভোটার তালিকায় না থাকে, তাহলে আগামী দিনে তারা নাগরিক হিসেবেও থাকবেন না।’
ভোটার নিবন্ধনকে নাগরিকত্ব প্রমাণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা মোদির বিজেপির এক পরীক্ষিত কৌশল। ২০১৯ সাল থেকে দলটি প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে, সারা দেশে নাগরিকত্ব যাচাই অভিযান চালাবে। এখন পর্যন্ত একমাত্র যে রাজ্যে যাচাই সম্পন্ন হয়েছে, সেখানে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য দেখাতে হয়েছিল—১৯৭১ সালের আগে পরিবারের কোনো সদস্যের নাম ভোটার তালিকায় ছিল কি না।
বিহারের অনেকে এখন আশঙ্কা করছেন, ২০২৫ সালের ভোটার তালিকা তাদের পরিবারের নাগরিকত্বই বিপন্ন করতে পারে। অবসরপ্রাপ্ত ডাক কর্মী কৃষ্ণ দয়াল সিংকে টপ্পোর মায়ের মতো ‘মেরে ফেলেছিল’ ভারত সরকার। তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমার সন্তানেরা হয়তো এমন প্রশ্নের মুখে পড়বে যে, “তোমার দাদু তো ভোটার ছিলেন না, নাগরিকও ছিলেন না, তাহলে তুমি এ দেশে এলে কীভাবে?”’
দয়াল সিং জানান, তাঁর অবশ্য কপাল ভালো। কারণ, প্রথম ধাপের এসআইআর–এ খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের পর, এক নির্বাচনী কর্মকর্তা তাঁর বাড়িতে এসে তাঁকে ভোটার হিসেবে পুনর্নিবন্ধনের আবেদন করান।
অনেকের কাছে এই ভোটার নিবন্ধন লাইফলাইন বা জীবনরেখার মতো। ৯২ বছর বয়সী জিতনি দেবী তাঁর মাসিক সরকারি পেনশন ১ হাজার ১০০ রুপি দিয়ে খাবার এবং ওষুধের খরচ চালাতেন। এসআইআর চলাকালে, দেবীর পরিবারের ৭ জনের মধ্যে মাত্র দুজন তাদের গণনা ফর্ম জমা দিয়েছিলেন। নিরক্ষর জিতনি দেবী প্রথমে এই প্রক্রিয়ার দিকে মনোযোগ দেননি। অবশ্য দেওয়ার কোনো কারণও ছিল না। কারণ, নির্বাচনী কর্মকর্তারা তাঁর বাড়িতে আলমপুরে গ্রামে যাননি।
কিন্তু আগস্টে দেবী ব্যাংকে পেনশন নিতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখেন, তিনি আর নিবন্ধিত নন। যেহেতু নিবন্ধন নেই, তাই তাঁর পেনশনও নেই। পরে, স্থানীয় এনজিও মানথনের এক কর্মী তাঁকে জানান যে, এসআইআর–এ তাঁকে মৃত দেখানো হয়েছে।
জিতনি দেবী বলেন, ‘আমি জানি না আমি কী করব। আমি জানি না, সরকারই বা আমার সঙ্গে কী করবে। আমি জানি না আমি কীভাবে বাঁচব।’
এসআইআর-এর প্রভাব কতটা, তার পূর্ণ চিত্র প্রকাশ পেতে মাস কয়েক লাগবে। যদিও চূড়ান্ত ভোটার তালিকা ৩০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট অক্টোবর পর্যন্ত প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে শুনানি চালিয়ে গেছে। সর্বোচ্চ আদালত এসআইআর-এর ফলাফল বাতিল করতে পারে। ফলে বিহার রাজ্যে বিজেপি কি শাসক জোটের নেতৃত্বে থাকবে না কি থাকবে না—তা ১৪ নভেম্বরের রাজ্য নির্বাচনের পরই পরিষ্কার হবে।
কিন্তু যা কিছু বিহারে ঘটছে, শিগগিরই দেশের অন্যান্য জায়গায়ও এর পুনরাবৃত্তি হবে। রাজ্যের ভোটার যাচাই অভিযান শেষের পথে। ভারতের নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা রাজ্য-স্তরের সহকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন যে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ সারা দেশে এসআইআর-এর প্রস্তুতি নিতে। গত ২৭ অক্টোবর আরও ১২টি অতিরিক্ত রাজ্য ও অঞ্চলে এসআইআর শুরু হয়েছে। এসব রাজ্য ও অঞ্চলে প্রায় ৫০ কোটি ভোটার আছে।
১৪০ কোটিরও বেশি মানুষের নাগরিকত্ব যাচাই করার বিশাল কর্মযজ্ঞের বিষয়ে সমালোচকেরা বলছেন, এর ফলে প্রায় ৯ কোটি ভারতীয় ভোটাধিকার হারাতে পারেন। আর এ কারণেই মূলত বিহারের ঘটনা জাতীয় বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে। গত আগস্টে বিরোধীদলীয় সাংসদ ও ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস দলের নেতা রাহুল গান্ধী এসআইআর-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বিহারে মিছিলের নেতৃত্ব দেন। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর নেতারাও সেখানে অংশ নেন।
বিহারের ভোটার যাচাই অভিযান এখন নাগরিক সমাজ কর্মী ও বিরোধীদলীয় দলগুলোর চোখে ভারতের গণতান্ত্রিক বৈধতা রক্ষার নতুন সংগ্রাম। এই বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজের ভাইস–প্রেসিডেন্ট পুষ্পেন্দ্র বলেন, ‘এখন এটা একজাতীয় অভিযান। এই এসআইআর অন্য রাজ্যেও যাচ্ছে এবং তারা (বিরোধী দল) জানে যে, তাদের এমন ক্যাম্পেইন গড়ে তুলতে হবে যাতে এই প্রক্রিয়াকে পরাস্ত করা যায়।’
তথ্যসূত্র: ফরেন পলিসি

বিহারের বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সী ক্লেরেন্স টপ্পো তাঁর এক বন্ধুর কাছে জানতে পারেন, তাঁর মা মারা গেছেন। ঘটনা চলতি বছরের আগস্টের শুরুর দিকের। টপ্পো খবর পেয়ে বেশ অবাক হন। কারণ, তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকেন, মা সুস্থ শরীরে বহাল তবিয়তে। কিন্তু ৭৪ বছর বয়সী মেরি টপ্পো ভারত সরকারের নথিতে মৃত।
ভারতের বিহার রাজ্যে ভোটার তালিকা যাচাইয়ের বিশাল কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। লক্ষ্য—প্রতিটি নিবন্ধিত ভোটারের পরিচয় যাচাই করা এবং রাজ্যের বাইরে থাকা ও মৃত ব্যক্তিদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া। ক্লেরেন্স টপ্পো এই যাচাই অভিযানের কথা জানতেন। কিন্তু তাঁর পরিবারের কাছে কেউ কোনো নথি দেখতে আসেনি, নাগরিকদেরও কেউ নিজ গরজে কাগজপত্র জমা দিতে যায়নি।
টপ্পোর জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। তিনি জানতে পারেন, যে বিহারে যিনি জন্মেছেন, বড় হয়েছেন, সেখানেই নাকি তাঁর নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কারণ, নথিপত্র দেখাচ্ছে তিনি নাকি রাজ্যের বাইরে চলে গেছেন। তাঁর দুই ভাইয়ের নামও অনুপস্থিতদের তালিকায়। অথচ, তিন ভাইয়ের মধ্যে কেবল একজন অন্য রাজ্যে গেছেন। টপ্পো বলেন, ‘আমি খুব অবাক হয়েছি। আমি ভারতে থাকার পরও যদি আমার ভোটার পরিচয় কেড়ে নেওয়া হয়—তাহলে সেটা তো অনেক বড় ব্যাপার।’
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে অনেক সংখ্যালঘুর সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি খ্রিষ্টান সম্প্রদায়, টপ্পো এই ধর্মের মানুষ। পাশাপাশি তিনি দলিত, অর্থাৎ ভারতের বর্ণ প্রথায় ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর সদস্য। রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার সংখ্যালঘুদের অধিকার উপেক্ষা করছে—এমনটা ভেবে টপ্পো চেয়েছিলেন নভেম্বরের রাজ্য নির্বাচনে ‘পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দিতে’। কিন্তু পরিবারের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ার খবর শোনার পর তাঁর সেই আশাও শেষ! টপ্পো বলেন, ‘ভোট আমাদের দেশের লাগাম ধরার অধিকার। এটা আমাদের মৌলিক অধিকার।’
বিহারে চলমান ভোটার যাচাই প্রক্রিয়ায় লাখ লাখ মানুষ কার্যত ভোটাধিকার হারিয়েছেন। নাগরিক সমাজ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, এটি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনী মাঠ ক্ষমতাসীনদের পক্ষে নেওয়ার নতুন কৌশল। বিহারের প্রায় ৬৮ লাখ ভোটারের নাম, অর্থাৎ মোট ৭ কোটি ৯০ লাখ ভোটারের প্রায় ৮ শতাংশ, এই যাচাই প্রক্রিয়ায় বাদ দেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার নাম দেওয়া হয়েছে— স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর। এই প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে মামলা চলছে সুপ্রিম কোর্টে। রায় এলে নতুন ভোটার তালিকা বাতিলও হতে পারে।
এসআইআর-এর প্রথম ধাপে নির্বাচন কমিশনের (ইসিআই) কর্মীদের এক মাসের মধ্যে বিহারের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে ভোটারদের কাছ থেকে নথি সংগ্রহ করে একটি খসড়া তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয় এবং হয়ওনি। বিহার পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজের (পিইউসিএল) সাধারণ সম্পাদক সরফরাজ উদ্দিন বলেন, ‘এক মাসে প্রতিটি ঘরে যাওয়া, প্রতিটি ভোটারের সঙ্গে দেখা করা, ফরম নেওয়া এবং নথি সংযুক্ত করা—একেবারেই অসম্ভব।’
সরফরাজ জানান, ২০০৩ সালে এসআইআর সম্পূর্ণ করতে এক বছর লেগেছিল। কিন্তু এবার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়নি, তবু প্রত্যেককে এক মাসে প্রায় ৯০০ ভোটারের সঙ্গে যোগাযোগ করার কাজ দেওয়া হয়। ফলে অনেকেই শর্টকাটে কাজ শেষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যখন মাঠকর্মীরা কাউকে খুঁজে পেতেন না, তখন নিজেরাই ফরম পূরণ করে সেখানে নিজের স্বাক্ষর দিয়ে জমা দিতেন। ফলে অনেক প্রকৃত ভোটার বাদ পড়েছেন, আবার যারা বিহারে নেই তাদের অনেকের নাম তালিকায় থেকে গেছে।’
পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, এই প্রক্রিয়া কেবল অসতর্কতার ফল নয়, এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। দিল্লির আইনজীবী ও এই প্রক্রিয়ার সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা প্রশান্ত ভূষণ বলেন, ‘যদি তারা সচেতনভাবে সেই সব মানুষকে ভোটের বাইরে রাখে, যারা সরকারের পক্ষে ভোট দেয় না, তাহলে এর প্রভাব বিশাল হবে। সাধারণত নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণ হয় মাত্র ৪ থেকে ৬ শতাংশ ভোটে।’
মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য বিহার। এই দারিদ্র্যের মূল কারণ—ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের দমনমূলক নীতি, দুর্বল শাসনব্যবস্থা, আর খনিজ সমৃদ্ধ অঞ্চল ঝাড়খণ্ডের আলাদা হয়ে যাওয়া। ২০০০ সালে ঝাড়খন্ড পৃথক রাজ্য হয়। বিহারকে বলা হয় জাতপাতভিত্তিক অস্থির রাজনীতির এক ফুটন্ত কড়াই। একই নেতা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজ্য শাসন করছেন—একবার এই জোটে, আরেকবার প্রতিদ্বন্দ্বী জোটে যোগ দিয়ে। বিহারের সংবাদমাধ্যম ডেমোক্রেটিক চরখার সম্পাদক আমির আব্বাস বলেন, এই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণেই হয়তো বিহারকে বলা হয় ‘ভারতীয় রাজনীতির পরীক্ষাগার’।
কোভিড মহামারি ছড়িয়ে পড়লেও ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রথম রাজ্য হিসেবে বিধানসভা নির্বাচন আয়োজন করে বিহার। ফলে রাজনীতিকেরা দেশজুড়ে তীব্র সংক্রমণের মধ্যেও মুখে মাস্ক না পরে, স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে না মেনেই বিশাল জনসভা করেন। দুই বছর পর, বিহার আবারও প্রথম রাজ্য হিসেবে জনগণনার সময় জাতিগত তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। এই তথ্য পরে সর্বভারতীয় জনগণনায়ও অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
আমির আব্বাসের আশঙ্কা, এবার যে এসআইআর প্রক্রিয়া চালু হয়েছে, সেটিও রাজনৈতিকভাবে ভোটারদের বঞ্চিত করার এক নতুন পরীক্ষা। সমালোচকেরা বলছেন, এই প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে বিশেষ করে মুসলিম, খ্রিষ্টান ও নিম্নবর্ণের মানুষদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে—যাঁরা সাধারণত নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বিরোধী জোটকে সমর্থন করেন।
ভারতের নির্বাচন কমিশন প্রথমে জানিয়েছিল, নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য ১১ ধরনের কাগজপত্রের যেকোনো একটি গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু বিহারের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের কাছে থাকা, সবচেয়ে পরিচিত ও প্রচলিত পরিচয়পত্র আধার কার্ড ওই তালিকায় ছিল না। আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ বলেন, বরং যে নথিগুলো এসআইআর প্রক্রিয়ায় চাওয়া হয়েছিল—যেমন দশম শ্রেণির ভর্তি ফর্ম বা জমির দলিল—সেগুলো রাজ্যের বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছেই নেই।
গত ৮ সেপ্টেম্বর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, আধার কার্ডকেও নাগরিকত্ব যাচাইয়ের বৈধ প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এসআইআর–এর দ্বিতীয় ধাপে, যাঁরা ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন, তাঁরা আপত্তি জানিয়ে পুনরায় ভোটার হিসেবে নিবন্ধন করতে পারতেন। কিন্তু রাজ্যে সাক্ষরতার হার মাত্র ৭০ শতাংশ। ফলে অনেকে নিজের নাম বাদ পড়েছে কিনা, সেটিই যাচাই করতে পারেননি। খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশিত হয় ১ আগস্ট। কিন্তু যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁদের নামের তালিকা প্রকাশ পায় আরও দুই সপ্তাহ পর—১৭ আগস্ট।
এই খবর সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের কর্মীরা। কয়েক সপ্তাহ ধরে পাটনার মুসলিম অধ্যুষিত ফুলওয়ারি শরিফ এলাকায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে লোকজনকে জানান দিচ্ছিলেন সমাজকর্মী জাহিব আজমল। তিনি তাঁদের জানাচ্ছিলেন—তাঁদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ গেছে। আজমল বলেন, অনেকেই তাঁকে বলেছেন, ‘আমরা তো জানিই না কীভাবে তালিকা দেখতে হয়। আমাদের নাম কখনো বাদ পড়েনি। তাহলে কেন বাদ যাবে?’ তিনি আরও বলেন, ‘শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রবল ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।’
সরকারি এই এসআইআর তালিকায় অস্পষ্ট ঠিকানা আর ভুল তথ্যের কারণে কর্মীদের কাজ আরও কঠিন হয়ে পড়ে। আজমল বলেন, ‘তথ্য এমনভাবে দেওয়া হয়েছে যে, যাদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে, তাদের আমরা খুঁজেই পাচ্ছি না। কোনো একটি এলাকায় যদি আপনার কেউ পরিচিত না থাকে তাহলে সেখানে কেবল তালিকা ধরে কাউকে খুঁজে পাবেন না।’
প্রথম ধাপের নির্বাচনী নিবন্ধন যাচাই (এসআইআর) শেষে প্রায় ২২ লাখ মানুষ ভোটার নিবন্ধন করেন। তবে ভারতের নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, তাদের বেশির ভাগই নতুন ভোটার। তারা আগের তালিকায় ছিলেন না। অন্যদিকে, শুধু বিহারেই প্রায় ৬৮ লাখ মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
ভারতের নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক নির্দেশনাও দিয়েছিল বলে অভিযোগ করেন প্রশান্ত ভূষণ। তাঁর অভিযোগ, কমিশন ‘আসলে বিজেপির এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে।’ তিনি বলেন, ‘তারা যদি ইচ্ছা করে সংখ্যালঘু ও দলিতদের মতো নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে তালিকা থেকে বাদ দিতে পারে, আর এমন ভোটারদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারে—যারা বিজেপিকে ভোট দেয়, তাহলে তারা অবশ্যই সেটা করবে।’
তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী টপ্পো মনে করেন, তাঁর পরিবারের দ্বৈত সংখ্যালঘু পরিচয়ই (দলিত ও খ্রিষ্টান) হয়তো তালিকা থেকে বাদ যাওয়ার কারণ। তিনি বলেন, ‘একে আমি তফসিলি জাতির মানুষ, আবার খ্রিষ্টানও। এ কারণে আমার নাম কেটে দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।’ অবশ্য পরে, স্থানীয় এক সাংবাদিক টপ্পোর ঘটনা প্রকাশ করার পর, এক নির্বাচনী কর্মকর্তা এসে তাঁর পরিবারের তিন সদস্যের নাম পুনরায় নিবন্ধন করেন।
ভোটার যাচাই অভিযানের প্রভাব শুধু ভোটাধিকারেই সীমাবদ্ধ নয়। বিহারের এই যাচাই প্রক্রিয়ার পাশাপাশি মোদি সরকার এমন এক উদ্যোগ চালাচ্ছে, যার মাধ্যমে বৈধ কাগজপত্রবিহীন মুসলমানদের জোর করে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। বিহারেও নির্বাচন কমিশন দাবি করছে, এই যাচাই প্রক্রিয়া অবৈধ বিদেশিদের ভোট দেওয়া ঠেকাবে।
তবে বিরোধী দল ও অধিকারকর্মীরা আশঙ্কা করছেন, যাদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ছে, ভবিষ্যতে তাদের একইভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হতে পারে। ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির (লেনিনবাদী) মুখপাত্র কুমার পারভেজ বলেন, ‘যদি তাদের নাম ভোটার তালিকায় না থাকে, তাহলে আগামী দিনে তারা নাগরিক হিসেবেও থাকবেন না।’
ভোটার নিবন্ধনকে নাগরিকত্ব প্রমাণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা মোদির বিজেপির এক পরীক্ষিত কৌশল। ২০১৯ সাল থেকে দলটি প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে, সারা দেশে নাগরিকত্ব যাচাই অভিযান চালাবে। এখন পর্যন্ত একমাত্র যে রাজ্যে যাচাই সম্পন্ন হয়েছে, সেখানে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য দেখাতে হয়েছিল—১৯৭১ সালের আগে পরিবারের কোনো সদস্যের নাম ভোটার তালিকায় ছিল কি না।
বিহারের অনেকে এখন আশঙ্কা করছেন, ২০২৫ সালের ভোটার তালিকা তাদের পরিবারের নাগরিকত্বই বিপন্ন করতে পারে। অবসরপ্রাপ্ত ডাক কর্মী কৃষ্ণ দয়াল সিংকে টপ্পোর মায়ের মতো ‘মেরে ফেলেছিল’ ভারত সরকার। তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমার সন্তানেরা হয়তো এমন প্রশ্নের মুখে পড়বে যে, “তোমার দাদু তো ভোটার ছিলেন না, নাগরিকও ছিলেন না, তাহলে তুমি এ দেশে এলে কীভাবে?”’
দয়াল সিং জানান, তাঁর অবশ্য কপাল ভালো। কারণ, প্রথম ধাপের এসআইআর–এ খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের পর, এক নির্বাচনী কর্মকর্তা তাঁর বাড়িতে এসে তাঁকে ভোটার হিসেবে পুনর্নিবন্ধনের আবেদন করান।
অনেকের কাছে এই ভোটার নিবন্ধন লাইফলাইন বা জীবনরেখার মতো। ৯২ বছর বয়সী জিতনি দেবী তাঁর মাসিক সরকারি পেনশন ১ হাজার ১০০ রুপি দিয়ে খাবার এবং ওষুধের খরচ চালাতেন। এসআইআর চলাকালে, দেবীর পরিবারের ৭ জনের মধ্যে মাত্র দুজন তাদের গণনা ফর্ম জমা দিয়েছিলেন। নিরক্ষর জিতনি দেবী প্রথমে এই প্রক্রিয়ার দিকে মনোযোগ দেননি। অবশ্য দেওয়ার কোনো কারণও ছিল না। কারণ, নির্বাচনী কর্মকর্তারা তাঁর বাড়িতে আলমপুরে গ্রামে যাননি।
কিন্তু আগস্টে দেবী ব্যাংকে পেনশন নিতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখেন, তিনি আর নিবন্ধিত নন। যেহেতু নিবন্ধন নেই, তাই তাঁর পেনশনও নেই। পরে, স্থানীয় এনজিও মানথনের এক কর্মী তাঁকে জানান যে, এসআইআর–এ তাঁকে মৃত দেখানো হয়েছে।
জিতনি দেবী বলেন, ‘আমি জানি না আমি কী করব। আমি জানি না, সরকারই বা আমার সঙ্গে কী করবে। আমি জানি না আমি কীভাবে বাঁচব।’
এসআইআর-এর প্রভাব কতটা, তার পূর্ণ চিত্র প্রকাশ পেতে মাস কয়েক লাগবে। যদিও চূড়ান্ত ভোটার তালিকা ৩০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট অক্টোবর পর্যন্ত প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে শুনানি চালিয়ে গেছে। সর্বোচ্চ আদালত এসআইআর-এর ফলাফল বাতিল করতে পারে। ফলে বিহার রাজ্যে বিজেপি কি শাসক জোটের নেতৃত্বে থাকবে না কি থাকবে না—তা ১৪ নভেম্বরের রাজ্য নির্বাচনের পরই পরিষ্কার হবে।
কিন্তু যা কিছু বিহারে ঘটছে, শিগগিরই দেশের অন্যান্য জায়গায়ও এর পুনরাবৃত্তি হবে। রাজ্যের ভোটার যাচাই অভিযান শেষের পথে। ভারতের নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা রাজ্য-স্তরের সহকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন যে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ সারা দেশে এসআইআর-এর প্রস্তুতি নিতে। গত ২৭ অক্টোবর আরও ১২টি অতিরিক্ত রাজ্য ও অঞ্চলে এসআইআর শুরু হয়েছে। এসব রাজ্য ও অঞ্চলে প্রায় ৫০ কোটি ভোটার আছে।
১৪০ কোটিরও বেশি মানুষের নাগরিকত্ব যাচাই করার বিশাল কর্মযজ্ঞের বিষয়ে সমালোচকেরা বলছেন, এর ফলে প্রায় ৯ কোটি ভারতীয় ভোটাধিকার হারাতে পারেন। আর এ কারণেই মূলত বিহারের ঘটনা জাতীয় বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে। গত আগস্টে বিরোধীদলীয় সাংসদ ও ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস দলের নেতা রাহুল গান্ধী এসআইআর-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বিহারে মিছিলের নেতৃত্ব দেন। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর নেতারাও সেখানে অংশ নেন।
বিহারের ভোটার যাচাই অভিযান এখন নাগরিক সমাজ কর্মী ও বিরোধীদলীয় দলগুলোর চোখে ভারতের গণতান্ত্রিক বৈধতা রক্ষার নতুন সংগ্রাম। এই বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজের ভাইস–প্রেসিডেন্ট পুষ্পেন্দ্র বলেন, ‘এখন এটা একজাতীয় অভিযান। এই এসআইআর অন্য রাজ্যেও যাচ্ছে এবং তারা (বিরোধী দল) জানে যে, তাদের এমন ক্যাম্পেইন গড়ে তুলতে হবে যাতে এই প্রক্রিয়াকে পরাস্ত করা যায়।’
তথ্যসূত্র: ফরেন পলিসি

বিশেষত সংগীতের প্রতি উত্তমের ছিল অসীম একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও ভালোবাসা। প্রাথমিক জীবনে গানের শিক্ষক হিসেবেই কিন্তু তিনি টিকে থাকার চেষ্টা করেছিলেন। স্ত্রী গৌরী দেবীর সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও হয়েছিল এই গান শেখানোর মধ্য দিয়ে। অসামান্য গলা আর অসাধারণ গায়ন রীতির অধিকারী ছিলেন তিনি। অভিনয় যদি তিনি না করতেন, তাহলে উত
২৪ জুলাই ২০২১
দশকের পর দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে একটি পরিবার। নেহরু–গান্ধী পরিবার। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী এবং বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী ও সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র...
২ দিন আগে
সংযুক্ত আরব আমিরাতই প্রথম আরব দেশ হিসেবে সহিষ্ণুতা মন্ত্রণালয় চালু করেছিল। আবার প্রথম আরব দেশ হিসেবে গণহত্যার অভিযোগেও অভিযুক্ত দেশটি। গত ১০ এপ্রিল সুদানের পক্ষের আইনজীবীরা আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) এই অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করেন। তাঁদের অভিযোগ, আরব আমিরাত মাসালিত জাতিগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা
২ দিন আগে
আরএসএফ সম্প্রতি সুদানের উত্তর দারফুরের রাজধানী আল-ফাশের দখল করার পর সেখানে ব্যাপক নৃশংসতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ৫০০ দিনেরও বেশি অবরোধের পর এই বিজয়ের পর আরএসএফ যোদ্ধারা বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যা, এমনকি হাসপাতালেও নির্বিচারে হত্যার ভিডিও ধারণ করেছে।
৪ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

দশকের পর দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে একটি পরিবার। নেহরু–গান্ধী পরিবার। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী এবং বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী ও সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র এই পরিবারের সদস্য। এই পরিবারের প্রভাব ভারতের রাজনীতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
তাদের এই উত্তরাধিকার শুধু ইতিহাসে নয়, রাজনীতির মানসেও এক ধারণা গভীরভাবে বসিয়ে দিয়েছে যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব জন্মগত অধিকারও হতে পারে। এই চিন্তাই ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের রাজনীতির প্রতিটি দলে, প্রতিটি প্রদেশে, আর প্রতিটি স্তরে।
কেবল নেহরু–গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধেই পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ তোলা হলেও, রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বা বংশানুক্রমিক রাজনীতি আসলে ভারতের প্রায় সব দলেই দেখা যায়। জনতা দল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা বিজয়নন্দ (বিজু) পট্টনায়কের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে নবীন পট্টনায়ক লোকসভায় বাবার খালি আসনে নির্বাচিত হন। পরে নবীন বাবার নাম অনুসারে ‘বিজু জনতা দল’ প্রতিষ্ঠা করেন। বিজুর পথ অনুসরণ করে নবীন ওডিশার মুখ্যমন্ত্রী হন এবং দুই দশকেরও বেশি সময় রাজ্য পরিচালনা করেন।
মহারাষ্ট্রের দল শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা বাল ঠাকরে মৃত্যুর আগে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেন তাঁর ছেলে উদ্ধব ঠাকরেকে। উদ্ধবের ছেলে আদিত্য ঠাকরেও এখন রাজনীতির মঞ্চে সক্রিয়, ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের অপেক্ষায়। একই ধারা দেখা যায় সমাজবাদী পার্টিতেও। দলের প্রতিষ্ঠাতা মুলায়ম সিং যাদব উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। পরে তাঁর ছেলে অখিলেশ যাদবও সেই পদে আসেন। এখন তিনি দলের সভাপতি ও এমপি। বিহারের লোক জনশক্তি পার্টিতেও একই চিত্র। প্রয়াত নেতা রামবিলাস পাসওয়ানের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে চিরাগ পাসওয়ান দলের নেতৃত্বে এসেছেন।
ভারতের মূল ভূখণ্ডের বাইরেও এই বংশানুক্রমিক রাজনীতির প্রভাব স্পষ্ট। জম্মু–কাশ্মীরে তিন প্রজন্ম ধরে আবদুল্লাহ পরিবার রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে, আর বিরোধী শিবিরে নেতৃত্বে আছে মুফতি পরিবারের দুই প্রজন্ম। পাঞ্জাবে দীর্ঘদিন শিরোমণি আকালি দল পরিচালনা করেছেন প্রকাশ সিং বাদল। এখন তাঁর ছেলে সুখবীর বাদল দলের প্রধান। তেলেঙ্গানায় ভারত রাষ্ট্র সমিতির প্রতিষ্ঠাতা কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের ছেলে ও মেয়ে—দুজনেই এখন উত্তরাধিকারের লড়াইয়ে নেমেছেন। তামিলনাড়ুতে প্রয়াত এম করুণানিধির পরিবার এখনো ক্ষমতাসীন দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগাম (ডিএমকে) দলের নিয়ন্ত্রণে। তাঁর ছেলে এমকে স্ট্যালিন এখন মুখ্যমন্ত্রী, আর তাঁর নাতিকে ভবিষ্যৎ উত্তরসূরি হিসেবে প্রস্তুত করা হচ্ছে।
এটি শুধু কিছু বিখ্যাত পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ভারতের শাসনব্যবস্থার গাঁথুনিতেই এই পারিবারিক রাজনীতি বীজ গভীরভাবে বোনা। সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৪৯টি পরিবার থেকে একাধিক সদস্য রাজ্যের আইনসভায় রয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের ১১ জন মন্ত্রী ও ৯ জন মুখ্যমন্ত্রীরও পারিবারিক রাজনৈতিক সংযোগ আছে। ২০০৯ সালের নির্বাচনের এক গবেষণায় দেখা যায়, ৪৫ বছরের নিচে দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় কেউ না কেউ রাজনীতিতে ছিলেন। তরুণ সাংসদদের প্রায় সবাই কোনো আত্মীয়—সাধারণত বাবা বা মা—থেকে আসন উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সব দলের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, নারী সাংসদদের ৭০ শতাংশ বংশানুক্রমিক রাজনীতির ফল। এমনকি যেসব নারী রাজনীতিকের সরাসরি উত্তরসূরি নেই, যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও কুমারী মায়াবতী, তাঁরাও তাঁদের ভাতিজাদের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে গড়ে তুলছেন।
ন্যায্যভাবে বলতে গেলে, এই বংশানুক্রমিক রাজনীতি গোটা উপমহাদেশেই দেখা যায়। পাকিস্তানে ভুট্টো ও শরিফ পরিবার, বাংলাদেশে শেখ ও জিয়া পরিবার, শ্রীলঙ্কায় বন্দরনায়েকে ও রাজাপক্ষে পরিবার। তবে ভারতের প্রাণবন্ত গণতন্ত্রে এই প্রবণতা কিছুটা বেমানান বলেই মনে হয়। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কেন ভারত এত গভীরভাবে এই পারিবারিক রাজনীতি মেনে নিয়েছে?
এর একটি কারণ হতে পারে—পরিবার একটি কার্যকর রাজনৈতিক ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে কাজ করে। পরিচিত নামধারী প্রার্থীদের ভোটারদের মনোযোগ পেতে বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। যদি ভোটাররা কোনো প্রার্থীর বাবা, খালা বা ভাইকে একসময় গ্রহণ করে থাকেন, তবে তাঁরা সম্ভবত একই পরিবারের নতুন প্রার্থীকেও সহজেই মেনে নেন। এভাবে তাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য আলাদা করে কিছু করতে হয় না। ভারতের অতীত প্রেক্ষাপটে, যখন সাক্ষরতার হার ও গণমাধ্যমের প্রভাব কম ছিল, তখন এই বিষয়টি আরও বেশি শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছিল।
কিন্তু সাক্ষরতার হার যখন ৮১ শতাংশের কাছাকাছি এবং মোবাইল-ইন্টারনেট ব্যবহার ৯৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে, তখন বোঝা যায় অন্য আরও কিছু কারণ আছে এর পেছনে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়তো—দলীয় রাজনীতির ভেতরকার চর্চা ও গতিপ্রকৃতি। অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক। নেতৃত্ব বাছাইয়ের প্রক্রিয়াও প্রায় অস্বচ্ছ। প্রায় সব দলেই সিদ্ধান্ত নেয় একদল ক্ষুদ্র প্রভাবশালী গোষ্ঠী, কখনো বা একক কোনো নেতা, যাদের আবার পরিবর্তন আনাতে আগ্রহ কম। ফলে, যোগ্যতার চেয়ে পারিবারিক সম্পর্কই সাধারণত বেশি মূল্য পায়।
এ অবস্থায় প্রার্থী হতে গেলে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়, যা নতুনদের জন্য বাধা। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক পরিবারগুলোর হাতে থাকে বিপুল অর্থনৈতিক পুঁজি, যা তারা বছরের পর বছর ক্ষমতায় থেকে জমিয়েছে। তাদের আছে তৈরি নির্বাচনী কাঠামো—দাতা, কর্মী ও স্থানীয় সন্ত্রাসীদের নেটওয়ার্ক। এতে করে নতুন রাজনীতিকদের তুলনায় তাদের সুবিধা অনেক বেশি।
ভারতের এই পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির পেছনে সাংস্কৃতিক কারণও আছে। আধুনিকায়নের অগ্রগতি সত্ত্বেও সমাজে এখনো জমিদারি মানসিকতা টিকে আছে। আগের দিনে যেভাবে স্থানীয় জমিদার বা রাজাদের প্রতি আনুগত্য দেখানো হতো, এখন সেই শ্রদ্ধা দেওয়া হয় রাজনৈতিক নেতাদের। এতে মনে হয় রাজনৈতিক অভিজাতরা যেন অন্য শ্রেণির মানুষ, যাদের পরিবারই ক্ষমতার উপযুক্ত। এই অহংবোধ এতটাই গভীর যে দুর্বল কর্মক্ষমতাও তাদের নেতৃত্ব থেকে সরাতে পারে না। বারবার নির্বাচনে হারলেও তারা দলীয় নেতৃত্ব ধরে রাখে।
এ ধরনের রাজনীতি ভারতের গণতন্ত্রের জন্য গুরুতর হুমকি। যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্ধারিত হয় বংশপরম্পরায়, যোগ্যতা, নিষ্ঠা বা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বদলে, তখন শাসনব্যবস্থার মান নেমে যায়। সীমিত প্রতিভার ভান্ডার থেকে নেতৃত্ব বেছে নেওয়া কখনোই সুবিধাজনক নয়। আরও খারাপ হয় যখন প্রার্থীর একমাত্র যোগ্যতা হয় তার পদবি। এমন নেতারা সাধারণ মানুষের বাস্তব চ্যালেঞ্জ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। ফলে জনগণের প্রয়োজন বুঝে কাজ করার সক্ষমতাও কম থাকে। তবুও তাদের ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত হয় না।
এখন সময় এসেছে ভারতকে ‘রাজবংশের’ রাজনীতি ছাড়িয়ে যোগ্যতাভিত্তিক রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার। এর জন্য প্রয়োজন গভীর সংস্কার—আইন করে মেয়াদসীমা নির্ধারণ, দলীয় পর্যায়ে প্রকৃত নির্বাচনের ব্যবস্থা, এবং ভোটারদের সচেতন করে যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতা বাছাইয়ের প্রেরণা জাগানো। যত দিন ভারতীয় রাজনীতি পরিবারকেন্দ্রিক থাকবে, তত দিন পর্যন্ত গণতন্ত্রের আসল লক্ষ্য—‘জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য’—পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে না।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

দশকের পর দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে একটি পরিবার। নেহরু–গান্ধী পরিবার। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী এবং বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী ও সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র এই পরিবারের সদস্য। এই পরিবারের প্রভাব ভারতের রাজনীতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
তাদের এই উত্তরাধিকার শুধু ইতিহাসে নয়, রাজনীতির মানসেও এক ধারণা গভীরভাবে বসিয়ে দিয়েছে যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব জন্মগত অধিকারও হতে পারে। এই চিন্তাই ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের রাজনীতির প্রতিটি দলে, প্রতিটি প্রদেশে, আর প্রতিটি স্তরে।
কেবল নেহরু–গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধেই পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ তোলা হলেও, রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বা বংশানুক্রমিক রাজনীতি আসলে ভারতের প্রায় সব দলেই দেখা যায়। জনতা দল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা বিজয়নন্দ (বিজু) পট্টনায়কের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে নবীন পট্টনায়ক লোকসভায় বাবার খালি আসনে নির্বাচিত হন। পরে নবীন বাবার নাম অনুসারে ‘বিজু জনতা দল’ প্রতিষ্ঠা করেন। বিজুর পথ অনুসরণ করে নবীন ওডিশার মুখ্যমন্ত্রী হন এবং দুই দশকেরও বেশি সময় রাজ্য পরিচালনা করেন।
মহারাষ্ট্রের দল শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা বাল ঠাকরে মৃত্যুর আগে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেন তাঁর ছেলে উদ্ধব ঠাকরেকে। উদ্ধবের ছেলে আদিত্য ঠাকরেও এখন রাজনীতির মঞ্চে সক্রিয়, ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের অপেক্ষায়। একই ধারা দেখা যায় সমাজবাদী পার্টিতেও। দলের প্রতিষ্ঠাতা মুলায়ম সিং যাদব উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। পরে তাঁর ছেলে অখিলেশ যাদবও সেই পদে আসেন। এখন তিনি দলের সভাপতি ও এমপি। বিহারের লোক জনশক্তি পার্টিতেও একই চিত্র। প্রয়াত নেতা রামবিলাস পাসওয়ানের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে চিরাগ পাসওয়ান দলের নেতৃত্বে এসেছেন।
ভারতের মূল ভূখণ্ডের বাইরেও এই বংশানুক্রমিক রাজনীতির প্রভাব স্পষ্ট। জম্মু–কাশ্মীরে তিন প্রজন্ম ধরে আবদুল্লাহ পরিবার রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে, আর বিরোধী শিবিরে নেতৃত্বে আছে মুফতি পরিবারের দুই প্রজন্ম। পাঞ্জাবে দীর্ঘদিন শিরোমণি আকালি দল পরিচালনা করেছেন প্রকাশ সিং বাদল। এখন তাঁর ছেলে সুখবীর বাদল দলের প্রধান। তেলেঙ্গানায় ভারত রাষ্ট্র সমিতির প্রতিষ্ঠাতা কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের ছেলে ও মেয়ে—দুজনেই এখন উত্তরাধিকারের লড়াইয়ে নেমেছেন। তামিলনাড়ুতে প্রয়াত এম করুণানিধির পরিবার এখনো ক্ষমতাসীন দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগাম (ডিএমকে) দলের নিয়ন্ত্রণে। তাঁর ছেলে এমকে স্ট্যালিন এখন মুখ্যমন্ত্রী, আর তাঁর নাতিকে ভবিষ্যৎ উত্তরসূরি হিসেবে প্রস্তুত করা হচ্ছে।
এটি শুধু কিছু বিখ্যাত পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ভারতের শাসনব্যবস্থার গাঁথুনিতেই এই পারিবারিক রাজনীতি বীজ গভীরভাবে বোনা। সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৪৯টি পরিবার থেকে একাধিক সদস্য রাজ্যের আইনসভায় রয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের ১১ জন মন্ত্রী ও ৯ জন মুখ্যমন্ত্রীরও পারিবারিক রাজনৈতিক সংযোগ আছে। ২০০৯ সালের নির্বাচনের এক গবেষণায় দেখা যায়, ৪৫ বছরের নিচে দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় কেউ না কেউ রাজনীতিতে ছিলেন। তরুণ সাংসদদের প্রায় সবাই কোনো আত্মীয়—সাধারণত বাবা বা মা—থেকে আসন উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সব দলের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, নারী সাংসদদের ৭০ শতাংশ বংশানুক্রমিক রাজনীতির ফল। এমনকি যেসব নারী রাজনীতিকের সরাসরি উত্তরসূরি নেই, যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও কুমারী মায়াবতী, তাঁরাও তাঁদের ভাতিজাদের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে গড়ে তুলছেন।
ন্যায্যভাবে বলতে গেলে, এই বংশানুক্রমিক রাজনীতি গোটা উপমহাদেশেই দেখা যায়। পাকিস্তানে ভুট্টো ও শরিফ পরিবার, বাংলাদেশে শেখ ও জিয়া পরিবার, শ্রীলঙ্কায় বন্দরনায়েকে ও রাজাপক্ষে পরিবার। তবে ভারতের প্রাণবন্ত গণতন্ত্রে এই প্রবণতা কিছুটা বেমানান বলেই মনে হয়। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কেন ভারত এত গভীরভাবে এই পারিবারিক রাজনীতি মেনে নিয়েছে?
এর একটি কারণ হতে পারে—পরিবার একটি কার্যকর রাজনৈতিক ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে কাজ করে। পরিচিত নামধারী প্রার্থীদের ভোটারদের মনোযোগ পেতে বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। যদি ভোটাররা কোনো প্রার্থীর বাবা, খালা বা ভাইকে একসময় গ্রহণ করে থাকেন, তবে তাঁরা সম্ভবত একই পরিবারের নতুন প্রার্থীকেও সহজেই মেনে নেন। এভাবে তাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য আলাদা করে কিছু করতে হয় না। ভারতের অতীত প্রেক্ষাপটে, যখন সাক্ষরতার হার ও গণমাধ্যমের প্রভাব কম ছিল, তখন এই বিষয়টি আরও বেশি শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছিল।
কিন্তু সাক্ষরতার হার যখন ৮১ শতাংশের কাছাকাছি এবং মোবাইল-ইন্টারনেট ব্যবহার ৯৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে, তখন বোঝা যায় অন্য আরও কিছু কারণ আছে এর পেছনে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়তো—দলীয় রাজনীতির ভেতরকার চর্চা ও গতিপ্রকৃতি। অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক। নেতৃত্ব বাছাইয়ের প্রক্রিয়াও প্রায় অস্বচ্ছ। প্রায় সব দলেই সিদ্ধান্ত নেয় একদল ক্ষুদ্র প্রভাবশালী গোষ্ঠী, কখনো বা একক কোনো নেতা, যাদের আবার পরিবর্তন আনাতে আগ্রহ কম। ফলে, যোগ্যতার চেয়ে পারিবারিক সম্পর্কই সাধারণত বেশি মূল্য পায়।
এ অবস্থায় প্রার্থী হতে গেলে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়, যা নতুনদের জন্য বাধা। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক পরিবারগুলোর হাতে থাকে বিপুল অর্থনৈতিক পুঁজি, যা তারা বছরের পর বছর ক্ষমতায় থেকে জমিয়েছে। তাদের আছে তৈরি নির্বাচনী কাঠামো—দাতা, কর্মী ও স্থানীয় সন্ত্রাসীদের নেটওয়ার্ক। এতে করে নতুন রাজনীতিকদের তুলনায় তাদের সুবিধা অনেক বেশি।
ভারতের এই পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির পেছনে সাংস্কৃতিক কারণও আছে। আধুনিকায়নের অগ্রগতি সত্ত্বেও সমাজে এখনো জমিদারি মানসিকতা টিকে আছে। আগের দিনে যেভাবে স্থানীয় জমিদার বা রাজাদের প্রতি আনুগত্য দেখানো হতো, এখন সেই শ্রদ্ধা দেওয়া হয় রাজনৈতিক নেতাদের। এতে মনে হয় রাজনৈতিক অভিজাতরা যেন অন্য শ্রেণির মানুষ, যাদের পরিবারই ক্ষমতার উপযুক্ত। এই অহংবোধ এতটাই গভীর যে দুর্বল কর্মক্ষমতাও তাদের নেতৃত্ব থেকে সরাতে পারে না। বারবার নির্বাচনে হারলেও তারা দলীয় নেতৃত্ব ধরে রাখে।
এ ধরনের রাজনীতি ভারতের গণতন্ত্রের জন্য গুরুতর হুমকি। যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্ধারিত হয় বংশপরম্পরায়, যোগ্যতা, নিষ্ঠা বা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বদলে, তখন শাসনব্যবস্থার মান নেমে যায়। সীমিত প্রতিভার ভান্ডার থেকে নেতৃত্ব বেছে নেওয়া কখনোই সুবিধাজনক নয়। আরও খারাপ হয় যখন প্রার্থীর একমাত্র যোগ্যতা হয় তার পদবি। এমন নেতারা সাধারণ মানুষের বাস্তব চ্যালেঞ্জ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। ফলে জনগণের প্রয়োজন বুঝে কাজ করার সক্ষমতাও কম থাকে। তবুও তাদের ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত হয় না।
এখন সময় এসেছে ভারতকে ‘রাজবংশের’ রাজনীতি ছাড়িয়ে যোগ্যতাভিত্তিক রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার। এর জন্য প্রয়োজন গভীর সংস্কার—আইন করে মেয়াদসীমা নির্ধারণ, দলীয় পর্যায়ে প্রকৃত নির্বাচনের ব্যবস্থা, এবং ভোটারদের সচেতন করে যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতা বাছাইয়ের প্রেরণা জাগানো। যত দিন ভারতীয় রাজনীতি পরিবারকেন্দ্রিক থাকবে, তত দিন পর্যন্ত গণতন্ত্রের আসল লক্ষ্য—‘জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য’—পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে না।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

বিশেষত সংগীতের প্রতি উত্তমের ছিল অসীম একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও ভালোবাসা। প্রাথমিক জীবনে গানের শিক্ষক হিসেবেই কিন্তু তিনি টিকে থাকার চেষ্টা করেছিলেন। স্ত্রী গৌরী দেবীর সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও হয়েছিল এই গান শেখানোর মধ্য দিয়ে। অসামান্য গলা আর অসাধারণ গায়ন রীতির অধিকারী ছিলেন তিনি। অভিনয় যদি তিনি না করতেন, তাহলে উত
২৪ জুলাই ২০২১
বিহারের বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সী ক্লেরেন্স টপ্পো তাঁর এক বন্ধুর কাছে জানতে পারেন, তাঁর মা মারা গেছেন। ঘটনা চলতি বছরের আগস্টের শুরুর দিকের। টপ্পো খবর পেয়ে বেশ অবাক হন। কারণ, তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকেন, মা সুস্থ শরীরে বহাল তবিয়তে। কিন্তু ৭৪ বছর বয়সী মেরি টপ্পো ভারত সরকারের নথিতে মৃত।
১৭ ঘণ্টা আগে
সংযুক্ত আরব আমিরাতই প্রথম আরব দেশ হিসেবে সহিষ্ণুতা মন্ত্রণালয় চালু করেছিল। আবার প্রথম আরব দেশ হিসেবে গণহত্যার অভিযোগেও অভিযুক্ত দেশটি। গত ১০ এপ্রিল সুদানের পক্ষের আইনজীবীরা আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) এই অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করেন। তাঁদের অভিযোগ, আরব আমিরাত মাসালিত জাতিগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা
২ দিন আগে
আরএসএফ সম্প্রতি সুদানের উত্তর দারফুরের রাজধানী আল-ফাশের দখল করার পর সেখানে ব্যাপক নৃশংসতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ৫০০ দিনেরও বেশি অবরোধের পর এই বিজয়ের পর আরএসএফ যোদ্ধারা বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যা, এমনকি হাসপাতালেও নির্বিচারে হত্যার ভিডিও ধারণ করেছে।
৪ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

সংযুক্ত আরব আমিরাতই প্রথম আরব দেশ হিসেবে সহিষ্ণুতা মন্ত্রণালয় চালু করেছিল। আবার প্রথম আরব দেশ হিসেবে গণহত্যার অভিযোগেও অভিযুক্ত দেশটি। গত ১০ এপ্রিল সুদানের পক্ষের আইনজীবীরা আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) এই অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করেন। তাঁদের অভিযোগ, আরব আমিরাত মাসালিত জাতিগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালানো সুদানি আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসকে (আরএসএফ) সমর্থন দিয়েছে।
আরব আমিরাত এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা রিম কেতায়েত বলেছেন, এটি ‘নোংরা ও ভিত্তিহীন প্রচারণা।’ তাঁর দাবি, সুদানের সেনাবাহিনীর বর্বরতা থেকে দৃষ্টি ফেরাতে এসব অভিযোগ আনা হয়েছে। এই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেই দুই বছর ধরে গৃহযুদ্ধে লড়াইরত আরএসএফ।
বিষয়টি সত্যি যে, সুদানি সেনাবাহিনীও যুদ্ধাপরাধ করেছে। কিন্তু আরএসএফ–এর প্রতি আমিরাতের সমর্থন নিয়ে কারও তেমন সন্দেহ নেই। তবে তারপরও আইনি জটিলতার কারণে মামলাটির সামনে এগোনোর সম্ভাবনা কম। তবে এই ঘটনা একটি প্রবণতা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে আমিরাত এমন সব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সমর্থন দিচ্ছে, যারা হয়—রাষ্ট্র দখল করতে চায়, নয়তো সেটিকে ভাঙতে চায়।
আধুনিক আরব বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু এখন সৌদি আরব ও আমিরাত। দুই দেশই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি ও প্রভাবশালী কূটনৈতিক শক্তি। উভয়ই নিজেদের বহু মেরু বিশ্বের স্বাধীন শক্তি হিসেবে দেখে। কিন্তু আঞ্চলিক রাজনীতিতে তাদের পথ আলাদা। সৌদি আরব স্থিতিশীলতাকে মূল স্বার্থ হিসেবে বিবেচনা করে এবং (যদিও সব সময় নয়) যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলার চেষ্টা করে।
অন্যদিকে, সাতটি আমিরাত নিয়ে গঠিত সংযুক্ত আরব আমিরাতের (যার মধ্যে দুবাই আছে এবং সবচেয়ে ধনী আবুধাবি) নীতিনির্ধারণ ভিন্ন ধাঁচের। লিবিয়ায় তারা বিদ্রোহী নেতা খলিফা হাফতারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। হাফতারই লিবিয়ায় জাতিসংঘ-সমর্থিত সরকার উৎখাতের চেষ্টা করেছিলেন। ইয়েমেনে আমিরাত বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিলকে সমর্থন দিচ্ছে। সোমালিয়ার বিচ্ছিন্ন দুই অঞ্চল—পুন্টল্যান্ড ও সোমালিল্যান্ডের নেতাদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে দেশটি।
এসব নীতির অনেকটাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী। সুদানে আরএসএফ–কে সমর্থন দিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তো বটেই, চীন ও শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ করেছে। ফলে বিষয়টি সামান্য কিছু নয়।
আঞ্চলিক ইস্যুতে নিজেদের নীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমিরাতের কর্মকর্তারা প্রায়ই বলেন, ‘এই নীতি আমাদের নয়।’ আর এর ধারাবাহিকতায় দেশটি আরএসএফ–কে অস্ত্র দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে জাতিসংঘের তদন্ত ও স্যাটেলাইট চিত্র প্রমাণ করেছে, তারা প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও দেশটি আরএসএফকে অস্ত্র পাঠাচ্ছিল।
আমিরাতের এক কর্মকর্তা দাবি করেছিলেন, হাফতারের প্রতি তাদের সমর্থন ছিল ‘মিত্রদের পূর্ণ সম্মতি সাপেক্ষেই।’ যদিও লিবিয়ার বেশির ভাগ মিত্র, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, হাফতারের বিরোধী ছিল।
আবুধাবিতে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকরা মনে করেন, এই নীতির পেছনে আরব আমিরাতের অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কেউ কেউ বলেন, সুদানের স্বর্ণ খনির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পেতেই হয়তো আমিরাত আগ্রহী। কিন্তু এই ব্যাখ্যা যথেষ্ট নয়। কারণ সুদানের বেশির ভাগ স্বর্ণ এরই মধ্যে আমিরাতে রপ্তানি হচ্ছে। আবার অনেকে মনে করেন, খাদ্য নিরাপত্তা উদ্যোগে অগ্রগতি আনতে আমিরাত সুদানে কৃষিজমি ও সমুদ্রবন্দরে প্রবেশাধিকার চায়; কারণ দেশটির ৯০ শতাংশ খাদ্য আমদানিনির্ভর।
তবে কেবল বাণিজ্যিক দিক দিয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা ভুল হবে। আমিরাতের প্রধান প্রেরণা আদর্শিক। প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান ইসলামি রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর তীব্র বিরোধী। তিনি এবং তাঁর পরিবার চান আরব বিশ্বে কাতার ও তুরস্কের প্রভাব কমাতে। কারণ, এই দুই দেশই মুসলিম বিশ্বে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর বড় সমর্থক। একই সঙ্গে আরব আমিরাত সৌদি আরবের প্রভাবের বাইরে নিজেদের আলাদা প্রভাব বলয় গড়ে তুলতে চায়।
ইয়েমেনে নিরাপত্তা ঝুঁকির আশঙ্কা থেকেই আমিরাত ২০১৫ সালে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেয়। সে সময় রিয়াদ হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। হুতি ইরান-সমর্থিত শিয়া গোষ্ঠী। রাজধানী সানাসহ ইয়েমেনের বড় একটি অংশ তাদের দখলে। সৌদি ও আমিরাত কেউই চায়নি—ইরানের মদদপুষ্ট কোনো গোষ্ঠী আরব উপদ্বীপে শক্ত ঘাঁটি পাক। তবে আমিরাত চেয়েছিল নিজেদের অনুগত মিত্র তৈরি করতে। কারণ, তাদের কাছে সৌদি আরবও বিশ্বাসযোগ্য মিত্র নয়। কারণ, সৌদিরা ইসলামি রাজনৈতিক দল ইসলাহের বেশ ঘনিষ্ঠ মিত্র, যা আবার মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি শাখা।
ইয়েমেন ১৯৯০ সালের আগে পর্যন্ত কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ছিল। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নীতিগত অবস্থানের সঙ্গে আমিরাতের নীতি বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই জোট ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক সুফলও বয়ে আনতে পারে। আবুধাবিভিত্তিক রাষ্ট্রীয় শিপিং জায়ান্ট এডি পোর্টস আশা করছে, তারা দক্ষিণ ইয়েমেনের এডেন বন্দরের পরিচালনার অধিকার পাবে। আমিরাতের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির স্বার্থে তারা আঞ্চলিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করছে, তবে এটাই দেশটির মূল উদ্দেশ্য নয়।
২০১৯ সালে ওমর আল-বশির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সুদানে কয়েক দশকের ইসলামপন্থী শাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু সেনাবাহিনীতে এখনো ইসলামপন্থী কর্মকর্তাদের প্রভাব রয়েছে। এ কারণেই শেখ মুহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান দ্রুত সমর্থন দেন আরএসএফ–কে। আরেকটি কারণ ছিল, মিলিশিয়া নেতা মুহাম্মদ হামদান দাগালো—যিনি ‘হেমেদতি’ নামেও পরিচিত—ইয়েমেনে যুদ্ধের সময় আরব আমিরাতকে সহায়তা দিতে হাজার হাজার যোদ্ধা পাঠিয়েছিলেন। শেখ মুহাম্মদ হয়তো সেই সহযোগিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চেয়েছেন। সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার মনে হয়, তিনি এই লোকদের প্রতি একধরনের আনুগত্য অনুভব করেন।’
আমিরাতের দাবি—তারা শুধু বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে এগোচ্ছে। যুক্তিটা কিছুটা গ্রহণযোগ্যও। ইয়েমেনে তাদের মিত্ররা সৌদি সমর্থিত বাহিনীর চেয়ে দক্ষ যোদ্ধা প্রমাণিত হয়েছিল। লিবিয়ার জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারও যতটা বৈধ বলে শোনা যায়, বাস্তবে তা নয়—সেখানে প্রভাবশালী হলো মিলিশিয়ারা।
তবু এসব শক্তির প্রতি সমর্থন খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। ২০১৮ সালে আমিরাত দামেস্কে দূতাবাস পুনরায় চালু করে এবং অন্যান্য দেশকেও বাশার আল-আসাদ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আহ্বান জানায়। শেখ মুহাম্মদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাশ বলেন, ‘দশ বছরের হতাশা থেকেই এই যোগাযোগ শুরু হয়েছিল।’ তাঁর মতে, সিরিয়ার একনায়ককে একঘরে করে রাখা কাজে আসেনি; তাই তাঁকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা উচিত ছিল। সেই চেষ্টা করে অবশ্য কোনো ফল পায়নি আমিরাত।
আসাদ গত ডিসেম্বরে মস্কো পালিয়ে যান। সিরিয়ার ইসলামপন্থী নতুন সরকারের প্রতি আমিরাতের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো সন্দেহ প্রবণ। এমনকি অন্যান্য উপসাগরীয় দেশের তুলনায়ও অনেক বেশি। তবে এখনো নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি আমিরাত।
এর আগে, হাফতার ত্রিপোলি দখলের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছেন। আরএসএফও গত মাসে সুদানের রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে শহর ছেড়ে পালিয়েছে। বলা যায়, দুই ক্ষেত্রেই আমিরাতের ভূমিকা উল্টো ফল দিয়েছে। এতে তুরস্ক সুদানি সেনাবাহিনী ও ত্রিপোলির সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার আরও বেশি সুযোগ পেয়েছে। ওই দুই পক্ষই এখন তুর্কি ড্রোনের ওপর নির্ভর করছে প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করতে।
এসব নীতি আমিরাতের সুনামেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। গত মাসে ওয়াশিংটনে কয়েক দফা বৈঠকে তিন কংগ্রেস সদস্যের সহযোগী আমিরাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনা উত্থাপন করেছেন। যদিও তা আপাতত কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রচলিত আছে যে, আরএসএফ-এর মতো গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করা শুধু অপরাধ নয়, বরং এক ভয়াবহ ভুল।
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

সংযুক্ত আরব আমিরাতই প্রথম আরব দেশ হিসেবে সহিষ্ণুতা মন্ত্রণালয় চালু করেছিল। আবার প্রথম আরব দেশ হিসেবে গণহত্যার অভিযোগেও অভিযুক্ত দেশটি। গত ১০ এপ্রিল সুদানের পক্ষের আইনজীবীরা আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) এই অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করেন। তাঁদের অভিযোগ, আরব আমিরাত মাসালিত জাতিগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালানো সুদানি আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসকে (আরএসএফ) সমর্থন দিয়েছে।
আরব আমিরাত এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা রিম কেতায়েত বলেছেন, এটি ‘নোংরা ও ভিত্তিহীন প্রচারণা।’ তাঁর দাবি, সুদানের সেনাবাহিনীর বর্বরতা থেকে দৃষ্টি ফেরাতে এসব অভিযোগ আনা হয়েছে। এই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেই দুই বছর ধরে গৃহযুদ্ধে লড়াইরত আরএসএফ।
বিষয়টি সত্যি যে, সুদানি সেনাবাহিনীও যুদ্ধাপরাধ করেছে। কিন্তু আরএসএফ–এর প্রতি আমিরাতের সমর্থন নিয়ে কারও তেমন সন্দেহ নেই। তবে তারপরও আইনি জটিলতার কারণে মামলাটির সামনে এগোনোর সম্ভাবনা কম। তবে এই ঘটনা একটি প্রবণতা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে আমিরাত এমন সব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সমর্থন দিচ্ছে, যারা হয়—রাষ্ট্র দখল করতে চায়, নয়তো সেটিকে ভাঙতে চায়।
আধুনিক আরব বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু এখন সৌদি আরব ও আমিরাত। দুই দেশই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি ও প্রভাবশালী কূটনৈতিক শক্তি। উভয়ই নিজেদের বহু মেরু বিশ্বের স্বাধীন শক্তি হিসেবে দেখে। কিন্তু আঞ্চলিক রাজনীতিতে তাদের পথ আলাদা। সৌদি আরব স্থিতিশীলতাকে মূল স্বার্থ হিসেবে বিবেচনা করে এবং (যদিও সব সময় নয়) যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলার চেষ্টা করে।
অন্যদিকে, সাতটি আমিরাত নিয়ে গঠিত সংযুক্ত আরব আমিরাতের (যার মধ্যে দুবাই আছে এবং সবচেয়ে ধনী আবুধাবি) নীতিনির্ধারণ ভিন্ন ধাঁচের। লিবিয়ায় তারা বিদ্রোহী নেতা খলিফা হাফতারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। হাফতারই লিবিয়ায় জাতিসংঘ-সমর্থিত সরকার উৎখাতের চেষ্টা করেছিলেন। ইয়েমেনে আমিরাত বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিলকে সমর্থন দিচ্ছে। সোমালিয়ার বিচ্ছিন্ন দুই অঞ্চল—পুন্টল্যান্ড ও সোমালিল্যান্ডের নেতাদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে দেশটি।
এসব নীতির অনেকটাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী। সুদানে আরএসএফ–কে সমর্থন দিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তো বটেই, চীন ও শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ করেছে। ফলে বিষয়টি সামান্য কিছু নয়।
আঞ্চলিক ইস্যুতে নিজেদের নীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমিরাতের কর্মকর্তারা প্রায়ই বলেন, ‘এই নীতি আমাদের নয়।’ আর এর ধারাবাহিকতায় দেশটি আরএসএফ–কে অস্ত্র দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে জাতিসংঘের তদন্ত ও স্যাটেলাইট চিত্র প্রমাণ করেছে, তারা প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও দেশটি আরএসএফকে অস্ত্র পাঠাচ্ছিল।
আমিরাতের এক কর্মকর্তা দাবি করেছিলেন, হাফতারের প্রতি তাদের সমর্থন ছিল ‘মিত্রদের পূর্ণ সম্মতি সাপেক্ষেই।’ যদিও লিবিয়ার বেশির ভাগ মিত্র, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, হাফতারের বিরোধী ছিল।
আবুধাবিতে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকরা মনে করেন, এই নীতির পেছনে আরব আমিরাতের অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কেউ কেউ বলেন, সুদানের স্বর্ণ খনির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পেতেই হয়তো আমিরাত আগ্রহী। কিন্তু এই ব্যাখ্যা যথেষ্ট নয়। কারণ সুদানের বেশির ভাগ স্বর্ণ এরই মধ্যে আমিরাতে রপ্তানি হচ্ছে। আবার অনেকে মনে করেন, খাদ্য নিরাপত্তা উদ্যোগে অগ্রগতি আনতে আমিরাত সুদানে কৃষিজমি ও সমুদ্রবন্দরে প্রবেশাধিকার চায়; কারণ দেশটির ৯০ শতাংশ খাদ্য আমদানিনির্ভর।
তবে কেবল বাণিজ্যিক দিক দিয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা ভুল হবে। আমিরাতের প্রধান প্রেরণা আদর্শিক। প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান ইসলামি রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর তীব্র বিরোধী। তিনি এবং তাঁর পরিবার চান আরব বিশ্বে কাতার ও তুরস্কের প্রভাব কমাতে। কারণ, এই দুই দেশই মুসলিম বিশ্বে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর বড় সমর্থক। একই সঙ্গে আরব আমিরাত সৌদি আরবের প্রভাবের বাইরে নিজেদের আলাদা প্রভাব বলয় গড়ে তুলতে চায়।
ইয়েমেনে নিরাপত্তা ঝুঁকির আশঙ্কা থেকেই আমিরাত ২০১৫ সালে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেয়। সে সময় রিয়াদ হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। হুতি ইরান-সমর্থিত শিয়া গোষ্ঠী। রাজধানী সানাসহ ইয়েমেনের বড় একটি অংশ তাদের দখলে। সৌদি ও আমিরাত কেউই চায়নি—ইরানের মদদপুষ্ট কোনো গোষ্ঠী আরব উপদ্বীপে শক্ত ঘাঁটি পাক। তবে আমিরাত চেয়েছিল নিজেদের অনুগত মিত্র তৈরি করতে। কারণ, তাদের কাছে সৌদি আরবও বিশ্বাসযোগ্য মিত্র নয়। কারণ, সৌদিরা ইসলামি রাজনৈতিক দল ইসলাহের বেশ ঘনিষ্ঠ মিত্র, যা আবার মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি শাখা।
ইয়েমেন ১৯৯০ সালের আগে পর্যন্ত কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ছিল। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নীতিগত অবস্থানের সঙ্গে আমিরাতের নীতি বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই জোট ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক সুফলও বয়ে আনতে পারে। আবুধাবিভিত্তিক রাষ্ট্রীয় শিপিং জায়ান্ট এডি পোর্টস আশা করছে, তারা দক্ষিণ ইয়েমেনের এডেন বন্দরের পরিচালনার অধিকার পাবে। আমিরাতের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির স্বার্থে তারা আঞ্চলিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করছে, তবে এটাই দেশটির মূল উদ্দেশ্য নয়।
২০১৯ সালে ওমর আল-বশির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সুদানে কয়েক দশকের ইসলামপন্থী শাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু সেনাবাহিনীতে এখনো ইসলামপন্থী কর্মকর্তাদের প্রভাব রয়েছে। এ কারণেই শেখ মুহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান দ্রুত সমর্থন দেন আরএসএফ–কে। আরেকটি কারণ ছিল, মিলিশিয়া নেতা মুহাম্মদ হামদান দাগালো—যিনি ‘হেমেদতি’ নামেও পরিচিত—ইয়েমেনে যুদ্ধের সময় আরব আমিরাতকে সহায়তা দিতে হাজার হাজার যোদ্ধা পাঠিয়েছিলেন। শেখ মুহাম্মদ হয়তো সেই সহযোগিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চেয়েছেন। সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার মনে হয়, তিনি এই লোকদের প্রতি একধরনের আনুগত্য অনুভব করেন।’
আমিরাতের দাবি—তারা শুধু বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে এগোচ্ছে। যুক্তিটা কিছুটা গ্রহণযোগ্যও। ইয়েমেনে তাদের মিত্ররা সৌদি সমর্থিত বাহিনীর চেয়ে দক্ষ যোদ্ধা প্রমাণিত হয়েছিল। লিবিয়ার জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারও যতটা বৈধ বলে শোনা যায়, বাস্তবে তা নয়—সেখানে প্রভাবশালী হলো মিলিশিয়ারা।
তবু এসব শক্তির প্রতি সমর্থন খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। ২০১৮ সালে আমিরাত দামেস্কে দূতাবাস পুনরায় চালু করে এবং অন্যান্য দেশকেও বাশার আল-আসাদ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আহ্বান জানায়। শেখ মুহাম্মদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাশ বলেন, ‘দশ বছরের হতাশা থেকেই এই যোগাযোগ শুরু হয়েছিল।’ তাঁর মতে, সিরিয়ার একনায়ককে একঘরে করে রাখা কাজে আসেনি; তাই তাঁকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা উচিত ছিল। সেই চেষ্টা করে অবশ্য কোনো ফল পায়নি আমিরাত।
আসাদ গত ডিসেম্বরে মস্কো পালিয়ে যান। সিরিয়ার ইসলামপন্থী নতুন সরকারের প্রতি আমিরাতের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো সন্দেহ প্রবণ। এমনকি অন্যান্য উপসাগরীয় দেশের তুলনায়ও অনেক বেশি। তবে এখনো নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি আমিরাত।
এর আগে, হাফতার ত্রিপোলি দখলের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছেন। আরএসএফও গত মাসে সুদানের রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে শহর ছেড়ে পালিয়েছে। বলা যায়, দুই ক্ষেত্রেই আমিরাতের ভূমিকা উল্টো ফল দিয়েছে। এতে তুরস্ক সুদানি সেনাবাহিনী ও ত্রিপোলির সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার আরও বেশি সুযোগ পেয়েছে। ওই দুই পক্ষই এখন তুর্কি ড্রোনের ওপর নির্ভর করছে প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করতে।
এসব নীতি আমিরাতের সুনামেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। গত মাসে ওয়াশিংটনে কয়েক দফা বৈঠকে তিন কংগ্রেস সদস্যের সহযোগী আমিরাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনা উত্থাপন করেছেন। যদিও তা আপাতত কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রচলিত আছে যে, আরএসএফ-এর মতো গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করা শুধু অপরাধ নয়, বরং এক ভয়াবহ ভুল।
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

বিশেষত সংগীতের প্রতি উত্তমের ছিল অসীম একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও ভালোবাসা। প্রাথমিক জীবনে গানের শিক্ষক হিসেবেই কিন্তু তিনি টিকে থাকার চেষ্টা করেছিলেন। স্ত্রী গৌরী দেবীর সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও হয়েছিল এই গান শেখানোর মধ্য দিয়ে। অসামান্য গলা আর অসাধারণ গায়ন রীতির অধিকারী ছিলেন তিনি। অভিনয় যদি তিনি না করতেন, তাহলে উত
২৪ জুলাই ২০২১
বিহারের বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সী ক্লেরেন্স টপ্পো তাঁর এক বন্ধুর কাছে জানতে পারেন, তাঁর মা মারা গেছেন। ঘটনা চলতি বছরের আগস্টের শুরুর দিকের। টপ্পো খবর পেয়ে বেশ অবাক হন। কারণ, তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকেন, মা সুস্থ শরীরে বহাল তবিয়তে। কিন্তু ৭৪ বছর বয়সী মেরি টপ্পো ভারত সরকারের নথিতে মৃত।
১৭ ঘণ্টা আগে
দশকের পর দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে একটি পরিবার। নেহরু–গান্ধী পরিবার। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী এবং বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী ও সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র...
২ দিন আগে
আরএসএফ সম্প্রতি সুদানের উত্তর দারফুরের রাজধানী আল-ফাশের দখল করার পর সেখানে ব্যাপক নৃশংসতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ৫০০ দিনেরও বেশি অবরোধের পর এই বিজয়ের পর আরএসএফ যোদ্ধারা বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যা, এমনকি হাসপাতালেও নির্বিচারে হত্যার ভিডিও ধারণ করেছে।
৪ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

আফ্রিকা মহাদেশে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার এবং চলমান সংঘাতকে উসকে দেওয়ার এক চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)-এর বিরুদ্ধে। সোমালিয়ার পুনটল্যান্ড রাজ্যের বোসাসো বিমানবন্দরকে একটি গোপন ট্রানজিট হাব হিসেবে ব্যবহার করে আমিরাত সুদানের বিতর্কিত আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-কে ব্যাপক সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। সরবরাহ করা হচ্ছে কলম্বিয়ার ভাড়াটে সেনা।
মিডল ইস্ট আই-এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ফ্লাইট ট্র্যাকিং ডেটা, স্যাটেলাইট চিত্র, স্থানীয় সূত্র এবং মার্কিন ও আঞ্চলিক কূটনীতিকদের বরাত দিয়ে এ তথ্য উঠে এসেছে। আরএসএফ সম্প্রতি সুদানের উত্তর দারফুরের রাজধানী আল-ফাশের দখল করার পর সেখানে ব্যাপক নৃশংসতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ৫০০ দিনেরও বেশি অবরোধের পর এই বিজয়ের পর আরএসএফ যোদ্ধারা বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যা, এমনকি হাসপাতালেও নির্বিচারে হত্যার ভিডিও ধারণ করেছে।

ভারী কার্গো বিমানের রহস্যময় যাতায়াত
বোসাসো বিমানবন্দরে আজকাল ভারী কার্গো পরিবহনকারী আইএফ-৭৬ বিমানের ঘন ঘন অবতরণ স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে অস্বাভাবিক ছিল, কিন্তু এখন নিয়মিত ঘটনা। পুনটল্যান্ড মেরিটাইম পুলিশ ফোর্সের (পিএমপিএফ) একজন কমান্ডার (আবদুল্লাহি) মিডল ইস্ট মনিটরকে জানিয়েছেন, এই বিমানগুলো ঘন ঘন আসে এবং এগুলোর মাধ্যমে আসা সামরিক সরঞ্জাম ও রসদ দ্রুত অপেক্ষমাণ অন্য বিমানে তুলে সুদানে আরএসএফ-এর জন্য পাঠানো হয়।
সূত্রের বরাত দিয়ে মিডল ইস্ট আই-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বিমানগুলোর উৎস হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত। বিমানবন্দর ব্যবহারের সময়সূচি ঘন ঘন পরিবর্তন করা হয় এবং বিমানগুলো সাধারণত বিমানবন্দরের কর্মচাঞ্চল্য কম থাকার সময় বোসাসোতে পৌঁছায়। মার্কিন গোয়েন্দা সূত্র অনুযায়ী, এই চালানগুলোর মধ্যে চীনা-নির্মিত ড্রোনসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম রয়েছে।
বোসাসো বন্দরের একজন সিনিয়র ম্যানেজার প্রথমবারের মতো মিডল ইস্ট আই-কে নিশ্চিত করেছেন, গত দুই বছরে পাঁচ লাখেরও বেশি ‘বিপজ্জনক’ চিহ্নিত কন্টেইনার আমিরাত বোসাসো বন্দরের মাধ্যমে পাঠিয়েছে। সাধারণ কার্গোর বিপরীতে, এই আমিরাতি চালানগুলোতে ভেতরের মালপত্র বা গন্তব্যের কোনো বিস্তারিত বিবরণ নথিভুক্ত করা হয় না। বন্দরে একটি জাহাজ ভিড়লে পিএমপিএফ বাহিনীকে মোতায়েন করে এলাকা ঘিরে ফেলা হয় এবং ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকে।
কলম্বিয়ান ভাড়াটে সেনাদের গোপন নেটওয়ার্ক
বোসাসো বিমানবন্দরের উত্তর দিকে একটি সামরিক স্থাপনা রয়েছে, এটি কলম্বিয়ার ভাড়াটে সেনাদের আশ্রয়স্থল। মিডল ইস্ট আই-এর হাতে আসা ছবিতে দেখা গেছে, ব্যাকপ্যাক বহনকারী ডজন ডজন কলম্বিয়ান বিমানবন্দরে নেমে সরাসরি সামরিক ক্যাম্পে যাচ্ছে। পিএমপিএফ কমান্ডার আব্দুল্লাহি নিশ্চিত করেছেন, এই এলাকায় বিপুলসংখ্যক কলম্বিয়ান ভাড়াটে সেনা আরএসএফ-এর পক্ষে সুদানে যুদ্ধ পরিচালনার কাজ করছে।
এই ভাড়াটে সেনারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ফ্লাইটে বোসাসোতে আসে এবং এরপর প্রায় প্রতিদিনই ট্রানজিট হয়ে সুদানে পাড়ি জমায়। এই ভাড়াটে সেনারা তাদের ক্যাম্পের ভেতরে একটি নতুন হাসপাতালও নির্মাণ করেছে। সেখানে সুদানে আহত হওয়া আরএসএফ সৈন্যদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। আব্দুল্লাহি রক্তমাখা বিমান দেখার কথা স্মরণ করে বলেন, এই ক্যাম্প আহত আরএসএফ যোদ্ধাদের জন্য একটি চিকিৎসা ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে।

বোসাসো বিমানবন্দরকে সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত সেখানে একটি ফরাসি-নির্মিত সামরিক রাডার সিস্টেমও স্থাপন করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক আইনের প্রশ্ন
যুক্তরাষ্ট্র সরকার ২০২৩ সালেই ঘোষণা করেছিল, আরএসএফ এবং তাদের সহযোগী মিলিশিয়ারা সুদানে ‘গণহত্যা’ চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আরএসএফ-কে সোমালিয়ার মাটি ব্যবহার করে সাহায্য করার বিষয়টি স্থানীয় পিএমপিএফ সৈন্যদের মধ্যে তীব্র নৈতিক দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে। অনেক সেনা কর্মকর্তা মনে করেন, দীর্ঘদিনের মিত্র সুদানের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ভাড়াটে সেনাদের সহায়তা করা নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য।
হর্ন অব আফ্রিকার সংঘাত বিশেষজ্ঞ মার্টিন প্লট সতর্ক করেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) সুদানের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত করছে এবং পুনটল্যান্ড কর্তৃপক্ষ এই অপরাধে সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত হতে পারে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে গৃহযুদ্ধে সুদানের আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-কে সমর্থন করার অভিযোগে সুদান সংযুক্ত আরব আমিরাতকে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। খার্তুম অভিযোগ করে, আরব আমিরাত পশ্চিম দারফুরে মাসালিত সম্প্রদায়ের ‘গণহত্যায় জড়িত’, তারা আরএসএফকে সামরিক, আর্থিক এবং রাজনৈতিক সহায়তা দিয়ে এ অপরাধ সংঘটিত করছে।
যদিও ২০২৩ সালের এপ্রিলে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে, আরএসএফ এবং সুদানি সেনাবাহিনী উভয়ের বিরুদ্ধেই নৃশংসতার অভিযোগ আনা হয়েছে।
মোগাদিসুর নীরবতা ও আমিরাতের কৌশলগত ঘাঁটি
সোমালিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার মোগাদিসুর আকাশপথ নিয়ন্ত্রণ করলেও, তাদের বোসাসোর বন্দর ও বিমানবন্দরের ওপর কোনো কর্তৃত্ব নেই। বিশ্লেষকদের মতে, কেন্দ্রীয় সরকার (প্রেসিডেন্ট হাসান শেখ-এর নেতৃত্বাধীন) আমিরাতের ক্রমবর্ধমান ও প্রসারমান প্রভাব মোকাবিলা করতে প্রস্তুত না থাকায় সামরিক কার্যক্রমে প্রকাশ্যে বাধা দিতে পারছে না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আমিরাতের এই কার্যকলাপের প্রধান উদ্দেশ্য হলো সুদানের স্বর্ণখনি দখল এবং লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার। আমিরাত এই অঞ্চলে মায়ুন, আবদ আল-কুরি, সামহা, সোমালিল্যান্ডের বেরবেরা এবং ইয়েমেনের মোচা বন্দরে ঘাঁটি নির্মাণ বা সম্প্রসারণের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে।
প্লট আরও বলেন, পুনটল্যান্ডের কৌশলগত অবস্থান এবং নজরদারির অভাব এটিকে আমিরাতের জন্য আদর্শ অপারেশনাল ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। কারণ এখানে তাদের কার্যক্রম নিয়ে কেউ প্রশ্ন করবে না।
আমিরাত সরকার একাধিকবার আরএসএফকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করলেও, এ বিষয়ে মির বা পুনটল্যান্ড কর্তৃপক্ষের কেউই কখনো গণমাধ্যমে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি।

আফ্রিকা মহাদেশে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার এবং চলমান সংঘাতকে উসকে দেওয়ার এক চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)-এর বিরুদ্ধে। সোমালিয়ার পুনটল্যান্ড রাজ্যের বোসাসো বিমানবন্দরকে একটি গোপন ট্রানজিট হাব হিসেবে ব্যবহার করে আমিরাত সুদানের বিতর্কিত আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-কে ব্যাপক সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। সরবরাহ করা হচ্ছে কলম্বিয়ার ভাড়াটে সেনা।
মিডল ইস্ট আই-এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ফ্লাইট ট্র্যাকিং ডেটা, স্যাটেলাইট চিত্র, স্থানীয় সূত্র এবং মার্কিন ও আঞ্চলিক কূটনীতিকদের বরাত দিয়ে এ তথ্য উঠে এসেছে। আরএসএফ সম্প্রতি সুদানের উত্তর দারফুরের রাজধানী আল-ফাশের দখল করার পর সেখানে ব্যাপক নৃশংসতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ৫০০ দিনেরও বেশি অবরোধের পর এই বিজয়ের পর আরএসএফ যোদ্ধারা বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যা, এমনকি হাসপাতালেও নির্বিচারে হত্যার ভিডিও ধারণ করেছে।

ভারী কার্গো বিমানের রহস্যময় যাতায়াত
বোসাসো বিমানবন্দরে আজকাল ভারী কার্গো পরিবহনকারী আইএফ-৭৬ বিমানের ঘন ঘন অবতরণ স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে অস্বাভাবিক ছিল, কিন্তু এখন নিয়মিত ঘটনা। পুনটল্যান্ড মেরিটাইম পুলিশ ফোর্সের (পিএমপিএফ) একজন কমান্ডার (আবদুল্লাহি) মিডল ইস্ট মনিটরকে জানিয়েছেন, এই বিমানগুলো ঘন ঘন আসে এবং এগুলোর মাধ্যমে আসা সামরিক সরঞ্জাম ও রসদ দ্রুত অপেক্ষমাণ অন্য বিমানে তুলে সুদানে আরএসএফ-এর জন্য পাঠানো হয়।
সূত্রের বরাত দিয়ে মিডল ইস্ট আই-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বিমানগুলোর উৎস হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত। বিমানবন্দর ব্যবহারের সময়সূচি ঘন ঘন পরিবর্তন করা হয় এবং বিমানগুলো সাধারণত বিমানবন্দরের কর্মচাঞ্চল্য কম থাকার সময় বোসাসোতে পৌঁছায়। মার্কিন গোয়েন্দা সূত্র অনুযায়ী, এই চালানগুলোর মধ্যে চীনা-নির্মিত ড্রোনসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম রয়েছে।
বোসাসো বন্দরের একজন সিনিয়র ম্যানেজার প্রথমবারের মতো মিডল ইস্ট আই-কে নিশ্চিত করেছেন, গত দুই বছরে পাঁচ লাখেরও বেশি ‘বিপজ্জনক’ চিহ্নিত কন্টেইনার আমিরাত বোসাসো বন্দরের মাধ্যমে পাঠিয়েছে। সাধারণ কার্গোর বিপরীতে, এই আমিরাতি চালানগুলোতে ভেতরের মালপত্র বা গন্তব্যের কোনো বিস্তারিত বিবরণ নথিভুক্ত করা হয় না। বন্দরে একটি জাহাজ ভিড়লে পিএমপিএফ বাহিনীকে মোতায়েন করে এলাকা ঘিরে ফেলা হয় এবং ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকে।
কলম্বিয়ান ভাড়াটে সেনাদের গোপন নেটওয়ার্ক
বোসাসো বিমানবন্দরের উত্তর দিকে একটি সামরিক স্থাপনা রয়েছে, এটি কলম্বিয়ার ভাড়াটে সেনাদের আশ্রয়স্থল। মিডল ইস্ট আই-এর হাতে আসা ছবিতে দেখা গেছে, ব্যাকপ্যাক বহনকারী ডজন ডজন কলম্বিয়ান বিমানবন্দরে নেমে সরাসরি সামরিক ক্যাম্পে যাচ্ছে। পিএমপিএফ কমান্ডার আব্দুল্লাহি নিশ্চিত করেছেন, এই এলাকায় বিপুলসংখ্যক কলম্বিয়ান ভাড়াটে সেনা আরএসএফ-এর পক্ষে সুদানে যুদ্ধ পরিচালনার কাজ করছে।
এই ভাড়াটে সেনারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ফ্লাইটে বোসাসোতে আসে এবং এরপর প্রায় প্রতিদিনই ট্রানজিট হয়ে সুদানে পাড়ি জমায়। এই ভাড়াটে সেনারা তাদের ক্যাম্পের ভেতরে একটি নতুন হাসপাতালও নির্মাণ করেছে। সেখানে সুদানে আহত হওয়া আরএসএফ সৈন্যদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। আব্দুল্লাহি রক্তমাখা বিমান দেখার কথা স্মরণ করে বলেন, এই ক্যাম্প আহত আরএসএফ যোদ্ধাদের জন্য একটি চিকিৎসা ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে।

বোসাসো বিমানবন্দরকে সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত সেখানে একটি ফরাসি-নির্মিত সামরিক রাডার সিস্টেমও স্থাপন করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক আইনের প্রশ্ন
যুক্তরাষ্ট্র সরকার ২০২৩ সালেই ঘোষণা করেছিল, আরএসএফ এবং তাদের সহযোগী মিলিশিয়ারা সুদানে ‘গণহত্যা’ চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আরএসএফ-কে সোমালিয়ার মাটি ব্যবহার করে সাহায্য করার বিষয়টি স্থানীয় পিএমপিএফ সৈন্যদের মধ্যে তীব্র নৈতিক দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে। অনেক সেনা কর্মকর্তা মনে করেন, দীর্ঘদিনের মিত্র সুদানের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ভাড়াটে সেনাদের সহায়তা করা নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য।
হর্ন অব আফ্রিকার সংঘাত বিশেষজ্ঞ মার্টিন প্লট সতর্ক করেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) সুদানের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত করছে এবং পুনটল্যান্ড কর্তৃপক্ষ এই অপরাধে সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত হতে পারে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে গৃহযুদ্ধে সুদানের আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-কে সমর্থন করার অভিযোগে সুদান সংযুক্ত আরব আমিরাতকে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। খার্তুম অভিযোগ করে, আরব আমিরাত পশ্চিম দারফুরে মাসালিত সম্প্রদায়ের ‘গণহত্যায় জড়িত’, তারা আরএসএফকে সামরিক, আর্থিক এবং রাজনৈতিক সহায়তা দিয়ে এ অপরাধ সংঘটিত করছে।
যদিও ২০২৩ সালের এপ্রিলে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে, আরএসএফ এবং সুদানি সেনাবাহিনী উভয়ের বিরুদ্ধেই নৃশংসতার অভিযোগ আনা হয়েছে।
মোগাদিসুর নীরবতা ও আমিরাতের কৌশলগত ঘাঁটি
সোমালিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার মোগাদিসুর আকাশপথ নিয়ন্ত্রণ করলেও, তাদের বোসাসোর বন্দর ও বিমানবন্দরের ওপর কোনো কর্তৃত্ব নেই। বিশ্লেষকদের মতে, কেন্দ্রীয় সরকার (প্রেসিডেন্ট হাসান শেখ-এর নেতৃত্বাধীন) আমিরাতের ক্রমবর্ধমান ও প্রসারমান প্রভাব মোকাবিলা করতে প্রস্তুত না থাকায় সামরিক কার্যক্রমে প্রকাশ্যে বাধা দিতে পারছে না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আমিরাতের এই কার্যকলাপের প্রধান উদ্দেশ্য হলো সুদানের স্বর্ণখনি দখল এবং লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার। আমিরাত এই অঞ্চলে মায়ুন, আবদ আল-কুরি, সামহা, সোমালিল্যান্ডের বেরবেরা এবং ইয়েমেনের মোচা বন্দরে ঘাঁটি নির্মাণ বা সম্প্রসারণের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে।
প্লট আরও বলেন, পুনটল্যান্ডের কৌশলগত অবস্থান এবং নজরদারির অভাব এটিকে আমিরাতের জন্য আদর্শ অপারেশনাল ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। কারণ এখানে তাদের কার্যক্রম নিয়ে কেউ প্রশ্ন করবে না।
আমিরাত সরকার একাধিকবার আরএসএফকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করলেও, এ বিষয়ে মির বা পুনটল্যান্ড কর্তৃপক্ষের কেউই কখনো গণমাধ্যমে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি।

বিশেষত সংগীতের প্রতি উত্তমের ছিল অসীম একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও ভালোবাসা। প্রাথমিক জীবনে গানের শিক্ষক হিসেবেই কিন্তু তিনি টিকে থাকার চেষ্টা করেছিলেন। স্ত্রী গৌরী দেবীর সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও হয়েছিল এই গান শেখানোর মধ্য দিয়ে। অসামান্য গলা আর অসাধারণ গায়ন রীতির অধিকারী ছিলেন তিনি। অভিনয় যদি তিনি না করতেন, তাহলে উত
২৪ জুলাই ২০২১
বিহারের বাসিন্দা ৩৮ বছর বয়সী ক্লেরেন্স টপ্পো তাঁর এক বন্ধুর কাছে জানতে পারেন, তাঁর মা মারা গেছেন। ঘটনা চলতি বছরের আগস্টের শুরুর দিকের। টপ্পো খবর পেয়ে বেশ অবাক হন। কারণ, তিনি মায়ের সঙ্গেই থাকেন, মা সুস্থ শরীরে বহাল তবিয়তে। কিন্তু ৭৪ বছর বয়সী মেরি টপ্পো ভারত সরকারের নথিতে মৃত।
১৭ ঘণ্টা আগে
দশকের পর দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে একটি পরিবার। নেহরু–গান্ধী পরিবার। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী এবং বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী ও সংসদ সদস্য প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র...
২ দিন আগে
সংযুক্ত আরব আমিরাতই প্রথম আরব দেশ হিসেবে সহিষ্ণুতা মন্ত্রণালয় চালু করেছিল। আবার প্রথম আরব দেশ হিসেবে গণহত্যার অভিযোগেও অভিযুক্ত দেশটি। গত ১০ এপ্রিল সুদানের পক্ষের আইনজীবীরা আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) এই অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করেন। তাঁদের অভিযোগ, আরব আমিরাত মাসালিত জাতিগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা
২ দিন আগে