Ajker Patrika

১৯৪৭ থেকে ২০২৫: ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ও ফলাফল

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ০৩ মে ২০২৫, ১৭: ০৪
১৯৪৭ থেকে ২০২৫: ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ও ফলাফল

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাতের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। এর মূলে রয়েছে কাশ্মীর ভূখণ্ড নিয়ে আঞ্চলিক বিরোধ, ধর্ম ও আদর্শিক পার্থক্য এবং ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পরবর্তী ঐতিহাসিক ঘটনাবলী। আঞ্চলিক বিরোধ একাধিকবার সশস্ত্র যুদ্ধে গড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপে সাময়িক সময়ের জন্য অস্ত্রবিরতি হলেও দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা আসেনি। সীমান্তে অস্ত্র সংবরনের চুক্তি হলেও তা বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে, ফলস্বরূপ অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হয়েছে। এখানে সংক্ষেপে ভারত–পাকিস্তান সংঘাতের চিত্র তুলে ধরা হলো:

প্রথম ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ (১৯৪৭–৪৮)

কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধ থেকে এই সংঘাতের সূত্রপাত। তৎকালীন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের মহারাজা ছিলেন হিন্দু। পাকিস্তান সে সময় কাশ্মীরকে নিজেদের ভূখণ্ডের অংশ করতে স্থানীয় মিলিশিয়াদের সমর্থন দেয়। অন্যদিকে মহারাজা ভারতের সঙ্গে যোগ দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেন, ফলে ভারত সরসারি কাশ্মীরে হস্তক্ষেপ করে।

এর জেরে ভারতীয় বাহিনী এবং পাকিস্তান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। পরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও যোগ দেয়।

জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। সমঝোতার ভিত্তিতে কাশ্মীরকে বিভক্ত করে নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) টানা হয়। ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকে জম্মু ও কাশ্মীরের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, বাকি অংশ (আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিট-বালটিস্তান) পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থাকে। কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে জাতিসংঘ গণভোটের আহ্বান জানায়। কিন্তু ভারতের আপত্তিতে তা আর কখনো হয়নি।

ফলাফল দাঁড়ায়—অচলাবস্থা। সেই থেকে কাশ্মীর একটি সংঘাতপূর্ণ এলাকা। ভারত ও পাকিস্তানের বিরোধের প্রধান উপাদান হয়ে রয়েছে এই ভূখণ্ড।

দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ (১৯৬৫)

পাকিস্তান ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’ শুরু করে। ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা স্থানীয়দের ছদ্মবেশে সেখানে বিদ্রোহ উসকে দেওয়ার চেষ্টা করে। ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধে হারের পর ভারত দুর্বল হয়ে পড়েছে—এই বিশ্বাস থেকে পাকিস্তান কাশ্মীরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আশা দেখতে পায়।

দ্রুতই সংঘাত পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেয়। কাশ্মীর ও পাঞ্জাবে যুদ্ধ শুরু হয়। ভারত পাল্টা আক্রমণ চালায় এবং লাহোর ও সিয়ালকোটের দিকে অগ্রসর হয়।

এবারও জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে ১৯৬৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর যুদ্ধবিরতি হয়। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় তাসখন্দ চুক্তি (১৯৬৬) স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির আওতায় সামান্য সমন্বয়ের মাধ্যমে যুদ্ধ-পূর্ববর্তী সীমানা (নিয়ন্ত্রণ রেখা) পুনরুদ্ধার করা হয়। ফের অচলাবস্থা শুরু হয়। কিন্তু তাতে আঞ্চলিক পরিস্থিতির কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। উভয় পক্ষই নিজেদের বিজয়ী দাবি করে।

তৃতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ (১৯৭১)

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বেসামরিক জনগণের ওপর নৃশংস আক্রমণ করে। ভয়াবহ সামরিক দমনপীড়নে লাখ লাখ মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। সেখানে রীতিমতো শরণার্থী সংকট তৈরি হয়। ভারত মুক্তি বাহিনীকে সমর্থন দেয়। আশ্রয়, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করে। একপর্যায়ে পাকিস্তান ভারতীয় বিমান ঘাঁটিতে আকস্মিক হামলা চালায়।

এরপর ভারত পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে, পাশাপাশি পশ্চিম সীমান্তেও যুদ্ধ হয়। অবশ্য যুদ্ধ মাত্র ১৩ দিন স্থায়ী হয়েছিল।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এর ফলে সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এরপর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তি (১৯৭২) স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির আওতায় যুদ্ধবিরতি রেখাকে নিয়ন্ত্রণ রেখা হিসেবে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করা হয়। দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসার ওপর জোর দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় এবং সিমলা চুক্তির মধ্য দিয়ে বড় ধরনের ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন আসে। পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে হারায় এবং বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

কার্গিল যুদ্ধ (১৯৯৯)

পাকিস্তানি সেনা ও বিদ্রোহীরা ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের কার্গিল সেক্টরে অনুপ্রবেশ করে। তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর রসদ সরবরাহ লাইন ব্যাহত করতে কৌশলগত এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। ভারত অনুপ্রবেশকারীদের হঠাতে ‘অপারেশন বিজয়’ শুরু করে। তীব্র লড়াই হয়। কয়েক সপ্তাহ পর ভারত নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করে।

ভারত ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসের মধ্যে হারানো বেশিরভাগ এলাকা পুনরুদ্ধার করে। যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তান পিছু হটতে বাধ্য হয়। তবে এবার কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি।

এই যুদ্ধে ভারতের কৌশলগত বিজয় হয় এবং এই অঞ্চলে স্থিতাবস্থা পুনরুদ্ধার করে। নিয়ন্ত্রণ রেখা লঙ্ঘনের জন্য পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়ে।

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সংঘাত ও উত্তেজনা

সিয়াচেন সংঘাত (১৯৮৪–বর্তমান)

ভারত ১৯৮৪ সালে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর থেকে সিয়াচেন হিমবাহে (এটি বিশ্বের উচ্চতম যুদ্ধক্ষেত্র) দুই দেশই সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে। এখনো বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ঘটে, তবে কোনো বড় যুদ্ধ হয়নি। হিমবাহের বেশিরভাগ অংশ ভারতের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

সীমান্ত পেরিয়ে সংঘর্ষ

নিয়ন্ত্রণ রেখায় ঘন ঘন যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন, বিশেষ করে ২০০০ এবং ২০১০–এর দশকে আর্টিলারি (ভারী গোলা) ও হালকা অস্ত্রের গোলাগুলি হয়। উত্তেজনার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির মধ্যে রয়েছে ২০১৬ সালের উরি হামলা এবং ২০১৯ সালের বালাকোট বিমান হামলা।

২০০১–০২ সালের অচলাবস্থা: ২০০১ সালে ভারতের জাতীয় সংসদে সন্ত্রাসী হামলা হয়। এই হামলার জন্য পাকিস্তান ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা ও জয়শ-ই-মহাম্মদকে দায়ী করে ভারত। এই হামলায় এক জন সাধারণ নাগরিকসহ বারো জনের মৃত্যু হয়।

এই ঘটনার পর উভয় দেশ সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে। কূটনৈতিক চাপে ১০ মাসের অচলাবস্থার অবসান ঘটে এবং যুদ্ধ এড়ানো যায়।

২০১৯ সালের পুলওয়ামা-বালাকোট সংকট: কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৪০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়। এরপর ভারত পাকিস্তানের বালাকোটে কথিত সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালিয়ে প্রতিশোধ নেয়। পাকিস্তানের বিমান বাহিনী পাল্টা জবাব দেয়, ফলে একটি সংক্ষিপ্ত বিমান যুদ্ধ হয়। কিন্তু পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশ করতে গিয়ে একজন ভারতীয় পাইলট আটক হন। পরে অবশ্য তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। ফলে উত্তেজনা প্রশমিত হয়।

এই ঘটনার প্রভাব সেভাবে আঞ্চলিক পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটায়নি। উভয় পক্ষই বিজয় দাবি করে।

পেহেলগাম হামলা (২০২৫)

গত ২২ এপ্রিল জম্মু–কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হয়। তারা সবাই বেসামরিক নাগরিক এবং পর্যটক। এই হামলার জন্য পাকিস্তান ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর–ই–তৈয়বার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সংগঠনকে দায়ী করছে ভারত। সেই সঙ্গে এতে পাকিস্তান রাষ্ট্রেরও হাত আছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে।

এই হামলার জেরে ভারত ও পাকিস্তান পাল্টাপাল্টি কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারত সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি, বাণিজ্য, ভিসা ও আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি স্থগিত করেছে। পাল্টা পাকিস্তানও সিমলা চুক্তি, বাণিজ্য, ভিসা ও আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি স্থগিত করেছে। সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ রেখায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে টানা আট দিন রাতের বেলা গোলাগুলি হয়েছে। তবে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। দুইপক্ষে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে।

মোট কথা, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধের মূলে কাশ্মীর। ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগের মিশেলে এটি ক্রমেই অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করেছে। পাকিস্তান কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ওপর জোর দেয়। কিন্তু ভারত কাশ্মীরকে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ দাবি করে।

এ নিয়ে উত্তেজনার মধ্যে ১৯৯৮ সালে উভয় দেশ পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এতে সংঘাতের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। উভয়ই পারমাণবিক অস্ত্রধারী হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের সম্ভাবনা কমে এলেও ছায়াযুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদ দিন দিন বাড়ছে।

এই বিরোধ ও সংঘাত নিরসনে একাধিকবার চেষ্টা হয়েছে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছে। এর মধ্যে লাহোর ঘোষণা (১৯৯৯) এবং আগ্রা শীর্ষ সম্মেলনের (২০০১) মতো শান্তি উদ্যোগগুলো অন্যতম। তবে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং বারবার সন্ত্রাসী হামলার মতো ঘটনার কারণে সব উদ্যোগ বারবার ভেস্তে গেছে।

সর্বশেষ চলতি বছর মাঝে মধ্যেই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের কারণে নিয়ন্ত্রণ রেখা অস্থির হয়ে উঠেছে। ২০১৯ সালের সংকটের পর থেকে কোনো উল্লেখযোগ্য দ্বিপক্ষীয় আলোচনা না হওয়ায় কূটনৈতিক সম্পর্কও এখন বেশ দুর্বল। ২০১৯ সালে ভারত জম্মু ও কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে, এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। পাকিস্তানও ভারতের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে থাকে। স্বায়ত্তশাসন বাতিলের পর ব্যাপক অভিযান ও তল্লাশি চালায় ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী। ব্যাপক নিপীড়ন, উচ্ছেদ ও গ্রেপ্তার চলে। এরপর ভারত সরকার কাশ্মীর পরিস্থিতি নজিরবিহীনভাবে স্থিতিশীল হওয়ার দাবি করে আসছিল। কিন্তু ২২ এপ্রিলের ঘটনার পর সরকারি বয়ান সমালোচনার মুখে পড়েছে।

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত