Ajker Patrika

মাত্র ১৩ দেশে নারী নেতৃত্ব, বেশি হলে কি বিশ্বে শান্তি আসবে

মাত্র ১৩ দেশে নারী নেতৃত্ব, বেশি হলে কি বিশ্বে শান্তি আসবে

সম্প্রতি বিশ্ব কি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে? যদি এমনটা মনে হয়, তবে আপনার ধারণা ভুল নয়। বাস্তবিকই বিশ্বে সংঘাতের সংখ্যা বাড়ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ থেকে শুরু করে ইসরায়েল-গাজা ও সুদান। এসব সংঘাতের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলো পুরুষেরাই চালাচ্ছে। অন্য দিকে, বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তেও ক্ষমতাধর পুরুষদের করাত হাতে খেলা করতে দেখা যাচ্ছে।

২০২৪ সালের অক্টোবর মাসের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মধ্যে মাত্র ১৩টির নেতৃত্বে আছেন নারী। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মতো ব্যক্তিত্বরা মনে করেন, যদি এই সংখ্যা আরও বেশি হতো, তবে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারত।

বারাক ওবামা একসময় বলেছিলেন, ‘নারীরা যদি বিশ্ব পরিচালনা করত, তবে যুদ্ধ কম হতো, ভালোভাবে শিশুদের যত্ন নেওয়া হতো এবং সার্বিক জীবনমান উন্নত হতো।’

আজ থেকে ১৯ বছর আগে, জাতিসংঘের প্রাক্তন প্রধান কফি আনানও বলেছিলেন, ‘নারীদের ক্ষমতায়নের চেয়ে সংঘাত প্রতিরোধে আর কোনো নীতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ তবে ৮০ বছরের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কোনো নারী জাতিসংঘের প্রধান হতে পারেননি।

তাহলে ইতিহাস কী বলছে? প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ক্রিস্টোফার ব্লেয়ার মনে করেন, নারী নেতারাও অনেক সময় পুরুষদের মতোই যুদ্ধ বাধিয়েছেন।

ক্রিস্টোফার ব্লেয়ার বলেন, ‘নারীরা সমাজে প্রচলিত ‘‘নরমপন্থী’’ ভাবমূর্তি কাটিয়ে উঠতে এবং নিরাপত্তা ইস্যুতে নিজেকে দক্ষ প্রমাণ করতে ‘‘আয়রন লেডি’’ হওয়ার চেষ্টা করেন।’ এর উদাহরণ হিসেবে তিনি ব্রিটেনের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের কথা বলেন। থ্যাচার ১৯৮২ সালে ফকল্যান্ড যুদ্ধে আর্জেন্টিনার বেলগ্রানো যুদ্ধজাহাজে ৩২৩ জনের মৃত্যুর জন্য দায়ী। অথবা বিখ্যাত যুদ্ধবাজ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, যিনি উপদেষ্টাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ‘নরম প্রকৃতির ভাবমূর্তি তৈরি হওয়ার ভয়ে’ তালেবানের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় যেতে দ্বিধা বোধ করেছিলেন বলে জানান ক্রিস্টোফার ব্লেয়ার।

লেখক জসলিন বার্নহার্টের মতে, আজকের ‘ভয়াবহ পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বে’ নারীদের ওপর ‘পুরুষালি’ স্টেরিওটাইপগুলোর দিকে বেশি ঝুঁকে থাকার প্রবণতা থাকে। যেমন— ইতালির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি তাঁর পদবির নারীবাচক রূপ বাদ দিয়ে ‘Il Presidente’ বা পুরুষবাচক শব্দ ব্যবহার করেন।

ব্লেয়ারের গবেষণা আরও বলছে, নারী নেতৃত্ব হুমকি থেকে পিছু হটলে পুরুষদের তুলনায় বেশি সমালোচিত হন, যা তাঁদের আগুন নেভানোর পরিবর্তে আরও উসকে দিতে উৎসাহিত করে। যেমন—২০১৬ সালে থেরেসা মে যখন ব্রেক্সিটের বিষয়ে কঠোর হন, তখন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘দ্যা সান’ তাঁকে ‘লৌহমানবী মার্গারেট থ্যাচার’ বলে প্রশংসা করেছিল। কিন্তু দুই বছর পর, যখন তিনি ব্রেক্সিট প্রশ্নে ‘নরম’ হলেন, তখন মানুষ তাঁর অনেক সমালোচনা করল! অনেকে এমনও বলল, তিনি ব্রেক্সিটের কাছে দেশ বেচে দিয়েছেন।

‘প্যাট্রিয়ার্কস: হাউ মেন কেইম টু রুল’ গ্রন্থের লেখিকা অ্যাঞ্জেলা সাইনি বলেন, ‘নারীরা পুরুষের আগ্রাসনের অনুকরণ করেন বিষয়টি এমন নয়, বরং তাঁরা নিজেরাই আগ্রাসী হতে পারেন। যেমন—১৯৭৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং বিরোধী, নাগরিক অধিকার ও সংবাদপত্রের ওপর দমন-পীড়ন চালান।’

এ ছাড়া, ঝাঁসীর রানী লক্ষ্মীবাই ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতীয় বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর আগেও বৌডিক্কা ও জোয়ান অব আর্কের মতো নারী শাসকদেরও উদাহরণ আছে। তাই নারী নেতৃত্ব বিশ্বকে আরও শান্তিপূর্ণ করতে পারবে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে সাইনি পাল্টা প্রশ্ন করেন।

সাইনি বলেন, ‘কোন নারীদের কথা বলা হচ্ছে? যদি নেতৃত্ব হয় মার্গারেট থ্যাচার, লিজ ট্রাস, মারজোরি টেইলর গ্রিন বা সারা পেলিনের মতো নারীদের, তেমন বিশ্বে আমি বাস করতে চাইব না।’

বিশ্বে নারী নেতৃত্বের সংখ্যা এত কম যে, পুরুষদের সঙ্গে তাদের সঠিকভাবে তুলনা করাও কঠিন। যদিও একটি গবেষণাপত্রে দেখা গেছে, পঞ্চদশ থেকে বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপের রানীদের রাজাদের তুলনায় যুদ্ধে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল। তবে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে প্রতি তিনটিতে মাত্র একটিতে শীর্ষ পদে নারীরা এসেছেন।

মনোবিজ্ঞানী কর্ডেলিয়া ফাইন বলেন, ‘নারী নেতৃত্বাধীন একটি বিশ্বে পৌঁছাতে সমাজকে বৈপ্লবিকভাবে পরিবর্তিত হতে হবে। তবে আজকের পরিস্থিতি থেকে সেই অবস্থায় পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব।’

‘দ্যা এল্ডার্স’-এর সদস্য মেরি রবিনসন জাতিসংঘের প্রধান পদে একজন নারীকে দেখতে চান। তিনি বলেন, ‘নারী নেতৃত্ব শুধু নারীদের ‘‘দায়িত্বে’’ থাকার বিষয় নয়। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোয় নারীদের সম্পৃক্ততা বিশ্বকে আরও শান্তিপূর্ণ করতে পারে।’

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শান্তি প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণ বেশি হলে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। পার্লামেন্টে নারীদের উপস্থিতি প্রতিরক্ষা ব্যয় কমায় এবং নির্বাচনে নারীরা গণতন্ত্রকে আরও শান্তিপূর্ণ করে তোলেন। আর এ ধরনের সমাজই নারীদের বিভিন্ন প্রকার নেতৃত্বের পথ প্রশস্ত করে।

এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের জরিপে দেখা গেছে, নারীরা যুদ্ধের চেয়ে শান্তির প্রতি বেশি আগ্রহী (এটা প্রকৃতিগত নাকি পরিবেশ-লালিত, তা অন্য বিতর্ক)। তবে যখন তাৎক্ষণিক হুমকির পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন নারী-পুরুষ উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গিতেই ভারসাম্যে আসে।

সাবেক আইরিশ প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন বলেন, ‘নারীরা পুরুষের চেয়ে ভালো, এটি সত্য নয়। তবে বিশ্বকে শান্তিপূর্ণ করতে সবার উপস্থিতি প্রয়োজন, শুধু অর্ধেক জনগোষ্ঠীর নয়।’

দ্যা স্কাই নিউজ থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত