Ajker Patrika

বিবিসির প্রতিবেদন /কাশ্মীরসংকট সমাধানে ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাবে উভয়সংকটে ভারত

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৩ মে ২০২৫, ১৩: ০৩
কাশ্মীর নিয়ে ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাব নিয়ে উভয়সংকটে পড়েছে ভারত। ছবি: সংগৃহীত
কাশ্মীর নিয়ে ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাব নিয়ে উভয়সংকটে পড়েছে ভারত। ছবি: সংগৃহীত

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিগত কয়েক দশক ধরেই একটি বিষয় স্পর্শকাতর। সেটি হলো তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা। বিশেষ করে, পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীর নিয়ে দীর্ঘদিনের বিবাদের আলোচনায়। কাশ্মীর নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দিল্লির স্পর্শকাতর জায়গায় আঘাত করেছেন। তিনি অপ্রচলিত কূটনীতির জন্য পরিচিত। তবে যাঁরা এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল, তাঁরা মোটেও আশ্চর্য হননি।

গত শনিবার ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানান, ভারত-পাকিস্তান অবিলম্বে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে। চার দিনের তীব্র সংঘর্ষের পর তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি মার্কিন মধ্যস্থতায় হয়েছে। পরে আরেক পোস্টে ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদের ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদের দুজনের সঙ্গেই কাজ করব। দেখব হাজার বছর পর কাশ্মীর নিয়ে কোনো সমাধানে পৌঁছানো যায় কি না।’

কাশ্মীর নিয়ে বিবাদ চলছে ১৯৪৭ সাল থেকে। ওই সময় ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ভারত-পাকিস্তান। দুই প্রতিবেশীই পুরো কাশ্মীর অঞ্চলকে নিজেদের বলে দাবি করে। কিন্তু তারা নিয়ন্ত্রণ করে এর অংশবিশেষে। কয়েক দশক ধরে বহুবার দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হলেও কোনো সমাধান আজও মেলেনি।

ভারত কাশ্মীরকে অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে। তারা এ বিষয়ে কোনো আলোচনার সম্ভাবনাও নাকচ করে দেয় বারবার। বিশেষ করে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার মাধ্যমে আলোচনার সম্ভাবনা তারা সব সময়ই খারিজ করে দিয়েছে। সর্বশেষ উত্তেজনা শুরু হয় গত মাসে। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলা হয়। ওই হামলায় ২৬ পর্যটক নিহত হন।

ভারত এই ঘটনায় পাকিস্তানকে দায়ী করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালায়। ভারত হামলার লক্ষ্যবস্তুগুলোকে ‘সন্ত্রাসী পরিকাঠামো’ বলে দাবি করে। পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে ট্রাম্প এমন এক সময়ে হস্তক্ষেপ করেন, যখন দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে লড়াই পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।

দুই পক্ষই যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন ব্যবহার করেছে। তারা পরস্পরের সামরিক স্থাপনা নিশানা করে হামলার কথা বলেছে। লক্ষ্যবস্তুর সবগুলোই প্রধানত সীমান্ত এলাকায় ছিল। মার্কিন মধ্যস্থতা ও কূটনৈতিক গোপন আলোচনা বড় ধরনের সংঘাত এড়াতে সাহায্য করেছে। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রস্তাব দিল্লিকে অস্বস্তিতে ফেলেছে।

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শ্যাম শরণ বিবিসিকে বলেন, ‘স্পষ্টতই, এটিকে ভারতের দিক থেকে স্বাগত জানানো হবে না। এটি আমাদের বহু বছরের ঘোষিত অবস্থানের পরিপন্থী।’ অন্যদিকে ইসলামাবাদ ট্রাম্পের মন্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘আমরা জম্মু-কাশ্মীর বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আগ্রহকে স্বাগত জানাই। এটি এক দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা যা দক্ষিণ এশিয়া এবং তার বাইরেও শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য গুরুতর প্রভাব ফেলে।’

কাশ্মীর নিয়ে দিল্লির অবস্থান আরও কঠোর হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৯ সালের পর থেকে। ওই বছর জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করা হয়। এর ফলে কাশ্মীরে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্য অনেক ভারতীয়কে ক্ষুব্ধ করেছে। তারা এটিকে কাশ্মীর বিরোধের ‘আন্তর্জাতিকীকরণের’ চেষ্টা বলে মনে করছেন।

প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস বিজেপি সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে। তারা ‘ওয়াশিংটন ডিসি থেকে প্রথম যুদ্ধবিরতির ঘোষণা’ প্রসঙ্গে সর্বদলীয় বৈঠক চেয়েছে। কংগ্রেসের মুখপাত্র জয়রাম রমেশ বলেছেন, ‘আমরা কি তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার দরজা খুলে দিয়েছি? ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক চ্যানেল কি আবার খোলা হচ্ছে?’

যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এক বিবৃতি বলেন, দুই দেশ ‘একটি নিরপেক্ষ স্থানে বিস্তৃত পরিসরের ইস্যুতে আলোচনা শুরু করতে’ রাজি হয়েছে। এটি ভারতীয়দের অবাক করেছে। দিল্লি ইসলামাবাদের সঙ্গে আলোচনা করতে অস্বীকার করেছে। কারণ, তারা প্রতিবেশী দেশটিকে সীমান্ত সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগ অভিযুক্ত করে আসছে।

ঐতিহাসিকভাবেই ভারত কাশ্মীর ইস্যুতে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার বিরোধিতা করে আসছে। দেশটি ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তির কথা উল্লেখ করে। চুক্তি অনুযায়ী, দুই দেশের নেতারা ‘দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের মতপার্থক্য নিরসন করতে সম্মত হয়েছিলেন।’

ভারতীয় কর্মকর্তাদের যুক্তি, পাকিস্তানে বেসামরিক সরকারের সঙ্গে কোনো বোঝাপড়া হলেও দেশটির শক্তিশালী সেনাবাহিনী সেই চুক্তিগুলো নষ্ট করে দেয়। নয়া দিল্লি ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের উদাহরণ টানে। সে সময় ‘পাকিস্তান সমর্থিত’ সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা ভারতীয় নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের কৌশলগত এলাকা দখল করেছিল। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে সংঘাত শুরু হয়। তৎকালীন ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীরা দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের এবং পরস্পরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার ব্যাপারে সম্মত হওয়ার মাত্র কয়েক মাস পর এই যুদ্ধ হয়।

যাই হোক, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাবের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো উত্তর দেয়নি। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর বলেছেন, ‘ভারত সব সময় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দৃঢ় ও আপসহীন অবস্থান বজায় রেখেছে এবং তা বজায় রাখবে।’ এটিকে ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে যে, ভারত হয়তো শিগগিরই সরাসরি দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করবে না।

পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য ভিন্ন। ইসলামাবাদভিত্তিক থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ইমতিয়াজ গুল বিবিসিকে বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার অভাবে পাকিস্তান কাশ্মীর ইস্যুতে সব সময় তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা চেয়েছে। এখন একটি পরাশক্তি এগিয়ে আসতে চাইছে। পাকিস্তান এটাকে নৈতিক বিজয় হিসেবে দেখবে।’

সৈয়দ মুহাম্মদ আলীর মতো পাকিস্তানি কৌশলগত বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় ধারাবাহিক অস্বীকৃতির কারণেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ করা উচিত। এতে ভবিষ্যতে কোনো সংঘাত এড়ানো যাবে। আলী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য কাশ্মীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাম্প্রতিক দ্রুত উত্তেজনা প্রমাণ করে যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।’

ভারতের তথাকথিত ‘বলিষ্ঠ কূটনীতিকে’, বিশেষ করে ২০১৪ সালে মোদি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ভারতের আত্মবিশ্বাসের লক্ষণ হিসেবে দেখা হয়েছে। কিন্তু ট্রাম্পের প্রস্তাব এড়াতে ভারতকে কঠিন ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। ক্রমবর্ধমানভাবে চীনকে মোকাবিলায় প্রাচীর হিসেবে ভারতকে ব্যবহারের জন্যই এই ঘনিষ্ঠতা। ভারত কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ গ্রুপের (কোয়াড) গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানকে নিয়ে এটি গঠিত হয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের তথাকথিত ‘সম্প্রসারণবাদ’ মোকাবিলাই এর উদ্দেশ্য।

সাম্প্রতিক দশকে যুক্তরাষ্ট্র দিল্লিকে আধুনিক পরিবহন বিমান, হেলিকপ্টার ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম দিয়েছে। ভারত তার ১৪ লাখ সদস্যের সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণে আগ্রহী। ভারতীয় সেনাবাহিনী মূলত রুশ অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। আগের মার্কিন প্রশাসনগুলো কাশ্মীরের বিষয়ে ভারতের সংবেদনশীলতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল এবং হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের সময়ে সেই অবস্থান বজায় থাকবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রায় ১৩০ বিলিয়ন ডলার ছিল ২০২৪ সালে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। মোদির সরকার বর্তমানে শুল্ক এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে। দিল্লিকে খুব সতর্ক থাকতে হবে। ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাব গ্রহণ করতে দিল্লি নারাজ হবে। অথবা যুক্তরাষ্ট্র-প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি বা তাদের ভাষায় ‘বোঝাপড়া’ যেন বর্তমান সামরিক উত্তেজনা ছাড়িয়ে অন্য বিষয়ে না যায়, সেটাও দিল্লি চাইবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনুকূল বাণিজ্যিক সম্পর্ক রাখতেও দিল্লি আগ্রহী।

আলোচনার পরিধি বাড়ানোর যেকোনো প্রচেষ্টা, যেমন বিতর্কিত দ্বিপক্ষীয় বিষয়—বর্তমানে স্থগিত থাকা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি বা কাশ্মীরের মর্যাদা নিয়ে আলোচনা—অভ্যন্তরীণভাবে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়বে। এই ফাঁদ সম্পর্কে মোদি ভালোভাবে ওয়াকিবহাল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত