Ajker Patrika

ইমরান খান কি পারবেন পূর্বসূরিদের রেকর্ড ভাঙতে

ইয়াসিন আরাফাত 
আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২২, ২৩: ৩৯
ইমরান খান কি পারবেন পূর্বসূরিদের রেকর্ড ভাঙতে

প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিরোধী জোটের অনাস্থা প্রস্তাবের পর পাকিস্তানে দানা বাঁধছে রাজনৈতিক সংকট। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টি থেকে একদল এমপি বেরিয়ে যাওয়ার পর তিনি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে চলতি মাসের শুরুর দিকে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব আনে বিরোধীরা। 

মনে করা হচ্ছে, ২০১৮ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সবচেয়ে কঠিন রাজনৈতিক পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন। যদিও এ পরীক্ষা উতরে যাবেন বলেই জোর গলায় বলে আসছেন। ইমরানের ভাগ্য নির্ধারণ হবে আগামী তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে। 

ইমরানের ভাগ্য নিয়ে বড় শঙ্কার কারণ হলো—পাকিস্তান রাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত কোনো প্রধানমন্ত্রী মেয়াদের পুরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। 

 ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় তৈরি করা হয়। এর আগে গভর্নর জেনারেলই দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রতিনিধি। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। ১৯৫১ সালে আততায়ীদের হাতে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত ৪ বছর ৬৩ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। 

লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দিন। তাঁর সরকার ক্ষমতায় ছিল ১ বছর ১৮২ দিন। তাঁর সময় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক চ্যালেঞ্জ বেসামাল হয়ে যায়। তিনি পদত্যাগে বাধ্য হোন। 

 ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন মোহাম্মদ আলী বগুড়া। স্বাস্থ্যগত কারণে ১৯৫৫ সালের আগস্টে মোহাম্মদ আলী পদত্যাগ করেন। 

 ১৯৫৫ সালের ১১ আগস্ট পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার নির্দেশে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। ১৯৫৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের পার্লামেন্টে মুহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়। পরে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার সমর্থন সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। 

 ১৯৫৬ থেকে অক্টোবর ১১ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তাঁর ক্ষমতাকাল ছিল ১ বছর ৩৫ দিন। 

 ১৯৫৭ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পদত্যাগ করার পর রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জার নির্দেশে ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দ্রিগড় অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হন। কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ ও রিপাবলিকান পার্টির সমন্বয়ে তাঁর জোট সরকার গঠিত হয়েছিল। কিন্তু শিগগিরই শরিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। এরপর ইস্কান্দার মির্জা তাঁকে পদচ্যুত করেন। 

 ১৯৫৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্যার ফিরোজ খান নূন পাকিস্তানের ৭ম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি এ পদে ছিলেন। এরপর ইস্কান্দার মির্জা সামরিক আইন জারি করেন। 

দীর্ঘ সামরিক শাসনের মধ্যে ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন নুরুল আমিন। পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর চার দিন পর ২০ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন নুরুল আমিন। 

এরপর ১৯৭৩ সালে সংবিধান পরিবর্তন আনা হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী হন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ১৯৭৭ সালে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই জেনারেল জিয়াউল হক সামরিক অভ্যুত্থানে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। বেশ কিছু বছর সামরিক শাসনের পর ১৯৮৫ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে মুহাম্মদ খান জুনেজো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। শপথ গ্রহণের ৩ বছর ৬৬ দিন পরই পদত্যাগ করেন মুহাম্মদ জুনেজো। ১৯৮৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তান পিপলস পার্টির বেনজির ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তিনি প্রথম কোনো মুসলিম দেশে নির্বাচিত নারী প্রধানমন্ত্রী। 

 ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই চলে। এ সময় তিনবার ভেঙে দেওয়া হয় পার্লামেন্ট। এ সময়ের মধ্যে দুবার করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন বেনজির ভুট্টো ও নওয়াজ শরিফ। ১৯৯৯ সালে বেসামরিক সরকার ও সেনাবাহিনীর সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় জেনারেল পারভেজ মোশাররফ অভ্যুত্থান করে নওয়াজ শরিফের সরকারকে উৎখাত করেন। 

 ২০০২ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে জয় লাভ করেন পাকিস্তান মুসলিম লীগের মীর জাফরুল্লাহ খান জামালি। বেলুচিস্তান থেকে প্রথম কোনো রাজনীতিকের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা এটি।  পাকিস্তান রাষ্ট্রের কোনো প্রধানমন্ত্রীই এখন পর্যন্ত পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে পারেননি।২০০৪ সালের জুনে প্রেসিডেন্ট মোশাররফের সঙ্গে তিন ঘণ্টা বৈঠকের পর জামালি হঠাৎ করে টেলিভিশনে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। পরে শওকত আজিজ জাতীয় সংসদে ১৯১টি ভোটের মধ্যে ১৫১ পেয়ে বিজয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তাঁর ক্ষমতাকাল ছিল ৩ বছর ৩৯ দিন। 

 ২০০৮ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন পিপিপির ইউসুফ রাজা গিলানি। ২০১২ সালে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় গিলানি পদত্যাগ করেন। ওই বছরই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন রাজা পারভেজ আশরাফ। পরের বছর সুপ্রিম কোর্ট দেশটির প্রধানমন্ত্রী রাজা পারভেজ আশরাফের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। 

রাজা পারভেজ আশরাফ ২০১০ সালে পাকিস্তানের পানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রী থাকাকালে বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদনে দুর্নীতি করেন বলে অভিযোগ আনা হয়। পারভেজ আশরাফ ২৭৫ দিন ক্ষমতায় থাকার পর ২০১৩ সালে আবারও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ শরিফ। ২০১৭ সালে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে সরকারি কোনো দপ্তর পরিচালনার জন্য অযোগ্য ঘোষণা করার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তিনি পদত্যাগ করেন। 

 ১ আগস্ট ২০১৭ সালে পাকিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হন শহীদ খাকান আব্বাসি। এরপর ১৮ আগস্ট ২০১৮-এ নতুন দল তেহরিক-ই-ইনসাফ থেকে নির্বাচিত হয়ে ইমরান খান দেশের ২২ তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। 

পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে হলে ইমরান খানকে অন্তত ১৭২ জন এমপির সমর্থন পেতে হবে। তাঁর দলের বর্তমান আসনসংখ্যা ১৫৫, সঙ্গে আরও আছে জোট দলগুলোর সমর্থন। অন্যদিকে নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগসহ পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলোর মোট আসনসংখ্যা ১৬৩। 

এ প্রসঙ্গে ইমরান খান বলেন, ‘আমি ঘরে বসে থাকব এমন মিথ্যা ধারণা কেউ যেন না নেয়। আমি পদত্যাগ করব কেন? চোরদের চাপে আমার পদত্যাগ করা উচিত?’ ইমরান খানের দাবি, পাকিস্তানের ৬০-৬৫ শতাংশ মানুষ তাঁর পাশে আছে। 

শুরু থেকে বিরোধীদের অভিযোগ—সেনাবাহিনীর সহায়তায় নির্বাচনে জালিয়াতি করে ক্ষমতায় এসেছেন ইমরান খান। অনাস্থা ভোটের আগে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেনাদের প্রশংসা করেছেন ইমরান খান। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর মতে, পাকিস্তানের জন্য একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগে দেশটির সেনাবাহিনীর সমালোচনা করা ভুল ছিল। সেনাবাহিনী না থাকলে দেশ তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যেত। 

আগামীকাল শুক্রবার পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাবটির ওপর ভোট হতে পারে। পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী, অনাস্থা প্রস্তাব পাওয়ার ১৪ দিনের মধ্যে অধিবেশন আহ্বান করতে হয়। এই সময়সীমা শেষ হচ্ছে আগামী সোমবার। তবে স্পিকারের অফিস থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইসলামাবাদে ওআইসির সম্মেলনের কারণে তারিখ কয়েক দিন পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

এর আগে গত বছর মার্চে বিরোধীদের দাবিতে প্রথমবারের মতো আস্থা ভোটে অল্প ভোটের ব্যবধানে উতরে যান ইমরান খান। এবার তাঁর জন্য আরও কঠিন হবে বলেই মনে হচ্ছে। কারণ, তেহরিক-ই-ইনসাফের নেতৃত্বাধীন পাঁচ দলীয় জোট সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে তিনটি শরিক দল বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অবশ্য তারা জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা এখনো দেয়নি। 

এই ভোটে হেরে গেলে পাকিস্তানে আবারও হয়তো আগাম ভোট হবে। এর আভাসও দিয়েছেন দেশটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ আহমেদ। আর এমনটি হলে ইমরান খানের ভাগ্যও হয়তো হতে চলছে তাঁর পূর্বসূরিদের মতো! 

সূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, ডন, এএফপি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সেই রুহুল আমিনের বসুন্ধরা, বনানী ও উত্তরার জমিসহ ৫০০ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্রোক

৬১৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ: এক্সিম ব্যাংকের নজরুল ইসলাম মজুমদারসহ ৩০ জনের নামে মামলা

ঠাকুরগাঁওয়ের ৩টি আসনেই জয়ী হবে জামায়াত: মাওলানা হালিম

আক্কেলপুরে ‘একঘরে’ করে রাখা দিনমজুরকে মারধর, থানায় মামলা

‘কথিত আওয়ামী লীগ সদস্যদের’ বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতার বিষয়ে ভারত অবহিত নয়: মুখপাত্র

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত