ইজাজুল হক

এক.
১৯৪০ সাল। কাশ্মীর তখনো তিন টুকরো হয়নি। ভারতবর্ষে বৃটিশরাজ টালমাটাল; পতনোন্মুখ। ব্রিটিশদের আশীর্বাদপুষ্ট মহারাজা হরি সিং অখণ্ড কাশ্মীরের একচ্ছত্র অধিপতি। জম্মু থেকে লাদাখ, কারাকোরাম থেকে গিলগিত-বালতিস্তান কিংবা শ্রীনগর থেকে মুজাফফরাবাদ—সর্বত্রই মহারাজার শাসন। ব্রিটিশরা ১৮৪৬ সালে শিখ রাজাদের পরাজিত করে কাশ্মীর দখল করলেও কখনো সরাসরি কাশ্মীর শাসন করেনি। আনুগত্যের শর্তে হরি সিংয়ের চতুর্থ পুরুষ ডোগরা রাজা গুলাব সিংয়ের কাছে লর্ড হার্ডিঞ্জ মাত্র সাড়ে ৭ লাখ রুপি দিয়ে ভূস্বর্গ কাশ্মীর বেচে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই কাশ্মীরে ডোগরা রাজার শাসন। ৫০০ বছরের মুসলিম-শাসনের সোনালি ইতিহাস থাকলেও এবং কাশ্মীরের দুই তৃতীয়াংশ জনগণ মুসলমান হলেও তত দিনে মুসলমানরা ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। কাশ্মীরি মুসলিম নেতা শেখ আবদুল্লাহ নিপীড়িত মুসলমানদের শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।
সেই দিনগুলোতে, সুলতান জাইনুল আবেদিনের প্রধান বিচারপতি মির সৈয়দ আলি বুখারির এক উত্তরপুরুষ—মির গোলাম রসুল নাজকি কাশ্মীরের বান্ডিপোরায় বাস করতেন। কাশ্মীরের সুফি কবিতার পুনর্জন্মে তাঁকে পথিকৃতের মর্যাদা দেওয়া হয়। সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি গোলাম রসুল নাজকি বিয়ে করেছিলেন কাশ্মীরের বিখ্যাত ফাজিলি পরিবারের এক শিক্ষিত-বিদূষী নারীকে। সে বছর, ১৯৪০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, তাঁদের কোল আলো করে জন্ম নেন এক শিশু—সাইয়েদ মুহাম্মদ ফারুক নাজকি—আজকের কাশ্মীরের সেরা কবি ফারুক নাজকি।
বারামুল্লা জেলার অন্তর্গত এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ স্বাদু পানির হ্রদ উলার লেকের উত্তর তীরের এক সবুজ জনপদ বান্ডিপোরা তখনো জেলা হয়নি। সেখানে এক মায়াবী পাহাড় ছিল—নিবু পাহাড়, যার পাদদেশের সারি সারি চিনার-দেবদারুর মাঝে গড়ে উঠেছে ছোট্ট গ্রাম—মাদরাবন; ফারুক নাজকির আশৈশব স্মৃতির জনপদ। মাদরাবনের এক তিনতলা বাড়িতে থাকত ফারুক নাজকির পরিবার। একই ছাদের নিচে যৌথভাবে বসবাস করতেন তাঁর তিন চাচাও—গোলাম মুহাম্মদ, বাহাউদ্দিন ও গোলাম জিলানি। পিঠাপিঠি বড় ভাই রিয়াজুল ইসলামের সঙ্গে খেলেদুলে বড় হতে থাকেন ছোট্ট ফারুক নাজকি। ঘর থেকে বেরোলেই সবুজ ঘাসেভরা উঠোন, উঠোন পেরোলেই নানারঙা ফুলেল মাঠ, মাঠ পেরোলেই কুলকুল বয়ে চলা শীতল নদী, নদী পেরোলেই হলদে পাতাঝরার বন এবং দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়। টিউলিপ, সূর্যমুখী, গোলাপ ও জাফরানের ঘ্রাণ এবং আপেল, আঙুর, চেরি ও নাশপাতির স্বাদ নিতে নিতেই বেড়ে ওঠেন নাজকি। বড়দের সঙ্গে নদী তীরে যান, স্বচ্ছ শীতল জলধারার ছোঁয়ায় মাতেন। দূরে নদীর ওপারে পাহাড় থেকে নেমে আসে শিংঅলা লাল হরিণের দল। ক্লান্ত-তৃষ্ণার্ত সুবোধ হরিণেরা মুখ ডুবিয়ে জল পান করে। শিশু নাজকি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। হরিণের মোলায়েম গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় তার। কখনো-সখনো দূরের পাহাড়েও যাওয়া হতো নাজকির—বড়দের আঙুল চেপে ধরে। পাহাড়ের ওপর থেকে উপত্যকার যে দৃশ্য দেখা যেত, তা এখনো ভুলতে পারেন না তিনি। সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়াত গাছের শুকনো ডালের মতো বাঁকা শিংঅলা বিপুলদেহ লাল হরিণের দল। এ ধরনের হরিণকে স্থানীয় ভাষায় ‘হানগুল’ বলে, যা বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়—বিপন্ন প্রজাতির তালিকাভুক্ত।
ফারুক নাজকিদের সেই তিনতলা বাড়িটি সারা দিন মেহমানদের আগমনে গমগম করত। এখানে-ওখানে থরে থরে সাজানো বইপুস্তক, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পত্রিকা-ম্যাগাজিন এবং দেয়ালে-দেয়ালে ঝোলানো দেয়ালচিত্র—মাঝখানের বিশাল হলরুমে বসে গভীর রাত পর্যন্ত চলত কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা। বাবা গোলাম রসুল নাজকি কাশ্মীরের উর্দু সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। তাঁর কাছে নিয়মিত আশীর্বাদ নিতে আসতেন উর্দু ও কাশ্মীরি সাহিত্যের সেরা ব্যক্তিত্বরা। খলিলুর রহমান আজমি, জিএম মির তাউস, জিএইচ আলি বুলবুল, নাজমুদ্দিন ইশরাত, জাবেদ কাশ্মীরি, নিয়াজ কামরাজি, কমরুদ্দিন কমর, তানহা আনসারি, সাওলুরুক শাবানসহ অসংখ্য সাহিত্যসেবী। উর্দু সাহিত্যের কিংবদন্তি পুরুষ জিগর মুরাদাবাদী ও ফিরাক গুরকপুরীও মাঝেমধ্যে আসতেন। এত এত চমৎকার মানুষের রাতজাগা আড্ডা দেখে এবং তাঁদের কোলে-পিঠে চড়ে কবিতার রূপ-রস অজান্তেই প্রবেশ করতে থাকে ফারুক নাজকির রক্তে-মাংসে।
একসময় নাজকির পড়াশোনার বয়স হয়। দাদাবাড়ির এমন কোলাহলে সেই পরিবেশ মোটেও ছিল না। সাহিত্যসাধনায় বুঁদ বাবা গোলাম রসুল নাজকি ছেলেমেয়েদের গামরোর নানাবাড়ি পাঠিয়ে দেন। নানাবাড়ির পরিবেশ বেশ চমৎকার। পড়াশোনা, গবেষণা ও আভিজাত্যে বান্ডিপোরার অন্যতম সেরা পরিবার। কাশ্মীরের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ হাসান খুরামি ছিলেন ফারুক নাজকির চাচাতো নানা। সেই পরিবারের বিখ্যাত শিক্ষক আবদুল কাদিফ ফাজিলির কাছেই শুরু হয় তাঁর পড়াশোনার আনুষ্ঠানিক যাত্রা। মামাতো ভাই মনসুর আমহদ তাঁর সহপাঠী ও অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। কিছুদিন পর স্কুলেও যাওয়া শুরু করেন ফারুক। দু-এক বছরের ব্যবধানে দুটি স্কুল পাল্টাতে হয় তাঁকে। আট বছর বয়সে, ১৯৪৮ সালে তাঁর বান্ডিপোরা অধ্যায়ের ইতি ঘটে এবং পরিবারের সঙ্গে তিনি স্থায়ীভাবে শ্রীনগরের বাসিন্দা হয়ে যান। শৈশবের দুরন্ত দিনগুলোকে তিনি খুব মিস করেন। অনেক বছর পরে এসে লেখা তাঁর ‘শৈশব’ কবিতাটি পড়ুন—
‘হালকা-সরল কথার ফুলে
তৈরি হতো গানের মালা
ক্ষুদ্র-ছোট শব্দ-শলায়
চিন্তাদ্বীপে জ্বলত আগুন
প্রতিটি মুখ আমার ছিল
আমার ছিল দর্পণও সব
ছিল সকল ঘর আমাদের
উঠোনও সব আমার ছিল।
ঠোঁটের আগায় আসত কথা
বের হলেও, মন থেকে না
ঢালত কানে অমৃত-শরাব
বইত হাওয়া হৃদয় ছুঁয়ে
সময়টি বেশ প্রিয় ছিল
মধুর ছিল মুহূর্ত সব
সেই সময়ের আলোর সড়ক—
শুরু আছে, সমাপ্তি নেই।
সেই সময়ের আলোর সড়ক—
শুরু আছে, সমাপ্তি নেই
সময়টি কই হারিয়ে গেল
স্মৃতির ভুবন বর্ণনাতীত।’
(লফ্জ লফ্জ নোহা/ফারুক নাজকি)
দুই.
১৯৪৭ সাল। ভারত উপমহাদেশের রাজনীতির চেহারা পাল্টে যায়। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যায় ২০০ বছরের ব্রিটিশশাসিত নিখিল ভারত। জন্ম নেয় দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তান। ভারতজুড়ে শুরু হয় এক নিষ্ঠুর খেলা—সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। লাখে-লাখে মানুষ ভারত ছেড়ে পাকিস্তান যাচ্ছে; অথবা পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আসছে। পথে-পথে আগুনের লেলিহান শিখা। মুসলমানেরা হিন্দুদের মারছে, হিন্দুরা কাটছে মুসলমানদের। ফলে পাশের রাষ্ট্র কাশ্মীরেও আছড়ে পড়ে সেই দাঙ্গার প্রমত্ত ঢেউ। কাশ্মীরের অসংখ্য মুসলিম চলে যেতে বাধ্য হয় সদ্যোজাত মুসলিম দেশ পাকিস্তানে। তবে অধিকাংশ কাশ্মীরি মুসলমান একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্ন দেখত। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদের প্রাণপুরুষ এবং পরবর্তীতে রিয়াসত-এ-কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ। এরই মধ্যে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে কাশ্মীর আক্রমণ করে বসে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত এলাকার কয়েকটি উপজাতীয় বাহিনী। বলা হয়ে থাকে, কাশ্মীরকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে রাজা হরি সিংয়ের সঙ্গে পাকিস্তানের একটি চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির কারণে সরাসরি দখল করতে না পেরে পাকিস্তান কাশ্মীর-সংলগ্ন উপজাতিদের উসকে দেয় এবং বর্তমান আজাদ কাশ্মীর অংশটি দখল করে নেয়। ফলে হরি সিং অনেকটা নিরুপায় হয়ে ভারতের সাহায্য চান এবং নেহেরু-প্যাটেলরা সুকৌশলে অবশিষ্ট কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার কথা বলে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করে নেন। পরে, ১৯৬২ সালে ভারতশাসিত কাশ্মীরের আরেকটি অংশ দখল করে নেয় চীন। ফলে কাশ্মীর তিন দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির সবচেয়ে জটিল ভূখণ্ডে পরিণত হয়।
ভারতের সঙ্গে যুক্ত হলে হরি সিংকে রাজার মর্যাদায় রাখা হলেও কাশ্মীরি মুসলিম নেতা শেখ আবদুল্লাহকে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়। ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি তখন ‘রেডিও কাশ্মীর জম্মু’ স্টেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তাঁর সঙ্গে শেখ আবদুল্লাহর বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। সেই দিনগুলোতে রাজা হরি সিং ‘রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ফারুক নাজকির বাবাকেই তা পরিচালনার দায়িত্ব দেন। ফলে আট বছরের শিশু ফারুকসহ পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে তিনি স্থায়ীভাবে শ্রীনগরের রেইনাওয়ারিতে চলে যান। সেখানে এক্সচেঞ্জ রোডে তাদের জন্য একটি বিশাল পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। বাড়িটি কাশ্মীরের সাবেক শিক্ষা পরিচালক খালিফ আবদুল হাকিমের সরকারি বাসভবন ছিল—দেশভাগের পর তিনি পাকিস্তানে চলে যান।
১৩ জুলাই, ১৯৪৮। শ্রীনগরের পলোগ্রাউন্ডে ‘রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। সংবাদপাঠ করে উদ্বোধন করবেন ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি। ফারুক নাজকি ভাইবোনদের নিয়ে রেইনাওয়ারির বাড়িটিতে রেডিওর সামনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। কিছুক্ষণ পর কাশ্মীরি ভাষায় তরঙ্গায়িত হলো কাশ্মীরি ভাষার প্রথম রেডিওধ্বনি—‘আদাব, রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর থেকে বলছি…’। ফারুক নাজকিসহ লাখো কাশ্মিরির মনে সেদিন বয়ে যায় আনন্দের ফল্গুধারা। বাবার কণ্ঠ বালক ফারুককে দারুণভাবে আপ্লুত করে। সেদিনের অনুপ্রেরণাই হয়তো পরবর্তীতে কাশ্মীরের কিংবদন্তি মিডিয়া ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে ফারুক নাজকিকে।
দুই বছর পর, ১৯৫০ সালে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে ফারুক নাজকির জীবনে। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রাসাদ কাশ্মীরের সৌন্দর্যসুধা পান করতে আসেন। তাঁর সম্মানে শ্রীনগরের ঝিলম নদীতে আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য নৌবিহারের। শতরঙা আলপনায় আবৃত সারি সারি বজরা নৌকার মিছিল। নদীর দু-কুলে সাজ-সাজ রব। রেডিওতে এই আয়োজনের ধারাভাষ্য দিচ্ছেন ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি। ঝিলমের এমন নয়নকাড়া রূপ অনেক কাশ্মিরিদের মতো ফারুকও এর আগে দেখেননি। বহতা ঝিলমের রূপরহস্য যেন প্রথমবারের মতো দৃশ্যমান হয় তাঁর সামনে। সেদিন তাঁর শিশুমনে হয়তো বেজেছিল আনন্দের গান—যেমন বেজেছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে। সন্ধ্যার আলো-আঁধারে ঝিলমের তীরে বসে ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—
‘সন্ধ্যারাগে-ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা
আঁধারে মলিন হলো, যেন খাপে ঢাকা
বাঁকা তলোয়ার;
দিনের ভাটার শেষে রাত্রির জোয়ার;
অন্ধকার গিরিতটতলে
দেওদার-তরু সারে সারে;
মনে হলো, সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে,
বলিতে না পারে স্পষ্ট করি—
অব্যক্ত ধ্বনিপুঞ্জ অন্ধকারে উঠিছে গুমরি।’
(বলাকা/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
তিন.
ফারুক নাজকি যখন বান্ডিপোরার প্রাইমারি স্কুলে পড়তেন, তখনই তিনি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন, নিজের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভার সন্ধান পান। চতুর্থ শ্রেণিতে থাকাকালে স্কুলে এক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। মহারাজা হরি সিং বান্ডিপোরা আসবেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁর সম্মানে স্কুলেরই এক শিক্ষার্থীকে পাঠ করতে হবে মানপত্র। সবাইকে পেছনে ফেলে ফারুক নাজকিই নির্বাচিত হন। তবে শেষ মুহূর্তে মহারাজা এলেন না। পাঠালেন প্রধানমন্ত্রী মেহর চাঁদ মহাজনকে। অনুষ্ঠানে ফারুকের বাবা গোলাম রসুল নাজকি এবং আল্লামা ইকবালের ছেলে জাবেদ ইকবালও অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। শিশু ফারুকের মানপত্র পাঠের আভিজাত্য দেখে জাবেদ ইকবাল পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন—‘আখের ব্যাটা কিসকা হ্যায়’। আল্লামা ইকবাল সম্পর্কে ফারুক আগে থেকেই জানতেন। ফলে ইকবালের ছেলে জাবেদ ইকবালের কাছ থেকে এমন মন্তব্য তাঁকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল এবং বুকের পেলব জমিতে আত্মবিশ্বাসের বীজ বপন করে দিয়েছিল।
ফারুক নাজকির বাবা বড় অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। কখনো সন্তানদের সরাসরি কোনো কিছু পড়তে বা লিখতে বলতেন না। দূর থেকে টুকটাক নির্দেশনা দিতেন। কেউ পরামর্শ চাইলে ‘সিদকে জাদিদ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত বিখ্যাত তাফসিরগ্রন্থ ‘তাফসিরে মাজেদি’র পর্বগুলো পড়ার পরামর্শ দিতেন। কখনো কোনো সমস্যা হলে সেটির সমাধান বের করার প্রতি জোর দিতেন। ফলে ফারুকের মন নিজের মতো করেই বিকশিত হতে থাকে। ফারুক বিচরণ করতে শুরু করেন সাহিত্যের ডালপালায়। কবিতা, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ নানা বিষয়ে।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই দিল্লির জামিয়া মিলিয়া থেকে প্রকাশিত ড. জাকির হুসাইন সম্পাদিত ‘মেরা পারসা’ ম্যাগাজিনে ফারুকের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে তিনি তৎকালীন কাশ্মীরের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র শ্রী প্রতাপ কলেজে ভর্তি হন। কলেজজীবনে ডেইলি খেদমাত, দেহলি আশিয়ানা, মাস্তানা যোগি ও সাপ্তাহিক চিত্রাসহ বেশ কিছু পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। তখনই সচেতনভাবে রচনার প্রতিপাদ্য হিসেবে তিনি বেছে নেন ‘কাশ্মীর ও কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদ’।
ফারুকের কবিতা লেখার হাতেখড়ি হয় প্রখ্যাত উর্দু কবি জিগর মুরাদাবাদীর হাত ধরে। সেই গল্প শুনুন কবি ফারুক নাজকির মুখ থেকেই। তিনি বলেন, একদিন মুরাদাবাদী আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। একটি ডায়েরিতে দুই লাইনের কবিতা লিখে আমাকে বললেন, ‘ফারুক, তুমি যদি এই কবিতার অন্ত্যমিলের সঙ্গে মিল রেখে আরেকটি পঙ্ক্তি বলতে পারো, তবে আমি এই ডায়েরি তোমাকে অটোগ্রাফ হিসেবে দিয়ে দেব।’ কবিতার শেষে ‘দিওয়ানা’ শব্দ ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই আমি ‘পরোয়ানা’ অন্ত্যমিল দিয়ে একটি পঙ্ক্তি বলে দিই এবং মুরাদাবাদী বেশ খুশি হন। এর পর থেকে আমি কবিতা লেখায় আগ্রহী হই এবং প্রথম যে লাইনগুলো লিখি তা এ রকম—
‘রাজনীতিকেরা রাজনীতিই বোঝে
ভালোবাসায় রাজনীতি চলে না
তোমাকে দেখে সকলেই ‘বলছে—
এ ছবি নয় খোদা, জাদু, জাদু!’
নাজকিদের শ্রীনগরের বাড়িটি ছিল কলেজের হোস্টেলের মতো। সহোদর সাত ভাই ছাড়াও সেখানে থেকে পড়াশোনা করত চাচাতো-মামাতো ভাইয়েরাও। ফলে একই ছাদের নিচে রাতদিন আলোচনা চলত জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে। চিকিৎসাবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, নৃবিজ্ঞান, সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, কৃষি, ভেটেরিনারি সায়েন্স, আইন—কী ছিল না তাদের পড়ার বিষয়সূচিতে। জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার মেলা বসত সেখানে। ফলে সেই বাড়ির সকলেই আজ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলছেন। আবার অনেকে জীবনের ইতিও টেনেছেন। নাজকি পরিবার থেকেই এসেছেন তিনজন বিখ্যাত কবি। ফারুক নাজকি, ইকবাল নাজকি ও আয়াজ রসুল নাজকি।
ফারুক নাজকি খুব অল্প বয়সে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উর্দু সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেন। তরুণ চঞ্চল দুরন্ত নাজকির স্বপ্ন ছিল অভিনেতা কিংবা শিক্ষক হওয়ার। কিন্তু এক জীবনে তাঁর এই দুটি স্বপ্ন কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। বরং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তিনি নিজের ক্যারিয়ার গড়েন এবং কবি হিসেবে সর্বমহলে বরণীয় হয়ে ওঠেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে শুরু করেন সাংবাদিকতা। কাশ্মীরের প্রথিতযশা দুই সাংবাদিক কাজি সানাউল্লাহ বাট ও মুহাম্মদ শফির কাছে হাতে-কলমে শেখেন সাংবাদিকতার পাঠ।
এর পর ১৯৬০ সালে, মাত্র ২০ বছর বয়সে নিজেই একটি পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নেন এবং কাশ্মিরজুড়ে মোটামুটি হইচই ফেলে দেন। ‘ডেইলি মজদুর’ নামের সেই পত্রিকার মূল প্রতিপাদ্য ছিল কাশ্মীর উপত্যকার শ্রমিক-মজুর-মেহনতি মানুষের জীবন অগ্রাধিকার দিয়ে তুলে ধরা। জম্মু-কাশ্মীরে এমন পত্রিকার ধারণা ছিল সম্পূর্ণ নতুন। ফলে গণমানুষের মাঝে তা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তবে এক বছরের মাথায় সরকারের রোষানলে পড়ে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি।
আরও পড়ুন:

এক.
১৯৪০ সাল। কাশ্মীর তখনো তিন টুকরো হয়নি। ভারতবর্ষে বৃটিশরাজ টালমাটাল; পতনোন্মুখ। ব্রিটিশদের আশীর্বাদপুষ্ট মহারাজা হরি সিং অখণ্ড কাশ্মীরের একচ্ছত্র অধিপতি। জম্মু থেকে লাদাখ, কারাকোরাম থেকে গিলগিত-বালতিস্তান কিংবা শ্রীনগর থেকে মুজাফফরাবাদ—সর্বত্রই মহারাজার শাসন। ব্রিটিশরা ১৮৪৬ সালে শিখ রাজাদের পরাজিত করে কাশ্মীর দখল করলেও কখনো সরাসরি কাশ্মীর শাসন করেনি। আনুগত্যের শর্তে হরি সিংয়ের চতুর্থ পুরুষ ডোগরা রাজা গুলাব সিংয়ের কাছে লর্ড হার্ডিঞ্জ মাত্র সাড়ে ৭ লাখ রুপি দিয়ে ভূস্বর্গ কাশ্মীর বেচে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই কাশ্মীরে ডোগরা রাজার শাসন। ৫০০ বছরের মুসলিম-শাসনের সোনালি ইতিহাস থাকলেও এবং কাশ্মীরের দুই তৃতীয়াংশ জনগণ মুসলমান হলেও তত দিনে মুসলমানরা ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। কাশ্মীরি মুসলিম নেতা শেখ আবদুল্লাহ নিপীড়িত মুসলমানদের শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।
সেই দিনগুলোতে, সুলতান জাইনুল আবেদিনের প্রধান বিচারপতি মির সৈয়দ আলি বুখারির এক উত্তরপুরুষ—মির গোলাম রসুল নাজকি কাশ্মীরের বান্ডিপোরায় বাস করতেন। কাশ্মীরের সুফি কবিতার পুনর্জন্মে তাঁকে পথিকৃতের মর্যাদা দেওয়া হয়। সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি গোলাম রসুল নাজকি বিয়ে করেছিলেন কাশ্মীরের বিখ্যাত ফাজিলি পরিবারের এক শিক্ষিত-বিদূষী নারীকে। সে বছর, ১৯৪০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, তাঁদের কোল আলো করে জন্ম নেন এক শিশু—সাইয়েদ মুহাম্মদ ফারুক নাজকি—আজকের কাশ্মীরের সেরা কবি ফারুক নাজকি।
বারামুল্লা জেলার অন্তর্গত এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ স্বাদু পানির হ্রদ উলার লেকের উত্তর তীরের এক সবুজ জনপদ বান্ডিপোরা তখনো জেলা হয়নি। সেখানে এক মায়াবী পাহাড় ছিল—নিবু পাহাড়, যার পাদদেশের সারি সারি চিনার-দেবদারুর মাঝে গড়ে উঠেছে ছোট্ট গ্রাম—মাদরাবন; ফারুক নাজকির আশৈশব স্মৃতির জনপদ। মাদরাবনের এক তিনতলা বাড়িতে থাকত ফারুক নাজকির পরিবার। একই ছাদের নিচে যৌথভাবে বসবাস করতেন তাঁর তিন চাচাও—গোলাম মুহাম্মদ, বাহাউদ্দিন ও গোলাম জিলানি। পিঠাপিঠি বড় ভাই রিয়াজুল ইসলামের সঙ্গে খেলেদুলে বড় হতে থাকেন ছোট্ট ফারুক নাজকি। ঘর থেকে বেরোলেই সবুজ ঘাসেভরা উঠোন, উঠোন পেরোলেই নানারঙা ফুলেল মাঠ, মাঠ পেরোলেই কুলকুল বয়ে চলা শীতল নদী, নদী পেরোলেই হলদে পাতাঝরার বন এবং দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়। টিউলিপ, সূর্যমুখী, গোলাপ ও জাফরানের ঘ্রাণ এবং আপেল, আঙুর, চেরি ও নাশপাতির স্বাদ নিতে নিতেই বেড়ে ওঠেন নাজকি। বড়দের সঙ্গে নদী তীরে যান, স্বচ্ছ শীতল জলধারার ছোঁয়ায় মাতেন। দূরে নদীর ওপারে পাহাড় থেকে নেমে আসে শিংঅলা লাল হরিণের দল। ক্লান্ত-তৃষ্ণার্ত সুবোধ হরিণেরা মুখ ডুবিয়ে জল পান করে। শিশু নাজকি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। হরিণের মোলায়েম গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় তার। কখনো-সখনো দূরের পাহাড়েও যাওয়া হতো নাজকির—বড়দের আঙুল চেপে ধরে। পাহাড়ের ওপর থেকে উপত্যকার যে দৃশ্য দেখা যেত, তা এখনো ভুলতে পারেন না তিনি। সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়াত গাছের শুকনো ডালের মতো বাঁকা শিংঅলা বিপুলদেহ লাল হরিণের দল। এ ধরনের হরিণকে স্থানীয় ভাষায় ‘হানগুল’ বলে, যা বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়—বিপন্ন প্রজাতির তালিকাভুক্ত।
ফারুক নাজকিদের সেই তিনতলা বাড়িটি সারা দিন মেহমানদের আগমনে গমগম করত। এখানে-ওখানে থরে থরে সাজানো বইপুস্তক, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পত্রিকা-ম্যাগাজিন এবং দেয়ালে-দেয়ালে ঝোলানো দেয়ালচিত্র—মাঝখানের বিশাল হলরুমে বসে গভীর রাত পর্যন্ত চলত কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা। বাবা গোলাম রসুল নাজকি কাশ্মীরের উর্দু সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। তাঁর কাছে নিয়মিত আশীর্বাদ নিতে আসতেন উর্দু ও কাশ্মীরি সাহিত্যের সেরা ব্যক্তিত্বরা। খলিলুর রহমান আজমি, জিএম মির তাউস, জিএইচ আলি বুলবুল, নাজমুদ্দিন ইশরাত, জাবেদ কাশ্মীরি, নিয়াজ কামরাজি, কমরুদ্দিন কমর, তানহা আনসারি, সাওলুরুক শাবানসহ অসংখ্য সাহিত্যসেবী। উর্দু সাহিত্যের কিংবদন্তি পুরুষ জিগর মুরাদাবাদী ও ফিরাক গুরকপুরীও মাঝেমধ্যে আসতেন। এত এত চমৎকার মানুষের রাতজাগা আড্ডা দেখে এবং তাঁদের কোলে-পিঠে চড়ে কবিতার রূপ-রস অজান্তেই প্রবেশ করতে থাকে ফারুক নাজকির রক্তে-মাংসে।
একসময় নাজকির পড়াশোনার বয়স হয়। দাদাবাড়ির এমন কোলাহলে সেই পরিবেশ মোটেও ছিল না। সাহিত্যসাধনায় বুঁদ বাবা গোলাম রসুল নাজকি ছেলেমেয়েদের গামরোর নানাবাড়ি পাঠিয়ে দেন। নানাবাড়ির পরিবেশ বেশ চমৎকার। পড়াশোনা, গবেষণা ও আভিজাত্যে বান্ডিপোরার অন্যতম সেরা পরিবার। কাশ্মীরের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ হাসান খুরামি ছিলেন ফারুক নাজকির চাচাতো নানা। সেই পরিবারের বিখ্যাত শিক্ষক আবদুল কাদিফ ফাজিলির কাছেই শুরু হয় তাঁর পড়াশোনার আনুষ্ঠানিক যাত্রা। মামাতো ভাই মনসুর আমহদ তাঁর সহপাঠী ও অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। কিছুদিন পর স্কুলেও যাওয়া শুরু করেন ফারুক। দু-এক বছরের ব্যবধানে দুটি স্কুল পাল্টাতে হয় তাঁকে। আট বছর বয়সে, ১৯৪৮ সালে তাঁর বান্ডিপোরা অধ্যায়ের ইতি ঘটে এবং পরিবারের সঙ্গে তিনি স্থায়ীভাবে শ্রীনগরের বাসিন্দা হয়ে যান। শৈশবের দুরন্ত দিনগুলোকে তিনি খুব মিস করেন। অনেক বছর পরে এসে লেখা তাঁর ‘শৈশব’ কবিতাটি পড়ুন—
‘হালকা-সরল কথার ফুলে
তৈরি হতো গানের মালা
ক্ষুদ্র-ছোট শব্দ-শলায়
চিন্তাদ্বীপে জ্বলত আগুন
প্রতিটি মুখ আমার ছিল
আমার ছিল দর্পণও সব
ছিল সকল ঘর আমাদের
উঠোনও সব আমার ছিল।
ঠোঁটের আগায় আসত কথা
বের হলেও, মন থেকে না
ঢালত কানে অমৃত-শরাব
বইত হাওয়া হৃদয় ছুঁয়ে
সময়টি বেশ প্রিয় ছিল
মধুর ছিল মুহূর্ত সব
সেই সময়ের আলোর সড়ক—
শুরু আছে, সমাপ্তি নেই।
সেই সময়ের আলোর সড়ক—
শুরু আছে, সমাপ্তি নেই
সময়টি কই হারিয়ে গেল
স্মৃতির ভুবন বর্ণনাতীত।’
(লফ্জ লফ্জ নোহা/ফারুক নাজকি)
দুই.
১৯৪৭ সাল। ভারত উপমহাদেশের রাজনীতির চেহারা পাল্টে যায়। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যায় ২০০ বছরের ব্রিটিশশাসিত নিখিল ভারত। জন্ম নেয় দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তান। ভারতজুড়ে শুরু হয় এক নিষ্ঠুর খেলা—সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। লাখে-লাখে মানুষ ভারত ছেড়ে পাকিস্তান যাচ্ছে; অথবা পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আসছে। পথে-পথে আগুনের লেলিহান শিখা। মুসলমানেরা হিন্দুদের মারছে, হিন্দুরা কাটছে মুসলমানদের। ফলে পাশের রাষ্ট্র কাশ্মীরেও আছড়ে পড়ে সেই দাঙ্গার প্রমত্ত ঢেউ। কাশ্মীরের অসংখ্য মুসলিম চলে যেতে বাধ্য হয় সদ্যোজাত মুসলিম দেশ পাকিস্তানে। তবে অধিকাংশ কাশ্মীরি মুসলমান একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্ন দেখত। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদের প্রাণপুরুষ এবং পরবর্তীতে রিয়াসত-এ-কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ। এরই মধ্যে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে কাশ্মীর আক্রমণ করে বসে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত এলাকার কয়েকটি উপজাতীয় বাহিনী। বলা হয়ে থাকে, কাশ্মীরকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে রাজা হরি সিংয়ের সঙ্গে পাকিস্তানের একটি চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির কারণে সরাসরি দখল করতে না পেরে পাকিস্তান কাশ্মীর-সংলগ্ন উপজাতিদের উসকে দেয় এবং বর্তমান আজাদ কাশ্মীর অংশটি দখল করে নেয়। ফলে হরি সিং অনেকটা নিরুপায় হয়ে ভারতের সাহায্য চান এবং নেহেরু-প্যাটেলরা সুকৌশলে অবশিষ্ট কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার কথা বলে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করে নেন। পরে, ১৯৬২ সালে ভারতশাসিত কাশ্মীরের আরেকটি অংশ দখল করে নেয় চীন। ফলে কাশ্মীর তিন দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির সবচেয়ে জটিল ভূখণ্ডে পরিণত হয়।
ভারতের সঙ্গে যুক্ত হলে হরি সিংকে রাজার মর্যাদায় রাখা হলেও কাশ্মীরি মুসলিম নেতা শেখ আবদুল্লাহকে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়। ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি তখন ‘রেডিও কাশ্মীর জম্মু’ স্টেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তাঁর সঙ্গে শেখ আবদুল্লাহর বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। সেই দিনগুলোতে রাজা হরি সিং ‘রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ফারুক নাজকির বাবাকেই তা পরিচালনার দায়িত্ব দেন। ফলে আট বছরের শিশু ফারুকসহ পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে তিনি স্থায়ীভাবে শ্রীনগরের রেইনাওয়ারিতে চলে যান। সেখানে এক্সচেঞ্জ রোডে তাদের জন্য একটি বিশাল পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। বাড়িটি কাশ্মীরের সাবেক শিক্ষা পরিচালক খালিফ আবদুল হাকিমের সরকারি বাসভবন ছিল—দেশভাগের পর তিনি পাকিস্তানে চলে যান।
১৩ জুলাই, ১৯৪৮। শ্রীনগরের পলোগ্রাউন্ডে ‘রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। সংবাদপাঠ করে উদ্বোধন করবেন ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি। ফারুক নাজকি ভাইবোনদের নিয়ে রেইনাওয়ারির বাড়িটিতে রেডিওর সামনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। কিছুক্ষণ পর কাশ্মীরি ভাষায় তরঙ্গায়িত হলো কাশ্মীরি ভাষার প্রথম রেডিওধ্বনি—‘আদাব, রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর থেকে বলছি…’। ফারুক নাজকিসহ লাখো কাশ্মিরির মনে সেদিন বয়ে যায় আনন্দের ফল্গুধারা। বাবার কণ্ঠ বালক ফারুককে দারুণভাবে আপ্লুত করে। সেদিনের অনুপ্রেরণাই হয়তো পরবর্তীতে কাশ্মীরের কিংবদন্তি মিডিয়া ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে ফারুক নাজকিকে।
দুই বছর পর, ১৯৫০ সালে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে ফারুক নাজকির জীবনে। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রাসাদ কাশ্মীরের সৌন্দর্যসুধা পান করতে আসেন। তাঁর সম্মানে শ্রীনগরের ঝিলম নদীতে আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য নৌবিহারের। শতরঙা আলপনায় আবৃত সারি সারি বজরা নৌকার মিছিল। নদীর দু-কুলে সাজ-সাজ রব। রেডিওতে এই আয়োজনের ধারাভাষ্য দিচ্ছেন ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি। ঝিলমের এমন নয়নকাড়া রূপ অনেক কাশ্মিরিদের মতো ফারুকও এর আগে দেখেননি। বহতা ঝিলমের রূপরহস্য যেন প্রথমবারের মতো দৃশ্যমান হয় তাঁর সামনে। সেদিন তাঁর শিশুমনে হয়তো বেজেছিল আনন্দের গান—যেমন বেজেছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে। সন্ধ্যার আলো-আঁধারে ঝিলমের তীরে বসে ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—
‘সন্ধ্যারাগে-ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা
আঁধারে মলিন হলো, যেন খাপে ঢাকা
বাঁকা তলোয়ার;
দিনের ভাটার শেষে রাত্রির জোয়ার;
অন্ধকার গিরিতটতলে
দেওদার-তরু সারে সারে;
মনে হলো, সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে,
বলিতে না পারে স্পষ্ট করি—
অব্যক্ত ধ্বনিপুঞ্জ অন্ধকারে উঠিছে গুমরি।’
(বলাকা/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
তিন.
ফারুক নাজকি যখন বান্ডিপোরার প্রাইমারি স্কুলে পড়তেন, তখনই তিনি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন, নিজের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভার সন্ধান পান। চতুর্থ শ্রেণিতে থাকাকালে স্কুলে এক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। মহারাজা হরি সিং বান্ডিপোরা আসবেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁর সম্মানে স্কুলেরই এক শিক্ষার্থীকে পাঠ করতে হবে মানপত্র। সবাইকে পেছনে ফেলে ফারুক নাজকিই নির্বাচিত হন। তবে শেষ মুহূর্তে মহারাজা এলেন না। পাঠালেন প্রধানমন্ত্রী মেহর চাঁদ মহাজনকে। অনুষ্ঠানে ফারুকের বাবা গোলাম রসুল নাজকি এবং আল্লামা ইকবালের ছেলে জাবেদ ইকবালও অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। শিশু ফারুকের মানপত্র পাঠের আভিজাত্য দেখে জাবেদ ইকবাল পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন—‘আখের ব্যাটা কিসকা হ্যায়’। আল্লামা ইকবাল সম্পর্কে ফারুক আগে থেকেই জানতেন। ফলে ইকবালের ছেলে জাবেদ ইকবালের কাছ থেকে এমন মন্তব্য তাঁকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল এবং বুকের পেলব জমিতে আত্মবিশ্বাসের বীজ বপন করে দিয়েছিল।
ফারুক নাজকির বাবা বড় অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। কখনো সন্তানদের সরাসরি কোনো কিছু পড়তে বা লিখতে বলতেন না। দূর থেকে টুকটাক নির্দেশনা দিতেন। কেউ পরামর্শ চাইলে ‘সিদকে জাদিদ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত বিখ্যাত তাফসিরগ্রন্থ ‘তাফসিরে মাজেদি’র পর্বগুলো পড়ার পরামর্শ দিতেন। কখনো কোনো সমস্যা হলে সেটির সমাধান বের করার প্রতি জোর দিতেন। ফলে ফারুকের মন নিজের মতো করেই বিকশিত হতে থাকে। ফারুক বিচরণ করতে শুরু করেন সাহিত্যের ডালপালায়। কবিতা, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ নানা বিষয়ে।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই দিল্লির জামিয়া মিলিয়া থেকে প্রকাশিত ড. জাকির হুসাইন সম্পাদিত ‘মেরা পারসা’ ম্যাগাজিনে ফারুকের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে তিনি তৎকালীন কাশ্মীরের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র শ্রী প্রতাপ কলেজে ভর্তি হন। কলেজজীবনে ডেইলি খেদমাত, দেহলি আশিয়ানা, মাস্তানা যোগি ও সাপ্তাহিক চিত্রাসহ বেশ কিছু পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। তখনই সচেতনভাবে রচনার প্রতিপাদ্য হিসেবে তিনি বেছে নেন ‘কাশ্মীর ও কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদ’।
ফারুকের কবিতা লেখার হাতেখড়ি হয় প্রখ্যাত উর্দু কবি জিগর মুরাদাবাদীর হাত ধরে। সেই গল্প শুনুন কবি ফারুক নাজকির মুখ থেকেই। তিনি বলেন, একদিন মুরাদাবাদী আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। একটি ডায়েরিতে দুই লাইনের কবিতা লিখে আমাকে বললেন, ‘ফারুক, তুমি যদি এই কবিতার অন্ত্যমিলের সঙ্গে মিল রেখে আরেকটি পঙ্ক্তি বলতে পারো, তবে আমি এই ডায়েরি তোমাকে অটোগ্রাফ হিসেবে দিয়ে দেব।’ কবিতার শেষে ‘দিওয়ানা’ শব্দ ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই আমি ‘পরোয়ানা’ অন্ত্যমিল দিয়ে একটি পঙ্ক্তি বলে দিই এবং মুরাদাবাদী বেশ খুশি হন। এর পর থেকে আমি কবিতা লেখায় আগ্রহী হই এবং প্রথম যে লাইনগুলো লিখি তা এ রকম—
‘রাজনীতিকেরা রাজনীতিই বোঝে
ভালোবাসায় রাজনীতি চলে না
তোমাকে দেখে সকলেই ‘বলছে—
এ ছবি নয় খোদা, জাদু, জাদু!’
নাজকিদের শ্রীনগরের বাড়িটি ছিল কলেজের হোস্টেলের মতো। সহোদর সাত ভাই ছাড়াও সেখানে থেকে পড়াশোনা করত চাচাতো-মামাতো ভাইয়েরাও। ফলে একই ছাদের নিচে রাতদিন আলোচনা চলত জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে। চিকিৎসাবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, নৃবিজ্ঞান, সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, কৃষি, ভেটেরিনারি সায়েন্স, আইন—কী ছিল না তাদের পড়ার বিষয়সূচিতে। জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার মেলা বসত সেখানে। ফলে সেই বাড়ির সকলেই আজ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলছেন। আবার অনেকে জীবনের ইতিও টেনেছেন। নাজকি পরিবার থেকেই এসেছেন তিনজন বিখ্যাত কবি। ফারুক নাজকি, ইকবাল নাজকি ও আয়াজ রসুল নাজকি।
ফারুক নাজকি খুব অল্প বয়সে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উর্দু সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেন। তরুণ চঞ্চল দুরন্ত নাজকির স্বপ্ন ছিল অভিনেতা কিংবা শিক্ষক হওয়ার। কিন্তু এক জীবনে তাঁর এই দুটি স্বপ্ন কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। বরং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তিনি নিজের ক্যারিয়ার গড়েন এবং কবি হিসেবে সর্বমহলে বরণীয় হয়ে ওঠেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে শুরু করেন সাংবাদিকতা। কাশ্মীরের প্রথিতযশা দুই সাংবাদিক কাজি সানাউল্লাহ বাট ও মুহাম্মদ শফির কাছে হাতে-কলমে শেখেন সাংবাদিকতার পাঠ।
এর পর ১৯৬০ সালে, মাত্র ২০ বছর বয়সে নিজেই একটি পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নেন এবং কাশ্মিরজুড়ে মোটামুটি হইচই ফেলে দেন। ‘ডেইলি মজদুর’ নামের সেই পত্রিকার মূল প্রতিপাদ্য ছিল কাশ্মীর উপত্যকার শ্রমিক-মজুর-মেহনতি মানুষের জীবন অগ্রাধিকার দিয়ে তুলে ধরা। জম্মু-কাশ্মীরে এমন পত্রিকার ধারণা ছিল সম্পূর্ণ নতুন। ফলে গণমানুষের মাঝে তা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তবে এক বছরের মাথায় সরকারের রোষানলে পড়ে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি।
আরও পড়ুন:
ইজাজুল হক

এক.
১৯৪০ সাল। কাশ্মীর তখনো তিন টুকরো হয়নি। ভারতবর্ষে বৃটিশরাজ টালমাটাল; পতনোন্মুখ। ব্রিটিশদের আশীর্বাদপুষ্ট মহারাজা হরি সিং অখণ্ড কাশ্মীরের একচ্ছত্র অধিপতি। জম্মু থেকে লাদাখ, কারাকোরাম থেকে গিলগিত-বালতিস্তান কিংবা শ্রীনগর থেকে মুজাফফরাবাদ—সর্বত্রই মহারাজার শাসন। ব্রিটিশরা ১৮৪৬ সালে শিখ রাজাদের পরাজিত করে কাশ্মীর দখল করলেও কখনো সরাসরি কাশ্মীর শাসন করেনি। আনুগত্যের শর্তে হরি সিংয়ের চতুর্থ পুরুষ ডোগরা রাজা গুলাব সিংয়ের কাছে লর্ড হার্ডিঞ্জ মাত্র সাড়ে ৭ লাখ রুপি দিয়ে ভূস্বর্গ কাশ্মীর বেচে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই কাশ্মীরে ডোগরা রাজার শাসন। ৫০০ বছরের মুসলিম-শাসনের সোনালি ইতিহাস থাকলেও এবং কাশ্মীরের দুই তৃতীয়াংশ জনগণ মুসলমান হলেও তত দিনে মুসলমানরা ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। কাশ্মীরি মুসলিম নেতা শেখ আবদুল্লাহ নিপীড়িত মুসলমানদের শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।
সেই দিনগুলোতে, সুলতান জাইনুল আবেদিনের প্রধান বিচারপতি মির সৈয়দ আলি বুখারির এক উত্তরপুরুষ—মির গোলাম রসুল নাজকি কাশ্মীরের বান্ডিপোরায় বাস করতেন। কাশ্মীরের সুফি কবিতার পুনর্জন্মে তাঁকে পথিকৃতের মর্যাদা দেওয়া হয়। সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি গোলাম রসুল নাজকি বিয়ে করেছিলেন কাশ্মীরের বিখ্যাত ফাজিলি পরিবারের এক শিক্ষিত-বিদূষী নারীকে। সে বছর, ১৯৪০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, তাঁদের কোল আলো করে জন্ম নেন এক শিশু—সাইয়েদ মুহাম্মদ ফারুক নাজকি—আজকের কাশ্মীরের সেরা কবি ফারুক নাজকি।
বারামুল্লা জেলার অন্তর্গত এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ স্বাদু পানির হ্রদ উলার লেকের উত্তর তীরের এক সবুজ জনপদ বান্ডিপোরা তখনো জেলা হয়নি। সেখানে এক মায়াবী পাহাড় ছিল—নিবু পাহাড়, যার পাদদেশের সারি সারি চিনার-দেবদারুর মাঝে গড়ে উঠেছে ছোট্ট গ্রাম—মাদরাবন; ফারুক নাজকির আশৈশব স্মৃতির জনপদ। মাদরাবনের এক তিনতলা বাড়িতে থাকত ফারুক নাজকির পরিবার। একই ছাদের নিচে যৌথভাবে বসবাস করতেন তাঁর তিন চাচাও—গোলাম মুহাম্মদ, বাহাউদ্দিন ও গোলাম জিলানি। পিঠাপিঠি বড় ভাই রিয়াজুল ইসলামের সঙ্গে খেলেদুলে বড় হতে থাকেন ছোট্ট ফারুক নাজকি। ঘর থেকে বেরোলেই সবুজ ঘাসেভরা উঠোন, উঠোন পেরোলেই নানারঙা ফুলেল মাঠ, মাঠ পেরোলেই কুলকুল বয়ে চলা শীতল নদী, নদী পেরোলেই হলদে পাতাঝরার বন এবং দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়। টিউলিপ, সূর্যমুখী, গোলাপ ও জাফরানের ঘ্রাণ এবং আপেল, আঙুর, চেরি ও নাশপাতির স্বাদ নিতে নিতেই বেড়ে ওঠেন নাজকি। বড়দের সঙ্গে নদী তীরে যান, স্বচ্ছ শীতল জলধারার ছোঁয়ায় মাতেন। দূরে নদীর ওপারে পাহাড় থেকে নেমে আসে শিংঅলা লাল হরিণের দল। ক্লান্ত-তৃষ্ণার্ত সুবোধ হরিণেরা মুখ ডুবিয়ে জল পান করে। শিশু নাজকি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। হরিণের মোলায়েম গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় তার। কখনো-সখনো দূরের পাহাড়েও যাওয়া হতো নাজকির—বড়দের আঙুল চেপে ধরে। পাহাড়ের ওপর থেকে উপত্যকার যে দৃশ্য দেখা যেত, তা এখনো ভুলতে পারেন না তিনি। সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়াত গাছের শুকনো ডালের মতো বাঁকা শিংঅলা বিপুলদেহ লাল হরিণের দল। এ ধরনের হরিণকে স্থানীয় ভাষায় ‘হানগুল’ বলে, যা বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়—বিপন্ন প্রজাতির তালিকাভুক্ত।
ফারুক নাজকিদের সেই তিনতলা বাড়িটি সারা দিন মেহমানদের আগমনে গমগম করত। এখানে-ওখানে থরে থরে সাজানো বইপুস্তক, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পত্রিকা-ম্যাগাজিন এবং দেয়ালে-দেয়ালে ঝোলানো দেয়ালচিত্র—মাঝখানের বিশাল হলরুমে বসে গভীর রাত পর্যন্ত চলত কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা। বাবা গোলাম রসুল নাজকি কাশ্মীরের উর্দু সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। তাঁর কাছে নিয়মিত আশীর্বাদ নিতে আসতেন উর্দু ও কাশ্মীরি সাহিত্যের সেরা ব্যক্তিত্বরা। খলিলুর রহমান আজমি, জিএম মির তাউস, জিএইচ আলি বুলবুল, নাজমুদ্দিন ইশরাত, জাবেদ কাশ্মীরি, নিয়াজ কামরাজি, কমরুদ্দিন কমর, তানহা আনসারি, সাওলুরুক শাবানসহ অসংখ্য সাহিত্যসেবী। উর্দু সাহিত্যের কিংবদন্তি পুরুষ জিগর মুরাদাবাদী ও ফিরাক গুরকপুরীও মাঝেমধ্যে আসতেন। এত এত চমৎকার মানুষের রাতজাগা আড্ডা দেখে এবং তাঁদের কোলে-পিঠে চড়ে কবিতার রূপ-রস অজান্তেই প্রবেশ করতে থাকে ফারুক নাজকির রক্তে-মাংসে।
একসময় নাজকির পড়াশোনার বয়স হয়। দাদাবাড়ির এমন কোলাহলে সেই পরিবেশ মোটেও ছিল না। সাহিত্যসাধনায় বুঁদ বাবা গোলাম রসুল নাজকি ছেলেমেয়েদের গামরোর নানাবাড়ি পাঠিয়ে দেন। নানাবাড়ির পরিবেশ বেশ চমৎকার। পড়াশোনা, গবেষণা ও আভিজাত্যে বান্ডিপোরার অন্যতম সেরা পরিবার। কাশ্মীরের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ হাসান খুরামি ছিলেন ফারুক নাজকির চাচাতো নানা। সেই পরিবারের বিখ্যাত শিক্ষক আবদুল কাদিফ ফাজিলির কাছেই শুরু হয় তাঁর পড়াশোনার আনুষ্ঠানিক যাত্রা। মামাতো ভাই মনসুর আমহদ তাঁর সহপাঠী ও অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। কিছুদিন পর স্কুলেও যাওয়া শুরু করেন ফারুক। দু-এক বছরের ব্যবধানে দুটি স্কুল পাল্টাতে হয় তাঁকে। আট বছর বয়সে, ১৯৪৮ সালে তাঁর বান্ডিপোরা অধ্যায়ের ইতি ঘটে এবং পরিবারের সঙ্গে তিনি স্থায়ীভাবে শ্রীনগরের বাসিন্দা হয়ে যান। শৈশবের দুরন্ত দিনগুলোকে তিনি খুব মিস করেন। অনেক বছর পরে এসে লেখা তাঁর ‘শৈশব’ কবিতাটি পড়ুন—
‘হালকা-সরল কথার ফুলে
তৈরি হতো গানের মালা
ক্ষুদ্র-ছোট শব্দ-শলায়
চিন্তাদ্বীপে জ্বলত আগুন
প্রতিটি মুখ আমার ছিল
আমার ছিল দর্পণও সব
ছিল সকল ঘর আমাদের
উঠোনও সব আমার ছিল।
ঠোঁটের আগায় আসত কথা
বের হলেও, মন থেকে না
ঢালত কানে অমৃত-শরাব
বইত হাওয়া হৃদয় ছুঁয়ে
সময়টি বেশ প্রিয় ছিল
মধুর ছিল মুহূর্ত সব
সেই সময়ের আলোর সড়ক—
শুরু আছে, সমাপ্তি নেই।
সেই সময়ের আলোর সড়ক—
শুরু আছে, সমাপ্তি নেই
সময়টি কই হারিয়ে গেল
স্মৃতির ভুবন বর্ণনাতীত।’
(লফ্জ লফ্জ নোহা/ফারুক নাজকি)
দুই.
১৯৪৭ সাল। ভারত উপমহাদেশের রাজনীতির চেহারা পাল্টে যায়। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যায় ২০০ বছরের ব্রিটিশশাসিত নিখিল ভারত। জন্ম নেয় দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তান। ভারতজুড়ে শুরু হয় এক নিষ্ঠুর খেলা—সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। লাখে-লাখে মানুষ ভারত ছেড়ে পাকিস্তান যাচ্ছে; অথবা পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আসছে। পথে-পথে আগুনের লেলিহান শিখা। মুসলমানেরা হিন্দুদের মারছে, হিন্দুরা কাটছে মুসলমানদের। ফলে পাশের রাষ্ট্র কাশ্মীরেও আছড়ে পড়ে সেই দাঙ্গার প্রমত্ত ঢেউ। কাশ্মীরের অসংখ্য মুসলিম চলে যেতে বাধ্য হয় সদ্যোজাত মুসলিম দেশ পাকিস্তানে। তবে অধিকাংশ কাশ্মীরি মুসলমান একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্ন দেখত। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদের প্রাণপুরুষ এবং পরবর্তীতে রিয়াসত-এ-কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ। এরই মধ্যে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে কাশ্মীর আক্রমণ করে বসে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত এলাকার কয়েকটি উপজাতীয় বাহিনী। বলা হয়ে থাকে, কাশ্মীরকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে রাজা হরি সিংয়ের সঙ্গে পাকিস্তানের একটি চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির কারণে সরাসরি দখল করতে না পেরে পাকিস্তান কাশ্মীর-সংলগ্ন উপজাতিদের উসকে দেয় এবং বর্তমান আজাদ কাশ্মীর অংশটি দখল করে নেয়। ফলে হরি সিং অনেকটা নিরুপায় হয়ে ভারতের সাহায্য চান এবং নেহেরু-প্যাটেলরা সুকৌশলে অবশিষ্ট কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার কথা বলে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করে নেন। পরে, ১৯৬২ সালে ভারতশাসিত কাশ্মীরের আরেকটি অংশ দখল করে নেয় চীন। ফলে কাশ্মীর তিন দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির সবচেয়ে জটিল ভূখণ্ডে পরিণত হয়।
ভারতের সঙ্গে যুক্ত হলে হরি সিংকে রাজার মর্যাদায় রাখা হলেও কাশ্মীরি মুসলিম নেতা শেখ আবদুল্লাহকে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়। ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি তখন ‘রেডিও কাশ্মীর জম্মু’ স্টেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তাঁর সঙ্গে শেখ আবদুল্লাহর বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। সেই দিনগুলোতে রাজা হরি সিং ‘রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ফারুক নাজকির বাবাকেই তা পরিচালনার দায়িত্ব দেন। ফলে আট বছরের শিশু ফারুকসহ পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে তিনি স্থায়ীভাবে শ্রীনগরের রেইনাওয়ারিতে চলে যান। সেখানে এক্সচেঞ্জ রোডে তাদের জন্য একটি বিশাল পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। বাড়িটি কাশ্মীরের সাবেক শিক্ষা পরিচালক খালিফ আবদুল হাকিমের সরকারি বাসভবন ছিল—দেশভাগের পর তিনি পাকিস্তানে চলে যান।
১৩ জুলাই, ১৯৪৮। শ্রীনগরের পলোগ্রাউন্ডে ‘রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। সংবাদপাঠ করে উদ্বোধন করবেন ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি। ফারুক নাজকি ভাইবোনদের নিয়ে রেইনাওয়ারির বাড়িটিতে রেডিওর সামনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। কিছুক্ষণ পর কাশ্মীরি ভাষায় তরঙ্গায়িত হলো কাশ্মীরি ভাষার প্রথম রেডিওধ্বনি—‘আদাব, রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর থেকে বলছি…’। ফারুক নাজকিসহ লাখো কাশ্মিরির মনে সেদিন বয়ে যায় আনন্দের ফল্গুধারা। বাবার কণ্ঠ বালক ফারুককে দারুণভাবে আপ্লুত করে। সেদিনের অনুপ্রেরণাই হয়তো পরবর্তীতে কাশ্মীরের কিংবদন্তি মিডিয়া ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে ফারুক নাজকিকে।
দুই বছর পর, ১৯৫০ সালে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে ফারুক নাজকির জীবনে। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রাসাদ কাশ্মীরের সৌন্দর্যসুধা পান করতে আসেন। তাঁর সম্মানে শ্রীনগরের ঝিলম নদীতে আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য নৌবিহারের। শতরঙা আলপনায় আবৃত সারি সারি বজরা নৌকার মিছিল। নদীর দু-কুলে সাজ-সাজ রব। রেডিওতে এই আয়োজনের ধারাভাষ্য দিচ্ছেন ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি। ঝিলমের এমন নয়নকাড়া রূপ অনেক কাশ্মিরিদের মতো ফারুকও এর আগে দেখেননি। বহতা ঝিলমের রূপরহস্য যেন প্রথমবারের মতো দৃশ্যমান হয় তাঁর সামনে। সেদিন তাঁর শিশুমনে হয়তো বেজেছিল আনন্দের গান—যেমন বেজেছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে। সন্ধ্যার আলো-আঁধারে ঝিলমের তীরে বসে ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—
‘সন্ধ্যারাগে-ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা
আঁধারে মলিন হলো, যেন খাপে ঢাকা
বাঁকা তলোয়ার;
দিনের ভাটার শেষে রাত্রির জোয়ার;
অন্ধকার গিরিতটতলে
দেওদার-তরু সারে সারে;
মনে হলো, সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে,
বলিতে না পারে স্পষ্ট করি—
অব্যক্ত ধ্বনিপুঞ্জ অন্ধকারে উঠিছে গুমরি।’
(বলাকা/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
তিন.
ফারুক নাজকি যখন বান্ডিপোরার প্রাইমারি স্কুলে পড়তেন, তখনই তিনি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন, নিজের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভার সন্ধান পান। চতুর্থ শ্রেণিতে থাকাকালে স্কুলে এক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। মহারাজা হরি সিং বান্ডিপোরা আসবেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁর সম্মানে স্কুলেরই এক শিক্ষার্থীকে পাঠ করতে হবে মানপত্র। সবাইকে পেছনে ফেলে ফারুক নাজকিই নির্বাচিত হন। তবে শেষ মুহূর্তে মহারাজা এলেন না। পাঠালেন প্রধানমন্ত্রী মেহর চাঁদ মহাজনকে। অনুষ্ঠানে ফারুকের বাবা গোলাম রসুল নাজকি এবং আল্লামা ইকবালের ছেলে জাবেদ ইকবালও অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। শিশু ফারুকের মানপত্র পাঠের আভিজাত্য দেখে জাবেদ ইকবাল পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন—‘আখের ব্যাটা কিসকা হ্যায়’। আল্লামা ইকবাল সম্পর্কে ফারুক আগে থেকেই জানতেন। ফলে ইকবালের ছেলে জাবেদ ইকবালের কাছ থেকে এমন মন্তব্য তাঁকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল এবং বুকের পেলব জমিতে আত্মবিশ্বাসের বীজ বপন করে দিয়েছিল।
ফারুক নাজকির বাবা বড় অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। কখনো সন্তানদের সরাসরি কোনো কিছু পড়তে বা লিখতে বলতেন না। দূর থেকে টুকটাক নির্দেশনা দিতেন। কেউ পরামর্শ চাইলে ‘সিদকে জাদিদ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত বিখ্যাত তাফসিরগ্রন্থ ‘তাফসিরে মাজেদি’র পর্বগুলো পড়ার পরামর্শ দিতেন। কখনো কোনো সমস্যা হলে সেটির সমাধান বের করার প্রতি জোর দিতেন। ফলে ফারুকের মন নিজের মতো করেই বিকশিত হতে থাকে। ফারুক বিচরণ করতে শুরু করেন সাহিত্যের ডালপালায়। কবিতা, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ নানা বিষয়ে।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই দিল্লির জামিয়া মিলিয়া থেকে প্রকাশিত ড. জাকির হুসাইন সম্পাদিত ‘মেরা পারসা’ ম্যাগাজিনে ফারুকের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে তিনি তৎকালীন কাশ্মীরের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র শ্রী প্রতাপ কলেজে ভর্তি হন। কলেজজীবনে ডেইলি খেদমাত, দেহলি আশিয়ানা, মাস্তানা যোগি ও সাপ্তাহিক চিত্রাসহ বেশ কিছু পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। তখনই সচেতনভাবে রচনার প্রতিপাদ্য হিসেবে তিনি বেছে নেন ‘কাশ্মীর ও কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদ’।
ফারুকের কবিতা লেখার হাতেখড়ি হয় প্রখ্যাত উর্দু কবি জিগর মুরাদাবাদীর হাত ধরে। সেই গল্প শুনুন কবি ফারুক নাজকির মুখ থেকেই। তিনি বলেন, একদিন মুরাদাবাদী আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। একটি ডায়েরিতে দুই লাইনের কবিতা লিখে আমাকে বললেন, ‘ফারুক, তুমি যদি এই কবিতার অন্ত্যমিলের সঙ্গে মিল রেখে আরেকটি পঙ্ক্তি বলতে পারো, তবে আমি এই ডায়েরি তোমাকে অটোগ্রাফ হিসেবে দিয়ে দেব।’ কবিতার শেষে ‘দিওয়ানা’ শব্দ ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই আমি ‘পরোয়ানা’ অন্ত্যমিল দিয়ে একটি পঙ্ক্তি বলে দিই এবং মুরাদাবাদী বেশ খুশি হন। এর পর থেকে আমি কবিতা লেখায় আগ্রহী হই এবং প্রথম যে লাইনগুলো লিখি তা এ রকম—
‘রাজনীতিকেরা রাজনীতিই বোঝে
ভালোবাসায় রাজনীতি চলে না
তোমাকে দেখে সকলেই ‘বলছে—
এ ছবি নয় খোদা, জাদু, জাদু!’
নাজকিদের শ্রীনগরের বাড়িটি ছিল কলেজের হোস্টেলের মতো। সহোদর সাত ভাই ছাড়াও সেখানে থেকে পড়াশোনা করত চাচাতো-মামাতো ভাইয়েরাও। ফলে একই ছাদের নিচে রাতদিন আলোচনা চলত জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে। চিকিৎসাবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, নৃবিজ্ঞান, সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, কৃষি, ভেটেরিনারি সায়েন্স, আইন—কী ছিল না তাদের পড়ার বিষয়সূচিতে। জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার মেলা বসত সেখানে। ফলে সেই বাড়ির সকলেই আজ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলছেন। আবার অনেকে জীবনের ইতিও টেনেছেন। নাজকি পরিবার থেকেই এসেছেন তিনজন বিখ্যাত কবি। ফারুক নাজকি, ইকবাল নাজকি ও আয়াজ রসুল নাজকি।
ফারুক নাজকি খুব অল্প বয়সে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উর্দু সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেন। তরুণ চঞ্চল দুরন্ত নাজকির স্বপ্ন ছিল অভিনেতা কিংবা শিক্ষক হওয়ার। কিন্তু এক জীবনে তাঁর এই দুটি স্বপ্ন কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। বরং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তিনি নিজের ক্যারিয়ার গড়েন এবং কবি হিসেবে সর্বমহলে বরণীয় হয়ে ওঠেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে শুরু করেন সাংবাদিকতা। কাশ্মীরের প্রথিতযশা দুই সাংবাদিক কাজি সানাউল্লাহ বাট ও মুহাম্মদ শফির কাছে হাতে-কলমে শেখেন সাংবাদিকতার পাঠ।
এর পর ১৯৬০ সালে, মাত্র ২০ বছর বয়সে নিজেই একটি পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নেন এবং কাশ্মিরজুড়ে মোটামুটি হইচই ফেলে দেন। ‘ডেইলি মজদুর’ নামের সেই পত্রিকার মূল প্রতিপাদ্য ছিল কাশ্মীর উপত্যকার শ্রমিক-মজুর-মেহনতি মানুষের জীবন অগ্রাধিকার দিয়ে তুলে ধরা। জম্মু-কাশ্মীরে এমন পত্রিকার ধারণা ছিল সম্পূর্ণ নতুন। ফলে গণমানুষের মাঝে তা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তবে এক বছরের মাথায় সরকারের রোষানলে পড়ে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি।
আরও পড়ুন:

এক.
১৯৪০ সাল। কাশ্মীর তখনো তিন টুকরো হয়নি। ভারতবর্ষে বৃটিশরাজ টালমাটাল; পতনোন্মুখ। ব্রিটিশদের আশীর্বাদপুষ্ট মহারাজা হরি সিং অখণ্ড কাশ্মীরের একচ্ছত্র অধিপতি। জম্মু থেকে লাদাখ, কারাকোরাম থেকে গিলগিত-বালতিস্তান কিংবা শ্রীনগর থেকে মুজাফফরাবাদ—সর্বত্রই মহারাজার শাসন। ব্রিটিশরা ১৮৪৬ সালে শিখ রাজাদের পরাজিত করে কাশ্মীর দখল করলেও কখনো সরাসরি কাশ্মীর শাসন করেনি। আনুগত্যের শর্তে হরি সিংয়ের চতুর্থ পুরুষ ডোগরা রাজা গুলাব সিংয়ের কাছে লর্ড হার্ডিঞ্জ মাত্র সাড়ে ৭ লাখ রুপি দিয়ে ভূস্বর্গ কাশ্মীর বেচে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই কাশ্মীরে ডোগরা রাজার শাসন। ৫০০ বছরের মুসলিম-শাসনের সোনালি ইতিহাস থাকলেও এবং কাশ্মীরের দুই তৃতীয়াংশ জনগণ মুসলমান হলেও তত দিনে মুসলমানরা ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। কাশ্মীরি মুসলিম নেতা শেখ আবদুল্লাহ নিপীড়িত মুসলমানদের শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।
সেই দিনগুলোতে, সুলতান জাইনুল আবেদিনের প্রধান বিচারপতি মির সৈয়দ আলি বুখারির এক উত্তরপুরুষ—মির গোলাম রসুল নাজকি কাশ্মীরের বান্ডিপোরায় বাস করতেন। কাশ্মীরের সুফি কবিতার পুনর্জন্মে তাঁকে পথিকৃতের মর্যাদা দেওয়া হয়। সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি গোলাম রসুল নাজকি বিয়ে করেছিলেন কাশ্মীরের বিখ্যাত ফাজিলি পরিবারের এক শিক্ষিত-বিদূষী নারীকে। সে বছর, ১৯৪০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, তাঁদের কোল আলো করে জন্ম নেন এক শিশু—সাইয়েদ মুহাম্মদ ফারুক নাজকি—আজকের কাশ্মীরের সেরা কবি ফারুক নাজকি।
বারামুল্লা জেলার অন্তর্গত এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ স্বাদু পানির হ্রদ উলার লেকের উত্তর তীরের এক সবুজ জনপদ বান্ডিপোরা তখনো জেলা হয়নি। সেখানে এক মায়াবী পাহাড় ছিল—নিবু পাহাড়, যার পাদদেশের সারি সারি চিনার-দেবদারুর মাঝে গড়ে উঠেছে ছোট্ট গ্রাম—মাদরাবন; ফারুক নাজকির আশৈশব স্মৃতির জনপদ। মাদরাবনের এক তিনতলা বাড়িতে থাকত ফারুক নাজকির পরিবার। একই ছাদের নিচে যৌথভাবে বসবাস করতেন তাঁর তিন চাচাও—গোলাম মুহাম্মদ, বাহাউদ্দিন ও গোলাম জিলানি। পিঠাপিঠি বড় ভাই রিয়াজুল ইসলামের সঙ্গে খেলেদুলে বড় হতে থাকেন ছোট্ট ফারুক নাজকি। ঘর থেকে বেরোলেই সবুজ ঘাসেভরা উঠোন, উঠোন পেরোলেই নানারঙা ফুলেল মাঠ, মাঠ পেরোলেই কুলকুল বয়ে চলা শীতল নদী, নদী পেরোলেই হলদে পাতাঝরার বন এবং দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়। টিউলিপ, সূর্যমুখী, গোলাপ ও জাফরানের ঘ্রাণ এবং আপেল, আঙুর, চেরি ও নাশপাতির স্বাদ নিতে নিতেই বেড়ে ওঠেন নাজকি। বড়দের সঙ্গে নদী তীরে যান, স্বচ্ছ শীতল জলধারার ছোঁয়ায় মাতেন। দূরে নদীর ওপারে পাহাড় থেকে নেমে আসে শিংঅলা লাল হরিণের দল। ক্লান্ত-তৃষ্ণার্ত সুবোধ হরিণেরা মুখ ডুবিয়ে জল পান করে। শিশু নাজকি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। হরিণের মোলায়েম গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় তার। কখনো-সখনো দূরের পাহাড়েও যাওয়া হতো নাজকির—বড়দের আঙুল চেপে ধরে। পাহাড়ের ওপর থেকে উপত্যকার যে দৃশ্য দেখা যেত, তা এখনো ভুলতে পারেন না তিনি। সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়াত গাছের শুকনো ডালের মতো বাঁকা শিংঅলা বিপুলদেহ লাল হরিণের দল। এ ধরনের হরিণকে স্থানীয় ভাষায় ‘হানগুল’ বলে, যা বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়—বিপন্ন প্রজাতির তালিকাভুক্ত।
ফারুক নাজকিদের সেই তিনতলা বাড়িটি সারা দিন মেহমানদের আগমনে গমগম করত। এখানে-ওখানে থরে থরে সাজানো বইপুস্তক, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পত্রিকা-ম্যাগাজিন এবং দেয়ালে-দেয়ালে ঝোলানো দেয়ালচিত্র—মাঝখানের বিশাল হলরুমে বসে গভীর রাত পর্যন্ত চলত কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা। বাবা গোলাম রসুল নাজকি কাশ্মীরের উর্দু সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। তাঁর কাছে নিয়মিত আশীর্বাদ নিতে আসতেন উর্দু ও কাশ্মীরি সাহিত্যের সেরা ব্যক্তিত্বরা। খলিলুর রহমান আজমি, জিএম মির তাউস, জিএইচ আলি বুলবুল, নাজমুদ্দিন ইশরাত, জাবেদ কাশ্মীরি, নিয়াজ কামরাজি, কমরুদ্দিন কমর, তানহা আনসারি, সাওলুরুক শাবানসহ অসংখ্য সাহিত্যসেবী। উর্দু সাহিত্যের কিংবদন্তি পুরুষ জিগর মুরাদাবাদী ও ফিরাক গুরকপুরীও মাঝেমধ্যে আসতেন। এত এত চমৎকার মানুষের রাতজাগা আড্ডা দেখে এবং তাঁদের কোলে-পিঠে চড়ে কবিতার রূপ-রস অজান্তেই প্রবেশ করতে থাকে ফারুক নাজকির রক্তে-মাংসে।
একসময় নাজকির পড়াশোনার বয়স হয়। দাদাবাড়ির এমন কোলাহলে সেই পরিবেশ মোটেও ছিল না। সাহিত্যসাধনায় বুঁদ বাবা গোলাম রসুল নাজকি ছেলেমেয়েদের গামরোর নানাবাড়ি পাঠিয়ে দেন। নানাবাড়ির পরিবেশ বেশ চমৎকার। পড়াশোনা, গবেষণা ও আভিজাত্যে বান্ডিপোরার অন্যতম সেরা পরিবার। কাশ্মীরের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ হাসান খুরামি ছিলেন ফারুক নাজকির চাচাতো নানা। সেই পরিবারের বিখ্যাত শিক্ষক আবদুল কাদিফ ফাজিলির কাছেই শুরু হয় তাঁর পড়াশোনার আনুষ্ঠানিক যাত্রা। মামাতো ভাই মনসুর আমহদ তাঁর সহপাঠী ও অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। কিছুদিন পর স্কুলেও যাওয়া শুরু করেন ফারুক। দু-এক বছরের ব্যবধানে দুটি স্কুল পাল্টাতে হয় তাঁকে। আট বছর বয়সে, ১৯৪৮ সালে তাঁর বান্ডিপোরা অধ্যায়ের ইতি ঘটে এবং পরিবারের সঙ্গে তিনি স্থায়ীভাবে শ্রীনগরের বাসিন্দা হয়ে যান। শৈশবের দুরন্ত দিনগুলোকে তিনি খুব মিস করেন। অনেক বছর পরে এসে লেখা তাঁর ‘শৈশব’ কবিতাটি পড়ুন—
‘হালকা-সরল কথার ফুলে
তৈরি হতো গানের মালা
ক্ষুদ্র-ছোট শব্দ-শলায়
চিন্তাদ্বীপে জ্বলত আগুন
প্রতিটি মুখ আমার ছিল
আমার ছিল দর্পণও সব
ছিল সকল ঘর আমাদের
উঠোনও সব আমার ছিল।
ঠোঁটের আগায় আসত কথা
বের হলেও, মন থেকে না
ঢালত কানে অমৃত-শরাব
বইত হাওয়া হৃদয় ছুঁয়ে
সময়টি বেশ প্রিয় ছিল
মধুর ছিল মুহূর্ত সব
সেই সময়ের আলোর সড়ক—
শুরু আছে, সমাপ্তি নেই।
সেই সময়ের আলোর সড়ক—
শুরু আছে, সমাপ্তি নেই
সময়টি কই হারিয়ে গেল
স্মৃতির ভুবন বর্ণনাতীত।’
(লফ্জ লফ্জ নোহা/ফারুক নাজকি)
দুই.
১৯৪৭ সাল। ভারত উপমহাদেশের রাজনীতির চেহারা পাল্টে যায়। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যায় ২০০ বছরের ব্রিটিশশাসিত নিখিল ভারত। জন্ম নেয় দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তান। ভারতজুড়ে শুরু হয় এক নিষ্ঠুর খেলা—সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। লাখে-লাখে মানুষ ভারত ছেড়ে পাকিস্তান যাচ্ছে; অথবা পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আসছে। পথে-পথে আগুনের লেলিহান শিখা। মুসলমানেরা হিন্দুদের মারছে, হিন্দুরা কাটছে মুসলমানদের। ফলে পাশের রাষ্ট্র কাশ্মীরেও আছড়ে পড়ে সেই দাঙ্গার প্রমত্ত ঢেউ। কাশ্মীরের অসংখ্য মুসলিম চলে যেতে বাধ্য হয় সদ্যোজাত মুসলিম দেশ পাকিস্তানে। তবে অধিকাংশ কাশ্মীরি মুসলমান একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্ন দেখত। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদের প্রাণপুরুষ এবং পরবর্তীতে রিয়াসত-এ-কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ। এরই মধ্যে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে কাশ্মীর আক্রমণ করে বসে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত এলাকার কয়েকটি উপজাতীয় বাহিনী। বলা হয়ে থাকে, কাশ্মীরকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে রাজা হরি সিংয়ের সঙ্গে পাকিস্তানের একটি চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির কারণে সরাসরি দখল করতে না পেরে পাকিস্তান কাশ্মীর-সংলগ্ন উপজাতিদের উসকে দেয় এবং বর্তমান আজাদ কাশ্মীর অংশটি দখল করে নেয়। ফলে হরি সিং অনেকটা নিরুপায় হয়ে ভারতের সাহায্য চান এবং নেহেরু-প্যাটেলরা সুকৌশলে অবশিষ্ট কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার কথা বলে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করে নেন। পরে, ১৯৬২ সালে ভারতশাসিত কাশ্মীরের আরেকটি অংশ দখল করে নেয় চীন। ফলে কাশ্মীর তিন দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির সবচেয়ে জটিল ভূখণ্ডে পরিণত হয়।
ভারতের সঙ্গে যুক্ত হলে হরি সিংকে রাজার মর্যাদায় রাখা হলেও কাশ্মীরি মুসলিম নেতা শেখ আবদুল্লাহকে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়। ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি তখন ‘রেডিও কাশ্মীর জম্মু’ স্টেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তাঁর সঙ্গে শেখ আবদুল্লাহর বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। সেই দিনগুলোতে রাজা হরি সিং ‘রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ফারুক নাজকির বাবাকেই তা পরিচালনার দায়িত্ব দেন। ফলে আট বছরের শিশু ফারুকসহ পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে তিনি স্থায়ীভাবে শ্রীনগরের রেইনাওয়ারিতে চলে যান। সেখানে এক্সচেঞ্জ রোডে তাদের জন্য একটি বিশাল পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। বাড়িটি কাশ্মীরের সাবেক শিক্ষা পরিচালক খালিফ আবদুল হাকিমের সরকারি বাসভবন ছিল—দেশভাগের পর তিনি পাকিস্তানে চলে যান।
১৩ জুলাই, ১৯৪৮। শ্রীনগরের পলোগ্রাউন্ডে ‘রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। সংবাদপাঠ করে উদ্বোধন করবেন ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি। ফারুক নাজকি ভাইবোনদের নিয়ে রেইনাওয়ারির বাড়িটিতে রেডিওর সামনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। কিছুক্ষণ পর কাশ্মীরি ভাষায় তরঙ্গায়িত হলো কাশ্মীরি ভাষার প্রথম রেডিওধ্বনি—‘আদাব, রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর থেকে বলছি…’। ফারুক নাজকিসহ লাখো কাশ্মিরির মনে সেদিন বয়ে যায় আনন্দের ফল্গুধারা। বাবার কণ্ঠ বালক ফারুককে দারুণভাবে আপ্লুত করে। সেদিনের অনুপ্রেরণাই হয়তো পরবর্তীতে কাশ্মীরের কিংবদন্তি মিডিয়া ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে ফারুক নাজকিকে।
দুই বছর পর, ১৯৫০ সালে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে ফারুক নাজকির জীবনে। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রাসাদ কাশ্মীরের সৌন্দর্যসুধা পান করতে আসেন। তাঁর সম্মানে শ্রীনগরের ঝিলম নদীতে আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য নৌবিহারের। শতরঙা আলপনায় আবৃত সারি সারি বজরা নৌকার মিছিল। নদীর দু-কুলে সাজ-সাজ রব। রেডিওতে এই আয়োজনের ধারাভাষ্য দিচ্ছেন ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি। ঝিলমের এমন নয়নকাড়া রূপ অনেক কাশ্মিরিদের মতো ফারুকও এর আগে দেখেননি। বহতা ঝিলমের রূপরহস্য যেন প্রথমবারের মতো দৃশ্যমান হয় তাঁর সামনে। সেদিন তাঁর শিশুমনে হয়তো বেজেছিল আনন্দের গান—যেমন বেজেছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে। সন্ধ্যার আলো-আঁধারে ঝিলমের তীরে বসে ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—
‘সন্ধ্যারাগে-ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা
আঁধারে মলিন হলো, যেন খাপে ঢাকা
বাঁকা তলোয়ার;
দিনের ভাটার শেষে রাত্রির জোয়ার;
অন্ধকার গিরিতটতলে
দেওদার-তরু সারে সারে;
মনে হলো, সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে,
বলিতে না পারে স্পষ্ট করি—
অব্যক্ত ধ্বনিপুঞ্জ অন্ধকারে উঠিছে গুমরি।’
(বলাকা/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
তিন.
ফারুক নাজকি যখন বান্ডিপোরার প্রাইমারি স্কুলে পড়তেন, তখনই তিনি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন, নিজের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভার সন্ধান পান। চতুর্থ শ্রেণিতে থাকাকালে স্কুলে এক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। মহারাজা হরি সিং বান্ডিপোরা আসবেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁর সম্মানে স্কুলেরই এক শিক্ষার্থীকে পাঠ করতে হবে মানপত্র। সবাইকে পেছনে ফেলে ফারুক নাজকিই নির্বাচিত হন। তবে শেষ মুহূর্তে মহারাজা এলেন না। পাঠালেন প্রধানমন্ত্রী মেহর চাঁদ মহাজনকে। অনুষ্ঠানে ফারুকের বাবা গোলাম রসুল নাজকি এবং আল্লামা ইকবালের ছেলে জাবেদ ইকবালও অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। শিশু ফারুকের মানপত্র পাঠের আভিজাত্য দেখে জাবেদ ইকবাল পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন—‘আখের ব্যাটা কিসকা হ্যায়’। আল্লামা ইকবাল সম্পর্কে ফারুক আগে থেকেই জানতেন। ফলে ইকবালের ছেলে জাবেদ ইকবালের কাছ থেকে এমন মন্তব্য তাঁকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল এবং বুকের পেলব জমিতে আত্মবিশ্বাসের বীজ বপন করে দিয়েছিল।
ফারুক নাজকির বাবা বড় অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। কখনো সন্তানদের সরাসরি কোনো কিছু পড়তে বা লিখতে বলতেন না। দূর থেকে টুকটাক নির্দেশনা দিতেন। কেউ পরামর্শ চাইলে ‘সিদকে জাদিদ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত বিখ্যাত তাফসিরগ্রন্থ ‘তাফসিরে মাজেদি’র পর্বগুলো পড়ার পরামর্শ দিতেন। কখনো কোনো সমস্যা হলে সেটির সমাধান বের করার প্রতি জোর দিতেন। ফলে ফারুকের মন নিজের মতো করেই বিকশিত হতে থাকে। ফারুক বিচরণ করতে শুরু করেন সাহিত্যের ডালপালায়। কবিতা, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ নানা বিষয়ে।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই দিল্লির জামিয়া মিলিয়া থেকে প্রকাশিত ড. জাকির হুসাইন সম্পাদিত ‘মেরা পারসা’ ম্যাগাজিনে ফারুকের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে তিনি তৎকালীন কাশ্মীরের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র শ্রী প্রতাপ কলেজে ভর্তি হন। কলেজজীবনে ডেইলি খেদমাত, দেহলি আশিয়ানা, মাস্তানা যোগি ও সাপ্তাহিক চিত্রাসহ বেশ কিছু পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। তখনই সচেতনভাবে রচনার প্রতিপাদ্য হিসেবে তিনি বেছে নেন ‘কাশ্মীর ও কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদ’।
ফারুকের কবিতা লেখার হাতেখড়ি হয় প্রখ্যাত উর্দু কবি জিগর মুরাদাবাদীর হাত ধরে। সেই গল্প শুনুন কবি ফারুক নাজকির মুখ থেকেই। তিনি বলেন, একদিন মুরাদাবাদী আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। একটি ডায়েরিতে দুই লাইনের কবিতা লিখে আমাকে বললেন, ‘ফারুক, তুমি যদি এই কবিতার অন্ত্যমিলের সঙ্গে মিল রেখে আরেকটি পঙ্ক্তি বলতে পারো, তবে আমি এই ডায়েরি তোমাকে অটোগ্রাফ হিসেবে দিয়ে দেব।’ কবিতার শেষে ‘দিওয়ানা’ শব্দ ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই আমি ‘পরোয়ানা’ অন্ত্যমিল দিয়ে একটি পঙ্ক্তি বলে দিই এবং মুরাদাবাদী বেশ খুশি হন। এর পর থেকে আমি কবিতা লেখায় আগ্রহী হই এবং প্রথম যে লাইনগুলো লিখি তা এ রকম—
‘রাজনীতিকেরা রাজনীতিই বোঝে
ভালোবাসায় রাজনীতি চলে না
তোমাকে দেখে সকলেই ‘বলছে—
এ ছবি নয় খোদা, জাদু, জাদু!’
নাজকিদের শ্রীনগরের বাড়িটি ছিল কলেজের হোস্টেলের মতো। সহোদর সাত ভাই ছাড়াও সেখানে থেকে পড়াশোনা করত চাচাতো-মামাতো ভাইয়েরাও। ফলে একই ছাদের নিচে রাতদিন আলোচনা চলত জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে। চিকিৎসাবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, নৃবিজ্ঞান, সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, কৃষি, ভেটেরিনারি সায়েন্স, আইন—কী ছিল না তাদের পড়ার বিষয়সূচিতে। জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার মেলা বসত সেখানে। ফলে সেই বাড়ির সকলেই আজ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলছেন। আবার অনেকে জীবনের ইতিও টেনেছেন। নাজকি পরিবার থেকেই এসেছেন তিনজন বিখ্যাত কবি। ফারুক নাজকি, ইকবাল নাজকি ও আয়াজ রসুল নাজকি।
ফারুক নাজকি খুব অল্প বয়সে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উর্দু সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেন। তরুণ চঞ্চল দুরন্ত নাজকির স্বপ্ন ছিল অভিনেতা কিংবা শিক্ষক হওয়ার। কিন্তু এক জীবনে তাঁর এই দুটি স্বপ্ন কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। বরং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তিনি নিজের ক্যারিয়ার গড়েন এবং কবি হিসেবে সর্বমহলে বরণীয় হয়ে ওঠেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে শুরু করেন সাংবাদিকতা। কাশ্মীরের প্রথিতযশা দুই সাংবাদিক কাজি সানাউল্লাহ বাট ও মুহাম্মদ শফির কাছে হাতে-কলমে শেখেন সাংবাদিকতার পাঠ।
এর পর ১৯৬০ সালে, মাত্র ২০ বছর বয়সে নিজেই একটি পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নেন এবং কাশ্মিরজুড়ে মোটামুটি হইচই ফেলে দেন। ‘ডেইলি মজদুর’ নামের সেই পত্রিকার মূল প্রতিপাদ্য ছিল কাশ্মীর উপত্যকার শ্রমিক-মজুর-মেহনতি মানুষের জীবন অগ্রাধিকার দিয়ে তুলে ধরা। জম্মু-কাশ্মীরে এমন পত্রিকার ধারণা ছিল সম্পূর্ণ নতুন। ফলে গণমানুষের মাঝে তা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তবে এক বছরের মাথায় সরকারের রোষানলে পড়ে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি।
আরও পড়ুন:

১৯৪৩ সালে তৈরি একটি হাতঘড়ি বিশ্বের সবচেয়ে দামি ঘড়ি হিসেবে রেকর্ড গড়ল। এর আগে ২০১৬ সালে নিলামে বিক্রি হওয়া সবচেয়ে দামি ঘড়ি হিসেবে রেকর্ড গড়ে এই ঘড়িটি। এবার আরও বেশি দামে ঘড়িটি বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছে নিলাম প্রতিষ্ঠান ফিলিপস।
১৩ ঘণ্টা আগে
এত অর্থ-সম্পদ দিয়ে ইলন মাস্ক কী করেন, এ নিয়ে অনেক জল্পনা চলে বছরজুড়েই। তিনি নতুন করে আরও একটি ঘোষণা দেন এবং আবারও উঠে আসে এই আলোচনা। তবুও মাস্কের দাবি, তাঁর জীবনযাপন বেশ সাধারণ এবং অনাড়ম্বর। ২০২১ সালে একবার মাস্ক জানান, টেক্সাসে যে ছোট্ট বাড়িটিতে তিনি থাকেন, সেটির মূল্য মাত্র ৫০ হাজার ডলার।
২ দিন আগে
‘হাজী মাখন বিরানী’ বা ‘হাজী মাখন পোলাও’—যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তাদের দোকান ওই দুইটাই; পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজারের নাসিরুদ্দিন লেনে। না, মাখন দিয়ে তাদের পোলাও বা বিরিয়ানি রান্না করা হয় না।
৩ দিন আগে
কমলকুমার মজুমদারের বই উচ্চারণ করে পড়লে, দাঁড়ি-কমা মেলে পড়া গেলে, বোঝা যায় যে, কী আশ্চর্য সুন্দর লেখা! কী বলব, আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তাঁর লেখা পড়ে। হাসান আজিজুল হকের লেখাও ভালোই লাগে, তাঁর লেখাতে একটা ত্রুটি আছে।
৪ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

১৯৪৩ সালে তৈরি একটি হাতঘড়ি বিশ্বের সবচেয়ে দামি ঘড়ি হিসেবে রেকর্ড গড়ল। এর আগে ২০১৬ সালে নিলামে বিক্রি হওয়া সবচেয়ে দামি ঘড়ি হিসেবে রেকর্ড গড়ে এই ঘড়িটি। এবার আরও বেশি দামে ঘড়িটি বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছে নিলাম প্রতিষ্ঠান ফিলিপস।
ঘড়িটির দাম উঠেছে ১ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার সুইস ফ্রাঁ, যা প্রায় ১ কোটি ৭৬ লাখ মার্কিন ডলারের সমান। ২০১৬ সালে একই ঘড়ি বিক্রি হয়েছিল ১ কোটি ১০ লাখ সুইস ফ্রাঁ দামে, অর্থাৎ প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ ডলারে।
ঘড়িটি হলো পাটেক ফিলিপ পারপেচুয়াল ক্যালেন্ডার ক্রোনোগ্রাফ রেফারেন্স ১৫১৮ মডেল। স্টেইনলেস স্টিলে তৈরি মাত্র চারটি ঘড়ির একটি এটি। স্বর্ণের ঘড়ির তুলনায় এমন স্টিলের ঘড়ি বিরল হওয়ায় এটি সংগ্রাহকদের কাছে আরও মূল্যবান।
২০১৬ সালে রিস্টওয়াচ হিসেবে ঘড়িটি বিশ্বে সর্বোচ্চ দামে বিক্রির রেকর্ড গড়েছিল। তবে ২০১৭ সালে হলিউড তারকা পল নিউম্যানের মালিকানাধীন রোলেক্স ডেটোনা ঘড়ি ১ কোটি ৭৮ লাখ ডলারে বিক্রি হয়ে সেই রেকর্ড ভেঙে দেয়।
২০১৯ সালে সেই রেকর্ড ভেঙে দেয় আরেকটি পাটেক ফিলিপ গ্র্যান্ডমাস্টার চাইম ঘড়ি, যা বিক্রি হয়েছিল ৩১ মিলিয়ন ডলারে।
নিলাম প্রতিষ্ঠান ফিলিপস বলেছে, স্টেইনলেস স্টিলের ১৫১৮ মডেল আবারও প্রমাণ করল, এটি ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতঘড়িগুলোর একটি।
প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ঘড়িটি বিক্রি হতে সময় লেগেছে মাত্র ৯ মিনিটের একটু বেশি। এতে পাঁচজন ক্রেতা দরপত্রে অংশ নেন। শেষ পর্যন্ত টেলিফোনে যুক্ত এক ক্রেতার কাছে ঘড়িটি বিক্রি হয়।
জেনেভার হোটেল প্রেসিডেন্টে অনুষ্ঠিত নিলাম অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা সংগ্রাহক, ব্যবসায়ী ও ঘড়িনির্মাতা।
ফিলিপস জানায়, ১৫১৮ এমন একটি ঘড়ি, যা সংগ্রহ করতে পারলে একজন সংগ্রাহক মনে করতে পারেন, তিনি ঘড়ি সংগ্রহের জগতে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গেছেন।
১৯৪১ সালে বাজারে আসা এই মডেল ছিল বিশ্বের প্রথম ধারাবাহিকভাবে উৎপাদিত পারপেচুয়াল ক্যালেন্ডার ক্রোনোগ্রাফ।
পাটেক ফিলিপ প্রায় ২৮০টি ১৫১৮ মডেলের ঘড়ি উৎপাদন করেছিল। এর মধ্যে বেশিরভাগ হলুদ স্বর্ণে এবং প্রায় এক পঞ্চম অংশ গোল্ডের রঙের (রোজ গোল্ড)।
স্টেইনলেস স্টিলে বানানো মাত্র চারটি ঘড়ির কথা জানা যায়। সম্প্রতি বিক্রি হওয়া ঘড়িটি সেই চারটির মধ্যে প্রথম উৎপাদিত। কেন পাটেক ফিলিপ এই ঘড়িগুলো তৈরি করেছিল, তা আজও রহস্য।
নিলাম প্রতিষ্ঠান ফিলিপস এটিকে আখ্যায়িত করেছে, ‘এটি প্রায় পৌরাণিক মর্যাদার একটি সময়যন্ত্র। এটি ইতিহাসের গুরুত্ব, নকশার শ্রেষ্ঠত্ব, যান্ত্রিক উদ্ভাবন এবং বিরলতার চূড়ান্ত সমন্বয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে।’
দুই দিনের নিলামে মোট ২০৭টি লট বিক্রি হয়, যা ৬৬.৮ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ অতিক্রম করে। ফিলিপস জানায়, এটি কোনো ঘড়ি নিলামের জন্য সর্বোচ্চ মোট বিক্রির রেকর্ড।
৭২টি দেশে নিবন্ধিত ১ হাজার ৮৮৬ জন ক্রেতা নিলামে অংশ নিয়েছিলেন।

১৯৪৩ সালে তৈরি একটি হাতঘড়ি বিশ্বের সবচেয়ে দামি ঘড়ি হিসেবে রেকর্ড গড়ল। এর আগে ২০১৬ সালে নিলামে বিক্রি হওয়া সবচেয়ে দামি ঘড়ি হিসেবে রেকর্ড গড়ে এই ঘড়িটি। এবার আরও বেশি দামে ঘড়িটি বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছে নিলাম প্রতিষ্ঠান ফিলিপস।
ঘড়িটির দাম উঠেছে ১ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার সুইস ফ্রাঁ, যা প্রায় ১ কোটি ৭৬ লাখ মার্কিন ডলারের সমান। ২০১৬ সালে একই ঘড়ি বিক্রি হয়েছিল ১ কোটি ১০ লাখ সুইস ফ্রাঁ দামে, অর্থাৎ প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ ডলারে।
ঘড়িটি হলো পাটেক ফিলিপ পারপেচুয়াল ক্যালেন্ডার ক্রোনোগ্রাফ রেফারেন্স ১৫১৮ মডেল। স্টেইনলেস স্টিলে তৈরি মাত্র চারটি ঘড়ির একটি এটি। স্বর্ণের ঘড়ির তুলনায় এমন স্টিলের ঘড়ি বিরল হওয়ায় এটি সংগ্রাহকদের কাছে আরও মূল্যবান।
২০১৬ সালে রিস্টওয়াচ হিসেবে ঘড়িটি বিশ্বে সর্বোচ্চ দামে বিক্রির রেকর্ড গড়েছিল। তবে ২০১৭ সালে হলিউড তারকা পল নিউম্যানের মালিকানাধীন রোলেক্স ডেটোনা ঘড়ি ১ কোটি ৭৮ লাখ ডলারে বিক্রি হয়ে সেই রেকর্ড ভেঙে দেয়।
২০১৯ সালে সেই রেকর্ড ভেঙে দেয় আরেকটি পাটেক ফিলিপ গ্র্যান্ডমাস্টার চাইম ঘড়ি, যা বিক্রি হয়েছিল ৩১ মিলিয়ন ডলারে।
নিলাম প্রতিষ্ঠান ফিলিপস বলেছে, স্টেইনলেস স্টিলের ১৫১৮ মডেল আবারও প্রমাণ করল, এটি ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতঘড়িগুলোর একটি।
প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ঘড়িটি বিক্রি হতে সময় লেগেছে মাত্র ৯ মিনিটের একটু বেশি। এতে পাঁচজন ক্রেতা দরপত্রে অংশ নেন। শেষ পর্যন্ত টেলিফোনে যুক্ত এক ক্রেতার কাছে ঘড়িটি বিক্রি হয়।
জেনেভার হোটেল প্রেসিডেন্টে অনুষ্ঠিত নিলাম অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা সংগ্রাহক, ব্যবসায়ী ও ঘড়িনির্মাতা।
ফিলিপস জানায়, ১৫১৮ এমন একটি ঘড়ি, যা সংগ্রহ করতে পারলে একজন সংগ্রাহক মনে করতে পারেন, তিনি ঘড়ি সংগ্রহের জগতে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গেছেন।
১৯৪১ সালে বাজারে আসা এই মডেল ছিল বিশ্বের প্রথম ধারাবাহিকভাবে উৎপাদিত পারপেচুয়াল ক্যালেন্ডার ক্রোনোগ্রাফ।
পাটেক ফিলিপ প্রায় ২৮০টি ১৫১৮ মডেলের ঘড়ি উৎপাদন করেছিল। এর মধ্যে বেশিরভাগ হলুদ স্বর্ণে এবং প্রায় এক পঞ্চম অংশ গোল্ডের রঙের (রোজ গোল্ড)।
স্টেইনলেস স্টিলে বানানো মাত্র চারটি ঘড়ির কথা জানা যায়। সম্প্রতি বিক্রি হওয়া ঘড়িটি সেই চারটির মধ্যে প্রথম উৎপাদিত। কেন পাটেক ফিলিপ এই ঘড়িগুলো তৈরি করেছিল, তা আজও রহস্য।
নিলাম প্রতিষ্ঠান ফিলিপস এটিকে আখ্যায়িত করেছে, ‘এটি প্রায় পৌরাণিক মর্যাদার একটি সময়যন্ত্র। এটি ইতিহাসের গুরুত্ব, নকশার শ্রেষ্ঠত্ব, যান্ত্রিক উদ্ভাবন এবং বিরলতার চূড়ান্ত সমন্বয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে।’
দুই দিনের নিলামে মোট ২০৭টি লট বিক্রি হয়, যা ৬৬.৮ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ অতিক্রম করে। ফিলিপস জানায়, এটি কোনো ঘড়ি নিলামের জন্য সর্বোচ্চ মোট বিক্রির রেকর্ড।
৭২টি দেশে নিবন্ধিত ১ হাজার ৮৮৬ জন ক্রেতা নিলামে অংশ নিয়েছিলেন।

ভূস্বর্গ কাশ্মীরের বরেণ্য সাহিত্যসাধক ফারুক নাজকি। ১৯৪০ সালে জন্ম নেওয়া কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ফারুক একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, নাট্যকার, গীতিকার ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। কাশ্মীরের রাজনীতির দুই পরিচিতমুখ মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ ও ওমর আবদুল্লাহর দীর্ঘদিনের গণমাধ্যম উপদেষ্টা
২৭ জুন ২০২২
এত অর্থ-সম্পদ দিয়ে ইলন মাস্ক কী করেন, এ নিয়ে অনেক জল্পনা চলে বছরজুড়েই। তিনি নতুন করে আরও একটি ঘোষণা দেন এবং আবারও উঠে আসে এই আলোচনা। তবুও মাস্কের দাবি, তাঁর জীবনযাপন বেশ সাধারণ এবং অনাড়ম্বর। ২০২১ সালে একবার মাস্ক জানান, টেক্সাসে যে ছোট্ট বাড়িটিতে তিনি থাকেন, সেটির মূল্য মাত্র ৫০ হাজার ডলার।
২ দিন আগে
‘হাজী মাখন বিরানী’ বা ‘হাজী মাখন পোলাও’—যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তাদের দোকান ওই দুইটাই; পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজারের নাসিরুদ্দিন লেনে। না, মাখন দিয়ে তাদের পোলাও বা বিরিয়ানি রান্না করা হয় না।
৩ দিন আগে
কমলকুমার মজুমদারের বই উচ্চারণ করে পড়লে, দাঁড়ি-কমা মেলে পড়া গেলে, বোঝা যায় যে, কী আশ্চর্য সুন্দর লেখা! কী বলব, আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তাঁর লেখা পড়ে। হাসান আজিজুল হকের লেখাও ভালোই লাগে, তাঁর লেখাতে একটা ত্রুটি আছে।
৪ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ইলন মাস্ক। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো কারণে যার নাম আসে খবরের পাতায়। ২০২১ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বের ধনীদের তালিকায় শীর্ষ স্থান দখল করেন এই মার্কিন উদ্যোক্তা। আর ধনীদের তালিকায় তো এসেছেন বহুকাল আগে। সম্প্রতি ইতিহাসের পাতায় নাম লেখালেন প্রথম ৫০০ বিলিয়ন ডলারের (অর্ধ ট্রিলিয়ন) মালিক হিসেবে।
এত অর্থ-সম্পদ দিয়ে ইলন মাস্ক কী করেন, এ নিয়ে অনেক জল্পনা চলে বছরজুড়েই। তিনি নতুন করে আরও একটি ঘোষণা দেন এবং আবারও উঠে আসে এই আলোচনা। তবুও মাস্কের দাবি, তাঁর জীবনযাপন বেশ সাধারণ এবং অনাড়ম্বর। ২০২১ সালে একবার মাস্ক জানান, টেক্সাসে যে ছোট্ট বাড়িটিতে তিনি থাকেন, সেটির মূল্য মাত্র ৫০ হাজার ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬১ লাখ টাকা)।
ইলন মাস্কের সাদামাটা জীবন নিয়ে তাঁর সাবেক সঙ্গীদের আলাপেও উঠে এসেছে।
ইলন মাস্কের তিন সন্তানের জননী সাবেক সঙ্গী কানাডিয়ান সঙ্গীতশিল্পী গ্রাইমস ২০২২ সালে ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’ সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, অনেকে যেমনটা মনে করেন আসলে তা নয়। মাস্ক বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন না। তিনি তেমন বেশি বিলাসিতার মধ্যে থাকেন না।

গ্রাইমস আরও বলেন, ‘তিনি মোটেও বিলিয়নিয়ারদের মতো থাকেন না। কখনো কখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের মতো জীবনযাপন করেন। একবার তো এমনও হয়েছিল, বিছানায় তাঁর (গ্রাইমসের) পাশটায় ম্যাট্রেসে গর্ত হয়ে যাওয়ার পরও মাস্ক নতুন একটা কিনতে রাজি হননি।’
জীবনযাপন সাধারণ হলেও কিছু ক্ষেত্রে মাস্কের খরচের খাতা বেশ ভারি।
মাস্কের গাড়ির প্রতি আকর্ষণ চোখে পড়ার মতো। তাঁর কাছে এমন গাড়িও আছে, যা সাবমেরিনে রূপ নিতে পারে। এছাড়া তাঁর ব্যক্তিগত জেটবিমানগুলোর মূল্যও কয়েক কোটি ডলার।
এরপর তো ২০২২ সালে পুরো প্রযুক্তি মাধ্যম কাঁপিয়ে দিয়ে সেই ‘ছোট্ট খরচা’ করলেন। ৪৪ বিলিয়ন ডলারে কিনে ফেললেন টুইটার। তারপর এর নাম দিলেন ‘এক্স’। এই কেনাকাটা ‘মন চাইল, কিনলাম’ টাইপই ছিল তাঁর কাছে।
১০ কোটি ডলারে ৭ বছরে ৭টি বাড়ি
ইলন মাস্কের এক বিশাল রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য ছিল। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সাত বছরে প্রায় ১০ কোটি ডলার দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার অভিজাত এলাকা বেল-এয়ারে সাতটি বাড়ি কিনেছিলেন মাস্ক।
এগুলোতে ছিল টেনিস কোর্ট, সুইমিং পুল, ওয়াইন সেলার, ব্যক্তিগত লাইব্রেরি। এমনকি বল রুমও ছিল। এর মধ্যে একটি ছিল ‘উইলি ওয়ঙ্কা’ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত কিংবদন্তি অভিনেতা জিন ওয়াইল্ডারের র্যাঞ্চ হাউস।

তবে ২০২০ সালে এসে এই বিলাসবহুল বাড়ি কেনার ঝোঁক পাল্টে যায় মাস্কের। তিনি এক টুইটে জানান, প্রায় সব ভৌত সম্পদ বিক্রি করে দেবেন তিনি। আর কোনো বাড়ির মালিক থাকবেন না।
তিনি লেখেন, ‘আমার টাকার দরকার নেই। আমি নিজেকে মঙ্গল গ্রহ ও পৃথিবীর কাজে উৎসর্গ করছি। সম্পত্তি মানুষকে ভারী করে ফেলে।’
তবে তিনি একটি শর্তও দেন, অভিনেতা জিন ওয়াইল্ডারের বাড়িটি যেন ‘ধ্বংস না করা হয়’ এবং এর কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না।
ওয়াইল্ডারের ভাতিজা জর্ডান ওয়াকার-পার্লম্যানের কাছে তিন বেডরুমের ওই বাড়িটি বিক্রি করে দেন মাস্ক। বাড়িটি কেনার জন্য মাস্ক নিজেই ওয়াইল্ডারের ভাতিজাকে কয়েক মিলিয়ন ডলার ঋণ দেন। কিন্তু ওয়াকার-পার্লম্যান সময়মতো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছিলেন বলে ২০২৫ সালের জুনে বাড়িটির মালিকানা ফেরত নেন তিনি।

২০২১ সালে মাস্ক টুইট করে জানান, এখন থেকে তাঁর ‘প্রধান বাসস্থান’ টেক্সাসের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত এক সাধারণ প্রিফ্যাব্রিকেটেড বাড়ি, যার দাম প্রায় ৫০ হাজার ডলার। তাঁর মহাকাশ সংস্থা স্পেসএক্স ওখান থেকেই পরিচালিত হয়। এই অঞ্চলটি এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ‘স্টারবেস’ নামে পরিচিত।
মাস্ক বলেন, ‘এটা আসলেই দারুণ।’
এর পরের বছর মাস্ক আবার জানান, তাঁর নিজের নামে কোনো বাড়িই নেই। একে নিজের কম ভোগবাদী জীবনযাপনের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন তিনি। যদিও তাঁর সম্পদের পরিমাণ বিপুল।
তিনি মার্কিন-কানাডিয়ান অলাভজনক মিডিয়া সংস্থা টেড-এর প্রধান ক্রিস অ্যান্ডারসনকে বলেন, ‘আমি বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতেই বেশি থাকি। যখন বে এরিয়ায় যাই, যেখানে টেসলার বেশিরভাগ ইঞ্জিনিয়ারিং কাজ হয়, তখন বন্ধুদের বাড়ির ফাঁকা ঘরগুলোতে পালা করে থাকি।’

এই কথা আসলেই সত্যি। ২০১৫ সালে গুগলের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী ল্যারি পেজ লেখক অ্যাশলি ভ্যান্সকে বলেছিলেন, মাস্ককে ‘একরকম গৃহহীন’-ই বলা যায়।
ল্যারি পেজ আরও বলেন, “সে ই-মেইল করে বলে, ‘আজ রাতে কোথায় থাকব বুঝতে পারছি না। তোমার বাড়িতে আসতে পারি?’ ”
বছরের পর বছর ধরে জল্পনা চলছে, মাস্ক যুক্তরাষ্ট্রে নতুন সম্পত্তি কিনছেন কিনা। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে টেক্সাসের ওই বাড়িটিই এখনো তাঁর একমাত্র বাড়ি হিসেবে পরিচিত।
মাস্কের সংগ্রহ যেন ঐতিহাসিক গাড়ির মেলা
ইলন মাস্ক বাড়ির পেছনে খরচ না করলেও গাড়ির ক্ষেত্রে বেশ উদার। টেসলার মালিক হিসেবে তাঁর বিরল ও ব্যতিক্রমধর্মী গাড়ির সংগ্রহ থাকা আশ্চর্যের কিছু নয়! তবে তাঁর কিছু গাড়ি একেবারেই সবার থেকে আলাদা।
মাস্কের সংগ্রহে ছিল ২০শ শতাব্দীর প্রথম সাশ্রয়ী মূল্যের গাড়ি হিসেবে পরিচিত ফোর্ড মডেল ‘টি’। গাড়ি শিল্পে এক ঐতিহাসিক বিপ্লব ঘটায় এই গাড়ি।
আরও ছিল ১৯৬৭ সালের জাগুয়ার ই-টাইপ রোডস্টার। এই গাড়িটির প্রতি নাকি শৈশব থেকেই মাস্কের আকর্ষণ। ১৯৯৭ সালের ম্যাকলারেন এফ ১ গাড়িটিও তাঁর সংগ্রহে ছিল। একবার দুর্ঘটনায় ভেঙে যায় গাড়িটি। বিপুল অর্থ ব্যয়ে মেরামত করেন তিনি। পরে অবশ্য বিক্রি করে দেন।

তাঁর আরেকটি বিখ্যাত গাড়ি হলো টেসলার প্রথম বাজারজাত করা টেসলা রোডস্টার। ২০১৮ সালে মাস্ক এই গাড়িটি মহাকাশে পাঠিয়েছিলেন।
১৯৭৭ সালের জেমস বন্ডের সিনেমা দ্য স্পাই হু লাভড মি-তে ব্যবহৃত ১৯৭৬ সালে বাজারে আসা লোটাস এসপ্রিৎ গাড়িটিও তাঁর সংগ্রহে ছিল। সিনেমায় ‘ওয়েট নেলি’ নামের এই গাড়িটি সাবমেরিনে রূপ নিতে পারত। মাস্ক ২০১৩ সালে প্রায় ১০ লাখ ডলারে নিলামে গাড়িটি কিনেছিলেন। সেই সাবমেরিনে রূপান্তরের ক্ষমতাটিকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনার ইচ্ছে ছিল তাঁর।
আকাশ পথেও পিছিয়ে নন মাস্ক
উড়ালপথেও খরচ করতে ভালোবাসেন ইলন মাস্ক। তবে তাঁর দাবি, ‘এটি বিলাসিতা নয়—বরং কাজের প্রতি তাঁর নিবেদন।’
২০২২ সালে টেডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাস্ক বলেন, ‘আমি যদি উড়োজাহাজ ব্যবহার করি, যাতে আমার কাজের জন্য হাতে বেশি সময় পাই।’
মাস্কের সংগ্রহে আছে একাধিক গালফস্ট্রিম মডেলের ব্যক্তিগত জেট, যার প্রতিটির দাম কয়েক কোটি ডলার।
মাস্ক যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা স্পেসএক্স ও টেসলার অফিসগুলো পরিদর্শনে এবং আন্তর্জাতিক সফরে এই উড়োজাহাজগুলো ব্যবহার করেন।
দাতব্য কাজ নিয়ে আলোচিত-সমালোচিত ইলন মাস্ক
মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থার নথি অনুযায়ী, মাস্ক বিভিন্ন দাতব্য সংস্থাকে বিলিয়ন ডলারের শেয়ার দান করেছেন। প্রায় সময়ই নানা উদ্যোগে বহু মিলিয়ন ডলার অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে তাঁর দানশীলতা নিয়ে সমালোচনাও আছে।
নিউইয়র্ক টাইমস গত বছর লিখেছিল, তাঁর দানের ধরন ‘অগোছালো এবং মূলত ব্যক্তিগত স্বার্থসংশ্লিষ্ট’। এই দানের ধরন তাঁকে বিশাল কর-ছাড়ের সুযোগ দেয় এবং তাঁর ব্যবসাকেও সহায়তা করে।
তাঁর দাতব্য সংস্থা মাস্ক ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে বলা আছে, প্রতিষ্ঠানটি মানবজাতির অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে।
তবে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, টানা তিন বছর ধরে ফাউন্ডেশনটি আইন অনুযায়ী যে পরিমাণ অর্থ দান করা প্রয়োজন, তা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। পত্রিকাটি যে কর সংক্রান্ত নথি পর্যালোচনা করেছে, তাতে দেখা গেছে, সংস্থাটির বেশিরভাগ অনুদানই গেছে মাস্কের প্রতিষ্ঠানগুলোতেই।
এ বিষয়ে মাস্ক ও তাঁর ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো সাড়া পায়নি নিউইয়র্ক টাইমস।
অতীতে দান ও সমাজসেবামূলক কাজ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মাস্ক প্রায়ই প্রচলিত দান পদ্ধতির বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
২০২২ সালে টেডের ক্রিস অ্যান্ডারসনকে তিনি বলেন, ‘আপনি যদি ভালো কাজের আসল প্রভাব নিয়ে ভাবেন, শুধু বাহ্যিক ভাবমূর্তি নয়, তাহলে দানশীলতা আসলে অত্যন্ত জটিল একটি বিষয়।’
মাস্ক বলেন, টেসলা টেকসই জ্বালানির প্রসার ঘটাচ্ছে, স্পেসএক্স মানবজাতির দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে, আর নিউরালিংক মস্তিষ্কজনিত আঘাত এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে সৃষ্ট অস্তিত্বগত ঝুঁকি মোকাবিলায় কাজ করছে।
তাঁর ব্যবসাগুলোই মানবকল্যাণের এক ধরনের দান বলে মনে করেন ইলন মাস্ক। তিনি বলেন, ‘যদি দানশীলতার অর্থ হয় মানবতার প্রতি ভালোবাসা, তবে এগুলোই দানশীলতা।’

ইলন মাস্ক। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো কারণে যার নাম আসে খবরের পাতায়। ২০২১ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বের ধনীদের তালিকায় শীর্ষ স্থান দখল করেন এই মার্কিন উদ্যোক্তা। আর ধনীদের তালিকায় তো এসেছেন বহুকাল আগে। সম্প্রতি ইতিহাসের পাতায় নাম লেখালেন প্রথম ৫০০ বিলিয়ন ডলারের (অর্ধ ট্রিলিয়ন) মালিক হিসেবে।
এত অর্থ-সম্পদ দিয়ে ইলন মাস্ক কী করেন, এ নিয়ে অনেক জল্পনা চলে বছরজুড়েই। তিনি নতুন করে আরও একটি ঘোষণা দেন এবং আবারও উঠে আসে এই আলোচনা। তবুও মাস্কের দাবি, তাঁর জীবনযাপন বেশ সাধারণ এবং অনাড়ম্বর। ২০২১ সালে একবার মাস্ক জানান, টেক্সাসে যে ছোট্ট বাড়িটিতে তিনি থাকেন, সেটির মূল্য মাত্র ৫০ হাজার ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬১ লাখ টাকা)।
ইলন মাস্কের সাদামাটা জীবন নিয়ে তাঁর সাবেক সঙ্গীদের আলাপেও উঠে এসেছে।
ইলন মাস্কের তিন সন্তানের জননী সাবেক সঙ্গী কানাডিয়ান সঙ্গীতশিল্পী গ্রাইমস ২০২২ সালে ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’ সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, অনেকে যেমনটা মনে করেন আসলে তা নয়। মাস্ক বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন না। তিনি তেমন বেশি বিলাসিতার মধ্যে থাকেন না।

গ্রাইমস আরও বলেন, ‘তিনি মোটেও বিলিয়নিয়ারদের মতো থাকেন না। কখনো কখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের মতো জীবনযাপন করেন। একবার তো এমনও হয়েছিল, বিছানায় তাঁর (গ্রাইমসের) পাশটায় ম্যাট্রেসে গর্ত হয়ে যাওয়ার পরও মাস্ক নতুন একটা কিনতে রাজি হননি।’
জীবনযাপন সাধারণ হলেও কিছু ক্ষেত্রে মাস্কের খরচের খাতা বেশ ভারি।
মাস্কের গাড়ির প্রতি আকর্ষণ চোখে পড়ার মতো। তাঁর কাছে এমন গাড়িও আছে, যা সাবমেরিনে রূপ নিতে পারে। এছাড়া তাঁর ব্যক্তিগত জেটবিমানগুলোর মূল্যও কয়েক কোটি ডলার।
এরপর তো ২০২২ সালে পুরো প্রযুক্তি মাধ্যম কাঁপিয়ে দিয়ে সেই ‘ছোট্ট খরচা’ করলেন। ৪৪ বিলিয়ন ডলারে কিনে ফেললেন টুইটার। তারপর এর নাম দিলেন ‘এক্স’। এই কেনাকাটা ‘মন চাইল, কিনলাম’ টাইপই ছিল তাঁর কাছে।
১০ কোটি ডলারে ৭ বছরে ৭টি বাড়ি
ইলন মাস্কের এক বিশাল রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য ছিল। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সাত বছরে প্রায় ১০ কোটি ডলার দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার অভিজাত এলাকা বেল-এয়ারে সাতটি বাড়ি কিনেছিলেন মাস্ক।
এগুলোতে ছিল টেনিস কোর্ট, সুইমিং পুল, ওয়াইন সেলার, ব্যক্তিগত লাইব্রেরি। এমনকি বল রুমও ছিল। এর মধ্যে একটি ছিল ‘উইলি ওয়ঙ্কা’ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত কিংবদন্তি অভিনেতা জিন ওয়াইল্ডারের র্যাঞ্চ হাউস।

তবে ২০২০ সালে এসে এই বিলাসবহুল বাড়ি কেনার ঝোঁক পাল্টে যায় মাস্কের। তিনি এক টুইটে জানান, প্রায় সব ভৌত সম্পদ বিক্রি করে দেবেন তিনি। আর কোনো বাড়ির মালিক থাকবেন না।
তিনি লেখেন, ‘আমার টাকার দরকার নেই। আমি নিজেকে মঙ্গল গ্রহ ও পৃথিবীর কাজে উৎসর্গ করছি। সম্পত্তি মানুষকে ভারী করে ফেলে।’
তবে তিনি একটি শর্তও দেন, অভিনেতা জিন ওয়াইল্ডারের বাড়িটি যেন ‘ধ্বংস না করা হয়’ এবং এর কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না।
ওয়াইল্ডারের ভাতিজা জর্ডান ওয়াকার-পার্লম্যানের কাছে তিন বেডরুমের ওই বাড়িটি বিক্রি করে দেন মাস্ক। বাড়িটি কেনার জন্য মাস্ক নিজেই ওয়াইল্ডারের ভাতিজাকে কয়েক মিলিয়ন ডলার ঋণ দেন। কিন্তু ওয়াকার-পার্লম্যান সময়মতো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছিলেন বলে ২০২৫ সালের জুনে বাড়িটির মালিকানা ফেরত নেন তিনি।

২০২১ সালে মাস্ক টুইট করে জানান, এখন থেকে তাঁর ‘প্রধান বাসস্থান’ টেক্সাসের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত এক সাধারণ প্রিফ্যাব্রিকেটেড বাড়ি, যার দাম প্রায় ৫০ হাজার ডলার। তাঁর মহাকাশ সংস্থা স্পেসএক্স ওখান থেকেই পরিচালিত হয়। এই অঞ্চলটি এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ‘স্টারবেস’ নামে পরিচিত।
মাস্ক বলেন, ‘এটা আসলেই দারুণ।’
এর পরের বছর মাস্ক আবার জানান, তাঁর নিজের নামে কোনো বাড়িই নেই। একে নিজের কম ভোগবাদী জীবনযাপনের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন তিনি। যদিও তাঁর সম্পদের পরিমাণ বিপুল।
তিনি মার্কিন-কানাডিয়ান অলাভজনক মিডিয়া সংস্থা টেড-এর প্রধান ক্রিস অ্যান্ডারসনকে বলেন, ‘আমি বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতেই বেশি থাকি। যখন বে এরিয়ায় যাই, যেখানে টেসলার বেশিরভাগ ইঞ্জিনিয়ারিং কাজ হয়, তখন বন্ধুদের বাড়ির ফাঁকা ঘরগুলোতে পালা করে থাকি।’

এই কথা আসলেই সত্যি। ২০১৫ সালে গুগলের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী ল্যারি পেজ লেখক অ্যাশলি ভ্যান্সকে বলেছিলেন, মাস্ককে ‘একরকম গৃহহীন’-ই বলা যায়।
ল্যারি পেজ আরও বলেন, “সে ই-মেইল করে বলে, ‘আজ রাতে কোথায় থাকব বুঝতে পারছি না। তোমার বাড়িতে আসতে পারি?’ ”
বছরের পর বছর ধরে জল্পনা চলছে, মাস্ক যুক্তরাষ্ট্রে নতুন সম্পত্তি কিনছেন কিনা। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে টেক্সাসের ওই বাড়িটিই এখনো তাঁর একমাত্র বাড়ি হিসেবে পরিচিত।
মাস্কের সংগ্রহ যেন ঐতিহাসিক গাড়ির মেলা
ইলন মাস্ক বাড়ির পেছনে খরচ না করলেও গাড়ির ক্ষেত্রে বেশ উদার। টেসলার মালিক হিসেবে তাঁর বিরল ও ব্যতিক্রমধর্মী গাড়ির সংগ্রহ থাকা আশ্চর্যের কিছু নয়! তবে তাঁর কিছু গাড়ি একেবারেই সবার থেকে আলাদা।
মাস্কের সংগ্রহে ছিল ২০শ শতাব্দীর প্রথম সাশ্রয়ী মূল্যের গাড়ি হিসেবে পরিচিত ফোর্ড মডেল ‘টি’। গাড়ি শিল্পে এক ঐতিহাসিক বিপ্লব ঘটায় এই গাড়ি।
আরও ছিল ১৯৬৭ সালের জাগুয়ার ই-টাইপ রোডস্টার। এই গাড়িটির প্রতি নাকি শৈশব থেকেই মাস্কের আকর্ষণ। ১৯৯৭ সালের ম্যাকলারেন এফ ১ গাড়িটিও তাঁর সংগ্রহে ছিল। একবার দুর্ঘটনায় ভেঙে যায় গাড়িটি। বিপুল অর্থ ব্যয়ে মেরামত করেন তিনি। পরে অবশ্য বিক্রি করে দেন।

তাঁর আরেকটি বিখ্যাত গাড়ি হলো টেসলার প্রথম বাজারজাত করা টেসলা রোডস্টার। ২০১৮ সালে মাস্ক এই গাড়িটি মহাকাশে পাঠিয়েছিলেন।
১৯৭৭ সালের জেমস বন্ডের সিনেমা দ্য স্পাই হু লাভড মি-তে ব্যবহৃত ১৯৭৬ সালে বাজারে আসা লোটাস এসপ্রিৎ গাড়িটিও তাঁর সংগ্রহে ছিল। সিনেমায় ‘ওয়েট নেলি’ নামের এই গাড়িটি সাবমেরিনে রূপ নিতে পারত। মাস্ক ২০১৩ সালে প্রায় ১০ লাখ ডলারে নিলামে গাড়িটি কিনেছিলেন। সেই সাবমেরিনে রূপান্তরের ক্ষমতাটিকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনার ইচ্ছে ছিল তাঁর।
আকাশ পথেও পিছিয়ে নন মাস্ক
উড়ালপথেও খরচ করতে ভালোবাসেন ইলন মাস্ক। তবে তাঁর দাবি, ‘এটি বিলাসিতা নয়—বরং কাজের প্রতি তাঁর নিবেদন।’
২০২২ সালে টেডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাস্ক বলেন, ‘আমি যদি উড়োজাহাজ ব্যবহার করি, যাতে আমার কাজের জন্য হাতে বেশি সময় পাই।’
মাস্কের সংগ্রহে আছে একাধিক গালফস্ট্রিম মডেলের ব্যক্তিগত জেট, যার প্রতিটির দাম কয়েক কোটি ডলার।
মাস্ক যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা স্পেসএক্স ও টেসলার অফিসগুলো পরিদর্শনে এবং আন্তর্জাতিক সফরে এই উড়োজাহাজগুলো ব্যবহার করেন।
দাতব্য কাজ নিয়ে আলোচিত-সমালোচিত ইলন মাস্ক
মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থার নথি অনুযায়ী, মাস্ক বিভিন্ন দাতব্য সংস্থাকে বিলিয়ন ডলারের শেয়ার দান করেছেন। প্রায় সময়ই নানা উদ্যোগে বহু মিলিয়ন ডলার অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে তাঁর দানশীলতা নিয়ে সমালোচনাও আছে।
নিউইয়র্ক টাইমস গত বছর লিখেছিল, তাঁর দানের ধরন ‘অগোছালো এবং মূলত ব্যক্তিগত স্বার্থসংশ্লিষ্ট’। এই দানের ধরন তাঁকে বিশাল কর-ছাড়ের সুযোগ দেয় এবং তাঁর ব্যবসাকেও সহায়তা করে।
তাঁর দাতব্য সংস্থা মাস্ক ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে বলা আছে, প্রতিষ্ঠানটি মানবজাতির অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে।
তবে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, টানা তিন বছর ধরে ফাউন্ডেশনটি আইন অনুযায়ী যে পরিমাণ অর্থ দান করা প্রয়োজন, তা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। পত্রিকাটি যে কর সংক্রান্ত নথি পর্যালোচনা করেছে, তাতে দেখা গেছে, সংস্থাটির বেশিরভাগ অনুদানই গেছে মাস্কের প্রতিষ্ঠানগুলোতেই।
এ বিষয়ে মাস্ক ও তাঁর ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো সাড়া পায়নি নিউইয়র্ক টাইমস।
অতীতে দান ও সমাজসেবামূলক কাজ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মাস্ক প্রায়ই প্রচলিত দান পদ্ধতির বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
২০২২ সালে টেডের ক্রিস অ্যান্ডারসনকে তিনি বলেন, ‘আপনি যদি ভালো কাজের আসল প্রভাব নিয়ে ভাবেন, শুধু বাহ্যিক ভাবমূর্তি নয়, তাহলে দানশীলতা আসলে অত্যন্ত জটিল একটি বিষয়।’
মাস্ক বলেন, টেসলা টেকসই জ্বালানির প্রসার ঘটাচ্ছে, স্পেসএক্স মানবজাতির দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে, আর নিউরালিংক মস্তিষ্কজনিত আঘাত এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে সৃষ্ট অস্তিত্বগত ঝুঁকি মোকাবিলায় কাজ করছে।
তাঁর ব্যবসাগুলোই মানবকল্যাণের এক ধরনের দান বলে মনে করেন ইলন মাস্ক। তিনি বলেন, ‘যদি দানশীলতার অর্থ হয় মানবতার প্রতি ভালোবাসা, তবে এগুলোই দানশীলতা।’

ভূস্বর্গ কাশ্মীরের বরেণ্য সাহিত্যসাধক ফারুক নাজকি। ১৯৪০ সালে জন্ম নেওয়া কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ফারুক একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, নাট্যকার, গীতিকার ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। কাশ্মীরের রাজনীতির দুই পরিচিতমুখ মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ ও ওমর আবদুল্লাহর দীর্ঘদিনের গণমাধ্যম উপদেষ্টা
২৭ জুন ২০২২
১৯৪৩ সালে তৈরি একটি হাতঘড়ি বিশ্বের সবচেয়ে দামি ঘড়ি হিসেবে রেকর্ড গড়ল। এর আগে ২০১৬ সালে নিলামে বিক্রি হওয়া সবচেয়ে দামি ঘড়ি হিসেবে রেকর্ড গড়ে এই ঘড়িটি। এবার আরও বেশি দামে ঘড়িটি বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছে নিলাম প্রতিষ্ঠান ফিলিপস।
১৩ ঘণ্টা আগে
‘হাজী মাখন বিরানী’ বা ‘হাজী মাখন পোলাও’—যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তাদের দোকান ওই দুইটাই; পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজারের নাসিরুদ্দিন লেনে। না, মাখন দিয়ে তাদের পোলাও বা বিরিয়ানি রান্না করা হয় না।
৩ দিন আগে
কমলকুমার মজুমদারের বই উচ্চারণ করে পড়লে, দাঁড়ি-কমা মেলে পড়া গেলে, বোঝা যায় যে, কী আশ্চর্য সুন্দর লেখা! কী বলব, আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তাঁর লেখা পড়ে। হাসান আজিজুল হকের লেখাও ভালোই লাগে, তাঁর লেখাতে একটা ত্রুটি আছে।
৪ দিন আগেসম্পাদকীয়

‘হাজী মাখন বিরানী’ বা ‘হাজী মাখন পোলাও’—যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তাদের দোকান ওই দুইটাই; পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজারের নাসিরুদ্দিন লেনে। না, মাখন দিয়ে তাদের পোলাও বা বিরিয়ানি রান্না করা হয় না। প্রতিষ্ঠাতা আবদুল কাদেরের ছেলের নাম হাজী মাখন। তাঁর নামেই ব্যবসার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সত্তর বছরের বেশি আবদুল কাদেরের এই ব্যবসার বয়স। পঞ্চাশের দশক থেকে তিন প্রজন্ম ধরে চলছে পারিবারিক এই ব্যবসা। একসময় ১ পয়সা কি ২ পয়সায় এক প্লেট মাখন বিরিয়ানি খাওয়া যেত। এখন খেতে হলে শ দেড়েক টাকা তো লাগবেই। পোলাওয়ের চালের সঙ্গে গরুর মাংসের মাখো মাখো এই বিরিয়ানি খেতে কিন্তু একেবারেই মাখন!
ছবি: হাসান রাজা

‘হাজী মাখন বিরানী’ বা ‘হাজী মাখন পোলাও’—যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তাদের দোকান ওই দুইটাই; পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজারের নাসিরুদ্দিন লেনে। না, মাখন দিয়ে তাদের পোলাও বা বিরিয়ানি রান্না করা হয় না। প্রতিষ্ঠাতা আবদুল কাদেরের ছেলের নাম হাজী মাখন। তাঁর নামেই ব্যবসার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সত্তর বছরের বেশি আবদুল কাদেরের এই ব্যবসার বয়স। পঞ্চাশের দশক থেকে তিন প্রজন্ম ধরে চলছে পারিবারিক এই ব্যবসা। একসময় ১ পয়সা কি ২ পয়সায় এক প্লেট মাখন বিরিয়ানি খাওয়া যেত। এখন খেতে হলে শ দেড়েক টাকা তো লাগবেই। পোলাওয়ের চালের সঙ্গে গরুর মাংসের মাখো মাখো এই বিরিয়ানি খেতে কিন্তু একেবারেই মাখন!
ছবি: হাসান রাজা

ভূস্বর্গ কাশ্মীরের বরেণ্য সাহিত্যসাধক ফারুক নাজকি। ১৯৪০ সালে জন্ম নেওয়া কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ফারুক একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, নাট্যকার, গীতিকার ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। কাশ্মীরের রাজনীতির দুই পরিচিতমুখ মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ ও ওমর আবদুল্লাহর দীর্ঘদিনের গণমাধ্যম উপদেষ্টা
২৭ জুন ২০২২
১৯৪৩ সালে তৈরি একটি হাতঘড়ি বিশ্বের সবচেয়ে দামি ঘড়ি হিসেবে রেকর্ড গড়ল। এর আগে ২০১৬ সালে নিলামে বিক্রি হওয়া সবচেয়ে দামি ঘড়ি হিসেবে রেকর্ড গড়ে এই ঘড়িটি। এবার আরও বেশি দামে ঘড়িটি বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছে নিলাম প্রতিষ্ঠান ফিলিপস।
১৩ ঘণ্টা আগে
এত অর্থ-সম্পদ দিয়ে ইলন মাস্ক কী করেন, এ নিয়ে অনেক জল্পনা চলে বছরজুড়েই। তিনি নতুন করে আরও একটি ঘোষণা দেন এবং আবারও উঠে আসে এই আলোচনা। তবুও মাস্কের দাবি, তাঁর জীবনযাপন বেশ সাধারণ এবং অনাড়ম্বর। ২০২১ সালে একবার মাস্ক জানান, টেক্সাসে যে ছোট্ট বাড়িটিতে তিনি থাকেন, সেটির মূল্য মাত্র ৫০ হাজার ডলার।
২ দিন আগে
কমলকুমার মজুমদারের বই উচ্চারণ করে পড়লে, দাঁড়ি-কমা মেলে পড়া গেলে, বোঝা যায় যে, কী আশ্চর্য সুন্দর লেখা! কী বলব, আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তাঁর লেখা পড়ে। হাসান আজিজুল হকের লেখাও ভালোই লাগে, তাঁর লেখাতে একটা ত্রুটি আছে।
৪ দিন আগেসম্পাদকীয়

কমলকুমার মজুমদারের বই উচ্চারণ করে পড়লে, দাঁড়ি-কমা মেলে পড়া গেলে, বোঝা যায় যে, কী আশ্চর্য সুন্দর লেখা! কী বলব, আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তাঁর লেখা পড়ে। হাসান আজিজুল হকের লেখাও ভালোই লাগে, তাঁর লেখাতে একটা ত্রুটি আছে। লেখাতে কিন্তু একটা জিনিস থাকা উচিত বলে আমার মনে হয়—হিউমার। রসবোধ থাকা উচিত, প্রত্যেকের লেখাতেই। যে ভিক্ষা করছে তাকে যদি ফলো করি, দেখা যাবে একটা সময়ে একটা হাসির কথা বলছে, একটা সময়ে একটা ভঙ্গি করল যেটা হাসির ভঙ্গি। সব সময়ই তাকে যদি এভাবে কষ্টকরভাবে দেখি, ঠিক না। ওর লেখাতে হাসিটা নেই। কায়েস আহমেদের লেখা আমার ভালো লাগত।
মঞ্জু সরকারের লেখা ভালো। আমার ভালো লাগে। সুশান্ত মজুমদারের কিছু লেখা আছে, খুব সিরিয়াসলি লিখেছে, খুব সিরিয়াসলি। বোঝা যায় আরকি। সিরিয়াস লিখলেও এখনো পর্যন্ত বলা চলে না যে ছোটগল্প লেখক হয়েছে। মঈনুল আহসান সাবের সো সো। একটা কথা কি, এদের সময় থেকে লেখকেরা প্রচণ্ড লোভী হয়ে পড়ল, তাই যা হবার হয়েছে। লোভী লোকের দ্বারা গল্প হয় না।
সমরেশ বসু ভার্সেটাইল লেখক। ভার্সেটাইল বলছি এ জন্য যে, উনি যে-সমস্ত বিষয় নিয়ে লিখেছেন, তা ওই লোকই। যেমন, রাস্তায় পড়ে থাকাদের নিয়ে তিনটা বই আছে ওনার। তিনটা কি দুটি হবে। অথচ মনে হবে ওদেরই ভাষা। ওদেরই জীবন, অসাধারণ। অন্য বইও লিখেছেন, সুন্দর।
অমিয়ভূষণ মজুমদারের লেখা আমার প্রথমেই খুব ভালো লেগেছিল, ওনার ভাষার জন্য। এত মেদহীন ভাষা বোধ হয় কারও নেই, এটা আমার মনে হয়েছিল। আমার মনে আছে, প্রায় টেক্সটের মতো বইটা (গড় শ্রীখন্ড) পড়তাম। অনেক মোটা বই। খুব ভালো লেগেছিল বইটা পড়ে।
সূত্র: প্রশান্ত মৃধা ও হামিম কামরুল হকের গ্রহণ করা কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হকের সাক্ষাৎকার, ‘হিরণ্ময় কথকতা’, পৃষ্ঠা ৬০-৬১

কমলকুমার মজুমদারের বই উচ্চারণ করে পড়লে, দাঁড়ি-কমা মেলে পড়া গেলে, বোঝা যায় যে, কী আশ্চর্য সুন্দর লেখা! কী বলব, আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তাঁর লেখা পড়ে। হাসান আজিজুল হকের লেখাও ভালোই লাগে, তাঁর লেখাতে একটা ত্রুটি আছে। লেখাতে কিন্তু একটা জিনিস থাকা উচিত বলে আমার মনে হয়—হিউমার। রসবোধ থাকা উচিত, প্রত্যেকের লেখাতেই। যে ভিক্ষা করছে তাকে যদি ফলো করি, দেখা যাবে একটা সময়ে একটা হাসির কথা বলছে, একটা সময়ে একটা ভঙ্গি করল যেটা হাসির ভঙ্গি। সব সময়ই তাকে যদি এভাবে কষ্টকরভাবে দেখি, ঠিক না। ওর লেখাতে হাসিটা নেই। কায়েস আহমেদের লেখা আমার ভালো লাগত।
মঞ্জু সরকারের লেখা ভালো। আমার ভালো লাগে। সুশান্ত মজুমদারের কিছু লেখা আছে, খুব সিরিয়াসলি লিখেছে, খুব সিরিয়াসলি। বোঝা যায় আরকি। সিরিয়াস লিখলেও এখনো পর্যন্ত বলা চলে না যে ছোটগল্প লেখক হয়েছে। মঈনুল আহসান সাবের সো সো। একটা কথা কি, এদের সময় থেকে লেখকেরা প্রচণ্ড লোভী হয়ে পড়ল, তাই যা হবার হয়েছে। লোভী লোকের দ্বারা গল্প হয় না।
সমরেশ বসু ভার্সেটাইল লেখক। ভার্সেটাইল বলছি এ জন্য যে, উনি যে-সমস্ত বিষয় নিয়ে লিখেছেন, তা ওই লোকই। যেমন, রাস্তায় পড়ে থাকাদের নিয়ে তিনটা বই আছে ওনার। তিনটা কি দুটি হবে। অথচ মনে হবে ওদেরই ভাষা। ওদেরই জীবন, অসাধারণ। অন্য বইও লিখেছেন, সুন্দর।
অমিয়ভূষণ মজুমদারের লেখা আমার প্রথমেই খুব ভালো লেগেছিল, ওনার ভাষার জন্য। এত মেদহীন ভাষা বোধ হয় কারও নেই, এটা আমার মনে হয়েছিল। আমার মনে আছে, প্রায় টেক্সটের মতো বইটা (গড় শ্রীখন্ড) পড়তাম। অনেক মোটা বই। খুব ভালো লেগেছিল বইটা পড়ে।
সূত্র: প্রশান্ত মৃধা ও হামিম কামরুল হকের গ্রহণ করা কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হকের সাক্ষাৎকার, ‘হিরণ্ময় কথকতা’, পৃষ্ঠা ৬০-৬১

ভূস্বর্গ কাশ্মীরের বরেণ্য সাহিত্যসাধক ফারুক নাজকি। ১৯৪০ সালে জন্ম নেওয়া কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ফারুক একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, নাট্যকার, গীতিকার ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। কাশ্মীরের রাজনীতির দুই পরিচিতমুখ মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ ও ওমর আবদুল্লাহর দীর্ঘদিনের গণমাধ্যম উপদেষ্টা
২৭ জুন ২০২২
১৯৪৩ সালে তৈরি একটি হাতঘড়ি বিশ্বের সবচেয়ে দামি ঘড়ি হিসেবে রেকর্ড গড়ল। এর আগে ২০১৬ সালে নিলামে বিক্রি হওয়া সবচেয়ে দামি ঘড়ি হিসেবে রেকর্ড গড়ে এই ঘড়িটি। এবার আরও বেশি দামে ঘড়িটি বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছে নিলাম প্রতিষ্ঠান ফিলিপস।
১৩ ঘণ্টা আগে
এত অর্থ-সম্পদ দিয়ে ইলন মাস্ক কী করেন, এ নিয়ে অনেক জল্পনা চলে বছরজুড়েই। তিনি নতুন করে আরও একটি ঘোষণা দেন এবং আবারও উঠে আসে এই আলোচনা। তবুও মাস্কের দাবি, তাঁর জীবনযাপন বেশ সাধারণ এবং অনাড়ম্বর। ২০২১ সালে একবার মাস্ক জানান, টেক্সাসে যে ছোট্ট বাড়িটিতে তিনি থাকেন, সেটির মূল্য মাত্র ৫০ হাজার ডলার।
২ দিন আগে
‘হাজী মাখন বিরানী’ বা ‘হাজী মাখন পোলাও’—যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তাদের দোকান ওই দুইটাই; পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজারের নাসিরুদ্দিন লেনে। না, মাখন দিয়ে তাদের পোলাও বা বিরিয়ানি রান্না করা হয় না।
৩ দিন আগে